‘বাতাস’ বিক্রির কথা

অনেক মানুষকে প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে মোবাইল কোম্পানীগুলো ‘বাতাস’ বিক্রি করে দেশের সব অর্থ বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। যেমন অবলীলায় একথাটি বলে ফেলা যায়, এই ‘বাতাস’ কি করে তৈরী হয় তা বুঝে কথাটি বলা বা ভাবা তেমনই যটিল।
একজন সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য এমনটা ভেবে নেয়া খুবই স্বাভাবিক। আমরা যখন এক বোতল পানি কিনি অথবা এক বোতল টমেটো কেচাপ কিনি – তখন কিন্তু একটুও ভাবি না যে “আরে পানি’তো আমাদের দেশে হাটে-মাঠে-ঘাটেই পাওয়া যায়! এর আবার দোকান থেকে বোতল কিনতে হবে কেন?” আমরা এও ভাবি না যে “এক কিলগ্রাম টমেটো কিনে এনে মসলা মাখিয়ে চুলোর ওপর জ্বাল দিলেই’তো কেচাপ তৈরী হয়ে যাবে!” তার কারণ আমার মনে হয় পানি এবং কেচাপ বোতলে করে কিনে পান করা এবং বিভিন্ন খাবারের সাথে খাওয়া আমাদের জীবনযাত্রায় এমন ভাবে মিশে গেছে যে এগুলোর অনুপস্থিতি আমাদের পীড়া দেয়। আবার এক বোতল পানি এবং কেচাপ যখন কিনে হাতে নিয়ে ধরতে পারি, তখন আমার সাথে এই বোতলগুলোর একটি শারীরিক যোগাযোগ তৈরী হয় এবং অবচেতন মনেই বুঝতে পারি যে আমি পানি নামের একটি সম্পদের মালিক।
অন্যদিকে যে ‘বাতাস’ আমরা মোবাইল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে আমরা পাই তা আমরা হাতে ধরতে পারি না বিধায় আমরা বুঝি না যে এই ‘বাতাস’ কিনে কেমন সম্পদের মালিক হলাম। মোবাইল হ্যান্ডসেট নামে যে যন্ত্রটির মাধ্যমে এই ‘বাতাস’ আমাদের কাছে পৌঁছে তা হাতে ধরে নিজের মনে করতে পারি বলেই হয়তো এই যন্ত্রটিকেই বেশি আপন মনে হয়।
এ’কথাগুলো বলছি তার কারণ, আমার মনে হয়, হয় এই ‘বাতাস’ ব্যবহারকারীরা কি ব্যবহার করছেন তা নিয়ে তেমনটা ভাবেন নি অথবা মোবাইল কোম্পানিগুলোই তাদের ব্যবসার পুরো প্রক্রিয়াটি কাউকে বোঝাতে পারেন নি। আমরা অন্যান্য ব্যবসা যেমন ব্যাংকিং, খাবার, সিমেন্ট, তৈজশপত্র ইত্যাদি যেমন বুঝি, এই ‘বাতাস’ ব্যবসা বোধহয় তেমন বুঝি না। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে, সারা দেশে হাজার-হাজার টাওয়ার বসিয়ে, হাজার-হাজার মানুষের চব্বিশ-ঘন্টা বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমের মাধ্যমে, প্রতি এক’শো টাকায় সরকারকে সাতচল্লিশ টাকা দিয়ে যে ‘বাতাস’ মোবাইল হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার যে যজ্ঞ এই কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছে তার চিন্তা বোধহয় এই ‘বাতাসের’ মাধ্যমে কথা বলা বা ইন্টারনেট ব্যবহার করা শেষ হয়ে গেলেই আমাদের মাথা থেকে উবে যায়।
বিদেশে টাকা পাঠিয়ে দেয়? বিদেশী বা মাল্টিন্যাশনাল কোন কোম্পানি দেয় না? ব্যাংক, বীমা, সিমেন্ট, টুথপেইষ্ট, শিশু-খাবার –- সব মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিই এদেশে বিনিয়োগ করে ব্যবসা করে মুনাফা লাভের আশায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছেঃ মোবাইল কোম্পানিগুলো কি ব্যবসা করে মুনাফা করতে পারছে? একটি ছাড়া আর কেউই পারছে না। তাহলে টাকা পাঠাবে কোথা থেকে? এ’প্রশ্নটি সবার কাছে রইলো ভেবে দেখার জন্য।
তবে আমি আজ এই কোম্পানিগুলোর সাফাই গাইতে বসিনি। মোবাইল কোম্পানিগুলো বহু পথ পাড়ি দেয়ার পর তাদের ব্যবসা ভবিষ্যতে কোন দিকে যেতে পারে তার সামান্য একটু ধারনা দিতে চাই। একই সাথে আমি বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ দিতে চাই যে তারা যদি ১৯৯৬ সালে সারা বিশ্বে কি হচ্ছে তা লক্ষ্য করে এই খাতের দুয়ার খুলে না দিতেন তাহলে বোধহয় এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে সারা দেশে মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলার সুযোগ হয়তো এই কোম্পানিগুলো পেত না।
হ্যা, একেবারে প্রথম দিকে হয়তো মোবাইলে কথা বলা সবার জন্য সহজলভ্য ছিল না। তবে আমাদের সরকার ও এই কোম্পানিগুলোর চেষ্টায় এখন যে কোন শ্রেনীর মানুষের পক্ষে মোবাইল ব্যবহার করা সম্ভব। এ’অঞ্চলে আমাদের দেশেই এই ‘বাতাস’ ব্যবহারের মূল্য সবচেয়ে কম। তবে এই ‘বাতাস’ সরকারের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে চড়া মূল্যে যা অন্যান্য দেশে অনেক কম।
আমরা কি মোবাইলে শুধুই কথা বলেছি? ইন্টারনেট ব্যবহার করেছি? এই প্রযুক্তি আমাদের ব্যবসায় ব্যবহার করেছি, আইন-শৃংখলা ঠিক রাখতে ব্যবহার করেছি, বৈদ্যুতিক ও অন্যান্য বিল পরিষোধ করতে ব্যবহার করেছি, অর্থ আদান-প্রদান করতে ব্যবহার করেছি। একটা সময় ছিল আমরা মোবাইল ফোনে শুধুই কথা বলতাম। তারপর মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট এল। ফোন ব্যবহার করেই আমরা পত্র-পত্রিকা-পুস্তক পড়া থেকে শুরু করে শেয়ার বাজারের খোঁজ-খবর রাখতে শুরু করলাম। এখন এই ইন্টারনেট ব্যবহার করেই মোবাইল ফোন সেটে চলছে পড়াশোনা, টেলিভিশন দেখা, বাস-ট্রেনের টিকিট কাটা, সিনেমা দেখা এবং আরো অনেক কিছু।
ইন্টারনেটের এই ব্যবহার আরো বাড়বে এবং আমাদের জীবনযাত্রা এর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যাবে। সময়’টা আসছে। আমি বলবো, সময়টা চলেই এসেছে। বিশ্বের দেশে-দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই প্রযুক্তি; বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন ও জীবনযাত্রা।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন অর্থ লেনদেনে, কেনাকাটায়, একে অপরের সাথে যোগাযোগে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। কিন্তু যে সময়টার কথা বলছি তা হল ‘ইন্টারনেট অব থিংস্’। ভাবছেন ‘থিংস্’ আবার কি?! থিংস্ হচ্ছে ‘জিনিস’! আপনার প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিস। লাইট-ফ্যানের সুইচ্, টেলিভিশন, ফ্রীজ, গাড়ির টায়ার, আপনার গাড়িটাই, আপনার রিক্সা, চায়ের কাপ, পায়েসের বাটি – এমন অনেক কিছু।
ভাবুন’তো একবার; আপনি আপনার আপিসের টেবিলে বসে আপনার বাড়ির সবকিছু নিয়ন্ত্রন করছেন। দিনশেষে বাড়িতে আপনি কি চান তা তা গোছাচ্ছেন। আপনার এয়ার-কন্ডিশন ঠিক আছে কিনা, ফ্রীজে ডিম ক’টি আছে, আপনার বাড়িওয়ালা প্রধান ফটক বন্ধ করেছেন না করেন নি, ঘরে কতটুকু ময়লা জমেছে – ইত্যাদি।
বাড়ি এলেন। গোসল করলেন। খাবার তৈরী করলেন। কিন্তু আপনার সঙ্গি বা সঙ্গিনী নেই। তিনি কাজে গেছেন অন্য শহরে বা অন্য দেশে। আপনার কম্পিউটার বা ল্যাপটপ বা হাতের টেলিফোনটির সামনে বসে তাঁর সাথে কথা বললেন। তারপর তাঁর অবয়ব ফোন বা ল্যাপটপ থেকে বেরিয়ে এসে আপনাকে চুমু দিল। তারপর আপনি শুভরাত্রি বলে ঘুমিয়ে গেলেন।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষন শুনতে পারেন নি? চিন্তা নেই – ‘বাতাসেই’ রেকর্ড করা আছে ভাষনটি; আপনি শুধু কানেক্ট করেই দেখে নিতে পারবেন। শুধু ভাষন নয়, এমন সব কিছুই থাকবে আপনার হাতের মুঠোয়।
বাড়ি থেকে সকালে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, দরজা আটকে দিতে ভুলে গেলেন। তাহলে?! আপিসে গিয়ে কি এ’ব্যপারে কিছু করা সম্ভব? অবশ্যই! আপনি তাও করলেন। আপিসে বসেই দরজাটি বন্ধ করে দিলেন। আপিসেও আপনার যাওয়া লাগবে না। আপনার কাজে সাহায্য করার জন্য সেখানে আপনি যা ব্যবহার করেন সেসব আপনার বাড়িতেই থাকবে। বাড়ি থেকেই আপিসের কাজ করবেন। বাড়ি থেকেই হয়তো বেরুতে হবে না। শুধু বেরুতে হবে পার্কে আপনার শরীর ঠিক রাখার জন্য শরীরচর্চা করতে।
বাড়ি ফিরছেন আপিস সেরে। গাড়ি চালাচ্ছেন। হঠাৎ আপনার গাড়ি তা নিজের সমস্যার কথা বলা শুরু করলৃএক পর্যায় গাড়িটি বললো সে আর চলতে পারছে না; ইঞ্জিনে সমস্যা হছে। আপনি গাড়ি থেকে নেমে তা’কে বললেন রাস্তার পাশে নিজেকে পার্ক করে বসে থাকতে। সে তাই করলো। আপনি একটি ট্যাক্সি ডাকলেন যার কোন ড্রাইভার নেই। সেটা চেপেই বাড়ি ফিরলেন। ওদিকে গাড়ি কোম্পানির কর্মীরা গিয়ে আপনার নিজের গাড়ির সমস্যা মেরামত করতে থাকলো। আপনার গাড়ির সমস্যা হলেই গাড়ি কোম্পানি তা নিমেষেই বুঝে যাবে এবং প্রয়োজন মত ব্যাবস্থা নেবে। এখনই’তো আমরা ট্যাক্সি ডাকছি ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
অদুর ভবিষ্যতে এই জীবনযাত্রার সহযোগী হতে যাচ্ছে এখন যাদের আমরা টেলিকম অপারেটর বলি। খুব শিঘ্রই দেখবেন এই কোম্পানীগুলো আর টেলিকম কোম্পানী থাকবে না। হয়ে যাবে ডিজিটাল কোম্পানী, এগিয়ে নেবে আমাদের ভবিষ্যতের চাহিদাগুলোকে। আমাদের শহরগুলো ও শহরে বসবাস করতে আমরা যেসব জিনিস ব্যবহার করি সব কানেক্টেড হয়ে যাবে। আমাদের গ্রামগুলো বদলে যাবে; গ্রামে বসবাস করতে আমরা সেসব জিনিস ব্যাবহার করি, সব কানেক্টেড হয়ে যাবে।
আমরা এগুচ্ছি এমনই একটি কানেক্টেড ভবিষ্যতের দিকে। আমাদের এই ভবিষ্যৎ বাস্তবায়ন করবে এই ডিজিটাল কোম্পানীগুলো। এই ভবিষ্যৎ বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে ইন্টারনেট এবং এই ইন্টারনেট সহজলভ্য ও দ্রুতগতির করার জন্য প্রয়োজন হবে সেই ‘বাতাস’।
এই বাতাসের অপর নাম ‘তরঙ্গ’।

৫,০২৮ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।