কেউ কেউ রয়ে যায়

রেলগাড়ির ভেতরে বসে সাঁই-সাঁই করে পার হয়ে যাওয়া স্টেশনগুলোর নামফলক পড়া আমার একটি নেশার মতো। সব পড়া যায় না, অনেকটি যায়। কিছু ফলক এতই পুরনো যে, পড়তে কষ্ট হয়। দিনের বেলা খুব একটা আনন্দদায়ক না হলেও, রাতের ট্রেনে যাওয়ার সময় ফলক চেনার পাশাপাশি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মগুলোও দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করে। অপেক্ষাকৃত নিশ্চুপ শহরের স্টেশন আমায় আরও বেশি টানে। স্বল্প-রাতে নিবুনিবু হলদে আলোয় দোকানিরা তাদের শেষ ক্রেতার কাছে সদাই বিক্রি করছে। প্ল্যাটফর্মের চা’ওয়ালা তখনও খদ্দেরদের জন্য চায়ের কাপে চামচ নেড়ে শব্দ করে দুধ-চিনি মেশাচ্ছে। কাপ ও চামচের সঙ্গমের শব্দ ট্রেনের ভেতর থেকে শোনা যায় না; ভেবে নিতে হয়। রাত আরও গভীর হলে দেখা যায় সারি-সারি মানুষ কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে; দোকানি তার ঝাঁপি নামাচ্ছে।
এমন দৃশ্যের প্রতি আমার আকর্ষণ চিরকালের। কোনো কোনো স্টেশনে বয়সে বড়রা কখনোই ঘুমায় না। যারা স্টেশনে রাত কাটাতে আসেন, হয়তো সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আবার কাজে চলে যান।
কোনো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায় যখন বসে থাকি, তখন এসব দৃশ্য আরও ভালো করে দেখা যায়। ছেলেবেলায় দেখতাম, প্রতি স্টেশনে একজন পাগল-কিসিমের মানুষ ঘুরে বেড়াত; তারা কখনোই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দূরে কোথাও যেত না। সেই সময় তাদের দেখে ভয় লাগত। বাবা-মার কাছে জানতে চাইতাম ওদের সম্পর্কে। তারা কোনো উত্তর না দিয়ে কথা পাশ কাটিয়ে চলে যেত। বলত, ওসব নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না; তাকিও না ওদের দিকে। লক্ষ্য করতাম, সবাই স্টেশন ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু এসব মানুষ রয়েই যায়। ছোটবেলায়ই বুঝতাম, এদের কেউ নেই, যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
আমার প্রথম স্টেশন দেখা অনেক ছোটবেলায়। বয়স তখন ৭। স্বাধীনতার পর পর। ১৯৭৩ সাল। মা-বাবা, আমি, ছোট ভাই আর একাত্তরে জন্ম নেওয়া বোন। আমরা চলেছি পোড়াদহ স্টেশন থেকে চুয়াডাঙ্গায়। রওনা হয়েছি নানাবাড়ির শহর কুষ্টিয়ার কোর্ট স্টেশন থেকে। যাচ্ছি দাদাবাড়িতে। কোর্ট স্টেশন থেকে রেলে উঠে কুড়ি মিনিট পরেই নামতে হয় পোড়াদহ জংশনে। খুবই কম সময় লাগে কোর্ট স্টেশন থেকে পোড়াদহ যেতে। সেখানে গাড়ি (কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গায় ট্রেনকে বেশির ভাগ মানুষ গাড়ি বলেই ডাকে) বদলাতে হয়। পোড়াদহ জংশন থেকে ডানে গেলে পাকশী ব্রিজ পার হয়ে ঈশ্বরদী, রাজশাহী। আর বাঁয়ে গেলে চুয়াডাঙ্গা। আরও পর যশোর; তারপর খুলনা। আমাদের বাঁয়ে যেতে হবে। নামব চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে। তারপর আরও পাঁচ মাইল যেতে হবে; তিন মাইল পাকা রাস্তা, দু’মাইল কাঁচা। এমনই কাঁচা যে, গরুর গাড়ির চাকা দেবে যায়। আশপাশ থেকে মুনিষ এনে টেনে তুলতে হয়।
আমরা কুষ্টিয়ার ট্রেন থেকে নেমে পোড়াদহ জংশনে চুয়াডাঙ্গাগামী ট্রেনের কামরায় বসেছি। আমি মায়ের কোলের কাছে দাঁড়িয়ে। সে আমাদের তিনজনকে নিয়ে নাস্তানাবুদ। মা বসেছে জানালার পাশে, ছোট ভাই তার পাশে, ছোট্ট বোন তার কোলে; আর আমি দাঁড়িয়ে। যেখানে আছি সেখানকার জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি বাবাকে। সে আমাদের প্ল্যাটফর্মের ওপারে আরেক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। পরনে খাকি রঙের প্যান্ট আর ঘিয়ে-সাদা শার্ট। বাবা কেন আমাদের সাথে এসে বসছে না; বুঝতে পারছি না।
কিছুক্ষণ পরই দেখি বাবার কাছে দু’জন মানুষ ঘুষাঘুষি করছে। মারামারি। চারপাশে তখনও লোক জমেনি। বাবা একাই দাঁড়িয়ে তাদের কাছে। হঠাৎ বাবাকে দেখলাম দাঁড়িয়েই তার সাদা শার্টের হাতা গোটাচ্ছে আর লাফাচ্ছে। মা তো অবাকঙ্ঘ মারামারি করছে ওরা দু’জন, আর তার স্বামী কেন হাতা গোটাচ্ছেঙ্ঘ মনে হচ্ছে, মা ভাবছিল, বাবা যেন ওদের ঘুষাঘুষিতে যোগ দিতে যাচ্ছে।
দু’জনের ঘুষাঘুষি শেষ হলো; আশপাশের মানুষ এসে তাদের থামিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর বাবা ফিরে এলো আমাদের মাঝে। এসেই আবিস্কার করল, তার খাকি রঙের প্যান্টের পেছন-পকেটে মানিব্যাগটি নেই। বোঝা গেল, সে যখন ঘুষাঘুষি দেখে তার হাতা গোটাচ্ছিল, তখনই কেউ তার পকেট মেরে দিয়েছে। এখন কী হবে? ট্রেনের টিকিট কাটা হয়েছে চুয়াডাঙ্গা স্টেশন পর্যন্ত। সেখানে নেমে আরও পাঁচ মাইল তো রিকশায় যেতে হবেঙ্ঘ ভাড়া দেবে কোথা থেকে? শেষে মা তার বাদামি রঙের স্যুটকেস খুলে আড়াই’শ টাকা বাবার হাতে দিল সে যাত্রায় রক্ষা পাওয়ার জন্য।
আমি কিন্তু আজও জানতে পারিনি বাবা কেন তার জামার হাতা গোটাচ্ছিল। আরেকটু বড় হয়ে যখন গল্প-উপন্যাস পড়া শিখেছি, সিনেমা দেখে বুঝতে শিখেছি, জেনেছি রেল স্টেশন যুগে-যুগে কত গল্পের জন্ম দিয়েছেঙ্ঘ গল্পকাররা স্টেশনে জড়ো হওয়া মানুষদের দেখেই কত লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেনঙ্ঘ স্টেশনে কেউ আসে অন্য কোথাও যেতে, কেউ আসে যে যাচ্ছে তাকে স্বাগত জানাতে এবং কেউ আসে যে চলে যাচ্ছে তাকে বিদায় দিতে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কাম্না, পূর্ণতা-রিক্ততা- সব উপাদানই মেলে এই স্টেশনে। কত মানুষ এই স্টেশন দিয়ে কতবার এসেছে, গেছে; তারা এক সময় জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, কিন্তু এই স্টেশন রয়েই গেছে। এ দেশের প্ল্যাটফর্মগুলোতে অনেক সময় ধরে যাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা পরিচিত কাউকে পেলে আলাপ করে, গল্প করে; নতুন পরিচয় হলেও গল্প করে। বিলেতে দেখেছিলাম ট্রেন থেকে শ’য়ে শ’য়ে মুখ বেরিয়ে আসছে, কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না, কথা বলছে না। তারা ছুটছে তো ছুটছেই। মুখে হাসি নেই, দুঃখও নেই। নির্লিপ্ত চেহারা।
তবে বিদেশি সিনেমায়, বিশেষ করে ইংরেজি সিনেমায় প্রায়ই দেখা যায় ঘটনা শেষ হয় রেল স্টেশনে এসে। কেউ কারও জন্য অপেক্ষা করছে, সেই স্টেশনেই। জেম্‌স বন্ড শত্রুদের কাছ থেকে পালাচ্ছে, স্টেশন দিয়েই, ট্রেনে চেপে। জেম্‌স বন্ড সিরিজের ‘ডাই অ্যানাদার ডে’তে দেখেছি কমান্ডার বন্ড ইংল্যান্ডের সংসদ ভবনের উল্টোদিকে ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজের নিচে নেমে ঢুকে যাচ্ছে এমআই-সিক্সের একটি গোপন আপিসে; সেটিও একটি পরিত্যক্ত রেল স্টেশন।
গত বছর জাপানের একটি স্টেশনের কথা খবরে পড়ে খুব ভালো লেগেছিল। হোক্কাইডো দ্বীপে কামি-শিরাতাকি ট্রেন স্টেশনটি যাত্রী না থাকায় বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল হোক্কাইডো রেলওয়ে কোম্পানি। কিন্তু যখন জানল, কানা হারাডা নামে এক ছাত্রী তার স্কুলে যায় এই স্টেশন থেকেই, তখন এই একজন যাত্রী নিয়েই ট্রেন ছেড়েছে এই স্টেশন থেকে। কানা হারাডার স্কুল ছিল ৫৬ কিলোমিটার দূরে। তিন বছর সে একাই একটি ট্রেনে যাতায়াত করেছে। এই ট্রেনটি শুধু তাকেই আনা-নেওয়া করত। সে স্কুল পাস করে গেলে কোম্পানি এই ছোট্ট ছিমছাম কাঠের তৈরি স্টেশনটি ২০১৬ সালে বন্ধ করে দিয়েছে। অদ্ভুত না?
দেশভেদে রেল স্টেশনের স্থাপত্যে ভিম্নতা আছে। দু’শ বছর আগে আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় স্টেশন ছিল কাঠের তৈরি। আমাদের উপমহাদেশের এই ভূখন্ডে রেল এনেছিল ঔপনিবেশিক ব্যবসায়ীরা। তারা তাদের মতো এক ধরনের স্থাপত্য আবিস্কার করেছিল, যা এখনও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ঢাকায় কমলাপুর স্টেশনই বোধহয় অন্যরকম করে তৈরি হয়েছিল। ছেলেবেলায় এই কমলাপুরকে কতই না বড় মনে হতোঙ্ঘ অনেক সাধারণ জ্ঞানের বইতে পড়েছি, এটি নাকি এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় স্টেশনঙ্ঘ ভুল ভাঙল যখন পশ্চিমবাংলা গিয়ে শুধু হাওড়া স্টেশন দেখলাম।
তবে স্থাপত্যের চেয়ে স্টেশনের মানুষ আরও বেশি নজর কাড়ে। ইংল্যান্ডের একটি গল্প বলি। কাজ করি ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কোম্পানিতে। ২০০৮ সাল। গেছি ট্রেনিংয়ে। থাকি লন্ডন থেকে ৫০ মাইল দূরে রেডিং নামে একটি শহরের এক মফস্বল- ক্যাভারশাম পার্কে। সপ্তাহান্তে আসি লন্ডনে ভায়ের বাড়ি। দু’দিন থেকে আবার চলে যাই রোববার সন্ধ্যায়। এক শুক্রবার সন্ধ্যায় লন্ডনের দিকে রওনা দিয়েছি। রেডিং স্টেশনে ঢোকার আগে একটি স্থানে ধূমপায়ীরা একটু-আধটু ধূমপান করে নেয়। আমিও দাঁড়িয়েছি। সিগারেট ধরিয়েছি কেবল। একজন ব্রিটিশ সাদা যুবক এসে বলল, ‘এক শলা সিগারেট দেবে আমায়?’
‘কেন? আমি তোমায় সিগারেট দেব কেন? তোমার নেই?’ আমি জানতে চাইলাম। বিরক্ত আমি। আমার দেশে আজ পর্যন্ত রাস্তায় কেউ এমন করে সিগারেট চায়নি।
সে উত্তর দিল, ‘না, আমার নেই; তুমি দাও।’
মজা পেলাম। মনে হলো, এই সাদা চামড়ার যুবকটিকে একটু জ্বালাই।
বললাম, ‘ছি, ছি, ছিঙ্ঘ তুমি না সাদা মানুষঙ্ঘ কত বছর দুনিয়া শাসন করেছঙ্ঘ এখন বলছ, তোমার কাছে এক শলা সিগারেট নেইঙ্ঘ একজন বাদামি মানুষের কাছে সিগারেট চাইছ, খারাপ লাগছে না?’
বেচারার মন খারাপ হয়ে গেল বুঝেই আমি বললাম, ‘আচ্ছা নাও; তোমাকে দু’শলা দিলাম।’
সে সিগারেটটা নিয়ে আগুন ধরিয়ে চলে গেল। মনে হয়েছিল, একজন সাদা চামড়ার মানুষকে এক হাত নিলামঙ্ঘ পরে অবশ্য মনে হয়েছিল, এমন ব্যবহার ঠিক হয়নি; যদি এক ঘা দিয়ে দিতঙ্ঘ গেছি তো ওর দেশে; মেরে বসলে কিছু করতে পারতাম? মার খেতে হতোঙ্ঘ
ওই দেশের স্টেশনগুলোর দিকে আমি তাকিয়ে থাকতাম। আমাদের স্টেশনগুলোর সব চার-দেয়াল দিয়ে তৈরি আয়তাকার সাধারণ ভবন। কিন্তু ওদেরগুলো আমার এক-একটি প্রকান্ড যন্ত্র মনে হয়েছে। রেডিং যেতাম প্যাডিংটন হয়ে। এই স্টেশনকে আমার লোহা-লক্কড়ের একটি দানবের মতো মনে হতো। রেডিং থেকে এসে যে প্ল্যাটফর্মে নামতাম, মাথার ওপর তাকালে শুধুই লোহা আর লোহা। বিলেতের অন্যান্য স্টেশনের মতো নয়। কেমন যেন গা ছমছম করতঙ্ঘ ভৌতিক চিন্তা আসত।
শুনেছি, ভৌত শরীরের মানুষ নাকি পৃথিবীর অনেক স্টেশনেই ঘুরে বেড়ায়। এমন কিছু রেল স্টেশন বিশ্বের অনেক দেশই পরিত্যক্ত করেছে। যাত্রীদের গোচরের বাইরে রেখেছে। আমাদের পাড়ার ছেলে জাদীদ আলম গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করতে। সিডনিতে। তার বোনও থাকত সেখানে। বোনের বাড়ি যেতে হলে ম্যাককোয়ারি ফিল্ডস স্টেশনে নামতে হতো। নেমে তারপর কয়েক মিনিটের পথ। এক রাতে জাদীদ ম্যাককোয়ারি ফিল্ডস স্টেশনে শেষ ট্রেনে এসে নেমেই একটি বাচ্চা মেয়ের কাম্নার আওয়াজ পেল। ২০১০ সালের কথা। প্রথমে কিছু মনে হয়নি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে সে যখন তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন শুনতে পেল বালির ওপর তার জুতোর শব্দ আর সেই শিশুর কাম্না।
বাকি সময় তার কেমন কেটেছে, ভেবে দেখুনঙ্ঘ
আমি নিজে রাত-বিরেতে ঘুরে বেড়িয়েছি অনেক। ১৯৮৪ সালে একবার কুষ্টিয়ার কোর্ট স্টেশনে রাজনৈতিক পোস্টার লাগাতে গিয়ে পুলিশ ধাওয়া দিয়েছিল। দৌড়ে পালিয়েছিলাম। কেবল ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়েছি। শরীরের পেশি টান-টান। পুলিশ আমার সাথে দৌড়ে পারবে কেনঙ্ঘ এ ঘটনার পর আমি যতবার কোনো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গেছি, ততবারই পুলিশের সেই ধাওয়ার কথা মনে হয়েছে। এখনও মনে হয়।
যে কোনো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের মানুষদের মুখ সবই অচেনা। সবাই ছুটছে নিজ-নিজ গন্তব্যে; বেশির ভাগই কারও দিকে তাকাচ্ছে না। নিজের বাক্স-পেটরা টানতে ও সন্তানদের দিকে খেয়াল রাখতেই ব্যস্ত। নিজের পেটরা অন্যের কাছে দেওয়ার কথা যেমন কেউ ভাবে না, তেমনই নিজের সন্তানকেও অন্যের কাছে রাখার কথা কেউ ভাবে না। কিন্তু এর ঠিক বিপরীত একটি ঘটনা ঘটেছিল আমার ছোট ভাই আশিকের জীবনে।
প্রায় ১২ বছর আগেকার কথা। সে তখন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা রওনা হয়েছে। অপেক্ষা করছে চট্টগ্রাম স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। এমনটি ঘটবে, সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। হঠাৎ একজন নারী তার দিকে এগিয়ে এসে তার নয়-দশ মাসের সন্তানকে তার কোলে দিয়ে বলল, ‘শোনো, আমার বাচ্চাকে নিয়ে তুমি ট্রেনে উঠবে; আর আমি ব্যাগগুলো নিয়ে উঠব।’
ঘটনার আকস্ট্মিকতায় আশিক হতবাকঙ্ঘ কী করে সম্ভবঙ্ঘ জানা নেই, শোনা নেই; একজন মা তার ছোট্ট সন্তানকে অবলীলায় তার কোলে দিয়ে বলল তার শিশু-সন্তানকে ধরে রাখতেঙ্ঘ সেই ছোট্ট শিশুকে ধরে রাখতে আশিকের তেমন অসুবিধে হয়নি; তার ঘাড়ে ছিল একটি মাত্র ব্যাগপ্যাক। ট্রেনে গিয়ে উঠে মা’টি তার পেটরা, ব্যাগ রাখার কুঠুরিতে উঠিয়ে তার সিটে এসে বসতেই, আশিক গিয়ে তার সন্তানকে মায়ের কোলে দিয়ে নিজের সিটে গিয়ে বসল। তার সাথে শিশুর মায়ের একটি কথাও হয়নি। এতকাল পরও আশিকের সেদিনের কথা মনে হয়। সে ভাবে, ওই মা তার কাছে নিজের সন্তানকে দেওয়ার সাহস কোথা থেকে পেয়েছিলঙ্ঘ সন্তানকে অন্য কারও কাছে গচ্ছিত রাখতে অন্য রকম আস্থার প্রয়োজন। একজন অপরিচিতের মাঝে সেই মা তেমন আস্থা কি আশিকের চেহারাতেই খুঁজে পেয়েছিল? নাকি কোনো চিন্তা না করেই তার কোলে শিশুটি গছিয়ে দিয়েছিল ট্রেনে ওঠা সহজ হবে জেনে? আশিক এখনও ভাবে।
তারপর সেই মায়ের সাথে আর কোনোদিন দেখা হয়নি আশিকের। সে তার কোনো ঠিকানাও রাখেনি। যদি রাখত, তাহলে অচেনা একজনের সাথে তার নতুন কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত। নাহ, কোনো ব্যাকরণ-বহির্ভূত সম্পর্কের কথা বলছি না। সাধারণ মানুষে-মানুষে যে জানা-পরিচয় হয়, তা-ই।
ট্রেন স্টেশন এমন অনেক সম্পর্কের সাক্ষী।
আমি দু’মাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিলাম। তখন থাকতাম নানাবাড়িতে। বাবা গিয়েছিল বিদেশে। আবারও সেই কোর্ট স্টেশন থেকে পোড়াদহ জংশন। যেদিন রাজশাহীর পথে রওনা দিলাম, মা আদর করে বিদায় দিল। মায়ের এমন ভাব যেন, তার ছেলে আর কোনোদিন হোস্টেলে থাকেনিঙ্ঘ পোড়াদহ থেকে রাজশাহীর ট্রেনে চড়েছি; সাথে কুষ্টিয়া শহরের অনেক ছেলে। বসার স্থানও পেয়েছি। ঈশ্বরদীতে ট্রেন থামতেই আমাদের কামরায় উঠলেন এক যুবতী। বসার স্থান নেই। দাঁড়িয়েই রইলেন। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার মনে হলো, তাকে বসতে দেওয়া উচিত। প্রায় জোর করেই তাকে আমি আমার সিটে বসিয়ে দিলাম। তিনি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ধন্যবাদ দিলেন।
ট্রেন চলছে তো চলছেই। লোকাল। প্রতি স্টেশনেই থামছে। রওনা হয়েছিলাম দুপুরে; ধীরে ধীরে গিয়ে পৌঁছুলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে; রাতে। পথে কোনো কথা হয়নি। বিনোদপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে নেমে দাঁড়াতেই যুবতী আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘তুমি কোন হলে যাবে? থাকার জায়গা ঠিক করে এসেছ?’ তার বলার ভঙ্গি বলে দিল, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়েন এবং আমার চাইতে বড়। আমি উত্তর দিলাম, ‘জি আপা, আমার খালাতো ভাই থাকে সোহরাওয়ার্দী হলে; সেখানেই যাব।’ তিনি রিকশা নিয়ে মিলিয়ে গেলেন তার হলের দিকে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তখন স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। পুলিশের সাথে যুদ্ধ বেধেই থাকত। পুলিশ হল রেইড করতে এলেই ছাত্রদের আশ্রয় হতো এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন। পুলিশ স্টেশনে হানা দিলে ছাত্ররা মিলিয়ে যেত বিনোদপুরের গ্রামবাসীর মধ্যে। স্টেশনের এপারে পুলিশ, ওপারে ছাত্র-জনতার অবস্থান। স্টেশনটি এমন কত ঘটনার নীরব সাক্ষীঙ্ঘ আপার সাথে ক্যাম্পাসে প্রায়ই দেখা হতো; এক সাথে চা খেতাম; বড্ড বেশি উপদেশ দিতেন; তাই আপার সাথে তেমন কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
এই স্টেশনেই ‘উদ্‌ভ্রান্ত’ একজন মানুষ বাস করত; সবাই তাকে মাসু পাগলা বলে ডাকত। অনেকে বলত, এই মাসু অনেক বছর আগে তারই এক সহপাঠীকে ভালোবেসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক ছুটি শেষে ভালোবাসার মানুষটিকে ট্রেন থেকে নামাতে সে স্টেশনে গিয়েছিল। সে মানুষটি সেদিন আসেনি, পরদিনও আসেনি; কোনোদিনই আসেনি। সেই থেকেই মাসু পাগলা রয়ে গেছে এই প্ল্যাটফর্মে। তার পর কত লাখো ছাত্র-ছাত্রী এসেছে-গেছে এই স্টেশন দিয়েঙ্ঘ এই মানুষটি রয়েই গেছে।
আজ এতদিন পরও, যখনই কোনো রেল স্টেশনে যাই, চারদিকে তাকিয়ে এমন মাসু পাগলাদের খুঁজি। পেয়েও যাই কোথাও কোথাও। মনে হয়, ওদের কাছে গিয়ে কথা বলি; জানতে ইচ্ছে করে ওদের গল্পগুলো। কিন্তু নিজেকে বিরত করি। কী দরকার অনেক বছরের শান্ত সমুদ্রে ঝড় তুলেঙ্ঘ আমি তো স্টেশন থেকে চলে যাব; ওরা রয়ে যাবে।
থাকুক ওরা ওদের মতো !

৫,৮৬৫ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “কেউ কেউ রয়ে যায়”

  1. জিহাদ (৯৯-০৫)

    এরকম একটা কর্পোরেট চেয়ারে বসেও এসব ভাবার জন্য মনটা সযত্নে আগলে রেখেছেন দেখে অনেক ভালো লাগে, ইকরাম ভাই। কখনো বলা হয়নি এ ভালোলাগার কথা। আলসেমিতে ভবিষ্যতেও হয়তো আর বলা হবেনা। 😀 ভালো থাকবেন।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ইকরাম কবীর (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।