দু’হাজার দুই কী তিন সালের কথা। গিয়েছি এক বিদেশি রেডিওতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। রেডিওটি খবর-নির্ভর এবং সঠিক খবর দেয় বলে খ্যাতি আছে। ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন দু’জন – একজন বাঙালি এবং একজন পাকিস্তানি। বাঙালি আমার কাছে জানতে চাইলেন আমাকে যদি সেখানে চাকরি দেওয়া হয়, আমি নতুন কী করতে পারবো। আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘জনমুখী কিছু অনুষ্ঠান চালু করতে হবে এবং সঙ্গীতের একটি প্রোগ্রাম প্রয়োজন।’ তিনি আমার দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। তার হাসির শব্দই আমায় বলে দিচ্ছিল যে তিনি আমায় একটি ‘ছাগল’ ভাবছেন। যেই বিভাগের জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম সেখানে আমার চাকরি হয়নি। অন্য বিভাগে হয়েছিল। তবে আমরা একই অফিসে বসে কাজ করতাম। খুব অবাক হয়ে দেখলাম যিনি আমার উত্তর শুনে হেসেছিলেন, তিনিই আমাকে চাকরি না দেওয়ার ঠিক দু’বছরের মাথায় কুড়ি মিনিটের একটি গানের অনুষ্ঠান রেডিওতে জুড়ে দিলেন।
ঘটনাটি উল্লেখ করলাম কাউকে তাচ্ছিল্য করার জন্যে নয়। বরং এ ঘটনার মাধ্যমে বলতে চাই যে তিনি সংবাদ-নির্ভর একটি রেডিওতে গানের অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা টের পেয়েছিলেন। ওই রেডিওর অনুষ্ঠান মানুষ কেন শুনবে তিনি সারাক্ষণ সেই চিন্তা করতেন বলেই এ কাজ করতে পেরেছিলেন। শুধু গান নয়, তিনি ওই রেডিওর রীতি ভেঙে আরও অনেক কিছু চালু করেছিলেন কারণ তাদের শ্রোতাদের মন এবং আগ্রহ বিশ্লেষণ করে তিনি বুঝেছিলেন যে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে তাদের অনুষ্ঠানেরও পরিবর্তন জরুরি। অনুষ্ঠানগুলো বেশ সার্থকও হয়েছিল; শ্রোতারা গ্রহণ করেছিলেন। এই রেডিওটির আরেকটি বিশেষ গুণ আছে– তারা শ্রোতাদের দিয়ে এখনও চিঠি লেখান অথবা ইমেইল করান; তাদের অনুষ্ঠান কেমন লাগছে তা শ্রোতাদের লিখে জানাতে বলেন। শ্রোতারাও সাড়া দেন এবং তারা শ্রোতাদের চাহিদা অনুযায়ী অনুষ্ঠান সাজানোর চেষ্টা করেন।
আরেকটি সংবাদ নির্ভর সংস্থার কথা বলি।
আমি এক সময় একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদকক্ষে কাজ করতাম। প্রথম থেকেই আমরা একটি সঙ্গীতের অনুষ্ঠান রাখবো বলে ঠিক করেছিলাম। শুক্র ও শনিবার খবরের চাপ কম থাকে তাই এই গানের অনুষ্ঠান লাইভ চালানো হতো এই দিনগুলোর দুপুরে। টেলিভিশন অন-এয়ারে আসার পরিকল্পনা চলছে তখনই একটি দর্শক জরিপ করা হয়েছিল। জরিপটি সাদামাটা হলেও কাজে দিয়েছিল। চিন্তা-ভাবনা করে অনুষ্ঠান সাজিয়েছিলাম। ওই চ্যানেলটি সে কারণেই, সংবাদনির্ভর হলেও, অন্যরকম একটি টেলিভিশন হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।
তবে আমি নিজে একটি অপরাধ করেছিলাম সেই প্রথম দিকেই। সাংবাদিকতার কিছু ব্যাকরণ আমি ভঙ্গ করেছিলাম। বলি তাহলে। আমি আফিসে যেতাম সেই সকাল সাতটায়। সপ্তাহে একদিন মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক বসতো। সকাল সাড়ে-ন’টায় অথবা দশটায়। আমার প্রতিবেদক ভাই/বোন আগে থেকেই সচিবালয়ে উপস্থিত। ন’টার সংবাদের সময় হলেই তাকে ফোন করে বলতাম– ‘ন’টায় লাইভে দাঁড়াও; পরিষদের বৈঠক নিয়ে কথা বলো।
‘প্রতিবেদক আমার ওপর ক্ষেপে যেত। বলতো, ‘ভাই, লাইভ কেন? কিছুতো হয়নি, ঘটেনি- কী বলব?’ ওদের রাগ আমি বুঝতাম। তারা ঠিকই বলতো। আসলেই তো কিছু ঘটেনি, বলা হয়নি; তারা লাইভে আসলেই বা কী বলবে?
আমি বড় ভাই, দাপট আমার।
বলতাম, ‘কথা বলো- গত বৈঠকে কী-কী হয়েছে, বলো। সারা সপ্তাহ দেখনি? কী হতে পারে, কোন-কোন মন্ত্রী এসেছেন – এসব বলো! কথা বলো! আগে লাইভে দাঁড়াও, তারপর আমি টকব্যাকে বলছি কী বলতে হবে।’
ওরা মনে না নিলেও মেনে নিতো। আর আমি অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে দেখিয়ে দিতাম ‘একাত্তর লাইভে আছে!’
এভাবেই ব্যাকরণ ভেঙেছিলাম। উচিত হয়নি।
কেন করেছিলাম এ কাজ! কারণ, যদি চব্বিশ ঘণ্টার একটি সংবাদ-ভিত্তিক চ্যানেলের জন্য কন্টেন্ট খুঁজে পাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দিনের শুরুতে কোনও কিছু ঘটে না; গতরাতের পুরনো খবর সকাল ন’টায় দর্শকদের দেখাবো। হ্যাঁ, কিছু-কিছু পুরনো সংবাদ অবশ্যই দেখানো যায়, তবে সব নয়। আমার প্রচেষ্টা ছিল ন’টায় কোনও কন্টেন্ট ছাড়াই লাইভ করে দর্শকদের মনকে একটু নাড়াচাড়া দেওয়া। দর্শক যে খুব পছন্দ করেছিল তা বলবো না, তবে আমাদের দেখাদেখি অন্যান্য চ্যানেলগুলোও লাইভ করার প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। চারিদিকে শুধু লাইভ আর লাইভ। দু’টো লাভ হতো, এক. কন্টেন্টের অভাব পূরণ এবং দুই. আমরা ধরেই নিতাম দর্শক লাইভ খুব পছন্দ করছে। হয়তো কিছু দর্শক পছন্দ করতেনও, তবে সবাই নয়; আমরা কোনও জরিপ করে দেখিনি যে তারা আসলেই পছন্দ করছেন কিনা।
চব্বিশ ঘণ্টা সংবাদ। বললেই হলো? কন্টেন্ট পাবো কোথায়? সারাদিনই কি ঘটনা ঘটে? হয়তো ঘটে, কিন্তু আমরা সব ঘটনাই কি দর্শকদের দেখাব? মানুষ কতক্ষণ সেই খবর দেখবে? তাহলেই আপনারা বুঝতে পারছেন এতো লাইভ কেন।
এবার অনুষ্ঠান অথবা নাটকের বিষয়ে একটু বলি।
একথা বলতে গিয়ে আমার এক লেখক বন্ধুর কথা বলি। সে অনেকগুলো টেলিভিশন নাটক লিখে বিখ্যাত হয়েছে। শাকুর মজিদ। সে একজন ইতিবাচক সমালোচক। লেখা পড়ে ও নাটক দেখে মন্তব্য করে। গেল ঈদের ছুটির এক সন্ধ্যায় সে একটি টেলিফিল্ম দেখছিল। দেখতে-দেখতে সে টের পেলো যে গল্পের সাথে অনেক আগে দেখা একটি সিরিয়ালের মিল আছে। অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে নাটক-নির্মাতারা নতুন-নতুন গল্প দিতে পারছেন না। শাকুর মনে করেন এমনটিই তো হবে। সে একটি হিসেব দিলো। প্রায় সতেরো-আঠারো বছর আগে বাংলাদেশে টেলি-জাগরণের পর থেকে প্রায় পাঁচ হাজার টিভি নাটক তৈরি হয়েছে। পাঁচ হাজার! টেলিভিশনে পাঁচ হাজার গল্প বলা হয়েছে? আমাদের দেশে এই পাঁচ হাজার স্ক্রিপ্ট লেখার মতো লেখক আছে? অপূর্ব একটি ব্যাপার! যদি থেকেও থাকে, দর্শকদের উপহার দেওয়ার মতো তাদের কাছে পাঁচ হাজার গল্প আছে? যদি থাকে, তাহলেও একটি বড় অর্জন। তবে আমার বন্ধু তা মনে করেন না। তার মতে আমাদের স্ক্রিপ্ট লেখকদের কাছে এতো গল্প নেই, তাই গল্পের পুনরাবৃত্তি হতে বাধ্য।
আমরা যারা সাধারণ দর্শক, সময় পেলে টেলিভিশনের সামনে বসি ভালো কিছু দেখার জন্য। আমার বন্ধুর মন্তব্য যদি ধর্তব্যে আনি, তাহলে বলতেই হয় যে টেলিভিশনের জন্য যারা কন্টেন্ট বা বিষয়বস্তু নির্ধারণ করছেন, তারা খুব একটা মনযোগ দিয়ে কাজটি করছেন না। আমাদের দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবনের সঙ্গে মিল রেখে বিষয়বস্তুর কথা ভাবছেন না।
পরিবর্তন? হয়তো জানতে চাইতে পারেন পরিবর্তন কেন প্রয়োজন। জীবন ও জীবনধারার বদলে যেতে পারে কিন্তু খবর ও বিনোদনে পরিবর্তন কেন আসবে? এগুলো তো একই রকম থাকার কথা। খবর তো খবরই, নাটক সেই গ্রিক-রোমানদের আমল থেকে একই রকম আছে, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান!
আমার আরেক বন্ধু, যে পেশায় কথাবন্ধু, রেডিও অনুষ্ঠান তৈরি করে, আরজে কিবরিয়া, জানালো যে আমরা সেই স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একই ধাঁচের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখছি তো দেখছিই।
কিবরিয়া মনে করেন ‘ইত্যাদি’র ধারে-কাছেও অন্য কোনও অনুষ্ঠান নেই। তার প্রত্যাশাও তাই বেশি। সে যতটুকু আজ থেকে কুড়ি বছর আগের ইত্যাদিকে অনেক পছন্দ এবং সম্মান করে। সে বলে, ‘ইত্যাদি’ সে যুগের অতি-আধুনিক একটি যুগসই অনুষ্ঠান। কিন্তু বর্তমান ‘ইত্যাদি’র কনটেন্ট নিয়ে হানিফ সংকেতকে আরও ভাবতে হবে।
আমি কিবরিয়ার কাছে জানতে চাইলাম বাংলাদেশে কি তাহলে কন্টেন্টের ক্রাইসিস হচ্ছে। সে অবাক! বলে, ‘কন্টেন্ট ক্রাইসিস! বাংলাদেশে? এদেশের কোনায় কোনায় কন্টেন্ট, ভাই। ‘ইত্যাদি’র কন্টেন্ট খুবই সাধারণ যা সবাই বুঝতে পারে। আপত্তি নেই, কিন্তু কন্টেন্ট হাতে নিয়েই আম-জনতাকে শিক্ষকের মতো উপদেশ দিতে হবে, এই স্টাইলটা নব্বইয়ের দশকের; এর পরিবর্তন প্রয়োজন’।
দর্শকদের মনে কি এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে বেশি সংখ্যক চ্যানেলের কারণে? অনেকেই বলছেন মন বসাতে পারছেন না। তাদের এই নেতিবাচক মনোভাবের কারণ তারা ঠিক করতে পারছেন না? এই পঁচিশ-ছাব্বিশ’টি চ্যানেল সবাই মিলে প্রায় একই রকম অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। টেলিভিশন খুলে আমরা কী করছি? রিমোট নিয়ে এক থেকে শুরু করছি। এক-এক করে পঁচিশ পর্যন্ত গিয়ে আবার এক নম্বরেই ফিরে আসছি। মন বসাতে পারছি না। আমরা জানি না কোথায় কোন অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। বিজ্ঞাপনের বিড়ম্বনাতো আছেই। ‘ইত্যাদি’র কথা সবাই জেনেছেন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে। তা না হলে জানতেন না। এমন অবস্থায় কী দেখব? দেখারই বা প্রয়োজন কী? না দেখলেই কী হয়? তাই অনেকেই দেখাও ছেড়ে দিয়েছেন।
মাঝে শোনা গেলো সবাই ভারতীয় বাংলা চ্যানেল দেখা শুরু করেছেন। সত্যিই তাই। আমার অনেক বন্ধু আছে যারা শুধুই ভারতীয় টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করে। ইদানিং ভারতীয়দের মতো করে বেশ কিছু নাটক তৈরি হচ্ছে এখানে। এগুলো কতখানি যুক্তিযুক্ত হচ্ছে তা একবার ভেবে দেখা প্রয়োজন। ভারতীয় আদলে নাটক কয়জন দেখছেন তাও একবার চিন্তা করা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়। দর্শক ভারতীয় চ্যানেলে সিরিয়াল দেখেন ভারতীয় সমাজের কথা চিন্তা করেই। বাংলাদেশি চ্যানেলের কাছে বাংলাদেশি সমাজের মতো করেই গল্প চান।
শোনা যাচ্ছে নাটকে ইদানিং কোনও স্ক্রিপ্ট ছাড়াই অভিনয় চলছে। এবং সে কারণে অনেক অভিনেতারা নাটকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। কয়েক মাস আগে অভিনেতা অপূর্ব একথা পত্রিকায় লিখেছিলেন।
সঙ্গীত জগতের কথা বলি। আমাদের আইয়ুব বাচ্চুকে কে না চেনেন! অনেক দিনের সংগীতজীবনে তিনি গানের পাশাপাশি তার গিটার জাদুতেও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। গিটারের এই জাদুকর সম্প্রতি তার গিটারগুলো বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আক্ষেপ ও কষ্ট থেকে একধরনের প্রতিবাদ হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
ফেসবুকে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তিনি এই কষ্টের কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল আমার গিটারগুলো নিয়ে গিটার বাজিয়েদের সঙ্গে নিয়ে দেশব্যাপী একটি গিটার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করার। যেখানে এই গিটারগুলো বাজিয়ে বিজয়ীরা জিতে নেবে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় একেকটি গিটার! কিন্তু বেশ কিছু দিন চেষ্টা করার পরও যখন কোনও পৃষ্ঠপোষকই পেলাম না গিটারগুলো তরুণদের হাতে তুলে দিতে তাঁদের মেধার মূল্যায়ন স্বরূপ, তাঁরা প্রাণ উজাড় করে গিটার বাজাবে আর আমরা আনন্দের সঙ্গে শুনব, দেখব এবং উৎসাহ দেব; যাতে করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যেন এটা একটা নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি আমার স্বপ্নের বাস্তবায়ন! কারণ হয়তো বা আমার স্বপ্নটা একটু বেশিই বড়ই ছিল গিটার নিয়ে!’
তার গিটার সংরক্ষণের খবর আমরা অনেকেই জানি। এই গিটার নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনাও তার অনেক দিনের। তাই অনেক কষ্ট সত্ত্বেও দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেক নামীদামি ব্র্যান্ডের গিটার সংগ্রহ করতেন। কিন্তু সারা দেশে গিটার শো করার উদ্যোগ নেওয়ার পর পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়ায় এখন গিটারই বিক্রি করে দিচ্ছেন।
এতো গেলো তার কষ্টের গল্প। কিন্তু গিটার বাজিয়েদের একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করলে কি কিছু দেখার মতো অনুষ্ঠান সাজানো যেত না?
টেলিভিশন আর টেলিভিশন থাকছে না বলেই মনে হচ্ছে। আমার তিন সন্তানের কথাই যদি ধরি, তাদের মধ্যে একজন শুধু টেলিভিশন দেখে। তাও বিদেশি চ্যানেলে ফুটবল এবং বিদেশি খবরের চ্যানেলগুলো। সে সিনেমা বা অন্যান্য অনুষ্ঠান দেখে ইউটিউবে বা সেখান থেকে নামিয়ে। আমার মেয়ে রেডিওতে কাজ করে বলে দেশি ও ভারতীয় চ্যানেল দেখে তার শ্রোতাদের সঙ্গে অনএয়ারে কথা বলার জন্য। আমার ছোট ছেলে তার মোবাইল ফোনে খেলে, ইউটিউবে ইংরেজি সিনেমা দেখে এবং পড়াশোনা করে। আমার স্ত্রী খবর জানতে চান টিভি দেখে।
আমি নিজে খবর পড়ি খবরের কাগজ এবং অনলাইন সংবাদ পোর্টাল থেকে। খবর ছাড়া আমি সিনেমা ও ডকুমেন্টারি দেখি। ইউটিউব দেখতে গিয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। বিশ্বের প্রায় সব টেলিভিশনই তাদের কার্যক্রম পুরোদমে সেখানে চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু টিভি নয়, সিনেমা নির্মাতারা অন্য পর্যায়ে চলে গেছেন। কলকাতার নির্মাতাদের দেখলাম তাঁরা কুড়ি মিনিটের ছায়াছবি নির্মাণ করে পুরস্কারও পাচ্ছেন। আপনি সার্চ দেবেন আর পাবেন না, তেমনটি হয় না। আমার ছোট ছেলেরও একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে। শুধু ইউটিউব নয়, সামাজিক মাধ্যমেও অনেক টিভি চ্যানেল এখন শুরু হয়ে গেছে।
বন্ধু কিবিরিয়া ঠিকই বলেছিলেন– হাটে, মাঠে, ঘাটে অনুষ্ঠনের উপাদান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। শুনেই দেখুন না এফএম রেডিওগুলো তারা কত রকমের অনুষ্ঠান নিয়ে সারাক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাজার সংক্রান্ত বিষয়, সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, ভ্রমণ, পরিবেশ– এমন সব বিষয়ই আমাদের সব চ্যানেলে আছে, কিন্তু তারা কেমন যেন শ্রেণিকক্ষ-শ্রেণিকক্ষ ভাব করেন। নির্মাতারা সবাই শিক্ষক এবং দর্শরা সবাই ছাত্র-ছাত্রী। টেলিভিশন থেকে কেউ শিখতে চাইছে না, এ বিষয়টি সবার বোঝার মতো ইচ্ছে থাকা প্রয়োজন।
যেই টক’শো নিয়ে শুরুতে আমরা এতো উত্তেজনা দেখিয়েছি, তা এখন আর ভালো লাগছে না। সব চ্যানেল কেন টক’শো দেখাবে? সবার কাছ থেকে একই রকম অনুষ্ঠান দর্শক আশা করেন না এ বিষয়টি বোঝার প্রয়োজন। আমি টক’শো আয়োজন করছি না তার অর্থ এই নয় যে আমার চ্যানেল হারিয়ে যাচ্ছে! বরং সবার মতো একই অনুষ্ঠান দেখাতে গিয়েই চ্যানেল সবার মন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ কি জানতে চেয়েছেন যে টক’শো দর্শকদের কাছে কেমন লাগে? হাতে গোনা কয়েকটি অনুষ্ঠান চলাকালীন ফোন পেয়ে মনে করা উচিত হবে না যে আমাদের টক সবাই দেখছেন।
ইউটিউবের পরের ধাপও এ দেশে চলে এসেছে। নেটফ্লিক্স এবং আইফ্লিক্স। নেটফ্লিক্স আমাদে ছবি বা অনুষ্ঠান এখনই নেবে কিনা জানি না, তবে আইফ্লিক্স নেবে। আমি মনে করি আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের এদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আমি আরও মনে করি আমাদের নির্মাতা, বিপণন কর্মী, পৃষ্ঠপোষক অথবা বিজ্ঞাপন দাতারা একসঙ্গে কাজ করতে পারছেন না। সব চেয়ে বড় বিষয় তারা দর্শক-শ্রোতাদের কাছে গিয়ে কোনও সমীক্ষা চালাচ্ছেন না। সমীক্ষাটি চালালে নতুন কিছু ধারণা বোধ হয় পাওয়া যেত।
সারাদিন ক্রিকেট খেলা দেখিয়ে আর হাতে গোনা কয়েকজনের কথা শুনিয়ে ভাবা উচিত হবে না যে আমরা অনেক খেলা দেখিয়ে ফেলেছি। ভারতীয়দের যে এতো সমালোচনা করি, তাদের চ্যানেলগুলো ফুটবল, কাবাডি ও ব্যাডমিন্টনকে কোথায় নিয়ে গেছে তা একটু পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন।
তবে শুনতে পাচ্ছি শিশুদের জন্য একটি চ্যানেল খুব ভালো করছে। শুনে ভালো লাগছে যে ঘরে-ঘরে শিশুরা সবাই দেখছে। তবে ক’দিন সবাই দেখে সেটিই দেখার বিষয়। ওই যে বললাম দর্শকদের কাছে গিয়ে সমীক্ষা না চালালে বেশিদিন ভালো নাও থাকতে পারে।
অনেক কথা বলে ফেললাম। হয়তো কিছু ঠিক এবং কিছু ভুল বলেছি। যারা কাজের মাঝে আছেন, তারা এ বিষয়ে আমার চাইতে অনেক ভালো বুঝবেন। তবে ভুল কিছু বলে থাকলে বা কাউকে আঘাত দিয়ে থাকলে ক্ষমা চাইছি। শেষ কথা বলতে চাই যে, আমি মনে করি না চ্যানেলের সংখ্যা আমাদের অনুষ্ঠানের মান কমিয়ে দিচ্ছে। অনুষ্ঠানের নিজের মানই অনুষ্ঠানের মান কমাচ্ছে।
ইকরাম ভাই, আপনার লেখা আসলেই আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ি। পেপারে, ব্লগে যেখানেই হোক না কেন। আর ফেসবুকের আপনার ফলোয়ার লিষ্টে আছি। 😛 এজন্য পড়ি যে, সাধারণত নতুন বিষয় নিয়ে জানতে পারি অথবা পুরাতন বিষয় গুলিই বিস্তারিত ভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোণ থেকে চিন্তা করতে পারি। টেলিভিশন সম্পর্কে কখনোই আমার উচ্চ ধারণা ছিল না, এখনো নাই। হয়তো যখন থেকে বুঝতে শুরু করেছি তখন থেকেই এর অধঃপতন। আমি জানি না। তবে এর গুরুত্বও অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখাচ্ছি না। গুরুত্ব আছে বলেই এর রাজনীতিকরণ হচ্ছে। এবং সেখান থেকেই এর অধঃপতনের শুরু বলে মনে করি। অনুষ্ঠানের মান নিয়ে কখনো নির্মাতারা এবং দায়িত্বশীলেরা যে চিন্তা করছে, দর্শক হিসেবে আমার কখনোই মনে হয়নি। দুএকজন যে ব্যতিক্রম নাই তা নয়। তবে সামষ্টিকভাবে আমাদের মানসিকতা এমনই যে আমি যেটা ভালো মনে করছি সুযোগ থাকলে সেটা করে দেখাচ্ছি এবং ভাবছি সবার জন্যই তা ভালো। অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা না করা, কখনো কখনো অস্বীকার করার "টেন্ডেন্সি" বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে 'অনুষ্ঠান অথবা তার মান নিশ্চিত করার জন্য' জরীপ/সমীক্ষা না করা। 'রিসার্চ' নিয়ে আমাদের কাজ খুবই নিম্ন মানের, অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। আমাদের কি কোন গণমাধ্যম এক্সপার্ট আছে কি? (আমার জানার সীমাবদ্ধতা থেকে বলছি।) যা চলছে টেলিভিশনে সবই হুজুগে। কাষ্টমার স্যাটিস্ফ্যাকশন নিয়ে কোন টেলিভিশন ভেবেছে বলে মনে হয় না।
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
amar lekhar shutro dhorey tumi ekta likho.
খুব ভালো লাগলো লেখাটা, ইকরাম ভাই। অনেক গুছিয়ে মনের কথা গুলো বলেছেন। শুধু রেডিও বা টিভি না আসলে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই সার্ভে হওয়া উচিত কিছুদিন পর পর।
আমি নিজে খুব একটা টিভি দেখি না। দেখা যায়, এখানে শুধু স্থানীয় খবর দেখার জন্যে টিভি খুলে বসি সন্ধ্যায়। ইদানীং শান্তশিষ্ট মেলবোর্নে হঠাত করে কিছু ক্রাইম গ্যাং এর উৎপাত শুরু হয়েছে। আমার মত খবর-বিরাগি মানুষও তাই খবর দেখি।
টিউনইন নামে একটা চমৎকার এপ আছে, ফোনে আর আইপ্যাডে, ওটাতে সব দেশি রেডিও চ্যানেল বুকমার্ক করে রেখেছি। ছুটির সকালে বা ড্রাইভ করার সময় সেগুলো নিয়মিত শোনা হয়।
মুভির জন্যে এখন নেটফ্লিক্স আর সিনেমাহলই ভরসা। আর সকল সমস্যার সমাধান হিসেবে দিনে কয়েকবার দেখা হয় ইউটিউব। পছন্দের গানই হোক বা নতুন কোন টিউটোরিয়াল।
দেশি নাটক এখন আর দেখি না একেবারেই, যদি না কেউ আলাদা করে রিকমেন্ড করে।
আপনার সমীক্ষায় কিছু পয়েন্ট রেখে গেলাম। 🙂
www.tareqnurulhasan.com