দীর্ঘস্থায়ী হোক আমাদের গ্রন্থাগারগুলো

আমরা যখন স্কুলে পড়ছিলাম, সেটা প্রায় ৭০’র দশকের কথা। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময়, আমাদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান ছিল সেখানকার গ্রন্থাগার। জেনেছিলাম তখন সেখানে ৪০ হাজারেরও বেশি বই ছিল। ‘লাইব্রেরি ক্লাস’ বলে আমাদের একটি ক্লাসই ছিল– সেখানে অন্যান্য বই থেকে ক্লাসের পড়া আরও ভালো করে জানা ছিল উদ্দেশ্য। যখনই কোনও শিক্ষক অনুপস্থিত থাকতেন অথবা অসুস্থ্ থাকতেন, তার ক্লাসের বদলে আমাদের অন্য কোনও ক্লাস হতো না। আমরা সবাই লাইব্রেরিতে চলে যেতাম। আমাদের কয়েকজন যোগ্য গ্রন্থগারিক ছিলেন, যারা আমাদের প্রয়োজন মতো বই খুঁজে দিতে সাহায্য করতেন। আমরা অনেকেই ওই লাইব্রেরির প্রায় সব গল্পের বই ছ’বছরের ক্যাডেট জীবনে পড়ে ফেলেছিলাম। সেখানে বাস্কেটবল খেলা নিয়েও তিনটি বই ছিল; আমি সেগুলোও পড়েছিলাম।
আশির দশকের মাঝামাঝি এলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। সেখানেও দেখলাম আমার বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে যাওয়া আসা করেন। প্রায়ই আমরা যে বইটি খুঁজছি তা পেতাম না। কেউ ইতিমধ্যেই নিয়ে পড়তে বসেছে।কেউ-কেউ অবশ্য সেখানে গিয়ে প্রেম করতেন, তবে তাদের সংখ্যা বেশি ছিল না। আমাদের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভর্তি বই-পিপাসু মানুষ থাকতো। অনেককে দেখেছি সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করতে।
পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আমাদের প্রথম চিন্তাই ছিল লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়া।
কাছেই ছিল আমাদের পাবলিক লাইব্রেরি। সেখানে গেলে দেখতাম সারা শহর থেকে ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞানের খোঁজে এসেছেন।এসেছেন এই আশায় তাদের পড়ার নোট তৈরি করার জন্য আরও অনেক বই খুঁজে পাবেন।
আমরা যারা সাহিত্যে পড়াশোনা করতাম, তাদের জন্য আমাদের নিজেদের বিভাগেও ছিল একটি সেমিনার লাইব্রেরি।এখনও আছে। সেমিনার লাইব্রেরিতে রাখা বইগুলো ছিল আমাদের জন্য এক একটি মূল্যবান রত্ন।
আরও অনেক অমূল্য রত্ন ছড়ানো ছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে।ওই লাইব্রেরি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য তীর্থস্থান। সেখানে যেতেই হতো।
আমার সাংবাদিকতা শুরুর প্রথম দিকেও– নব্বইয়ের দশকের প্রথমে– ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে যাতায়াত করতাম সাংবাদিকতার ওপর বইয়ের খোঁজে। আমি নিজেও নীলক্ষেত বই বাজারের সুবাদে নিজের বাড়িতে একটি লাইব্রেরি গড়তে পেরেছিলাম।
নব্বইয়ের মাঝামাঝি এসে আমার গ্রন্থ এবং গ্রন্থাগারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলো। তখনই প্রথম ইমেইল এবং ইন্টারনেটের সংস্পর্শে এলাম। পড়া শুরু করলাম শুধুই খবরের কাগজ। দেশ-বিদেশের কাগজ। নতুন এক বিশ্বের খোঁজ পেয়ে আমি কিছুকাল বই থেকে দূরে চলে গেলাম। অনলাইনে বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র পড়া যেন আমার নেশায় দাঁড়িয়ে গেলো। বাংলাদেশে আর কেউ লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ে কিনা তা জানতে চাওয়ার ইচ্ছের কথাও ভুলে গেলাম। আমি বইয়ের জগতে আবারও ফিরলাম আমার সাংবাদিকতার পাঠ চুকিয়ে প্রায় বাইশ বছরপর।
একটি ডিজিটাল কোম্পানিতে কাজের সুবাদে আমার সারা দেশ ঘুরে বেড়ানোর একটি সুযোগ তৈরি হলো। কয়েকটি বিভাগীয় শহরের পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে কাজ আছে। ঘুরে দেখলাম বেশ ক’টি লাইব্রেরি। সেগুলোতে বইয়ের সংগ্রহ দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি। এত বই এসব লাইব্রেরিতে!আমার ক্যাডেট কলেজে আর কত বই ছিল! তার চেয়েও আরো দশগুণ বেশি বইয়ের সমাহার সেখানে! এত ভালো সংগ্রহ তবে সেখানে পড়ার কেউ নেই।বিশাল বড়-বড় হলরুমগুলো ফাঁকা পড়ে রয়েছে। কালেভদ্রে দু-তিনজনকে পাওয়া যায়।
লাইব্রেরিয়ানদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম ডিজিটাল যুগের শুরুর সঙ্গে-সঙ্গে লাইব্রেরির চাহিদা কমে গেছে। দিন-দিন আরও কমে যাচ্ছে। যারা রেফারেন্স বইয়ের জন্য লাইব্রেরিতে আসতেন তারা এখন গুগলে সার্চ করে সে কাজ সারেন। কষ্ট করে কেউ আর লাইব্রেরিতে আসেন না। যারা ই-রিডার,আইপ্যাড, ট্যাব ইত্যাদি কিনতে পারেন তারা সে মাধ্যমে পড়াশোনা করছেন। আর অন্য সবার জন্য তো ল্যাপটপ এবং ডেস্কটপ কম্পিউটার আছেই। শুধু ইন্টারনেট থাকলেই হলো। আমাদের চিরচেনা লাইব্রেরিগুলো ধীরে-ধীরে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে পরিণত হচ্ছে।
আমাদের বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, যে লাইব্রেরিগুলোকে আমরা চিনতাম সেগুলো খুব তাড়াতাড়িই ইতিহাস হয়ে যাবে। ঢাকার ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিকে দেখলেই তা বোঝা যায়।
ইন্টারনেট-সংক্রান্ত একটি সভায় যোগ দিতে আমি সম্প্রতি সেখানে গিয়েছিলাম। লাইব্রেরি দেখা কান্না পেয়েছিল। তারা তাদের লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা আমরা ছাত্রাবস্থায় আশি এবং নব্বইর দশকে যা দেখেছি তার দশভাগের একভাগে নামিয়ে এনেছে।
ব্রিটিশ কাউন্সিল যখন এমন কিছু করে তাহলে বুঝতে হবে যে সামনে পরিবর্তন আসছে। মানুষের পড়ার ও গবেষণার অভ্যাসে পরিবর্তন এবং নতুন মাধ্যম ব্যবহার করায় পরিবর্তন।
ব্রিটিশ কাউন্সিল সে লক্ষ্যে লাইব্রেরি সংক্রান্ত বেশ ক’টি প্রকল্প শুরু করেছে– তারা লাইব্রেরিগুলোকে উজ্জীবিত করতে চায়, যা ঘটবে ডিজিটাল দুনিয়ায়। আগে মানুষ লাইব্রেরি থেকে শুধুই বই ধার নিয়ে, পড়ে তা ফেরত দিয়ে আবারও নতুন বই আনতো।কিন্তু ব্রিটিশ কাউন্সিল চাইছে মানুষে-মানুষে যোগাযোগ বাড়ুক সেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। লাইব্রেরিগুলো আর আগের মতো থাকবে না।
ব্রিটিশ কাউন্সিল আরেকটি খুব বড় কাজ করেছে। পেছন থেকে তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে একটি জাতীয় লাইব্রেরি দিবস পালনের জন্য। এবং সে সুবাদে এখন থেকে প্রতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিন পালিত হবে এই ভাষার মাসে।গ্রন্থাগার দিন পালন করার অর্থই হচ্ছে আমার নিজের একটি ইচ্ছের কাছাকাছি চলে যাওয়া। আমি চাই আমার সরকার এই ফেব্রুয়ারি মাসকে ‘জাতীয় বইপড়া মাস’ হিসেবে ঘোষণা করুক।
আমি আমাদের সরকারকে ধন্যবাদ জানাই এই গ্রন্থাগার দিবস চালু করার জন্য।
কিন্তু প্রশ্ন জাগতে পারে,যখন লাইব্রেরিগুলোর দিন ফুরিয়ে এসেছে, মানুষ কেউ আর লাইব্রেরিতে যাচ্ছে না, তখন লাইব্রেরি দিবস দিয়ে কী হবে? ডিজিটাল লাইব্রেরিতে জনগণকে পড়তে এবং গবেষণা করতে উৎসাহ দিয়ে তাদেরকে আসলেই লাইব্রেরিমুখী করতে কত সময় লাগবে? আমরা তা মন দিয়ে করবো কিনা?
আমি মনে করি এ কাজ করতে বেশ অনেকদিন সময় লাগতে পারে। আগে মানুষকে ডিজিটাল জ্ঞান দিতে হবে, তাদের কাছে ডিজিটাল প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে হবে যেন তারা ডিজিটাল লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতে পারেন।
আমাদের ডিজিটাল যাত্রার চ্যালেঞ্জ অনেক। এখনও দেশের পঞ্চাশ ভাগ মানুষের কাছে আমরা ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে পারিনি।
আমাদের লাইব্রেরিগুলোতে যত বই এবং জার্নাল আছে সেগুলোকে ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তরিত করতে হবে। ই-বইয়ে বা ই-পত্রিকায় রূপান্তর না করলে সেগুলো পড়া যাবে না।ইন্টারনেট থাকলেও পড়া যাবে না।
সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে মানুষের পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনা। আমাদের হাতে দ্রুতগতির ইন্টারনেট খুব তাড়াতাড়িই চলে আসবে।আমাদের আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। কাজে নেমে পড়তে হবে এখনই।
গ্রন্থাগার বলতে এতদিন যেই দালান-কোঠাকে আমরা চিনি তা আর বেশি দিন থাকবে না। যদিও ভাবকে কষ্ট হচ্ছে, তবুও লাইব্রেরি হারিয়ে যাবে বলে আমার মনে হয় না। জ্ঞানার্জনের ইচ্ছে হারিয়ে যাবে বলে আমার মনে হয় না। ডিজিটাল লাইব্রেরিতে মানুষ আরও বেশি পড়বে। প্রযুক্তি যখন এসে গেছে যে করেই হোক আমাদের তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারতে হবে। আমরা যেন আসলেই সময়ক্ষেপণ না করি।

৫,৮৪৫ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “দীর্ঘস্থায়ী হোক আমাদের গ্রন্থাগারগুলো”

  1. কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

    লাইব্রেরি প্রজম্ম কি তাহলে শেষ হয়ে গেলো??? আমাদের তো পড়ার অভ্যাস নেই বললেই চলে। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসহ বিভাগীয় কিছু গ্রন্থাগারে ডিজিটাল যুগের আগেও দেখেছি প্রকৃত পাঠকের সংখ্যা নিতান্তই নগন্য। তবুও সে সময় নিষ্ঠাবান পাঠকও ছিল। পাড়ায় পাড়ায় গ্রামে গ্রামে মফস্বলে কিংবা শহরেও নতুন নতুন গাঠাগার তৈরীতে উৎসাহ ছিল, জোয়ার ছিল। তারপরও পরিবর্তনকে যত দ্রুত গ্রহন করা যায় ততই জাতির জন্য মঙ্গল।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।