নিজের জন্যে শ্রদ্ধার্ঘ

কি? কি বললেন? নিজের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ লিখবেন। মানে আপনি আপনার জীবন-গাঁথা লিখে রেখে যাবেন আপনার মৃত্যুর পর পত্রিকায় ছাপার জন্য? কি বলছেন এসব? যা-তা, একেবারে! আপনার মাথাটা পুরোটাই গিয়েছে! মরনের ইচ্ছে হয়েছে নাকি আপনার?
ঠিক এমনই প্রতিক্রিয়া দেখাবেন সবাই আমি যদি বলি আমার মৃত্যু-পরবর্তী শ্রদ্ধার্ঘ আমি নিজেই লিখে রেখে যাব।
চিন্তাটি মাথায় এলো কয়েকদিন আগে যখন আমি আমার মায়ের জন্য একটি শ্রদ্ধার্ঘ লিখতে চাইছিলাম। চেষ্টা করলাম অনেক। মা এক বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মাকে নিয়ে আরো বেশি ভাবলাম। ভেবে দেখলাম, একহাজার শব্দের মধ্যে মাকে সীমাবদ্ধ করতে পারবো না; কোটিশব্দও তাঁকে নিয়ে লেখার জন্য যথেষ্ঠ নয়। যে মানুষটি আমায় জন্ম দিয়েছেন, বড় করেছেন, পথ দেখিয়েছেন, আমার চরিত্র নির্মান করে দিয়েছেন এবং তারপর জীবনের পথে মুক্ত করে দিয়েছেন, তাঁকে নিয়ে এত অল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়।
মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মনে হলো, আমার নিজের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ লিখতে পারব কিনা। আমার নিজের মৃত্যু-পরবর্তী জীবন-গাথা। এ চিন্তা আমার মনের ভেতর অন্য একটি চোখ খুলে দিল। আমি মৃত আমায় অন্য আরেকজনের দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম। আসলে দেখতে চাইলাম।
হ্যা, অবশ্যই আমার নিজের শ্রদ্ধার্ঘ লিখতে পারব যেথায় আমি আমার মৃত্যুর পর কেমন করে অন্যদের মনে বিরাজ করতে চাই। সবাই আমায় কেমন ভাবে মনে রাখবে তা থাকবে এ লেখায়। আবার বলবেন না যেন কেউ আপনাকে মনে রাখুক আপনি তা চান না। ভুলে আপনাকে সবাই যাবেই, তবে সবাই চায় এ জগতে ফেলে যাওয়া মানুষগুলো তাকে মনে রাখুক। অনেকেই বুক ফুলিয়ে অস্বীকার করবেন তবে আমি হলফ করে বলতে পারি যে সবাই চান মানুষ তাঁকে মনে রাখুক।
কি এমন এ জীবনে করেছেন যে সবাই মনে রাখবে? কাজী নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেক্সপিয়ার, মার্কেজ, মুহাম্মদ (সঃ), জিশু (আঃ), মুসা (আঃ) – এঁদের কথা আলাদা। এঁরা করেছেন; অনেক করেছেন। এঁরা যদি নিজের শ্রদ্ধার্ঘ লিখে যেতেন, কেমন হতো তা আমরা হয়তো ভাবতেও পারিনা। অমরত্বের কথা বলছিনা, শুধু একটু ভাবতে বলছি আর সবাই আপনাকে কেমন ভাবে মনে রাখবে।
ভাবতে ভাবতে আমার নিজের যে একটি চিত্র ফুটে উঠছে তা টের পেলাম। আমার আশা, আমার স্বপ্ন, সমাজে-পরিবারে-বন্ধুদের জীবনে আমার অবদান – এ সব ভেসে উঠল মনে পর্দায়। বেশ ভালই লাগলো। এভাবেই আমি সবার মাঝে বেঁচে থাকতে চাই। বুঝলাম, আমি যদি এভাবেই আমাকে মনে রাখাতে চাই তাহলে আমার জীবদ্ধশায় আমায় এমন মানুষটি হতে হবে। আমায় এমন চরিত্র অর্জন করতে হবে।
ভাবুনতো একবার; সকালে উঠে আপনি দেখলেন খবরের কাগজওয়ালারা ভুল করে আপনার স্মরনে একটি শ্রদ্ধার্ঘ ছেপে দিয়েছে। আঁতকে ওঠারই কথা; সেটাই স্বাভাবিক। যতই অবাক হোন না কেন, ভাল করে একবার পড়ে দেখুনতো আপনাকে নিয়ে কী লিখেছে! আপনি নিশ্চয়ই পড়তে চাইবেন। তাঁরা যা লিখেছেন, আপনি কি সেভাবেই তাঁদের মনে বিরাজ করতে চান? নাকি, আপনি আপনার মত চান? আপনার অবর্তমানে সবাই কী ভাবুক, কী বলুক এবং কী লিখুক তা নিয়ে আপনার নিশ্চয়ই এক ধরনের চাওয়া আছে। সে চাওয়াকে বাস্তবে রূপ দিতেই আপনার নিজের জন্য একবার শ্রদ্ধার্ঘ লেখা জরুরি বৈকি।
আমরা বেশিরভাগ মানুষই মৃত্যুর জন্য তৈরী নই, তৈরী থাকিনা; আমাদের কাছে মনে হয় আমরা সব সময়ই বেঁচে থাকবো। তবে আমরা যদি আমাদের অবর্তমানে আমাদের নিয়ে কি আলাপ হচ্ছে তা যদি জানতে পারি, তাহলে? সারাবিশ্ব আমার, আমার অবদানকে কিভাবে মুল্যায়ন করবে তা যদি জানতে পারতাম, তাহলে? আমি কি আসলেই আমার চারিপাশের মানুষগুলোর জীবনে সুন্দর কোন প্রভাব ফেলেছি? আমি কি তাদেরকে, আমারদের সমাজকে আসলেই কিছু দিয়েছি? আমি কি ইতিহাস রেখে যাচ্ছি? আমার কথা, আমার ব্যবহার নিশ্চয়ই তাঁদের জীবনে কোন না কোন প্রভাব ফেলেছে যা তাঁরা আমায় আমার জীবদ্দশায় বলেননি। আমি চলে যাওয়ার পর বলবেন।
আমার মনে হয় নিজের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ অর্থাৎ নিজের জীবনের গল্প নিজেকে বলতে পারা আমাদের জন্য একটি ভাল সুযোগ। আমরা নিজের জীবনের গল্প অন্য কাউকে বলার জন্য সবসময়ই উৎসুক থাকি। নিজের শ্রদ্ধার্ঘ আমার বিশ্বাস, আমার ধারণাগুলো সবাইকে জানানোর একটি সুন্দর সুযোগ। আমি হয়তো ভাবি কেউ আমায় নিয়ে চিন্তা করছেনা। আসলে করছে।
যেহেতু মৃত্যু অজানা ও ভীতিকর, পারতপক্ষে আমরা তা নিয়ে চিন্তা থেকে দূরে থাকতে চাই। হয়তো সবাই-ই জানেন মৃত্যু হবেই, তারপরও ক’জন মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেন? হ্যা, নিজের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ লেখার ভাবনা আমাদের মৃত্যুকে সহজে মেনে নিতেও সাহায্য করতে পারে। আমরা যে সবাই চলে যাব, সে বিষয়ে বোধহয় আমারদের ভেতরে একটি বোধের উন্মেষ হতে পারে। এবং সে চিন্তাই আমাদের আরো উন্নততর মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে।
বিষয়টি শুধুই নিজেকে উন্নত মানুষ হিসেবে গড়া নয়; জীবনের আর যতটুকু সময় বাকী আছে, এ চিন্তার মাধ্যমে সে বিষয়েও কিছু দিক-নির্দেশনা পাওয়া যাবে বোধ হয়। আমি যদি আজ চলে যাই, আমি কি তৃপ্ত মন নিয়ে যাব? একজন তৃপ্ত হওয়ার জন্য আমি কি-কি করেছি এ জীবনে? এখনকি আমি নিজেকে সেদিকে চালিত করতে পারিনা। হয়তো পারি, হয়তো না। তবে নিজের শ্রদ্ধার্ঘ লেখার জন্য যে চিন্তা আমার ভেতর শুরু হয়েছে, তা হয়তো আমায় কিছুটা পথ দেখাবে।
যেমনটি আমি আগেই বললাম, আমি যে ইতিহাস এখানে রেখে যাচ্ছি, তা নিয়ে আমি কি খুশি? রাজনীতিবিদদের কথাই ধরুননা! তাদের কথা মনে এলেই আমরা কি ভাবি?সমাজের জন্য, মানুষের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য তাঁদের অবদানের কথা ভাবি। তাঁদের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় তাঁরা তাঁদের নিজেদের শ্রদ্ধার্ঘে কি-কিলিখবেন, তাঁরা কি উত্তর দিতে পারেন বলে আপনাদের মনে হয়? ব্যপারটি বেশ মজার, তাই না?
নিজের শ্রদ্ধার্ঘ আমাদের আরেকটি বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দিতে পারে। আমাদের জীবনে কি-কি নেই তার একটি রূপ আমারদের সামনে তুলে ধরতে পারে। আমাদের জীবনে পূর্ণতা আসতে আর কি-কি করতে হতে পারে, সে বিষয়েও এক ধরনের চিন্তা মনে জাগাতে পারে। নিজের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ লেখার চিন্তাটি হচ্ছে নিজের আত্মার দিকে তাকানো, নিজের ভেতরে আবারও আরেকবার ভ্রমন করা। আমি যেভাবে এ লেখা লিখতে চাই, আর সবাই কি সেভাবেই লিখবে? অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমি কি কিছু শিখব? আমার মনে হয় শিখবো।
আমার মনে হয় এ চিন্তাটি বেশ অর্থপূর্ণ। আমায় নতুন মানুষ বানিয়ে দিতে পারে। আমায় যতই পাগল আর মাথা খারাপ বলুন না কেন, আমি কিন্তু আমার জন্য জীবন্ত অবস্থায় মৃত্যু-পরবর্তী একটি জীবন-গাঁথা লিখতে চাই।

৬,৯৪৪ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “নিজের জন্যে শ্রদ্ধার্ঘ”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।