সাংবাদিকতায় ফলো-আপের অভাব

সাংবাদিকতা পেশায় অনেকগুলো বছর পার করার পরও কেমন যেন লাগে। মনে হয় ঠিক মতো আমার সব কাজগুলো করতে পারিনি। কারণ অনেক। মাঝে-মাঝে নিজেরই ইচ্ছে হয়নি। কিছু সময়ে আলস্য গেঁড়ে বসেছিল, আবার অনেক সময় আমার নিজের দুর্বলতা ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ সময়-সুযোগ হয়নি। তার মানে কিছুই যে করতে পারিনি তা নয়; তবে অনেক কাজই অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।

এ কথা শুধু আমার একার নয়। বাংলাদেশে সাংবাদিকরা সুযোগের অভাবে অনেক কাজ করতে পারেন না। টেলিভিশন রিপোর্টারদের কথাই যদি ধরি, তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগেন। আমাদের টেলিভিশনগুলো খুব ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বাজারে আসে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে তারা সম্প্রচারের জন্য তৈরি থাকে না। সম্প্রচারে আসার আগেই বিনিয়োগের প্রায় সব অর্থই খরচ হয়ে যায়, তারপর সম্প্রচারে এসে ধুঁকতে থাকে। প্রতিবেদক দল থাকে অনেক বড়, কিন্তু তাদের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি থাকে না। ক্যামেরা যা থাকে তা প্রতিদিনের ঘটনাগুলোর খবর জানাতেই ব্যাস্ত থাকে। কেউ যে একটা বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করবে তার উপায় নেই। সংবাদ-ভিত্তিক টেলিভিশনগুলোয় এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি। আমি দিনের পর দিন অনেক রিপোর্টারকে বসে থাকতে দেখেছি। ক্যামেরার অভাবে তাদের ডেস্কে বসে কাজ করতে হয়েছে।

অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে রিপোর্টারের সংখ্যাই থাকে কম। টেলিভিশনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের দৈনিক ঘটনাগুলোর প্রতিবেদন পাঠাতে হয়। সারাদিন তাদের এক-একজনের প্রায় সাত-আটটি স্টোরি করতে হয়। তাদের ডেস্কের কাজও করতে হয় যখন ডেস্কের কেউ অনুপস্থিত থাকে।

দৈনিক খবরের কাগজগুলোর রিপোর্টাররা বোধহয় একটু ভালো অবস্থায় থাকেন, কারণ তাদের সময়ের সঙ্গে তেমন একটা পাল্লা দিতে হয় না, তারা যা করতে চাইছেন সেজন্য একটু বেশি সময় পান। তবে তাদের অন্য অনেক বাধা আছে।

তবে বাধা থাকুক আর না থাকুক আমরা প্রায় সবাই অবলীলায় যে কাজটি করি না, তা হচ্ছে উল্লেখযোগ্য ও চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোর ফলো-আপ প্রতিবেদন তৈরি করা। একটা ঘটনা সামান্য থিতিয়ে এলেই সাধারণত নতুন কোনো ঘটনা ঘটে এবং আমরা সবাই মিলে সেই ঘটনায় এতোই মনোযোগী হয়ে পড়ি যে আগের ঘটনার কথা প্রায় ভুলেই যাই। এক মাস যায়, দুই মাস যায়; ওই ঘটনা আর ফিরে আসে না। রমনা বটমূলে বোমা হামলার কথাই যদি ধরি, সে প্রমাণই পাওয়া যায়। বছর ঘুরে এই সন্ত্রাসী হামলার বার্ষিকী এলে তখন সে ব্যপারে ফলো-আপ স্টোরি হয়। এরকম অনেক ঘটনা ফলো-আপের অভাবে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

আমাদের পাঠক, দর্শক ও শ্রোতাদের এসব বিষয়ে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও, আমরা এই বিষয়গুলোর কথা প্রায় ভুলেই থাকি। থিতিয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে জনগণের আরো জানার ইচ্ছা থাকলেও আমরা তাদেরকে তথ্য দেয়ার কথা মাথা থেকে প্রায় ঝেড়েই ফেলি। ফলো-আপ করা একটা ব্যাবস্থাপনা ও গবেষণা সংক্রান্ত কাজ বলে আমার মনে হয়। আমি একটা টেলিভিশনে ইনপুট বিভাগে কাজ করতাম। সেখানে আমরা ফলো-আপ করতে পারতাম না যন্ত্রপাতির অভাবে। যেকোনো ঘটনা লাইভ করতে চাওয়ার উন্মাদনায় রিপোর্টারকে ক্যামেরা দিতে পারতাম না। নতুন কোনো ঘটনা শুরু হলেই আমরা সবাই যেন এক সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। গবেষণা বিভাগ আমাকে জানাতো কোন ঘটনার ফলো-আপ প্রয়োজন, কিন্তু তারপরও তা করা যেতো না।

পরিবেশ সংগঠন বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামীর অপহরণের ঘটনার পর প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেছে। অপহরণ ও তাকে উদ্ধারের পর কয়েকদিন আমরা এতো রিপোর্ট করলাম, এতো ফুটেজ দেখালাম, এতো লাইভ করলাম যে তখন এই বিষয়টি ছাড়া আর কোনো ঘটনা তেমন গুরুত্ব পায়নি। তারপর মাস পেরিয়ে দুই মাস হতে চললো, আর একটিও কথা নেই, একটিও প্রতিবেদন নেই। কারা তাকে অপহরণ করেছিল, পুলিশের তদন্ত কতদূর এগুলো, মামলাটির কি অবস্থা – কোনো কিছুই নেই। কেন? কারণ এরই মধ্যে যে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা এসে হাজির হয়েছে, র্যা ব থাকবে কি থাকবে না সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাই আমরা তার অপহরণের ঘটনার ফলো-আপ করতে বেমালুম ভুলে বসে আছি।

এই সঙ্গে খুনের ঘটনাও থিতিয়ে গেলো যখন নরেন্দ্র মোদি ও তার দল ভারতের লোকসভা নির্বাচনে জিতে গেল। সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল না বসলে বা ট্রাইবুনালের কোনো উকিল কোনো কথা না বললে যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কয়টা রিপোর্ট আমরা করি। আদালতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার প্রথম দিনের খবর আমরা দিয়েছি, কিন্তু তারপর বেশিরভাগ সাংবাদিক সেগুলোর খবরা-খবর দিতে অতটা মনোযোগী হয় না।

স্ব-উদ্যোগী হয়ে কোন ঘটনার ফলো-আপ আমরা করব এই ব্যাপারটি আমাদের মাথায় নেই বললেই বোধহয় ভুল বলা হবে না। আমার মনে হয় কিছুদিন পর-পর কিছু ঘটনার ফলো-আপ করা অত্যন্ত জরুরি। আমি যত ভালো সাংবাদিক হই’না কেন, কোনো ঘটনা কভার করতে গিয়ে কিছু না কিছু আমি ছেড়ে এসেছি। সে কারণেই ফলো-আপের প্রয়োজন। একটা ভারসাম্য আনার জন্যেও ফলো-আপ প্রতিবেদন প্রয়োজন। জাতীয় কোনো উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তের পর অনেকগুলো ফলো-আপ স্টোরি হতে পারে যা আমরা একদিন বা এক সপ্তাহে করার সময় না-ও পেতে পারি।

ফলো-আপ স্টোরি করার প্রবণতা বাড়লে, তা শুধু আমাদের সাংবাদিকতাকেই এগিয়ে নিয়ে যাবে না, তা আমরা যে সংবাদ সংস্থাগুলোতে কাজ করি তাদেরও সংবাদের বাজারে আরো এগিয়ে দেবে। তবে প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলে, খবরের কাগজে, সংবাদ-ভিত্তিক রেডিওতে ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে ‘গবেষণা সেল’ এর গুরুত্ব বাড়াতে হবে।

৮৭৩ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “সাংবাদিকতায় ফলো-আপের অভাব”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    সত্যি কথা।
    সবাই দৌড়ায় স্কুপের পিছে।
    বাসি খবর, ফলো আপ যে কড়া নিউজ হতে পারে এইটা কে কারে বুঝায়!


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    বাংলাদেশে কারো কোন জবাবদিহিতা করতে হয় না বলে ফলো আপ কালচার গড়ে উঠছে না।
    একজন সাংবাদিক কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রচার/প্রকাশ করার কিছুদিন পর তার কোন প্রভাব বা প্রতিকার যদি না দেখতে পান স্বভাবতই তিনি আর ফলো আপে উৎসাহিত হবেন না। তেমনিভাবে একজন পাঠক শুধুমাত্র খবর/ফলো আপ দেখে কতদিন সন্তুষ্ট থাকবেন, যদি না বাস্তবে তার কোন প্রয়োগ দেখতে না পান?? আর এভাবেই সংবাদ মাধ্যম ধীরে ধীরে 'পাবলিক যা খায় তাই খাওয়াইতে হবে' টাইপ হয়ে যাচ্ছে... 🙁
    (ব্যক্তিগত মতামত 😀 )

    ইকরাম ভাই, পুনঃ স্বাগতম! 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    কবি বলে গিয়েছিলেন হুজুগে বাঙালী। সেটাই বিজ্ঞানীরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নাম দিয়েছেন, issue attention cycle. মোটামুটি অনেক দেশেই সবাই এই চক্করের উপরেই থাকে তবে বাঙলাদেশ তথা আমরা সেই ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আমি ফেইসবুকে একবার বলেছিলাম ২ মাস সময় হাতে আছে আমাদের পুরো ব্যাপারটা ভুলে যেতে। এক বন্ধু তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, দুই মাস শালা দুই সপ্তাহ থাকবে না। প্রায় সঠিক। এক মাসের মাথায় মোটামুটি ঝকঝকে তকতকে মেঝে! কোন ময়লা নাই।

    ডিম আগে না মুরগী আগের মত চিন্তা করছি, বাঙালীর হুজুগ থেকেই ফলো-আপ না করার অভ্যাস গড়ে উঠলো নাকি ফলো-আপ না করতে করতে বাঙালী হুজুগে হয়ে গেল? 😀


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  4. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    আমি নিশ্চিত, অনেকেই বলবেন, ফলো আপের পাঠক নাই।
    কিন্তু ফলো আপ তো যাচ্ছেই না। তারমানে যেই প্রোডাক্ট বাজারে নাই তাঁর ক্রেতা আছে কি নাই, বুঝতেছি কেমনে?
    সব ফলো আপের নিউজ ভ্যালু থাকবে না কিন্তু করাটা উচিৎ কারন তাহলে নিউজ ভ্যালু সম্পন্ন নিউজটা হারাতে পারবে না।
    ফলো আপ না হবার কারনে, সংস্কৃতি না থাকার কারনে নিউজ ভ্যালু সম্পন্ন ফলো আপ গুলি হারিয়ে যাচ্ছে।


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  5. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    কোন একটা ঘটনা বা দুর্ঘটনা নিয়ে ফলোআপ করতে হলে আসলে লেগে থাকতে হয়, খ্যাপাটে হতে হয় -- ঘরের খেয়ে শুধু বনের মোষ তাড়াতে হয়। সেটা খুব দুরূহ।
    প্রতিটা পেশায় এমন একাগ্র মানুষ আছেন যাঁরা নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন সাধ্যে যতটা কুলায়। এসব মানুষদের পর্যাপ্ত মূল্যায়ন করলে বা নিদেনপক্ষে স্বীকৃতি দিলে এঁদের অনুসরণ করার সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে, তার আগে নয়।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।