আমার বন্ধুদের ভাইবারে একটি গ্রুপ আছে। চব্বিশ ঘণ্টা আড্ডা চলে সেখানে। রাতে ঘুমানোর সময় নোটিফিকেশন বন্ধ করে করে রাখতে হয়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বন্ধুরা। দেশে আমরা যখন ঘুমাচ্ছি, আমেরিকা-কানাডার বন্ধুরা তখন অফিসে যাচ্ছে; অথবা কেবল ঘুম থেকে উঠেছে। বেশিরভাগই ঠাট্টা-মশকরা ও কৌতুক লিখে পাঠায় সবাই। অনেক গুরুগম্ভীর জ্ঞানের আলোচনাও চলে হরদম। অনেকে আবার সে নিজে কত জানে তাও জাহির করতে চায়।
মাঝে-মাঝেই কেউ-কেউ ধর্ম নিয়ে কথা বলে বসে। অনেকেই ধর্মের প্রসঙ্গ এলেই ধর্মকে আক্রমণ করে ফেলে। আর যারা ধর্মে বিশ্বাস রেখে জীবনের পথ চলছে, তারা ক্ষেপে যায়, রাগ করে। দুই মতের মধ্যে ঝগড়া হয়, এক সময় কেউ একজন বলে- ধর্ম নিয়ে এই গ্রুপে আলোচনা না করতে। তারপর অনেকদিন আর ধর্ম নিয়ে কোনও আলোচনা হয় না।
গল্পটি বলার একটি কারণ আছে। ধর্ম নিয়ে আমরা যতবারই কথা বলেছি, ততবারই কেউ না কেউ তর্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। তারপর মনে হয় আমরা যেন আলোচনা থেকে পালিয়ে বাঁচি। ধর্ম এবং ধর্মহীনতা নিয়ে কেউ অন্যের ধারণা বা বিশ্বাস মেনে নিতে চায় না। সবাই মনে করে সে ধর্ম এবং ধর্মহীনতা সম্পর্কে যা জানে, সেটাই শেষ কথা। তার জানার বাইরে আর কোনও জ্ঞান বা কথা থাকতে পারে না। একটি মানুষ ধর্মকে কেন বেছে নিয়েছে তা না শুনেই তাকে আক্রমণ করা হয়। মনে হয় ধর্মবিরোধীরা ধর্মবানকে নানা উদাহরণ দিয়ে ধর্মচ্যুত করতে চায়।
কখনোই একজন আরেকজনের কথা মুক্তমন নিয়ে শোনে না। দু’জনেই কিন্তু নিজ-নিজ চিন্তায় নিজের মুক্তি খোঁজে। কিন্তু নিজের চিন্তাকে আরেকজনের কাছে পেশ করতে পারে না। দু’জনেই অন্ধ। একজন ধর্ম বিষয়ে। আর একজন ধর্মহীনতায়। দু’জনেই নিজ-নিজ জ্ঞানে মুক্ত চিন্তা করছে। কিন্তু দু’জনের চিন্তাই বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। একজন তার নিজের চিন্তা আরেকজনের কাছে মুক্ত করতে পারছে না। তার নিজের চিন্তার মুক্তির দেখা মিলছে না।
আমার আজকের প্রসঙ্গ এই মুক্তচিন্তা নিয়েই। সে কারণেই আমার বন্ধুদের গল্প বললাম। প্রসঙ্গটি নিজেই চিন্তার বিষয়। এটা কি মুক্তচিন্তা নাকি চিন্তার মুক্তি। মুক্তচিন্তার অর্থ দাঁড়াতে পারে এমন – আমি যে বিষয়েই চিন্তা করছি, তা অবারিত ভাবে করছি, কেউ সে চিন্তা বাধা দিচ্ছে না। আর চিন্তার মুক্তি হচ্ছে, আমি কোনও চিন্তায় আটকে আছি, সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না, কেউ আমায় সমাধান পেতে সাহায্য করলো অথবা আমি নিজেই সে সমাধান পেয়ে গেলাম।
তাই কি? আমার চিন্তাই কি শেষ কথা? আমিই কি শেষ বক্তা? আমিই কি শেষ তথ্যদানকারী? আমিই কি শেষ তত্ত্ববাদী? আমার পর আর কেউ কোনও কথা বলবে না? আমার ব্যাখ্যার পর আর কেউ বিশ্লেষণ দিতে পারবে না? আর কেউ নতুন কোনও তত্ত্ব দিতে পারবে না?
আমার নিজের চিন্তা আমার মনের ভেতর অবশ্যই মুক্ত; আকাশের মতো মুক্ত; আমি যা ইচ্ছে চিন্তা করতে পারি; যেখানে খুশী যেতে পারি; যা খুশী বিশ্বাস করতে পারি; যা খুশী অবিশ্বাস করতে পারি; যাকে খুশী ভালোবাসতে পারি; যাকে ইচ্ছে ছুঁতে পারি; বিশ্বের যে প্রান্তেই যেতে চাই, যেতে পারি; যে কাউকেই খারাপ ভাবতে পারি, আবার ভালোও মনে করতে পারি। কিন্তু এসব চিন্তার প্রকাশ কি করতে পারি? চিন্তা প্রকাশ না করা গেলে তাকে কি মুক্তচিন্তা বলা যায়? আমার চিন্তা কি মুক্তি পায়?
হ্যাঁ, প্রশ্ন আসতে পারে, মুক্তচিন্তার প্রয়োজন কী? মানব সভ্যতা এগিয়ে নিতে যতটুকু চিন্তার প্রয়োজন তা তো প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শেখানই হচ্ছে! স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অফিস-আদালতে। আর চিন্তার প্রয়োজন কী? সেটিও একটি চিন্তার বিষয়।
ধর্মের প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। ধরুন আমরা বিশ্বাস করি যে বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা। আমরা প্রায় সবাই তা মানি। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমার চিন্তা তো সৃষ্টিকর্তাকে ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর যেতে পারে। সেই চিন্তা কি আমরা করবো? আমরা ফেরেশতাদের কথা জানি, কিন্তু তাদের কখনও দেখিনি। যতটুকু ধর্মগ্রন্থে পড়েছি, ততটুকুই জানি। আমরা কি আমাদের কল্পনা কাজে লাগিয়ে তাদের নিয়ে ভাবতে পারি? আমরা তা করি না। সবসময় এসব বিষয়ে চিন্তার একটি ব্যাকরণ মেনে চলি।
ব্যাকরণটি আসলে কী? দেখতে পাই, ধর্মবিরোধী চিন্তা করলেই তাকে মুক্তচিন্তা বলা হয়। সেটিই কি ব্যাকরণ? আবার, কেউ ধর্মের বাইরে চিন্তা করলে তাকে পাপী বলা হয়। সেটিই ব্যাকরণ?
তেমন যুৎসই উত্তর নেই। ঠিক আছে। ধর্মের কথা আর নাই বলি। অন্য প্রসঙ্গে কিছু বলি।
আমার এক বন্ধু। খুব ভালো লেখক। কিন্তু তাকে নিয়ে সবাই আড়ালে-আবডালে সমালোচনা করে, কথা বলে। কারণ যেসব বিষয়ে সচরাচর কেউ কথা বলে না বা বলতে চায় না সেসব তার লেখার বিষয়বস্তু। সে যৌনতা ও যৌন শিক্ষা নিয়ে লেখে, পরকীয়া প্রেম নিয়ে লেখে। খুব বেশি সংখ্যক মানুষ আমি দেখিনি যারা তার লেখা পড়ে তাকে সবার সামনে প্রশংসা করেছে। অবশ্য তার লেখা পড়ে অনেকে উপকার পেয়েছেন, তবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন গোপনে। যৌনতা ও পরকীয়া আমাদের সমাজে চিন্তার জন্য বা কথা বলার জন্য স্বীকৃত বিষয় নয়। যৌনতার স্বল্প জ্ঞান নিয়ে যৌনকর্ম করতে গিয়ে অতৃপ্তিতে হতাশ হতে পারি, তারপরও তা নিয়ে চিন্তা বা আলোচনা করতে সাহস করবো না। তবে হাস্য-পরিহাস করতে পারি। আমরা যার সঙ্গে মিলনে ইচ্ছুক বা মিলনে আবদ্ধ হই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার সঙ্গেও আমাদের নিজেদের যৌনচিন্তা নিয়ে কথা বলি না।
তাহলে যৌনতা বিষয় হয়ে এলেই কি আমাদের চিন্তা বাধা পায়? আটকে যায়? ২০১৭ সালের চিন্তা আর দু’হাজার পঞ্চাশ সালের চিন্তার ভেতর কি কোনও পার্থক্য আছে? হয়তো। হয়তো না। আমার মনে হয় আমার এই বন্ধুর লেখাগুলো একসময়, আরো কুড়ি বছর পর বেশ সমাদৃত হবে। ভবিষ্যতের সমাজ তাকে ভালো লেখক হিসেবে, ভালো চিন্তাবিদ হিসেবে, ভালো শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। কেন? কারণ আমি মনে করি আমাদের প্রচলিত চিন্তাকে পেছনে ফেলে, তার বাইরে গিয়ে সে চিন্তা করেছে, যার মূল্যায়ন আমাদের ‘প্রচলিত’ মস্তিস্কে করতে পারছি না। আমাদের এক-বংশ পরেই তা হয় তো করা সম্ভব হবে। এটিই কি মুক্তচিন্তা? না কি চিন্তার মুক্তি?
উত্তর পাচ্ছি না। আপনারা পাচ্ছেন?
আরেকটি উদাহরণ দেই। দিনা ফেরদৌস নামে একজন লেখক লিখলেন যে নারীদের জন্যেও যৌনপল্লী প্রয়োজন কারণ নারীরও কামের প্রয়োজন আছে। চিন্তাটি যথার্থ। এযাবৎ কালে নারীর যে কামচিন্তা থাকতে পারে তা আমাদের সমাজ স্বীকৃতি দেয়নি। শুধু ছেলেদেরই কামঘরে যেতে হবে নারীদের নয় – এচিন্তা একটি প্রচলিত চিন্তা যার প্রকাশ আছে। কিন্তু নারীরও যে কামের প্রয়োজন আছে তা আমাদের সমাজে প্রকাশিত চিন্তা নয়। তবে প্রতিটি চিন্তাশীল নারীই কোনও না কোনও সময় এ চিন্তাটি করেছেন কিন্তু প্রকাশ করতে পারেননি। কারণ তাদের সে স্বাধীনতা নেই। এই লেখক এই চিন্তাটি করে তা প্রকাশও করেছেন।
খুব খারাপ লেগেছে কি? লাগতে পারে। আমরা এমনটি শুনতে অভ্যস্থ নই। আমার কাছে একটি স্বাভাবিক যুক্তি-যুক্ত চিন্তা মনে হয়েছে।
তাহলে কি এই লেখকের চিন্তাটিকে আমরা মুক্তচিন্তা বলতে পারি? যদি পারি, তাহলে কি তিনি বা দেশের সকল নারী তাদের এমন চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারছেন? পারুক বা না পারুক, সমাজ কি তাদের এই চিন্তাকে মুক্ত মনে মেনে নিতে পারছে?
প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
অনেকে হয় তো বলবেন, স্বাধীনতা যেমন পুরোপুরি স্বাধীন নয়, তেমন চিন্তার প্রকাশও পুরোপুরি স্বাধীন নয়। মনে মনে অনেক চিন্তাই করা যায়, কিন্তু তা কতটুকু প্রকাশ করা যায় সে প্রশ্নের উত্তর বোধহয় পৃথিবীর কারো কাছে নেই; থাকলেও একেক জনের ব্যাখ্যা হবে একেক রকম।
আচ্ছা, তাহলে সব চিন্তা প্রকাশ নাইবা করলাম। তবে আড্ডা-আলোচনায় আমরা যখন বসি এবং নিজ-নিজ চিন্তার প্রকাশ করি, তখন তো অন্তত একে অপরের চিন্তাগুলো মুক্তমন নিয়ে শুনতে পারি। নাকি ‘আমার চিন্তাই সঠিক’ এমন ভাবনাই প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাবো?
http://www.banglatribune.com/columns/opinion/245325/%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AE%E0%A6%A8
আপন অনুভূতিকে স্বচ্ছ্ব সরোবরে নাইতে দেবার উদার মনটুকু ধারণ করা তো দরকার আগে। সাথে থাকা দরকার পরমতসহিষ্ণুতা। এ দুটো না থাকলে মুক্তচিন্তা মুক্ত যতোটা না হবে বেপরোয়া হবে ততোধিক।