না ভারত; না পাকিস্তান

আমরা বাঙালিরা ক্রিকেটের জন্য পাগল। আর আমাদের সেই পাগলামির মাত্রা আরও বেড়ে যায় যখন আমাদের ছেলেরা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে খেলতে নামে। আমাদের আবেগ তখন সব ধরনের যৌক্তিকতার সীমানা পেরিয়ে যায়। আমরা চাই প্রতিটি খেলাতেই যেন আমাদের ছেলে-মেয়েরা জিতে যায়। মাঝে-মাঝে মনে হয়, বোধহয় খেলা নয়, আমরা আমাদের দেশ বাংলাদেশের জন্য আবেগ প্রকাশ করি; খেলার সঙ্গে দেশাত্মবোধকে এক করে দিই। আমার দেশ জিতবেই; বাঙালি সবসময়ই জিতবে।
কিন্তু খেলায় সব সময় কী তাই হয়, হওয়া সম্ভব? খেলায় হার-জিত থাকবেই। কখনো আমরা জিতব, কখনো হারব। আমি নিজে ছোটবেলায় খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম; সবসময় জিততেই চাইতাম। কিন্তু তাই বলে কি সবসময় জেতা যায়? কখনো জিততাম, কখনো হেরে যেতাম। স্বীকার করি, আমাদের নারী-ক্রিকেটারদের খেলা আমরা কম দেখি এবং ভেতরে ভেতরে তেমন একটা আশাও করি না যে, তারা কারো সঙ্গে খেলে জিতবে। শত সীমাবদ্ধতায় তারা যে কেবল জাগছে! কিন্তু আমাদের ছেলেরা ভালো খেলবে এবং জিতবে- সারাক্ষণ তাই’ই আশা করি। ছেলেরা যখন জিতে যায়, আমরা বলি, ‘সাবাশ ব্যাটা, তুই’তো আমাদের ছেলে’। যখন জেতে না, কষ্ট পাই, মন খারাপ হয়। তারপরও বলি, ‘ভালো খেলেছিস, এর পরের খেলায় জিতব’। যখন ওরা কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালের কাছাকাছি যায়, আমরা চাই ওরা চ্যাম্পিয়ন হোক।
কিন্তু হয়তো পারে না। তারপরও বলি, ‘হবে, হবে; খেলে যা; জেতার জন্য খেলে যা’।
প্রায়ই ওরা জিততে পারে না; ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারে না। আমরা বাঙালিরা তখন আমাদের ছেলেদের ক্ষমা করে দিয়ে আমাদের পছন্দমতো কোনো একটি দেশের ক্রিকেট দলের জন্য শুভকামনা করতে লেগে যাই। এইতো ক’দিন আগেই ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যেমনটি হলো। আমরা সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে গেলাম আর ওদিকে ইংল্যান্ড চলে গেলো। ফলে ফাইনাল হলো ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে। এই ফাইনাল খেলাটি অনেকরকম গল্প দিয়ে গেছে, অনেক চিন্তার খোরাক দিয়ে গেছে। অন্য দু’দল যখন খেলে, আমরা নিজের পছন্দমত পক্ষ নেই। যে দলকে আমাদের ভালো লাগে, তাদের পক্ষ নিই এবং নিজের সমর্থন প্রকাশও করি।
আমার নিজের কথা বলি। আমাদের ছেলেরা যখন হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়, আমি তখন শ্রীলংকা দলের পক্ষ নিই। তাদের পক্ষ নেওয়ার ব্যাপারে আমার মাথায় যা কাজ করে তা হচ্ছে শ্রীলংকার মানুষদের আমার খুব ভালো লাগে; দেশটিও ভালো লাগে। তাই আমি চাই শ্রীলংকা যেন চ্যাম্পিয়ন হয়। শ্রীলংকাও যদি হেরে বেরিয়ে যায়, আমি তখন চাই ওয়েষ্ট ইন্ডিজ জিতে যাক। আবার যখন অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের খেলা চলে, আমি অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ নিই। কিন্তু আবার ইংল্যান্ড যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলছে, আমি ইংল্যান্ডকেই আমার দল মনে করি।
বেশিরভাগ বাঙালি আমার মতো করেই ভাবেন। অন্ততঃ আমি তাই মনে করি।
কিন্তু যখন ভারত-পাকিস্তান খেলা হয়, বাংলাদেশের বাঙালিরা একেবারে দু’ভাগ হয়ে যায়। অর্ধেক ভারত, অর্ধেক পাকিস্তান। এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে পাকিস্তান দেশটিকে পছন্দ করেন না এমন মানুষের সংখ্যা কোটি-কোটি। এরাই খুব অবাক হয়ে দেখেন এদেশের অর্ধেক মানুষ সেই পাকিস্তান দলকেই খেলায় সমর্থন করছেন। এই মনোভাব তৈরিই হয়েছে ১৯৭১ সালের পর থেকে। পাকিস্তান রাষ্ট্র আমাদের দেশে যে হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তারপর থেকে সে রাষ্ট্রের প্রতি একধরনের সামগ্রিক অশ্রদ্ধা জমে আছে সবার মনে। অনেকে মনে করেন, যারা খেলায় পাকিস্তান দলকে সমর্থন করে তারা সবাই তরুণ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তারা দেখেননি বা সে সম্পর্কে ভালো করে জানেন না। তাই তারা পাকিস্তান দলকে সমর্থন করার মতো আগ্রহ দেখাতে পারেন। এ ভাবনাটি আমার কাছে খুব হাস্যকর মনে হয়। পাকিস্তান দলকে সমর্থন করার অর্থ যদি পাকিস্তান রাষ্ট্রকে পছন্দ করা হয়, তাহলে এ চিন্তায় ত্রুটি আছে। পাকিস্তান দলকে পছন্দ করলেই তারা স্বাধীনতাবিরোধী এমনটি ভাবাও খুবই অন্যায় হবে।
আমার জীবনে আমি অনেকগুলো বছর পাকিস্তানে তৈরি কোনো পণ্য ব্যবহার করতাম না, ছুঁয়েও দেখতাম না। পাকিস্তানি মানুষের সঙ্গেও মিশতাম না। কারণ, আমিও এই তরুণদের মতোই বিশ্বাস করতাম যে, পাকিস্তান মানেই ‘খারাপ’। ধীরে-ধীরে আমি পাকিস্তান রাষ্ট্র, পাকিস্তানের মানুষ ও পাকিস্তানের খেলা- এগুলোকে বুঝতে শুরু করেছি এবং পাকিস্তানি মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছে। মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার অর্থ এই নয় যে, আমি পাকিস্তান রাষ্ট্রকে পছন্দ করা শুরু করেছি। মাঝে-মাঝে পাকিস্তান দলের খেলা পছন্দ করি- এর অর্থ এই নয় যে, আমি পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তারা ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত ক্ষমা করা নিয়ে ভাবিই বা কি করে!
আমার এক খুব কাছের বন্ধু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল খেলার দিন সকালে তার ফেসবুকে লিখল, ‘আমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যারাই খেলে, তাদেরকেই সমর্থন করি’। হতেই পারে। সে তার মতো করে ভাবে এবং তেমন করেই তার চিন্তা প্রকাশ করে। তবে এই বাক্যটি কি লেখার তেমন প্রয়োজন ছিল? সে তো তার মতো করে সমর্থন করলেই পারতো! অথবা সরাসরি লিখতে পারতো, ‘আমি আজ ভারত দলকে সমর্থন করছি’। তা না লিখে সে বললো পাকিস্তান দলকে সমর্থন না করার কথা। খেলা হচ্ছে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে! তার লেখায় এক ধরনের খোঁচাও ছিল; এবং সে জানে যে বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ পাকিস্তান দলকে সমর্থন করবে- যা তার পছন্দ নয়। এই অর্ধেক সমর্থনকারীদের প্রতিই ছিল তার খোঁচাটি।
আমার এই বন্ধুর মতো করে আমরা অনেকেই ভাবি। আমরা যদি ভেবেই নিই যে, এই অর্ধেক মানুষ যারা চায় পাকিস্তান দল ভারতের বিরুদ্ধে জিতে যাক, তারা সবাই পাকিস্তান রাষ্ট্রকে পছন্দ করে এমনটি ভাবা বোধহয় ঠিক হবে না। বাংলাদেশে এমন কোটি-কোটি মানুষ আছেন যারা পাকিস্তান রাষ্ট্র্রকে ঘৃণা করেন কিন্তু পাকিস্তান ক্রিকেট দলের খেলা পছন্দ করেন। এদের কাছে খেলা এবং দেশনীতি এক নয়। তারা শুধুই তাদের খেলা ভালবাসেন। আবার এমনও অনেকে আছেন যারা ভারত রাষ্ট্রকে পছন্দ করেন না। এ চিন্তার সঙ্গে তারা ভারতীয় দলকেও জুড়ে নেন। ভারতের বিরুদ্ধে যে দলই খেলুক, তারা তাদেরকেই সমর্থন করেন।
আমরা যারা মনে করি যে, ভারতের বিরোধিতা করলেই পাকিস্তানকে সমর্থন করা হয়, তারা কি স্বাভাবিক চিন্তা করছি? ভারতীয় দলকে সমর্থন না করলেই যদি পাকিস্তান দলকে সমর্থন করা বোঝায়, তাহলে সম্ভবত আমরা ভুল ভাবছি। আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের মধ্যে কোটি মানুষ আছেন যারা এই দু’দেশকেই রাষ্ট্র হিসেবে পছন্দ করেন না। তারা যেমন ভারতকে অপছন্দ করেন, তেমনই পাকিস্তানকে ঘৃণা করেন। এই দুপক্ষেরই আছে নিজস্ব যুক্তি।
শুধুই রাজনৈতিক দৃষ্টিতে খেলাকে দেখেন এমন মানুষও অনেক। তাদেরও চিন্তায়ও যুক্তি আছে। যে রাষ্ট্র এমন নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে সে রাষ্ট্রের দলকেই বা কী করে পছন্দ করেন! আবার, ভারত আমাদের স্বাধীনতার সময় সাহায্য করেছে, তা সবাই মানে, স্বীকারও করে। কিন্তু ভারত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এবং এখনো কী করে বাংলাদেশ-বিরোধী অবস্থান নিয়ে রয়েছে, তাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, বাংলাদেশের প্রতি এই রাষ্ট্রের ব্যবহার, আমাদের প্রতি সা¤্রাজ্যবাদী মনোভাব, আমাদের জন্য তাদের বিদেশনীতি- এসব আমাদের দেশের মানুষের একটি বড় অংশকে ভারতবিরোধী করে তুলেছে এবং বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আবার, ভারতীয় দলকে পছন্দ না করার বোধহয় আরেকটি কারণও আছে। ভারতের কয়েকজন ক্রীড়াভাষ্যকার ও খেলোয়াড় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ দল নিয়ে যা বলেন তা বোধহয় আমাদের পছন্দ হয় না। বোধহয় বলছি কেন? একেবারেই পছন্দ হয় না। ভারতীয় দলের কয়েকজন খেলোয়াড়ের শারীরিক ভাষা দম্ভে ভরা। তাই বাংলাদেশিরা তাদের সমর্থন করতে পারেন না বলেই আমার মনে হয়। এদেশে প্রায় কোটি মানুষ আছেন; যারা ভারতের বিপক্ষে যারাই খেলে তাদেরই সমর্থন করেন।
এতক্ষণ যা বললাম সেটাই হচ্ছে এদেশের ক্রিকেট-পাগলদের বাস্তবচিত্র।
আমরা আসলে আবেগান্বিত হয়ে পড়ি আমাদের নিজেদের দল নিয়ে, নিজের দেশ নিয়ে। এবং সেটাই সবচেয়ে সত্যি! ক্রিকেটের জন্য ভালোবাসা অন্য যে কোনো খেলার প্রতি আমাদের ভালোবাসাকে হারিয়ে দিয়েছে। এই ক্রিকেটই হচ্ছে একমাত্র উপাদান, যা আমাদের দল-মত নির্বিশেষে এক সুতোয় বাঁধতে পারে। ভারত-পাকিস্তান খেলায় আমরা যে দলকেই সমর্থন করি না কেন, তা আসলে ধর্তব্যে আসে না। আমাদের আসল দেশপ্রেম প্রকাশ পায় যখন আমরা আমাদের দলের জন্য বুক চাপড়াই।
আমার আরেক বন্ধু মজা করে ফেসবুকে লিখেছিল, ‘ভারত-পাকিস্তান খেলা নিয়ে যারা বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক মনস্তত্ব খুঁজে পান, তাদেরই আসলে মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন!’

না ভারত; না পাকিস্তান

৫,২৫৫ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।