আমরা অনেকেই ছোটবেলায় ইংরেজ কবি জন ডানের মৃত্যু নিয়ে একটি কবিতা পড়েছিলাম – ‘ডেথ্, বি নট প্রাউড’। কবিতার শেষ দু’টি লাইন ছিল এমন – ‘একটা ছোট্ট ঘুমের পর যখন আমরা চিরকালের জন্য জাগবো / মৃত্যু, তুমি তখন থাকবে না; তোমারই তখন মৃত্যু হবে।‘
কবিতাটি আমাদের অনেকের মনেই বেশ গভীর চিহ্ন রেখে গিয়েছিল। কৈশর থেকে তারুণ্যে বেড়ে ওঠার জোয়ারে এবং জীবনের চাঞ্চল্যে ডুব দেয়ার সাথে-সাথে ছোটবেলার এই কবিতা অনেকেরই মনে থাকে নি। তখন আমরা জীবন-পাগল বা জীবন-উদাসী তরুণ – কবিতা দিয়ে মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ করাতো দূরের কথা, মৃত্যুর কথাই মনে আসে না। তবে সবাই যে মৃত্যুকে ভুলে থাকতাম তা নয়। চোখের সামনে মৃত্যু দেখলে মনে না এসে, মৃত্যুর কথা না ভেবে উপায় নেই। মৃত্যু এক অমোঘ সত্য যাকে ইচ্ছে করলেও দূরে রাখার সামর্থ আমাদের নেই। চোখের সামনে আরেকজনের মৃত্যু দেখতে হয়, নিজেকে মৃত্যুর গহ্ বরে সঁপে দিতে হয়। মৃত্যু আসেই, মৃত্যুর মত, ধেয়ে।
কখনো ধেয়ে, কখনো জীর্নতার কাঁধে ভর করে, কখনো নিরবে, কখনো পতাকা উড়িয়ে, কখনো প্রচার করে, কখনো অপ্রত্যাশিত ঘটনার মাধ্যমে, কখনো নিজের কাছ থেকে পালাতে গিয়ে আবার কখনো মৃত্যুর কাছ থেকে পালাতে গিয়েও – মৃত্যু আসেই। কবে যেন নাম না জানা এক কবির কবিতা পড়েছিলামঃ ‘জীবন মৃত্যুর কাছে জানতে চাইল, ‘বলতে পারো, মানুষ আমায় কেন ভালবাসে আর তোমায় ঘৃ্না করে?’ মৃত্যু উত্তর দিল, কারণ তুমি সুন্দর একটা মিথ্যা, আর আমি সত্যিকারের একটা কষ্ট’।
মৃত্যু নিয়ে উধৃতি দিচ্ছি বলে এবং জীবন-সংক্রান্তির কথা বলছি বলে, কেউ ভাববেন না যে আমি মৃত্যু-দর্শন কপচে যাচ্ছি। জীবনে অনেক মৃত্যু দেখার পর কিছু মৃত্যু আমার মনে দাগ কেটেছে এবং সেই মৃত্যুগুলো আমার জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মৃত্যু নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গী দানা বেধেঁছে, কিছু উপলব্ধি হয়েছে। আমি শুধু সেগুলোই তুলে ধরছি।
আমি জীবনে প্রথম মৃত্যু দেখেছিলাম উনিশ্য-একাত্তর সালে। তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আমাদের পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল আমার নানা বাড়িতে। আমি তখন পাঁচ বছরের বালক মাত্র। আমি কাউকে কখনো মৃত্যুবরণ করতে দেখি নি। আমি কোন জীবের মৃত্যুও দেখি নি। মারা যেতে দেখলাম আমার নানার ভেড়ার পালের একটিকে। ভেড়াটির গলায় যুদ্ধের গুলি লেগেছিল। শুনলাম একটি ভেড়ার গলায় গুলি লেগেছে এবং সবাই মিলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। নানার নেতৃ্ত্বে আমার সেজো মামা তার সেবা করছিলেন। তাকে কি করে বাঁচাবেন তা নিয়ে ব্যাস্ত। আমি যখন ভেড়াটির কাছে গেলাম, সে তখন দাঁড়িয়ে। গলায় একটি গামছা পেচাঁনো। কিছুটা লালচে রঙের। ভাল করে খেয়াল করলাম – না গামছার রঙ লাল নয়; তার রক্তে গামছাটি লাল হয়ে গেছে। তার গলা ভেদ করে গুলি গেছে। সেজোমামা হাঁটু গেড়ে বসে তাকে ধরে কিছু একটা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছেন না তাকে কিভাবে সাহায্য করবেন। ভেড়াটির চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। কোন পশু কাঁদতে পারে সেই আমার প্রথম দেখা।
কিছুক্ষণ পর ভেড়াটি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। অতি রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হলো। ভেড়াটি মারা যেতে দেখে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। তার ঢলে পড়ার ছবিটি আজও মনে ভাসে।
তার কিছুদিন পরই নানার বাড়ি থেকে পালিয়ে আমাদের অন্য স্থানে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। পালিয়ে যাওয়ার পথে আমি বেশ ক’টি মরদেহ একটি ডোবার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেছি। সবাই দেখেছে। দেহগুলো কেউ দেখতে পেয়ে ডোবায় নেমে সৎকার করার চেষ্টা কেউ করেছিল কিনা তা আমার মনে নেই, তবে সেই আমার প্রথম মৃত মানুষ দেখা। তাও বোধহয় কয়েক দিনের মৃত। পানিতে ভাসছিল। সবার ভেতর সন্ত্রস্ততা দেখে আমার মনেও ভয় জেগেছিল। মৃত্যু-ভয়। সেই বয়ষেই জেনে গিয়েছিলাম পাকিস্তানী বাহিনী ও মুক্তি-বিরোধীরা স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদের নির্বিচারে হত্যা করছিলো। মুক্তিকামী যারা হত্যা হয়েছিলেন তারা কখনোই ভাবেন নি যে ঘাতকের হাতে মৃত্যু হবে।
তবে মৃত্যুর আগে তাঁরা কতটুকু ভয় পেয়েছিলেন? মৃত্যুর ঠিক আগে ভয় পাওয়া খুবই স্বাভাবিক বলে আমার মনে হয়। আমরা মৃত্যু নিয়ে যখন ভীত হই, তখন কোন ব্যপারটি আমাদের বেশি ভাবায়? মৃত্যুকালীন যন্ত্রনা নাকি আমার মৃত্যুর পরের যন্ত্রনা? আমার বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত মানুষের সাথে কথা বলে জেনেছি বেশিরভাগই মৃত্যু-চিন্তা করেন ধর্মীয় ভাবনা থেকে। মৃত্যুর পর যে জীবন আছে বলে আব্রাহামীয় ধর্মগুলো দাবি করে তাই সবাই বিশ্বাস করেন এবং মৃত্যুর পরের যন্ত্রনা নিয়েই সবাই বেশি চিন্তিত। তবে আমি একটু অন্যরকম করে ভাবি। মৃত্যুর পর আমার শাস্তি হোক আর না হোক, তার চেয়ে বেশি করে মনে হয় মৃত্যু এক অতল একাকিত্ত। আমি চলে গেলে আমার বন্ধু ও স্বজনেরা আমিহীনতায় একা হয়ে যাবেন; আবার তাঁদের ছেড়ে গিয়ে আমিতো একা হয়ে যাবোই। এ কথাটি আমি প্রায়ই আমার বন্ধুদের বলি। ওরা আমায় থামিয়ে দেয়। বলেঃ ‘এসব বলিস না, মন খারাপ হয়ে যায়’। আমি বলি না। কিন্তু ভাবনাটি’তো রয়েই যায়। একাকিত্তের ভয় আমার ভেতর অস্থিরতার জন্ম দেয়।
তবে সবসময় আমার ভাবনা এমনটি ছিল না। আমার জীবনে এমনও সময় গেছে যখন কাছের মানুষেরা কেউ আমায় কেউ জীবন নিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন না। জীবনকে জীবনের মত করে দেখতে সাহায্য করছে না। এই সময়টি ছিল বেশ লম্বা। স্কুল থেকে শুরু – স্কুল পেরিয়ে কলেজ এবং কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়। সময়টি সত্যিই বেশ লম্বা। এই সময়ে যে’কারণেই হোক আমার মাঝে জীবনের তাগিদ ছিল কম; জীবন কোনমতে পার করে দিতে পারলেই হল। জীবনকে দূরের মনে হত আর মৃত্যুকে কাছে এবং আপন।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন আমার সেজো খালু চলে গেলেন। একদিন সকালে খবর এলো তিনি নেই। আমার এই খালু ছিলেন আমার দেখা একজন সাদা মানুষদের অন্যতম। আমি কবরস্থান-অব্দি গেলাম – মিরপুরের বুদ্ধিজিবী কবরস্থান। তাঁকে যখন মাটিতে শোয়ানো হচ্ছিল, খেয়াল করেছিলাম তাঁর গোরের রং। সেই ঘরের বর্ন ছিল লাল ও খয়েরী’র একটা মিশ্রন। কেমন যেন আদর-আদর ভাব ছিল সে’মাটিতে। ঠিক যেন অস্কার ওয়াইল্ড যেমনটি লিখেছিলেন তাঁর “দ্য ক্যান্টারভিল ঘোষ্ট” বইতেঃ ‘মৃত্যু নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর। নরম খয়েরী মাটিতে শুয়ে মাথার ওপরে ঘাসের দুলুনি নিঃশব্দের শব্দ শোনা। কোন গতকাল নেই; নেই কোন আগামীকাল। সময় ভুলে যাওয়া, জীবন ভুলে যাওয়া – কি শান্তি!’ ঠিক সেই মূহুর্তে সেজো খালুকে খুব হিংসে হয়েছিল। এতো সুন্দর পেলব মাটি! চারপাশে সবুজ ঘাস! সে’মাটিতে তিনি থাকবেন, আমি থাকবো না। অস্কার ওয়াইল্ডের মত তিনি সময় ভুলে থাকবেন, জীবন ভুলে যাবেন। আর আমি আমার জীবন-বিমুখতা নিয়েও এই জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাবো। সেই মূহুর্তে খালুকে আমার অতি ভাগ্যবান মনে হয়েছিল। তিনি এই জগতের চেয়েও আরো একটি সুন্দর স্থানে যাচ্ছেন।
কিন্তু আমরা সেই জগৎ সম্পর্কে কতটুকু জানি? সেটা সুখের না কষ্টের, তাও বা কতটুকু জানি। জানবই বা কি করে? আমরা’তো কেউ সেখানে গিয়ে দেখে আসিনি। তাহলে? তাহলে অন্য কারো কাছে শুনে আমাদের আমাদের মনের ভেতর একটি ছবি আঁকতে হবে; না’হয় আসমানী গ্রন্থগুলোর ওপর প্রশ্নহীন বিশ্বাস নিয়ে সে জগতের একটা ধারনা নিয়ে সেখানে যাবার প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে যেটুকু এই পুস্তকগুলোতে বলা আছে, পড়ে মনে হয় বোধহয় আরো কিছু বলার ছিল, জানানোর ছিল। বলা হয়নি। বললে হয়’তো মানুষ সে’জগৎ নিয়ে এতো চিন্তা করতো না। কবরে শোয়ার পর অথবা আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার পর কি হবে সেই কল্পনা করার শক্তি বোধহয় এখনো মানুষ প্রজাতির হয় নি। কবরে শুয়ে থাকি বা আগুনে ছাই হই, এই সূর্যটা’তো আর থাকবে না। কবরের নীচে নিশ্চয়ই অন্ধকার। আর অন্ধকার একটি অজানার নাম, একটি ভয়ের রূপ। যেমনটি “হ্যারী পটার” উপন্যাসের লেখক জেকে রোলিং বলেছেনঃ ‘মৃত্যু এবং অন্ধকারের দিকে তাকালে আমরা এক অজানাকে ভয় পাই। আর কিছু নয়।‘ হয়তো তাই। কিন্তু সেই অজানাই’তো ভয়ের কারণ, একাকিত্তের কারণ। মৃত্যুর পর জীবন থাকুক আর না থাকুক, এই অজানার কথা চিন্তা করলেই আমি সেই একাকিত্তের মধ্যেই বন্দি হয়ে যাই। এই বন্দিত্বই হয়’তো আমার একাকিত্ত। তবে এ ব্যাখ্যা খুব সহজেই দিয়েছিলেন আমাদের শাহ আব্দুল করিম। তাঁর কাছে একবার মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি অবলীলায় বলেছিলেনঃ ‘মৃত্যুর পর আমার মাটির দেহ মাটিতে মিলিয়ে যাবে, আর আমার নিঃশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যাবে।‘ তাঁর এই কথা শুনে আমার আদম ও হাওয়ার কথা মনে হয়। ‘আদম’ অর্থ মাটি আর ‘হাওয়া’ অর্থ বাতাস। এই মাটি আর বাতাসের সংমিশ্রণই আমরা – মানুষ। তারপরও করিম বয়াতির কথাটি মনে নিলেও মৃত্যু আমাদের কাছে অজানা এক একাকিত্তই রয়ে যাচ্ছে। অন্তত আমি মনে নিয়েও মেনে নিতে পারছি না।
কাছের মানুষের মৃত্যুতে আমদের মনে বিষাদ আসে, মন খারাপ করি, কাঁদি। কোন-কোন মৃত্যু আবার আমাদের রাগায়। সে’তো সেই একাকিত্তের কারণেই। যে মানুষটির জন্য আমরা কাঁদছি বা রেগে যাচ্ছি সে’তো এক একাকি পথে রওনা দিল আমাদের বা আমায় একা ফেলে। তাঁর অনুপস্থিতিই আমাদের কাঁদায়, রাগায়। মৃত্যু হয়’তো একসাথে না থাকার একাকিত্ত।
আমাদের বন্ধু মিখাইল চলে গিয়েছিল উনিশ্য-বিরাশি সালের মাঝামাঝি। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলও জেনে যেতে পারেনি। তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল তাঁর গ্রামেই এক বিলের মাঝে। যে বা যারা তাঁর মৃত্যু ঘটিয়েছিল, এত বছর পরও তাদেরকে কেউ চিনতে পারেনি এবং ধরতেও পারেনি। মিখাইলের এই মৃত্যু আমাদের রাগাহ্নিত করে রেখেছে এত বছর পরও। মিখাইলের মৃত্যু আমার কাছে সেই একাত্তরের ভেড়ার মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। পনেরো-ষোল বছর বয়ষে যে মানুষটি চলে গেল তাতে তাঁর কোন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু চলে’তো গেল!
তারপর শহিদুল চলে গেল দু’হাজার-ন’য়ে সালে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায়। আমি তখন বিবিসি’তে কাজ করি। সকালবেলা বন্ধুর মৃত্যুর খবরটি আমায় লিখতে হয়েছিল চোখভরা জল নিয়ে। খবরটি বিলাতে হেড-আপিসে মেইল করে দিয়ে সেখানে আর থাকতে পারিনি। ছুটি নিয়ে বেরিয়ে এসে সারাদিন কেঁদে কাটিয়েছিলাম। কষ্ট পেয়েছিলাম। কষ্টটি কিসের ছিল? শহিদুল মৃত্যুর সময় যে কষ্ট পেয়েছিল তা মনে করে? নাকি সে চলে গেল এবং আর ফিরবে না সে কষ্টে? নাকি মরে গিয়ে সে একা হয়ে গেল, আর আমাকেও একা করে গেল, সেই একাকিত্তের কষ্টে?
আবারো সেই একাকিত্তের ভয়! বন্ধু আমায়, আমাদের একা করে দিয়ে গেল!
তিন বছর হল মুনির চলে গেছে। ঘুমের গভীরে চলে গেছে আরো লম্বা ঘুমে। তাঁর স্ত্রী পাশেই ছিল। সেও কি টের পেয়েছিল মুনির তাঁকে একা ফেলে নিজেও এক একাকিত্তে চলে যাচ্ছে? না বোধহয়। আমরা যারা একাকিত্তের সওয়ারীদের কাছাকাছি থাকি, তারা বোধহয় বুঝতে পারি না তাঁদের চলে যাওয়ার ক্ষণ কখন আসবে। জীবনের বিভিন্ন অমুল্য মূহুর্তগুলো যেমন প্রায়ই আমরা টের পাই না, তেমন মৃত্যু-ক্ষণও বোঝার ক্ষমতা আমাদের বেশিরভাগ সময় থাকে না। কারণ কিছু-কিছু মানুষের মৃত্যু আমাদের চিন্তার পরিধিতে থাকে না, আমরা চাইনা তাঁরা আমাদের ছেড়ে চলে যান। যেমনটি হয়েছিল আমার স্ত্রীর বাবা – আমার শ্বশুর — এবং আমার মায়ের চলে যাওয়া। অবচেতন মনে হয়’তো আমাদের সবার মনেই কাছের মানুষগুলোর মৃত্যুর ছবি আঁকা থাকে, চেতন মনে হয়’তো থাকে না। আমরা জানি জীবনে সময় গড়ালে চলে যেতে হয়। তবে সময় যে গড়িয়ে যায় তা আমাদের উপলব্ধিতে থাকে না। অথবা চলে যাওয়ার ভাবনাটি আমরা ইচ্ছে করে দূরে রাখি।
শ্বশুর চলে যাবেন আমি জাগতিক মনে কখনো ভাবি নি; হয়তো ভাবতেই চাই নি। উনসত্তুর বছর বয়েষেও তিনি সারা জীবন যেমন শারীরিক ও মানসিক দৃঢ়তার নিদর্শন তাঁর চারপাশে ছড়াতেন, আমি ভাবিনি এক সকালে ‘আমি আর পারলাম না’ বলে তিনি ঢলে পড়বেন। ঢলে পড়েও তিনি চলে যান নি। তাঁর বাড়ির কাছেই হাসপাতালে যখন নেয়া হল, তখন তাঁর হৃদযন্ত্রটি বন্ধ ছিল। চিকিৎসাবিদ’দের কাছ থেকে জেনেছিলাম প্রায় তেরো মিনিট ধরে ফেরানোর চেষ্টার পর তিনি ফিরে এসেছিলেন। অবাক করা ঘটনা! কিসের টানে তিনি ফিরেতে চেয়েছিলেন? নাকি আমাদের চিন্তার বাইরে অতিপ্রাকিত কোন শক্তি তাঁকে ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন? কিন্তু সে’শক্তিও পারে নি? প্রায় দু’মাস তিনি মৃতের মত হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছিলেন। মাঝে-মাঝে আমরা তাঁর চোখের মনির নড়াচড়া দেখতে পেয়েছি, বুঝেছি তিনি আছেন, কিন্তু তাঁর শারীরিক অসাড়তা আমায় বলে দিয়েছে তিনি একা হতে চলেছেন। তাঁর সাথে আমরাও। তারপর তিনি সত্যিই চলে গেলেন। আমরা তাঁকে ধরে রাখতে চেষ্টার বিন্দুমাত্র ত্রুটি করি নি। সবাই কেন তাঁকে ফেরাতে চেষ্টা করেছিলাম? তিনি বেঁচে থাকবেন, সে’জন্যে? নাকি তিনি ছাড়া আমরা একা হয়ে যাব, সে’কারণে? আদতে কি হল? তিনিও একা হলেন, তাঁকে হারিয়ে আমরাও একা হয়ে গেলাম।
তাঁর চলে যাওয়া আমার জন্যে আরেকবার একা হয়ে যাওয়ার ঘটনা। তিনি আমার ভাল বন্ধু ছিলেন। তাঁর সাথে আমি জীবন-সংসার-ধর্ম নিয়ে খোলা মনে যে’আলোচনাগুলো আমি করতাম, তা আর কারো সাথে হত না। তিনিও তাঁর জীবনে এমন কাউকে পান নি যার সাথে সে’আলাপ করতে পারেন। তাঁর চলে যাবার কয়েক বছর হয়ে গেল। আমি এখনো স্বার্থপরের মত ভাবছি তিনি আমায় একা করে চলে গেছেন।
সূর্য ওঠার প্রহর গুনলে, মাত্র কয়েক প্রহর আগে আমার মা চলে গেল। একান্ন দিন হাসপাতালে থেকে আমাদের আমাদের কাছে ফেরার আপ্রান চেষ্টা করেও আর পারে নি। যেদিন তাঁকে হাসপাতালে নিয়েছিলাম, ভাবি নি মা চলে যাবে। এইতো ক’দিন পরই বাড়ি ফিরবে। সে নিজেও আমাদের বলেছিল যেসব গৃহস্থলি কাজ সে সারা জীবন করেছে তা আর তাঁর দ্বারা সম্ভব হবে না। তাঁর সবচেয়ে বেশি চিন্তা ছিল তাঁর স্বামীকে নিয়ে। তাঁকে খাবার করে দেবে কে! সে নিজে’তো আর পারবে না। আমরা বলেছিলাম সে’চিন্তা তাঁকে আর করতে হবে না। তাঁর চিন্তাটি বেশিদূর এগোয় নি। বাড়ি ফিরেছিল তাঁর প্রানহীন দেহ। না চাইলেও তাঁর দেহকে বিদায় দিতে হয়েছে।
মাটির নীচে নেমে তাঁর মাথা ছুঁয়ে বিদায় দিলেও এই মৃত্যু মায়ের কাছ থেকে আমায় একা করতে পারে নি। মায়ের কোন মৃত্যু নেই, হতে পারে না। জঠরে ধারন করে যে সম্পর্কের জন্ম সে দিয়েছে তার মৃত্যু নেই। আমি এখন বুঝতে পারি মায়ের সাথে সম্পর্ক মৃত্যুকেও জয় করতে পারে। আমি নিশ্চিত মা’ও আমায় ছেড়ে গিয়ে একা বোধ করছে না।
http://bangla.samakal.net/2017/03/03/274117
:boss: :boss: :boss: :boss:
মায়ের কোন মৃত্যু নেই, হতে পারে না। জঠরে ধারন করে যে সম্পর্কের জন্ম সে দিয়েছে তার মৃত্যু নেই। আমি এখন বুঝতে পারি মায়ের সাথে সম্পর্ক মৃত্যুকেও জয় করতে পারে। আমি নিশ্চিত মা’ও আমায় ছেড়ে গিয়ে একা বোধ করছে না।
ধন্যবাদ...
আজকাল মৃত্যু নিয়ে নিজের মধ্যেও কেমন জানি বোধ হচ্ছে.... কাছের মানুষগুলোর চলে যাওয়া মেনে নিতেও কষ্ট হয়। হেলিকপ্টারে টাঙ্গাইলে শহীদ স্যারের মৃত্যু মেনে নিতে যে আমারও কষ্ট হয় কারন দু'দিন আগে আমাদের স্বাক্ষাত হয়েছিল।
প্রায় সব ধর্মেই পুনর্জন্মের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। শক্তির যেমন ক্ষয় নাই, কেবল এক রূপ থেকে আরেক রূপে রূপান্তরিত হয়, তেমনি জম্ম ও মৃত্যুও কি জীবনের রূপান্তর মাত্র??!!!
কোন পশু কাঁদতে পারে সেই আমার প্রথম দেখা -- ছোটবেলায় কুরবানীর পশুর চোখের কান্না দেখে খুবই বিচলিত হ'তাম। করার কিছু ছিল না।
১৯৭১ সালে গুলিবিদ্ধ এক ব্যক্তিকে আমাদের গ্রামের এক গ্রাম্য ডাক্তারের কাছে লোকজন মাথায় বহন করে নিয়ে এসেছিলো। পেটের কাছের একটা ক্ষত দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে সাথে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল। গ্রাম্য ডাক্তার আর কতটুকুই বা কী করতে পারে এ অবস্থায়? লোকটা কাতরভাবে তাকাতে তাকাতে আর কাতরাতে কাতরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলো। এ বীভৎস দৃশ্য এখনো ভুলতে পারিনা।
আমি বলি না। কিন্তু ভাবনাটি’তো রয়েই যায়। একাকিত্তের ভয় আমার ভেতর অস্থিরতার জন্ম দেয় -- এ নিষ্ঠুর সত্যকে সত্যিই ভয় পাই!!!
সময় ভুলে যাওয়া, জীবন ভুলে যাওয়া – কি শান্তি! - আহা! আহা!
ঘুমের গভীরে চলে গেছে আরো লম্বা ঘুমে - মাঝে মাঝে এটাও ভাবি, এ ধরণের ঘুম থেকে ঘুমে চলে যাওয়াটা কি আদৌ বেদনাবিহীনভাবে ঘটে?
ইকরাম, তোমার এ লেখাটা পড়ে স্থির থাকা দায়!
অনেক ধন্যবাদ খায়রুল ভাই...
একটি লিটারারি পিস হিসাবে পড়লাম, কিন্তু ফিলসোফিটা নিয়ে ভাবতে আমার মধ্যে উৎসাহের অভাব বোধ করছি।
কারন মৃত্যু নিয়ে আমারও ভাবনা হলো:
"যতদিন আমি আছি, ততদিন মৃত্যু নাই
যেদিন মৃত্যু আসবে, সেদিন আমি আর নাই..."
তাই, আমিও আছি, মৃত্যুও আছে - এমনটা সম্ভব না।
যার সাথে আমার কোনো কো-এক্সিস্ট্যান্স নাই, যে দুটি ইভেন্ট মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ, ভেবে দেখলাম, তা নিয়ে মাথা ঘামানোটা অর্থহীন। সময়ের অপচয়।
অন্যের মৃত্যুজনিত বিচ্ছিন্নতা নিয়েও ভাবতে অনিচ্ছা বোধ করি আজকাল।
বেঁচেবর্তে থেকেও, রক্ত-মাংসের শরীর নিয়ে সামনে ঘুরে ফিরে বেরিয়েও তো কত কত কাছের মানুষই স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে নিজেদেরকে, সেখানে মৃত্যু-জনিত বাধ্যতামূলক বিচ্ছিন্নতায় কি আর আসে যায়!!!
তারচেয়ে এই ভাল, যারা নিজে থেকে যোগাযোগে থাকে, তাদেরকে সময় দেয়াটা............
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
মৃত্যু এক অপেক্ষমান ট্রেন। অনন্য অনুপম গন্তব্যে যে নামিয়ে দিচ্ছে যাত্রী ক্রমাগত।
এক একটা স্টেশন এলে গোটা এক প্ল্যাটফর্মে নেমে যায় এক একজন একাকী যাত্রী।
মৃত্যু অমোঘ অন্তিম এক স্টেশনের নাম, যেখানে পৌঁছে যায় কোনো একদিন জীবনের সকল অভিযাত্রী।