গৃহকর্মী কি বিদেশে পাঠাতেই হবে?

খবরে দেখলাম, আমিরা বিন আয়দান বিন নায়েফ নামে সৌদি এক প্রিন্সেস ফরাসি কাগজ ‘লো মন্দ’-এর কাছে রাজপরিবারের বেশকিছু গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ক্রীতদাস প্রথা এখনও সেখানে বহাল আছে। রাজপরিবারের কাছের লোকজন ক্রীতদাস প্রতিপালন করতে পারেন। তারা মেয়েশিশুদের কিনে নিয়ে অন্যের কাছে ‘ভাড়া’ দেন। শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং বাংলাদেশের মেয়েদের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশের কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, গৃহকর্মী হয়ে এসে সৌদি আরবে মেয়েরা ক্রীতদাসের মতো থাকেন এবং তাদেরকে দিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ‘অনৈতিক’ কাজ করানো হয়।
এমন ঘটনার কথা প্রায়ই দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে খবর হয়ে আসে। বাংলাদেশসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশের মেয়েদের মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী হিসেবে পাঠানোর বিষয়টি আমাদের দেশের গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়।

ক’দিন আগে বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের খবরের কথা বলি। একজন ময়না বেগমের কথা লিখেছিল দৈনিকটি। দেশে থাকতে তিনি একটি হাসপাতালে ১২০০ টাকা বেতনে কাজ করতেন। সৌদি আরবে ভালো বেতনে হাসপাতালে চাকরির লোভ দেখিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেখানে। ময়না বেগম তার এই কথাগুলো ঢাকায় এক গণশুনানিতে বলছিলেন। সৌদি আরবে গিয়ে তিনি দেখেন তাকে একটি বাড়িতে কাজের জন্য নেওয়া হয়েছে। বাড়ির কাজ করতে-করতে তিনি শিকার হয়েছেন যৌন নির্যাতনের। তিনি বলেছেন, ‘প্রথমে আমাকে বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে নিতে আসেন দুই পুরুষ। দেখে ভয় পাই। পরে ওই বাড়িতে ঢুকে যখন এক মহিলা দেখি তখন মনে সাহস আসে। কিন্তু রাতে গোসল করায়ে আমারে পাতলা ফিনফিনে কাপড় পরতে দেয়, সেটা আমি পরতে না চাইলে মারধর শুরু করে। এরপর আমার ঘরে প্রথমে আসে ছেলে, পরে আসে বাপ। তারপর আমারে জড়ায়ে ধরে নির্যাতন করে। বাধা দিতে গেলে আমারে মাইরা-ধইরা, কামড়াইয়া-চিমড়াইয়া কিছু রাখে নাই।’

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘কামড়ানো-চিমড়ানোর’ অর্থ কী? মারধোর করার অর্থ কী? যতদূর বুঝি বাড়ির কাজের পাশাপাশি তাদের কাছে কর্তারা যৌন নিবেদন করেন এবং সেই নিবেদনে সাড়া না দিলে মারধোর করেন।

গত বছর আরেকটি ইংরেজি দৈনিকে লেখা হয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা যারা গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব গিয়েছিলেন তারা বাংলাদেশি মিশনে সমবেত হয়েছিলেন আশ্রয় নেওয়ার জন্য। তারা বিভিন্ন ধরনের অত্যাচারের কথা তুলে ধরেছেন। অন্তত ১২৪৮ গৃহকর্মীকে, যারা মিশনে আশ্রয় নিয়েছিলেন, দেশে ফেরত আনা হয়েছিল। কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল ৩৫০ জন গৃহকর্মী তখনও সেখানে ছিলেন। এরপর, এ বছর ২৪ জানুয়ারি আরেকটি দৈনিক লিখেছে যে সৌদি আরবে প্রতিদিনই কোনও না কোনও বাংলাদেশি নারীকর্মী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এদের অনেকেই পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেক নারী যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে ভয়ঙ্কর সব নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সৌদি দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, শুধু ২০১৬ সালেই পাঁচ শতাধিক নারী কর্মীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এদের সবাই যৌন নির্যাতনসহ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারটি নিয়ে অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ সরকারসহ অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। আমরা গৃহকর্মী হিসেবে আমাদের মেয়েদের কেন সেখানে পাঠাতে গেলাম তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠেছে।

গেলো বছর আমার সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে গিয়ে অনেক বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। মদিনায় যে হোটেলে আমরা ছিলাম সেখানে দেখলাম হোটেলের কর্মীদের প্রায় পঁচাত্তর ভাগই আমাদের দেশের মানুষ। জানার চেষ্টা করেছিলাম বাংলাদেশিরা সেখানে কেমন আছেন। তারা অনেক কথা বললেন, তথ্য দিলেন। বাংলাদেশিরা সেখানে কেমন আছেন সে কথা জানালেন। তারা জানালেন এদের বেশিরভাগই খুবই কম বেতনে কাজ করেন এবং কষ্ট করে বেঁচে আছেন।

তারা জানালেন সৌদি বাসা-বাড়িতে বাংলাদেশের যেসব গৃহকর্মীরা কাজ করছেন তারা অমানবিক কষ্টে থাকেন। আমাদের গৃহকর্মীরা সেখানে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করেন। তাদেরকে শারীরিক, মানসিক– এমন কী যৌন নির্যাতনও করা হয়। বাংলাদেশি কর্মীরা জানালেন– এই গৃহকর্মীদের দশজনের আটজনই শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সৌদি পুরুষদের স্ত্রীরা তাদের বাড়িতে গৃহকাজের জন্য এখন কম বয়সী মেয়েদের রাখতে চান না। তারা মনে করেন বয়স্ক মহিলাদের চাকরি দিলে তাদের স্বামীরা গৃহকর্মীদের সঙ্গে যৌনকর্মে আগ্রহী হবেন না। বলা হয় একই পরিবারের একাধিক পুরুষ একজন গৃহকর্মীকে যৌন নিবেদন করে এবং তার ওপর চড়াও হন।

কী অদ্ভুত ব্যাপার! ছেলে যাকে যৌন আক্রমণ করছে, ছেলের বাবাও তাকেই করছে এবং ছেলের চাচাও বাদ যাচ্ছে না!

আমাদের দেশের সরকার দাবি করে– সৌদি সরকারের আইন-কানুন এ ব্যাপারে খুবই কঠোর। সেখানকার সরকার বলেছে যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে তারা যদি আদালতে আসেন তাহলে সুবিচার পাবেন। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে, এই গরিব মেয়েরা কখনই আদালত পর্যন্ত যেতে পারেন না এবং কোনও আইনি সাহায্য পান না।

সৌদি পুরুষদের যৌন আক্রমণের শিকার শুধু বাংলাদেশি মেয়েরাই নন। শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, উগান্ডা ও কম্বোডিয়ার মেয়েরাও একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। উগান্ডা এসব খবরের সত্যতা যাচাইয়ের পর বলেছে তারা তাদের মেয়েদের আর সেখানে পাঠাতে চায় না। বরং তারা শিক্ষিত জনবল পাঠাতে চায়। উগান্ডার সরকার বলেছে তারা সেদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া কর্মীদের ওপর অত্যাচারের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।

ইন্দোনেশিয়া, ইথিওপিয়া এবং ফিলিপাইনের অভিবাসী কর্মীদের পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। তারা বলেছে যতদিন সৌদি আরবে তাদের কর্মীদের অধিকার নিশ্চিত না করা হবে ততোদিন তারা তাদের কর্মীদের সেখানে পাঠাবে না। ইন্দোনেশিয়ার সরকার তাদের নারী কর্মীদের অন্তঃসত্ত্বা না হওয়ার টিকা দিয়ে তারপর সৌদি আরবে পাঠান। ইন্দোনেশিয়ার সরকার সৌদি সরকারকে একথাও বলেছেন– নারীকর্মীদের চাকরি দিতে হলে সঙ্গে তাদের স্বামীদেরও সেখানে নিতে হবে। নারীকর্মীরা যেন তাদের স্বামীসহ সেখানে যেতে পারেন এবং তাদের স্বামীদের ভরণ-পোষণও চাকরিদাতাদের দিতে হবে।

এসব কথা যদি কিছুটাও সত্য হয়, আমাদের মেয়েদের নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের চিন্তা করতে হবে আমাদের মেয়েরা সেখানে গিয়ে আমাদের মিশনের কাছে সাহায্য চাইলে আমরা যেন সাহায্য করতে পারি তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে দেশে আমরা আমাদের নীতি-প্রণয়ন ঠিক করার কথা ভাবতে হবে। আমাদের মেয়েরা যেন সৌদি পুরুষদের যৌন আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পারে তেমন নীতিই আমাদের তৈরি করতে হবে।

আমরা নতুন করে সৌদি সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারি। আমাদের নতুন করে চিন্তা শুরু করার প্রয়োজন আছে যেন আমাদের মেয়েরা ওই দেশে কাজ করতে গিয়ে অত্যাচারের শিকার না হয়, তাদের স্বামীদের নিয়ে যেতে পারেন– শুধু সৌদি আরবে নয়, মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশে।

আমরা যদি গৃহকর্মীদের সেখানে না পাঠাই, তাহলে কী ক্ষতি হতে পারে? আমাদের মেয়েরা বেকার থাকবে? আমাদের মেয়েরা সেখানে না গেলে কি তাদের আমরা চাকরি দিতে পারবো না? আমার তেমনটা মনে হয় না। লাখ-লাখ নারীকে কাজ দিতে পারলে ৫০ হাজারকে দেওয়া যাবে না কেন?

এমন অবস্থা বদলাতে হলে, সৌদি সরকারের যা করা উচিত বলে মনে হয় তা হচ্ছে সেখানে জাতীয় পর্যায়ে পুরুষদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা। সে দেশের পুরুষদের নারীদের প্রতি ব্যবহার তাদের জাতির ওপর কালিমা লেপে দিচ্ছে। সারাবিশ্বে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে।

http://www.banglatribune.com/columns/opinion/266277/%E0%A6%97%E0%A7%83%E0%A6%B9%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%80-%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%87%E0%A6%87-%E0%A6%B9%E0%A6%AC%E0%A7%87

৫,৫৪১ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।