ফেসবুক নিয়ে সম্প্রতি নাটকটি দেখে ছোটবেলার কয়েকটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি ১৯৭৫ সালে, তখনই জানলাম বাংলায় একটি ‘স্পাই সিরিজ’ ছোট-বড় সবাই পড়ছে। নাম ‘মাসুদ রানা’, লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন। বাঙালি এক স্পাই সারাবিশ্বে আসাইনমেন্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ায়; প্রেমে পড়ে কিন্তু কোথাও কোনও বাঁধনে জড়ায় না। অ্যাকশন-নির্ভর মাসুদ রানার গল্পে নায়কের প্রেমের অংশটি ছিল আমাদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার। নায়কের বিপদসংকুল জীবনের মাঝে তার ভালোবাসা আমাদের মনে এক অন্যরকম স্বপ্ন জাগিয়ে তুলতো।
রহস্য উপন্যাস ও স্পাই থ্রিলার আরও ছিল। যেমন ‘দস্যু বনহুর’, ‘দস্যু বাহরাম’, ‘দস্যু মোহন’, ‘কুয়াশা’ ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের কাছে ‘মাসুদ রানা’ই ছিল সবচেয়ে প্রিয়। আমি নিজে প্রথম ‘মাসুদ রানা’ পড়তে পেরেছিলাম যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। অঙ্ক বইয়ের একটি মলাট লাগিয়ে স্কুলের দেয়াল পেরিয়ে এক ঝোপের আড়ালে আমরা কয়েকজন পড়েছিলাম। রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’; গল্পের নায়কের দু’জন স্ত্রী ছিল এবং সে গল্পে ভালোবাসার বর্ণনা আরও বেশি ছিল। কিন্তু ‘দস্যু বনহুর’ পড়তে আমাদের বাবা-মায়েরা কখনোই বাধা দিতেন না। আমি জীবনে অনেক পরে টের পেয়েছিলাম যে বাবা-মায়েরা দু’টি গল্পের কোনও গল্পই পড়েননি। ‘মাসুদ রানা’র বইয়ের মলাটে মেয়েদের ছবি দেখে তারা ধরেই নিতেন এ গল্প তাদের সন্তানেরা পড়লে নষ্ট হয়ে যাবে।
আমাদের মূল আকর্ষণ ছিল ‘মাসুদ রানা’। যে গল্প পড়তে আমাদের বাবা-মা ও শিক্ষকেরা বাধা দিতেন, তা আমরা আরও বেশি করে পড়তাম।
আরেকটি গল্প বলি।
একসময় আমি একটি আবাসিক স্কুলে পড়াশোনা করতাম। সেখানে শৃঙ্খলা ও সময়নিষ্ঠা ছিল সবার আগে। আমাদের সব কিছুর জন্য সময় ছিল—পড়ার সময়, খেলার সময়, শরীরচর্চার সময়, সিনেমা দেখার সময়, নামাজের সময়, ঘুমিয়ে পড়ার সময় ইত্যাদি। আমাদের আবাসিক ভবনের কমন রুমেটেলিভিশন থাকতো। আমরা রাতের খাওয়া সেরে টেলিভিশন দেখতে পারতাম। কিন্তু টেলিভিশন সেটটি একটি কাঠের বাক্সে তালাবদ্ধ থাকতো। হাউস টিউটর যখন তালা খুলে দিতেন তখনই শুধু দেখতে পারতাম। কিন্তু আমরা কী স্যারের তালা খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম। তালা নিজেরাই খোলার পথ বের করে খুলে দেখতে বসে যেতাম। কিছু-কিছু অনুষ্ঠান আবার আমাদের বড় ভাইয়েরা ছোটদের দেখতে দিতেন না। যেগুলোই আমাদের জন্য নিষেধ ছিল সেগুলোই আমরা বেশ-বেশি করে করতাম। বড় ভাইয়েরা দেখবেন আর আমরা দেখব না, তা হবে না। আমাদের মিশন ছিল আমাদের যা দেখতে দেওয়া হচ্ছে না, তা দেখা; আর না দেখতে পারলে বড় ভাইদের দেখাও ভণ্ডুল করা।
এই উদাহরণগুলোর মধ্যে দিয়ে আমি সবিনয়ে বলতে চাই, যেকোনও কিছু বন্ধ করে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বা বাধা দিয়ে কিছু অর্জন করা যায় না। সামাজিক মাধ্যম বলুন, সিনেমা বলুন আর টেলিভিশনে ধারাবাহিক নাটকই বলুন—সব ক্ষেত্রেই একই কথা খাটে। বন্ধ, নিষেধাজ্ঞা, বাধা দিলে তা আরও আকর্ষণীয় হয়। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যতগুলো বই অথবা সিনেমা নিষেধ করা হয়েছে সেগুলো কী আরও জনপ্রিয় হয়নি? দর্শক বা পাঠক আরও বেশি করে চাইবেন সেগুলো দেখা বা পড়ার জন্য। এ বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই।
কয়েক বছর আগে—২০১২ সালে বাংলাদেশে ইউটিউব বন্ধ করে দেওয়া হলো। আমি তখন একটি টেলিভিশনের সংবাদকক্ষে কাজ করি। আমরা নিষেধাজ্ঞার খবর প্রচার করলাম। পরদিনই আফিসে গিয়ে আমি দেখতে চাইলাম ইউটিউব আসলেই বন্ধ হয়েছে কিনা। দেখলাম সাধারণভাবে ইউটিউবে যাওয়ার চেষ্টা করলে যাওয়া যায় না। তবে ইউটিউবের সিকিউর্ড সাইটের মাধ্যমে খোলার চেষ্টা করলে অবলীলায় তা দেখা যায়। শুনলাম সারাদেশেও মানুষ নানাভাবে বন্ধ ইউয়ারএলকে পাশ কাটিয়ে ইউটিউব দেখছে।
একজন রিপোর্টারকে ডেকে বললাম, এমন একটি রিপোর্ট করুন, যার শিরোনাম হবে, ‘বন্ধ করার পরও দেখা যাচ্ছে ইউটিউব’। তিনি খুব খুশি। কর্তৃপক্ষের কাছে ফোন করে জানালেন, এই ব্যাপারটি নিয়ে তিনি খবর করতে চান। কথা বলে তিনি বুঝলেন, যে সিকিউর্ড সাইট কী তা কর্তৃপক্ষ জানেনই না। তারা আমাদের রিপোর্টারের কাছে জানতে চাইলেন, কোন পদ্ধতিতে ইউটিউব দেখা যাচ্ছে? তিনি সব জানালেন। কর্তৃপক্ষ তাকে এই বিষয়টি নিয়ে খবর না করতে অনুরোধ করলেন। আমরা তাদের অনুরোধ রেখেছিলাম।
এবারে এসেছে ফেসবুক।
গত প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে এই সামাজিক মাধ্যমের সাইটটি অনেকদূর এগিয়েছে এবং অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। খুব সহজেই ‘শুধু ইন্টারনেট থাকলেই এই মাধ্যমটি ব্যবহার করা যায়; এখানে কারও নিষধাজ্ঞা বা চোখ রাঙানি বা ভয়ভীতি ছাড়াই নিজের অভিমত প্রকাশ করা যায়। মন খুলে লেখা, ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা যায়। শুরুতে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এই মাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন দেশে-বিদেশে নতুন-নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য। এক দশক পর এসে এখন আর নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের বিষয়টি আর প্রাধান্য পাচ্ছে না। সবাই তাদের নিজস্ব চেনা-অচেনা বন্ধু-বান্ধবের গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন।
ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এখন সামাজিকতার মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। তারা আজ তাদের জীবনে কাজে লাগে, এ ধরনের বিভিন্ন ধরনের কাজ এই মাধ্যমে সারছেন। হাজার হাজার মানুষ সাহিত্যচর্চা করছেন, লাখ লাখ মানুষ রাস্তা-ঘাটের খবর নিচ্ছেন, রোগীর জন্য রক্ত খুঁজছেন, সংবাদপত্র-টেলিভিশন-রেডিও এখন এখানেই শোনা-দেখা-পড়া যাচ্ছে এবং সবার আগে অনেক খবর পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুকে। লাখ লাখ মানুষ এখন ফেসবুক ব্যবহার করে নিজের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন।
সারাবিশ্বে হাজার হাজার মানুষ এখন নিজেই সিটিজেন সাংবাদিকতা করছেন; যেখানে ঘটনা সেখানে দাঁড়িয়ে লাইভ করছেন। ফেসবুক আস্তে-আস্তে যে সাধারণ গণমাধ্যমের চেয়েও বড় গণমাধ্যমে রূপ নিচ্ছে। কোটি কোটি উপেক্ষিত, নিষ্পেষিত, কণ্ঠহীন মানুষ ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের কণ্ঠ খুঁজে পাচ্ছেন—সমাজ ও সমাজপতিদের নানা দোষ-ত্রুটি তুলে ধরছেন। এই মাধ্যম এমন একটি মঞ্চে পরিণত হয়েছে বা হচ্ছে, যেখানে সবার জন্য কিছু-না-কিছু আছে।
আমার ধারণা, এই দোষ-ত্রুটি তুলে ধোরে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার বিষয়টিই সমাজপতিদের পছন্দ হচ্ছে না। সে কারণেই এই মাধ্যমটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা চিন্তা করা হয়। কর্তৃপক্ষ অথবা সমাজপতিরা হয়তো এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না এই মাধ্যমকে তারা কী করে সামলাবেন। সম্প্রতি কেউ-কেউ বলেছেন ফেসবুকে পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়ে যাচ্ছে। অবাক করা ব্যাপার! মনে হয় ফেসবুক না থাকলে যেন প্রশ্নফাঁস হতো না! প্রশ্নফাঁস করছেন অসৎ কর্মকর্তা! ফেসবুক নয়!
কর্তৃপক্ষের কেউ-কেউ যদি বলেন, ফেসবুকের কারণে আমাদের ছেলেমেয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাহলে হয়তো ভুল করবেন। বরং উল্টোটি হচ্ছে। ফেসবুকে সাধারণ মানুষ যেসব প্রশ্নের উত্তর চাইছেন, সেগুলোর উত্তর কর্তৃপক্ষের অনেকে দিতে না পারায় এই মাধ্যমের ওপর আক্রমণ আসছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
:clap: :clap: :clap: :clap:
অন্ধ হলে যে প্রলয় বন্ধ থাকেনা এটি কর্তা ব্যক্তিদের কে বুঝাবে!
সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জ্ঞান-বুদ্ধি এবং কাজের অভাব আছে বলেই কিছুদিন পর পর এই ধরণের স্টান্টবাজি দেখা যায় O:-)
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ