আহ্…… কি যে ভালো লাগছে। কত দিন ধরে অপেক্ষা করেছি এই একটা খবরের জন্য। আনন্দে লাফাতে ইচ্ছা করছে। শেষ পর্যন্ত তা হলে রেসিডেনসিটা হোল। অনু অবরয় …… কনগ্রেসুলেসন ..অবশেষে তুমি পারলে, নিজেকে নিজেই ধন্যবাদ দিল অনু। নিজের যোগ্যতায় যতটুকু না হয়েছে তার চেয়ে মনে হয় বেশি কাজ হয়েছে মুরুব্বিদের দোয়ায়। গ্যাস ইস্টিসনে কাজ করার ফাঁকে কম্পিউটারে ইমেল চেক করে মাত্রই ইরেস (ইলেক্টনিক রেসিডেনসি এপ্লিকেশ্ন সিস্টেম) থেকে ইমেলটা পেলাম। প্রথমে নিজের চোখকেই বিশ্বাস হয় নি। এখন মনে হচ্ছে, না আসলেই সত্যি।
কিছুদিন থেকেই মনে হচ্ছিলো, এই গ্যাস ইস্টিসনেই কাজ করতে করতে বুঝি জীবনটা যাবে। গত পর পর দু’ বৎসর চেষ্টা করেও রেসিডেন্সি পাই নি। অবশেষে উপরওয়ালা চোখ তুলে তাকিয়েছেন। ক্যালিফোরনিয়ার এপেল ভ্যালির হাইওয়ে ১৮-র পাশে এই দুর্গম এলাকায় গাড়ী খুব একটা আসে না বললেই চলে। গ্যাস ইস্টিসনের মালিক ইরানিয়ান, দারুন এক লোক। জীবনে খুব খাঁটা-খাঁটুনি করেছে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন জায়গায় তার গ্যাস ইস্টিসন, প্রত্যেক ইস্টিসনে একজন করে ম্যানেজার বসানো আছে, প্রত্যেক সপ্তাহে অটোমেটিক তার একাউন্টে টাকা জমা হয়ে যায়। আগের ম্যানেজারের কাছে শুনেছি মালিক নাকি এই দেশে চলে আসেন ছোট বেলায়। ইরানের শাহ’র আমলে এসে পলিটিকেল এসাইলাম চেয়ে আমেরিকায় আশ্রয় পায়। প্রথম দিকে জীবনে অনেক পরিশ্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। কোনো কারনে কেন যেন বিয়ে করে নি। কোনো ছেলে-মেয়েও নেই। বর্তমানে তার অর্ধেক বয়সী এক গ্রীক মহাসুন্দরীকে নিয়ে লিভ টুগেদার করছে। শোনা যাচ্ছে বিয়ে করলেও বিয়ের আগে নাকি চুক্তিনামা করে নেবে যাতে ডিভোর্স হলেও সম্পত্তির উপর হস্তখেপ করতে না পারে। আর সম্পত্তির লোভে তার সাথে কোনো সম্পর্ক না করে। চাকরীর দু’বৎসরে মাত্র একবার মালিককে দেখেছি, তাও দু’ সপ্তাহের মাথায়। একদিন এশটন্’মারটিন ডিবি-সেভেন নিয়ে এক পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক আসে এই গ্যাস ইস্টিসনে। ফজল ভাই’ ই প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন গ্যাস ইস্টিসনের মালিক মনসুর কাদেরীর সাথে।
ফজল ভাইঃ স্যার, আমার দেশের ছেলে, ডাক্তার, খুব ভালো, এ দেশে এসে খুব বিপদে পড়েছে, করার মতো কোন কাজ খুজে পাচ্ছে না। কোনো বদ অভ্যাস নেই। তাই সাথে করে নিয়ে এসেছি। আমি দেশে ছুটিতে গেলে এখানে গ্যাস ইস্টিসনটা ও ই দেখবে, আমি সব বুঝিয়ে দিয়েছি।
মনসুর কাদেরী তার রিমলেস রে’বান সান-গ্লাস নামিয়ে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে আমাকে একবার আপাদ মস্তক দেখে নিল। ততক্ষণে মনসুর কাদেরীর সঙ্গিনী গ্রীকদেবী গাড়ী থেকে নেমে তার পাশে এসে দাড়িয়েছে। মনসুর কাদেরী একটু ভ্রু কুচকে কি যেন ভাবল। আড় চোখে গ্রীকদেবীকে একবার দেখে ফজল ভাইকে বললঃ ও কে বেতনের ব্যাপারে কিছু বলেছ?
আমি ফজল ভাইকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললামঃ স্যার, বেতনের ব্যাপারে আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই, আমাকে শুধু এই দেশে থাকার জন্য ভিসার বন্দোবস্ত করে দিন।
প্রথমে কয়েক মুহূর্ত ভাবলেশহীন থাকলেও মুখে ম্লান হাসি এনে ফজল ভাইকে বললঃ হেড অফিসে ফোন করে ওর জন্য ওয়ার্ক পারমিট করতে বলো।
এত সহজে রাজি হওয়াতে ফজল ভাই আর আমি, দুজনই খুব অবাক হলাম। হয়ত গ্রীকদেবীর সামনে কঠোর হতে চায়নি। সংগিনীর সামনে ঊদারতা দেখাবার একটা মোক্ষম সু্যোগ দেখাতে পেরে মনসুর কাদেরী নিজেও বেশ খুশি হলো বলে মনে হোল।
ফজল ভাইয়ের সাথে মাত্র দু’ বৎসর আগে লস্এঞ্জেলেসের বাংলাদেশী দোকানে পরিচয়। আলাপ পরিচয়ে আমার হতাশা আর বিপদের কথা শুনে গ্যাস ইস্টিসনে ঊনার সাথে জয়েন করার প্রস্তাব দেন। আমিও না করলাম না। গ্যাস ইস্টিসনেই আমার থাকার ব্যবস্হা হোলো। সামনের রুমে অফিস কাম ক্যাশ-কাঊন্টার, পিছনে বেড-রুম, সাথে এটাচড্বাথ্রুম। এপেল ভ্যালির এই দুঃসহ গরম আর নিঃসংগতায় একমাত্র সান্ত্বনা এয়ার-কন্ডিস্ন যা সারাক্ষণই চলছে। ফজল ভাইয়ের কাছ থেকে হাল্কা রান্না-বান্নাও শিখে নিলাম। ফজল ভাই অনেক চেষ্টা করেও এদেশে ঊনার স্ত্রী আর বাচ্চাকে আনতে পারেননি। বার বার ভিসা প্রত্যাখান। আমার সাথে দেখা হবার তিন চার দিনের মাথায় চলে গেলেন, যাবার সময় শুধু বলে গেলেন ক্যাশ যাতে কখনো ঊনিশ-বিশ না হয়, মালিক মূহুতেই বুঝতে পারবে। এর পর থানা পুলিশ করে একদম জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বেন। এর আগে অনেকেরই চাকরি গেছে এ কারনে। ফজল ভাই, ভাবী আর বাচ্চা নিয়ে আবারও এমব্যাসিতে দাড়াবেন, অশ্রু-সজল চোখে দোয়া করতে বলে বিদায় নিলেন। মাত্র এ কয়েক দিনেই যে এতটা আপন করে নিলেন, আমারও খারাপ লাগছিল। ফজল ভাইয়ের সাথে সেটাই আমার শেষ দেখা। পরে বাংলাদেশ থেকে খবর এলো, ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ যাবার পথে বাংলাদেশের আজরাইল ‘বাস-ট্রাক’এর সংঘর্ষে এ অমায়িক শান্তশিষ্ট মানুষটা অপর পাড়ে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছেন। ওনার স্ত্রী আর বাচ্চাদের আর আমেরিকা আসা হল না। এই যে দেশের এতগুলি মানুষ প্রতিদিন সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে, পরিবারের পর পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার জন্য কারো কোন চিন্তা ভাবনা নেই। সড়ক জনপদ বিভাগ বা সংশিষ্ট কতৃপক্ষ এতই বেহায়া, নিজেদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা মেনে নিয়ে পদত্যাগ করে যোগ্যতর কাউকে সুযোগ দিতে তারা নারাজ। বাংলাদেশেকে ভাংগা’দেশ বানিয়েও এরা নিস্তার দেয় নি, প্রতিনিয়ত চুষে চলেছে। ফজল ভাইয়ের কাছে চির কৃতজ্ঞ হয়ে থাক্লাম আমার এ বিপদে পাশে এসে দাড়ানোর জন্যে।
আজ সকাল থেকেই তেমন কোনো কাস্টমার নেই, অবশ্য অনেক যে আসে তাও না। এই প্রাক্তন হাইওয়েতে অনেক বেশি গাড়ীর আনাগোনা নেই। ভাগ্য ভালো ইন্টারনেটের কানেকশনটা ছিল। সারাদিন ফেইস-বুক, ইমেল আর ইন্টারনেট সারফিং করে সময়টা মোটামুটি ভালোই কেটে যায়। একলা থাকতে থাকতে কেন যেন আজকাল একাকিত্তটাকেই বেশী ভালো লাগে। কিন্তু আজ আর কিছুতেই একলা থাকতে ইচ্ছে করছে না। আসিফ আর ফারুক ভাইকে ফোন করা দরকার। আমার পাশের শহর বারষ্ট’তে থাকে, প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল দূরে। কিন্তু আমেরিকাতে এটা কোনো দূরত্বই না। এখানে মানুষ হাইওয়েতে ঝড়ের গতিতে গাড়ী চালায়, ঘণ্টায় ৮০ মাইল, সুযোগ পেলে ৯০-৯৫ মাইল তো নরমাল ব্যাপার। ফারুক ভাই তো পুলিশের আনাগোনা কম দেখলে এক্সেলেটার পুরাটাই দাবিয়ে দেবে, অদ্ভুত কাজ পাগল এক লোক। আমি আসিফকে ফোন করলাম।
অনুঃ কিরে অনেকদিন ধরে কোনো খোঁজ খবর নাই, বেঁচে আছিস, না মরে গেছিস?
আসিফঃ গলা শুনে তো বুঝতেই পারছিস বেঁচে আছি, তা তোর খবর কি?
অনুঃ দোস্ত, সলিড খবর আছে, আল্লাহ্র রহমতে আমার রেসিডেনসিটা হয়ে গেছে।
আসিফঃ বলিশ কি? এটা তো জব্বর খবর, সেলি্ব্রেট করা দরকার। ফারুক ভাই শুনলে তো পাগল হয়ে যাবে।
ফোনে আসিফের উচ্ছ্বাস আর খুশী লাগাটা পরিষ্কার অনুভব করতে পারলাম।
অনুঃ তুই এক কাজ কর, ফারুক ভাইকে ফোন কর, কাল পরশু তো শনি আর রবিবার। দুই দিন বন্ধ, চল কেম্পিং-এ যাই, বহু দিন কেম্পিং-এ যাওয়া হয় না।
আসিফঃ ঠিক আছে, আমি ফারুক ভাই আর উনার কেম্পিং গিয়ার নিয়ে ঘন্টা খানেকের মধ্যে তোর দোকানে আসছি। তুই এর মধ্যে কিছু হালাল বার-বি-কিউ’র মাংশ আর খাবার-দাবার তুলে নে।
অনুঃ ঠিক আছে।
আসিফঃ চাচীকে দেশে ফোন করে জানিয়েছিস?
অনুঃ দেশে এখন অনেক রাত, ছোট ভাইকে ইমেল করে দিয়েছি। পরে ফোন করব।
আসিফঃ ঠিক আছে, আমরা আসছি।
হাতে সময় বেশি নেই, সব কিছু তাড়াতাড়ি ঘুছিয়ে নিতে হবে। সেন্টাল এসি আর অফিসের লাইট-টা অফ করে দিয়ে জানালায় ঝুলানো বোর্ডটাতে ‘Closed’ সাইন্টা ঠিক করে দিয়ে বের হয়ে এলাম। অবশ্য যাদের ক্রেডিট কার্ড আছে তারা পাম্পের সাথে লাগানো ক্রেডিট কার্ড চার্জ করেই তেল নিতে পারবে, আমার দরকার হবে না। দোকানের পিছনের দিকে গারাজ, রিমোটে চাপ দিতেই ধীরে ধীরে দরজাটা উপরের দিকে উঠতেই দেখা গেল আমার ‘টিংকারবেল’ পোরশা নাইন-ইলাভেন। ১৯৭৪ সালের মডেল, পুরানো হয়েছে। তাই রংটা ফেইড হয়ে গেছে, দু-এক জায়গায় রং উঠে আরও বেশি পুরানো লাগে। এখনো পরিষ্কার খেয়াল আছে, এপেল ভ্যালিতে আসার পর প্রথম কিছু দিন ফজল ভাইয়ের হোন্ডা সিভিক্টাই চালিয়ে টুক্টাক বাজার করতাম। ভাবিনি গাড়ী কিনব, আর গাড়ী দিয়ে কোথাইবা যাব, নূতন জায়গা, কাউকে তেমন একটা চিনি না। তাছাড়া গাড়ী না থাকলে ইন্সুরেন্স আর তেলের টাকা দু’টাই বাঁচবে। হলোও তাই, ৬ মাস যেতে না যেতেই বেশ কিছু টাকা জমে গেল। একদিন ফজল ভাইয়ের গাড়ীটা জিম্’এর দোকানে নিলাম ইঞ্জিন অয়েল চেইঞ্জ করতে। দেখি জিম পুরানো লক্ক্ড়-ঝক্কড় একটা পোরশা’র নিচে খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন ঠিক করছে। বল্লাম, জিম একটা নূতন গাড়ী কিনো, এই লক্ক্ড়-ঝক্কড় দিয়ে আর কতদিন? জিম বলল, ওটা বুঝলে তো তোমার আর গ্যাস ইস্টিসনে কাজ করা লাগতো না।
জিম এক অদ্ভুত মানুষ, অনেক বড়লোকের ছেলে, লেখাপড়া না করাতে বাবা’র সাথে বনিবনা হয় নি। ওর নেশা ছিল গাড়ী, ইঞ্জিন মডিফিকেস্ন থেকে শুরু করে গাড়ীর এমন কোনো কাজ নেই যেটা সে পারে না। তাই বাবা’র সিলিকন ভ্যালি’র আইটি টেক কোপানি’র বদলে এখন এই এপেল ভ্যালির নির্জন জায়গায় গারাজ দিয়েছে। জিম বলল্, এই পোরশাটার আগের ইঞ্জিনটা চেঞ্জ করে এখন জাঙ্কি-ইয়ার্ড থেকে আনা ২০০৩ সালে’র একটা নাইন-ইলাভেনের টুইন টার্বো ইঞ্জিন লাগিছে। ফলে ইঞ্জিন পাওয়ার এখন স্টক ১৭৫ হর্স-পাওয়ার থেকে বেড়ে গিয়ে ৪২০-এ দাড়িয়েছে। তারপর রেন্টেক কোম্পানির একটা মডিফাইড ইঞ্জিন-চিপ লাগিয়েছে। জিমে’র ধারণা ইঞ্জিন পাওয়ার এখন কম করে হলেও ৬৫০ হর্স-পাওয়ার।
কাজ শেষ করে জিম তার সবকটা দাঁত করে বলল, ‘দিস্ইজ এ উলফ ইন-এ শিপস্লেদার’ , তা চালিয়ে দেখবে নাকি? আমি বাবা’র ছোট টয়োটা স্টারলেটা চালিয়ে গাড়ী চালাতে শিখেছি। আমারও একটু গাড়ীর নেশা আছে। তাই জিমে’র অফারটা লুফে নিলাম। তা ছাড়া জীবনে কোনো দিন পোরশা চালাই নি। গাড়ীর ভিতরে ঢুকেই দেখলাম, খুবই ছোট আর কঞ্জেস্টেড, বেসিক স্টিয়ারিং, ৬-স্পিড গিয়ার আর রদ্দি-আমলের ডেশবোর্ড। এমন কি একটা এসি বা সিডি-প্লেয়ার পর্যন্ত নেই।
জিম ডেশবোর্ডে হাত বুলিয়ে অহংকারের ভংগিতে বলল, এটা হচ্ছে আসল ‘ড্রাইভার’স কার’। স্টার্ট দেবার পর ইঞ্জিনের শব্দটা একটু ভিন্ন মনে হল। চালাতেই বুঝলাম এটা সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জন্তু, অসম্ভব রকমের এক্সেলারেস্ন্। শূন্য থেকে ৬০ মাইল স্পীড ঊঠতে সময় লাগে মাত্র চার সেকেন্ডেরও কম। প্রিসাইস্ স্টিয়ারিং, কর্নারিং, পাওয়ারফুল চার-ক্যালিপার ব্রিমবো ব্রেক কোনো কিছুরই কমতি নেই এই গাড়ীতে। শুধু নেই কোনো লাক্সারী।
আমার চালানোর ভঙ্গি আর উৎসাহ দেখে জিম বলল্, কি বলেছিলাম না ড্রাইভার’স কার, তা কেমন লাগছে?
আমি জোক্করে বললামঃ তা এই সেক্সি-বেবি’র জন্য তোমায় কত দিতে হবে?
জিম তার হাসি আরও প্রসস্তত করে বললঃ নূতন একটা প্রজেক্ট-কার পেয়েছি, ওটার জন্য টাকা লাগবে। তুমি চাইলে এটা তোমার জন্য পাঁচ হাজার।
পাঁচ তো দূরের কথা, আমি পারলে দশ দিয়েও এ গাড়ী নিতে রাজী। তারপরও একটু কপট অনিচ্ছা ফুটিয়ে বললাম, দেখো, আমার এখন গাড়ীর তেমন কোনো প্রয়োজন নেই, তবে তুমি চাইলে আমি এখনই তোমাকে চার হাজার দিতে পারি। জিম তাতেই রাজী হলো। পরে জিমে’র সহায়তায় ফজল ভাইয়ের গাড়ীটা বিক্রি করে ওনার স্ত্রীর কাছে টাকাটা পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছিলাম।
এই গাড়ীটা রাস্তায় কোনো দিন আমায় ছোট হতে দেয় নি। কত মারসিডিস এ এম জি, বি-এম-ডাব্লিউ এম-থ্রী’র সূতা বের করে দিয়েছি তার ইয়াত্তা নেই। আজ পর্যন্ত যত বারই চালিয়েছি ততবারই জিমে’র সেই প্রশস্থ হাসি আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। আজও টিংকারবেলকে নিয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটে গেলাম পাঁচ মাইল দূরে বাসামের দোকানে। বাসাম ইরাকী, আমাদের এই এলাকার এক মাত্র হালাল মাংসের দোকানের মালিক। ওর ছাগলের মাংসের মেরিনেইট করা কাবাব এই এলাকার সেরা, এর চেয়ে মজাদার কাবাব কোথাও খেয়েছি বলে মনে পরে না। চিকেন আর ছাগলের মাংসের মেরিনেইট করা কাবাবের মাংস নিয়ে আবার ঝড়ের গতিতে ছুটে এলাম গ্যাস ইস্টিসনে। কিছু কাপড়-চোপড় আর প্রয়োজনীয় টয়লেট্রিজ্গুছিয়ে নিতে নিতেই আসিফ আর ফারুক ভাই গ্যাস ইস্টিসনে পৌঁছে গেলেন।
দুজনই আমাকে জড়িয়ে ধরে কনগ্রেচুলেট করলো। ফারুক ভাই বলল, তা তোমাকে তো এখন আমাদের ছেড়ে যেতে হবে। আমি বললাম, এখনো দেরি আছে, আরও চার মাস পরে রেসিডেনসি শুরু হবে। আসিফের চোখের কোনার একটু পানি লুকাতে চেষ্টা করেও পারলো না। আমি আর আসিফ একদম ছোট বেলার বন্ধু। সেই ক্লাস থ্রী থেকে একসাথে পড়ছি। অসম্ভব রকমের মেধাবী। আমার দেখা বেষ্ট আর মোষ্ট টেলেন্টেড পারস্ন কিন্তু একটু স্ক্রু ঢিলা। প্রায় একই সময়ে আমেরিকায় আসা। আমার আর ওর মধ্যে লুকাচুরির কিছু নেই। দুজনই দুজনের ঘাটের খবর রাখি।
ফারুক ভাই বলল, চল আর সময় নষ্ট না করে আমরা রওনা হয়ে যাই, অনেক দূরের পথ, সন্ধ্যার আগেই পৌঁছাতে হবে। আমরা ফারুক ভাইয়ের টয়োটা ফোর-রানারের পিছনে সব জিনিষপত্র তুলে রওনা হলাম। গন্তব্য এনযা-বরিগো ডেযার্ট ফেলে আরও বিশ মাইল দূরে ফন্ট-পয়েন্ট। মোট ১৮০ মাইল। যেতে হয়ত ৩ থেকে ৪ ঘন্টার মত লাগবে।
গল্প করতে করতে আমরা মরুভূমির উপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম। মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাহাড়ের পাশ ঘেষে আঁকাবাকাঁ রাস্তা দিয়ে যেতে বেশ লাগছিল। আমেরিকার মরুভূমি আর সাধারণ মরুভুমি বলতে আমরা যা বুঝি তার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। মরুভূমিতে সাধারণত থাকে মাইলের পর মাইল বালির পাহাড়। আর এখানে আমেরিকার মরুভূমিতে শুধু নূড়ি আর পাথর, ছোট ছোট গাছ-পালা, মাঝে মাঝে পাথরের টিলা-পাহাড়।
আমরা তিনজন যখনই একসাথে হই তখন একজন আরেকজনকে গুঁতানোর একটা প্রবনতা লেগেই থাকে। ফারুক ভাই পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। বিশাল বড়লোকের এক্মাত্র জামাই কিন্তু অত্যন্ত আত্মসচেতন লোক। তাই এই দেশে এসেছেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, ভাবীও অত্যন্ত আমায়িক, খুব সুন্দর গান করেন।
আসিফ একটা বায়োটেক কম্পানিতে কাজ করছে। থাকে এক বৃদ্ধ-আমেরিকান দম্পত্তির সাথে একটা শেয়ার করা বাসায়। এতে থাকার খরচ অনেক কম পড়ে। এই আমেরিকান দম্পত্তি আসিফকে নিজের সন্তানের মতই স্নেহ করেন। আসিফ শখের বশে মাঝে মাঝে রান্না-বান্না করতে খুব পছন্দ করে। খাসির মাংসের রেজালা, গরুর ভুনা মাংস, ডাল, ভাত এই গুলি খেয়ে খেয়ে এই আমেরিকান দম্পত্তি এখন আমেরিকান খাবারের চেয়ে বাংলাদেশী খাবারই বেশি পছন্দ করেন। তাই আসিফের মহা ভক্ত। আসিফের প্রতিবেশী সুজান। মাত্র ঊনিশ বছর বয়সী ভীষণ রূপবতী এই কলেজ ছাত্রী শুধু রূপে নয়, তাইকোয়ন্ডোতেও ব্লেকবেল্ট। কোনো এক অজানা কারনে আসিফকে সুজানের ভীষন পছন্দ যা আজও ফারুক ভাই আর আমার কাছে রহস্য। আসিফ, সুজানের ঠিক উল্টো, শ্যামলা, একটু মোটার ধাচের আর ভীষন চুপচাপ টাইপের। সবচে অদ্ভুত ব্যাপার আসিফ সুজানের ব্যাপারে একেবারেই নির্লিপ্ত। আর আসিফের এই নির্লিপ্তাই মনে হয় সুজানের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে যা হারতে সে মোটেই রাজী নয়। সুজানের গত বার্থডেতে সুজানের এক বান্ধবী আসিফকে হাই-হ্যালো বলছিলো, মনে হয় একটু লাইন মারারও চেষ্টা করছিলো। তা নিয়ে সুজান আর তার বান্ধবীর মধ্যে লংকাকান্ড বেঁধে গেলো। এক পযায়েবান্ধবীর চুল ধরে টেনে-হিচঁড়ে বাসা থেকে বের করে দেয়। এরপর থেকে সুজান আসিফের অঘোষিত গার্লফেন্ড হিসাবে এলাকায় আধিপত্য বিরাজ করে রেখেছে।
সুজানের লেটেস্ট আপডেটঃ প্রায় মাসখানেক আগে আসিফের বাসার সামনে বারান্দায় বসে আমরা আড্ডা মারছিলাম, সাথে চা আর সিগারেট চলছিলো। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ওয়াল্টনের নিষেধ বাসার ভিতরে সিগারেট খাওয়া যাবে না। এ সময় পাশের বাসা থেকে সুজান বের হয়েছে জগিং করতে সেন্ডো গেঞ্জি পরে। আমাদের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে আরেকটু এগুনোর পর বিপরীত দিক থেকে আসা তিন জন স্পেনিশ পান্ডা টাইপের ছেলে মনে হয় তাকে কোনো কটূ মন্তব্য করলো। সুজান ঘুরে ফিরে এসে তিনজনের সামনে দাড়ালো। কথোপকথন এখান থেকে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে না, তবে বুঝতে পারছি কিছু কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আমরা মজা দেখার জন্য আরও ঊৎসুক হয়ে দেখতে লাগলাম। তারপর যা ঘটলো তা আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। হঠাৎ দেখলাম সুজান বাঁ পাশের প্রথম ছেলেটাকে সজোরে একটা চপ্বসিয়ে দিলো গলা লক্ষ্য করে। ওর ডান পায়ের কিক্টা যেয়ে লাগলো দ্বিতীয় জনের মিড্সেক্সনে। ব্যাথায় বসে পড়ার আগেই ডান হাতের ফুল ব্লো’টা ছেলেটার মুখে আঘাত করলো। দু’জনই হাটুঁর উপর বসে পড়লো। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা এত দ্রুতগতিতে ঘটলো যে তৃতীয়জন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উল্টা ঘুরে দৌড় দিলো। আমরাও হঠাৎ বিষম খেলাম। আমি সিগেরেটে টান দিতে ভূলে গেলাম, আর আসিফের হাত থেকে চা পড়ে ওর প্যান্টের একটা বিশেষ জায়গা ভিজে গেল। আমরা দুজনই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ব্যাপারটা অনুসন্দ্বান করার জন্য সামনে এগিয়ে গেলাম।
সুজানকে জিজ্ঞেস করতেই শুধু বললোঃ আই এম ফাইন। এরপর আসিফের প্যান্টের দিকে তাকিয়ে মুচ্কি হেসে চলে গেল। আসিফ নিজের প্যান্টের দিকে তাকিয়ে নিজেও খুব লজ্জা পেলো। এ ঘটনার পর সুজানকে নিয়ে আর আমাদের মধ্যে আর কথা হয় নি। তবে আজ একটু ক্ষেপানো যাবে। আমিই কথা তুললাম।
‘তা, আসিফ সুজানের খবর কি?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘আমি কি করে বলবো, আসিফ জবাব দিল।
‘তোর গার্ল-ফ্রেন্ড, ওর খবর তুই জানবি নাতো আমি জানবো?’ আমি টিপ্পুনি কাটলাম।
‘দেখ, ফাজলামো করবি না’ আসিফ একটু ক্ষেপে বললো।
ফারুক ভাই গাড়ী চালাতে চালাতে মুচকি মুচকি হাসছেন, বললেন ‘আহ্ওকে বিরক্ত করছো কেন? তা আসিফ মেয়েটা যখন তোমাকে এতই পছন্দ করে তা ওকে বিয়ে করছো না কেন? অমন একটা ভালো মেয়ে তুমি কোথায় পাবে?’
আমি বললাম, ‘ও আসলে বঙ্গ-ললনা ছাড়া বিয়ে করবে না। আন্টি ওর হাড্ডি ভেঙ্গে দেবে আমেরিকান মেয়ের সাথে এফেয়ার করলে।
ফারুক ভাই বল্লেন, ‘আন্টিকে ভালো করে বুঝিয়ে বল্লেই হবে, উনি বুঝতে পারবেন’
আমি বললাম, ‘ওর ঐ সাহস থাকলে তো কাজই হতো, ঐ কাজটা শেষ পর্যন্ত আমাকেই করতে হবে’
আসিফ আরেকটু ক্ষেপে গেলো বলল, ‘তোর এত বিয়ের খায়েশ থাকলে তুই কর।
‘দোস্ত, আমি রাজী, এরকম একটা তাইকোয়ান্ডো জানা বঊ থাকলে জীবনে সেইফ্টি নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না’ আমি আরেকটু ক্ষেপানোর জন্য বললাম।
ফারুক ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেনঃ এই তোমরা থামো তো। ভালো খারাপ সব দেশের মেয়ের মধ্যেই আছে। তুমি যখন এই দেশেই আছো, এখানকার মেয়ের সাথেই তোমার ভালো এডজাস্ট হবে। তা ছাড়া দু’জনের মধ্যে ভালো এডজাস্ট হলে, পারস্পারিক শ্রদ্বা আর বিশ্বাস থাকলে সব দেশের মেয়ের সাথেই ভালো সুন্দর সম্পর্ক হতে পারে’।
আমি বললাম, ‘কিন্তু ফারুক ভাই, সুজানের সাথে আসিফের কখনো ঝগড়া লাগলে, ও কিন্তু আসিফকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলবে’।
ফারুক ভাই আর আমি দু’জনই উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। আসিফ মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ফারুক ভাই গানের ভলিউমটা একটু বাড়িয়ে দিলেন। রাহার ফতেহ্আলী খানের গান, তেরি ঈষক্পে, তেরি রুহ্পে বাস্এক হক্হে মেরা………
এভাবে নানা ঠাট্টা আর হাসি তামাসার মধ্যে দিয়ে আমরা এক সময় এনযা-বরিগো পৌঁছে গেলাম। পথে ১৫ মিনিটের জন্য ম্যাকডোনাস্এ নেমে টয়লেট সেরে, কফি খেয়ে একটু চাঙ্গা হয়ে নিলাম। আরও পনের-বিশ মাইল যাবার পর মেইন রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে বালির রাস্তা ধরে অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে আমরা ফন্ট-পয়েন্ট পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। ফন্ট-পয়েন্টের শেষ মাথার গাড়ী পার্ক করে গাড়ী থেকে সমস্ত জিনিষ পত্র নামালাম।
প্রকৃতির এক নৈস্বরগিগ এই ফন্ট-পয়েন্ট। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া বৃষ্টির পানির স্রোতে হাজার বছরে সৃষ্টি হয়েছে প্রায় এক মাইল গভীর বিশাল গিরিখাদ। এই মাথা থেকে ঐ মাথা প্রায় ৩ মাইল চওড়া। আমরা জিনিষ পত্র নিয়ে আঁকাবাঁকা পাথুরে রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে থাকলাম। প্রায় আধা ঘন্টা নামার পর আমরা শেষ পর্যন্ত নীচে পৌঁছলাম। এ টুকু পথ নামতে যেয়ে আমরা ঘামে ভিজে গেলাম। পরিস্কার একটা জায়গা বেছে আমি আর ফারুক ভাই টেন্ট লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। আসিফ কিছু পাথরকে গোল করে সাজিয়ে মাঝখানের জায়গায় কিছু শুকনো কাঠ দিয়ে চমৎকার একটা ফায়ার প্লেস বানিয়ে ফেললো। এখান থেকে লেইক্টা খুব বেশী দূরে নয়। বড় জোর মিনিট পাঁচেকের পথ। ঠান্ডা শীতল পানিতে হাত মুখ ধুয়ে আমরা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। টাওয়েল ভিজিয়ে গা’টা মুছে নেওয়াতে আরও একটু বেশি ভালো লাগছে। সন্ধ্যা পার হয়ে ততক্ষনে আঁধার নামতে শুরু করেছে। এই দিকটাতে কখনো কেউ ক্যাম্পিং করতে এসেছে বলে মনে হয় না। এই দিকটায় আমাদেরও এই প্রথম আসা। রাত নেমে আসলেও চাঁদের হালকা আলোতে এতটা অন্ধকার লাগছে না। চাঁদের আলো পানিতে পরে পানিগুলো কেমন যেন প্রশান্তময় করে তুলেছে। গভীর টলটলে নীল পানিতে হালকা নিলাভ চাঁদটাকে খুবই মায়াবি লাগছে। মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। খুব ইচ্ছে করছে পানিতে নেমে চাঁদটাকে ধরি। শীতল পানিতে গা ভিজিয়ে সমস্ত জ্বালা যন্ত্বনা ভুলে যাই। অচেনা জায়গায় যদি কেউ সাথে থাকে তবু থাকা যায় কিন্তু অচেনা পানিতে নামতে আমার সারা জীবনের ভয়, মনে হয় এই বুঝি কিছু একটা এসে আমার পা টেনে ধরবে। ছোট বেলার এই ভয় আমি জীবনে কোনোদিন কাটাতে পারবো বলে মনে হয় না। ফারুক ভাইয়ের কথায় টনক্নড়লো। আমরা আধোঁ-জ্যোৎস্নাতে কেম্পে ফিরে এলাম।
এতক্ষণে বুঝতে পারছি আমরা সবাই অনেক ক্ষুধার্থ। আসিফ ফায়ারে প্লেসের আগুনটা আরও কিছু নূতন কাঠ দিয়ে একটু উস্কে দিলো। সেই আগুনে আমরা তিন জনই সাথে আনা শিক্এ ছাগলের মাংসের টুকরা গেঁথে গেঁথে চমৎকার শিক্কাবাব বানিয়ে ফেল্লাম। একই ভাবে কিছু টমেটোও বার-বি-কিউ করে ফেল্লাম। সাথে আনা রুটি একটু আগুনে শেঁকে সাধারনের মধ্যেও অসাধারন ডিনার সারলাম। বাসেম্ব্যাটার আসলেই তারিফ করতে হয়, তার সিক্রেট রেসিপিটা একদিন কৌশলে জানতে হবে।
ফারুক ভাই বললেন, দারুন স্বাধের কাবাব হয়েছে আজকে। সাথে একটু ডিংকস্থাকলে আরও ভালো হতো। আসিফ আমাদের সাপ্লাই তাবু থেকে এক কেইস কোক নিয়ে এলো, সাথে তিনটা বিয়ার। আমি আর ফারুক ভাই দুজনের কেউই বিয়ার খাই না। আসিফ মাঝে মধ্যে একটু আধটু পান করে কিন্তু অন্যদিকে হালাল মাংস ছাড়া খাবে না। তার এই ব্যাপারটার কারন কি তা আমি আজ পর্যন্ত ধরতে পারি নি।
অসাধারন সুন্দর একটা রাত। গভীর নীলাভ আসমানে হালকা জ্যোস্নায় আকাশের তারাগুলো আস্তে আস্তে ফুটে উঠে একটা স্বপ্নীল পরিবেশ তৈরী করেছে। আমরা নিভু নিভু আগুনের পাশ ঘিরে টুক্টাক গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকাটা কেমন যেন নেশার মত, সহজে চোখ ফেরানো যায় না। তাই মনে হয় আদিম কালে আগুনের সৌন্দরয্য আর শক্তিতে মানুষ অভিভূত হয়ে পূজা করতো।
এখানে আসার পর থেকে কেমন যেন একটা অজানা অস্বস্তিতে মনটা ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন দূর থেকে আমাদের খুব লক্ষ্য করছে। আমার সিক্সথ্ সেন্স তো দূরের কথা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ই ঠিক মত কাজ করে বলে মনে হয় না। অথচ্আজ কেনো যেন মনে হচ্ছে সত্যিই কেউ অন্ধকার থেকে আমাদের খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছে। দূরে তাকালে যতদূর দেখা যাচ্ছে তাতে কিছুই চোখে পড়ছে না, কিছু হালকা ঝোপ-ঝাড় ছাড়া। একটু একটু ঠান্ডা হাওয়াও বইতে শুরু করেছে। ফারুক ভাই উনাও স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে গেলেন। ঠিক দু’মিনিটের মাথায় নাক ডাক্তে শুরু করলেন। আমি আর আসিফ স্লিপিং ব্যাগের উপর শুয়ে গল্প করতে লাগলাম। অদ্ভুত সুন্দর একটা রাত। আজ আমরা খোলা আকাশের নীচে ঘুমাব তারার চাদর জড়িয়ে। আসিফ অনেকক্ষন ধরে চুপচাপ।
আমি বললাম, খালাম্মাকে সুজানের কথা বলব?
আসিফ নিরুত্তর, ঠিক বুঝতে পারছি না মৌন সম্মতি নাকি ইচ্ছে করে এ ব্যাপারে এখন কথা বলতে চাচ্ছে না। থাক্, আমারও এখন আর কথা বলতে ভালো লাগছে না।
এমন সুন্দর একটা রোমান্টিক রাত, আজ ইচ্ছে করছে আজ সারারাত ধরে তারার লুকাচু্রি দেখি। কেন যেন জেরিনের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। জেরিন আমার জীবনের প্রথম প্রেম। মেডিকেলের পঞ্চম বর্ষে ওর সাথে আমার পরিচয় অনেকটা কাকতালীয় ভাবে। ভাবি নি আমাকে দিয়ে কখনো প্রেম হবে। প্রেমের জন্য যা ইমোশান, ফুল-কবিতা ইত্যাদি ভালো লাগার ব্যাপার আছে তা আমার মধ্যে কোনদিনই ছিল না। কবিতা আমার কাছে বিষের মত লাগত। অবশ্য কোনো দিন ভালো করে শুনাও হয়নি।
একদিন শনিবার ছুটির দিনে দুপুর বেলায় কমনরুমে গেলাম টেবিল টেনিস খেলতে। এই সময়টাতে সাধারণত কমনরুমে কেউ থাকে না। আমার পাশের রুমের কাজল ভাই আসার কথা আমার সাথে খেলার জন্য। কাজল ভাই দারুন টেবিল টেনিস খেলেন। অবশ্য উনি যেই খেলাই খেলেন না কেন অসাধারণ খেলেন। কিছু কিছু লোক মনে হয় জন্মগতভাবেই ভালো খেলার জিন্নিয়ে জন্মায়। কাজল ভাই তাদের মধ্যে একজন। আমি মোটামুটি খেলি। কমনরুমে ঢুকে দেখি কাজল ভাই তখনো এসে পৌছান নি। একটা মেয়ে টেবিল টেনিস ব্যাট হাতে নিয়ে নাড়াচারা করছে। আর কেউ কমনরুমে নেই। মেয়েটাকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। অবশ্য এপ্রোন ছাড়া অনেক সময় পরিচিত জনকেও অপরিচিত লাগে।
আমি কাজল ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করব নাকি চলে যাব এই নিয়ে দোনোমনো করছিলাম। তার মধ্যে মেয়েটা সুন্দরী হওয়াতে অস্বস্তিটা আরও বেশী লাগছিল। চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই মেয়েটা বলল্, ভাইয়া খেলবেন? এ রকম রিকোস্টে আমি ভীষন চম্কে গেলাম। ভিতরে ভিতরে যে এই সুন্দরীর সাথে পরিচিত হবার ইচ্ছে ছিল না তা নয়, নিজের আড়ষ্ঠতার জন্যই পারছিলাম না। সুযোগটা যখন নিজ থেকেই এলো মনে মনে একটু খুশিই হলাম। খেলার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছিল, জানালো সেকেন্ড ইয়ারে পরে, সামনে ফার্স্ট প্রফেশনাল পরীক্ষা, নাম জেরিন, চিটাগাং-এর লোকাল। বাসায় থাকে। সে জন্যই হয়ত চিনতে পারি নি। হোষ্টেলে থাকলে এতদিনে চেনার কথা। এরকম একটা সুন্দর মেয়ের সাথে এভাবে দেখা হবে, এত সহজে আলাপ পরিচয় হয়ে যাবে…ভাবতেই পারছিলাম না। কেমন যেন একটা ঘোর, স্বপ্ন স্বপ্ন ভাবের মধ্যে ছিলাম। খেলাতে খুব একটা মন ছিল না, খেলার ফাঁকে ফাঁকে জেরিন্কে দেখ্তেই ব্যস্ত ছিলাম বেশী। তাই মিস্করছিলাম অনেক। তাতে আমার কোন আক্ষেপ নাই, সে দিকে মনও নাই। চমৎকার গায়ের রং, একটু নয়, বেশ ফর্সাই বললেই যথার্থ হবে, তার উপর আবার স্লিম। লম্বা কালো চুল, তার মধ্যে আবার নেচারাল ওয়েভ, বার বার ওর মুখের উপর এসে পড়ছিলো। সে জন্য মনে হয় আরও বেশী ভাল লাগছিল। ভাবছিলাম জেরিনের সৌন্দয্যের মধ্যে কোথাও কোন খুঁত নেই কেন? ওর খেলার ভঙ্গিতে একটা ভীষন ভালো লাগা স্টাইল ছিলো। খেলার চেয়েও বেশী আমি ওর সৌন্দয্যের কাছে হেরে গেলাম।
আমাকে হারাতে পেরে ওর আনন্দ আর উৎসাহ দ্বিগুন ছাড়িয়ে মনে হয় সরাসরি চারগুনে চলে গেলো। সিনিওর্কে হারানোর মধ্যে একটা অন্য রকম আনন্দ আছে। জেরিন তা পুরাদমে উপভোগ করছে। মুখের হাসি কিছুতেই বন্ধ করতে পারছিলো না। ওর এই উৎফুল্লতা আমিও খুব এঞ্জয় করতে লাগলাম। এই হারাতেও অনেক আনন্দ। প্রায় ঘণ্টা খানেক টেবিল টেনিস খেলাতে দুজনই বেশ ঘামিয়ে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া গল্প করার লোভটা সামাল দিতে না পারার কারনে আমাকে হারানোর পুরষ্কার হিসাবে কোল্ড ড্রিঙ্কস্খাওয়ানোর প্রস্তাব দিলাম। প্রথমে যেতে রাজী না হলেও পরে আবার ঝাল্বিতানে যেতে রাজী হলো। কোল্ড ড্রিঙ্কস্এর পর চা-সিঙ্গারার সাথে হালকা আড্ডাও চলছিল। অবশ্য রোমান্টিক কোন গল্প নয়, সবই পড়াশুনা সংক্রান্ত। ও ফার্স্ট প্রফেশনাল পরীক্ষার ইনপোর্টেন্ট বিষয় গুলি বুঝিয়ে দেবার ব্যাপারে সাহায্য চাইলো। ঠিক হলো, আগামী সপ্তাহে ঠিক একই দিনে একই সময়ে কমনরুমে টেবিল টেনিস খেলার পর লাইব্রেরীতে ওকে পড়া দেখিয়ে দিব।
বিকেল বেলার এ সময়টায় হোস্টেলের কম বেশী সব ছেলেই ঝাল-বিতান আর আশে পাশের চায়ের দোকান গুলোতে চা খেতে আসে। লেডিস হোস্টেলের অনেক মেয়েরাও বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে আসে। হোস্টেলের অনেক ক্লাস্মেইট, সিনিয়র-জুনিয়র জেরিন আর আমাকে একসাথে চা খেতে দেখে গেল। জেরিন বিদায় নেবার পর আমি হেঁটে হেঁটে আমি হোস্টেলের পথে রওনা হলাম। হোস্টেলে পৌঁছতেই সিড়ির গোঁড়ায় বন্ধু এরশাদ, রুমি, শরিফ, মিলটন এবং আরো কয়েক জন মিলে আমাকে ছেঁকে ধরল।
এরশাদ বললঃ দোস্ত, ব্যাপার কি?…… খুইলা কয়, কবে থেইক্কা চলতাছে?
আমি বললামঃ কি চলছে, কি ব্যাপার, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মিল্টন বললঃ শালা বুঝ না, চল উপরে, পুরাটা শুনতে হইব, কিছুই বাদ দিতে পারবি না।
আমাকে মোটামুটি টেনে হিচঁড়ে পঁচিশ-বি-তে নেয়া হল। এ রুমটা আমাদের আড্ডার হেড-কোয়াটার। সবিস্তারে সব কিছু বলার পরও কেউ কিছু বিশ্বাস করছে না। শেষে প্রেম-সুচনা’র কাফ্ফারা হিসাবে সবাইকে তুংফং-এ চাইনিচ খাওয়ায়ে সে রাতে আমি নিস্তার পেলাম। চার’শ ত্রিশ টাকা গচ্চা।
তারপর দিন ক্যাম্পাসে সিনিয়র-জুনিয়র সবার কনগ্রেসুলেসনের জোয়ার আমার মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি এনে দিয়েছিল। আমাদের দেশে কেন জানি না একজন আরেক জনকে ভালো করে জানার আগেরই শুধু মাত্র দেখার উপর ভিত্তি করেই প্রেমের ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপন শুরু হয়ে যায়। এটাই রিতি।
যা হোক, আমার আর জেরিনের মধ্যে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ, রিক্সায় একসাথে ঘুরাঘুরি শুরু হয়ে গেল। জেরিন খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারত। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনতাম। রোমান্টিক প্রেমে’র তেমন কোন ডায়লগ আমাদের মধ্যে কখনো আদান-প্রদান হয় নি। হবার প্রয়োজনও ছিল না। একজন আরেকজনের সঙ্গ খুব উপভোগ করতাম। সময় গুলো কিভাবে কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না।
এভাবে চলছিল আমাদের প্রেম। প্রেমের সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায় জেরিনের ২১ তম বার্থডেতে ওকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য একটা সোনার আংটি কিনে গিফট করলাম। অবশ্য সোনার না বলে সোনার পানিতে ধোঁয়া বলাই ভালো। কিন্তু সেটা কিন্তেই আমার জমানো প্রায় সব টাকাই শেষ। ছাত্র জীবনের জমানো বহু কষ্টের সামান্য সঞ্চয়। জেরিন যখন খুব যত্ন করে আংটিটা দোকানেই পড়ে ফেললো তখন নিজেকে অনেক সার্থক মনে হয়েছিলো, খুব ভালো লাগছিলো। প্রেমের সফলতায় উৎসাহ আরও দ্বিগুন বেড়ে গেল।
আংটি দেবার তিন দিনের মাথায় জেরিনের বাসায় এক সন্ধ্যায় আমার ডাক পরলো। জেরিনই ফোন করে আস্তে বলল, ওর বাবা-মা আমার সাথে পরিচিত হতে চান। এ পর্বটা সম্পর্কের একটা পর্যায়ে আসবে জানতাম কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আসবে তা ভাবিনি। তাই খুবই নার্ভাস ছিলাম। আমার সবচে ভালো সার্টটা ২য় বার স্ত্রী-করে, আর মিল্টনের কাছ থেকে একটা প্যান্ট ধার করে দুরুদুরু বুকে ওদের খুলসীর বাসায় হাজির হলাম।
বিশাল বাড়ী, ড্রেস্ট দাড়োয়ান, বয়-বেয়ারা দেখে আরও বেশী নার্ভাস লাগছিলোল। ওরা বড়লোক শুনেছি কিন্তু এতটা বড়লোক সে বিষয়ে আমার কোন ধারনা ছিল না। আমাকে নীচের তলায় ড্রইং বসানো হলো। বয় একটা ট্রলি করে অনেক নাস্তা দিয়ে গেল। এক জনের জন্য দশ জনের খাবার। দুই-তিন রকমের ড্রিঙ্কস-সরবত কোন কিছুই কমতি ছিল না। বয়ের ব্যবহার পর্যন্ত অত্যন্ত অমায়িক। একটু পরে উপর তলা থেকে ওর বাবা-মা একসাথে নেমে এলেন। কিছুক্ষন পর জেরিনও নেমে এসে ওর মায়ের পাশে বসল। কথা বার্তার মূল-বিষয় আমি এবং আমার পারিবারিক অবস্থা। কথাবার্তা না বলে জেরা করা বলাই ভালো। সেটা চলল প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে। জেরার সারাংশ ছিলো, সামান্য সোনার পানিতে ধোঁয়া একটি আংটি দিয়ে আমি জেরিন এবং পক্ষান্তরে তাঁদের পুরা পরিবারকে অপমান করেছি। টাকা না থাকলে ওদের কাছ থেকে নিতে পারতাম। একটা ডাক্তার মেয়েকে তার যোগ্য সম্মান অনুযায়ি অন্তত একটা ডায়মন্ডের রিং দেয়া উচিত ছিল। সমাজে তাদের একটা প্রেস্টিজ আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ কথা হলো, হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিলো তেল আর জলে মিল খায় না। আমি নিরবে সবই হজম করে গেলাম। এতই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে একটা কথাও আমার মুখ দিয়ে বের হলো না। বলতে চেয়েছিলাম, আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা চাকরি করে যা পান তাতে আমাদের মোটামুটি চলে যায়। অতিরিক্ত বিলাশিতা আমাদের সাঁজে না। তা ছাড়া পৃথিবীর সব সম্পর্ক দুই কেরেটের ডায়মন্ডের রিং আর কোটি টাকার বিয়ে দিয়ে শুরু হয় না। যাদের এভাবে শুরু হয়, তাদের সম্পর্কও বেশীদিন টিকে না। এ রকম ভুঁড়ি ভুঁড়ি নজির আছে। দুজন জীবন সাথী যখন সুখ-দুঃখ, আশা-ভালবাসা একসাথে সেয়ার করে ধীরে ধীরে জীবনে এগিয়ে যায়, সে সংসারের ভিত্তি হয় অনেক শক্ত, ইট-সিমেন্টের। টাকার ভিত্তি-প্রস্তর অনেক নড়েবড়ে। আজ আমার কিছু নেই কিন্তু একদিন সব হবে। সবারই হয়। হয়ত প্রতি দু’মাস অন্তর অন্তর ব্যাংকক সিংগাপুর নিয়ে যেতে পারব না কিন্তু জীবনে দু-এক বার পারব।
আমার কিছুই বলা হল না। পারিবারিক বিচারের কাঠগড়া থেকে নামিয়ে জেরিন আমাকে এগিয়ে দিল বাসার গেইট পর্যন্ত। গেইটের কাছে এসে অনেক সাহস জোগাড় করে জেরিনের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলামঃ সরি, সামান্য একটা আংটি’র জন্য এত বড় ঘটনা হয়ে যাবে তা আমি বুঝতে পারি নি। তোমারও কি একই মত?
জেরিন তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ভেবে দেখি, পরে জানাব। খেয়াল করলাম, আমার দেয়া আংটি তখন আর জেরিনের হাতে নেই।
জেরিনের বাসা থেকে বের হয়ে কেন যেন প্রচন্ড কান্না পেয়েছিল। দু’চোখের অশ্রু কিছুতেই ধরে রাখতে পারি নি। একটা দিক অন্তত ভালো যে সন্ধ্যার অন্ধকারে অশ্রু দেখা যায় না। রিক্সা নেবার মত মানসিক অবস্থা তখন আমার ছিল না। খুলসী থেকে মেডিকেল পর্যন্ত সম্পূর্নটা পথ হেঁটে হেঁটে এসেছিলাম। অশ্রুতে আমার সার্টের বেশ কিছু অংশ ভিজে গিয়েছিল। জেরিনের বাবা-মাকে খুব একটা দোষ দেই না। একজন বাবা-মা তার সন্তানের জন্য সবচে ভালোটা চাইবে এটাই স্বাভাবিক। আমারই ভুল, ওর পথে পা বাড়ানো ঠিক হয় নি।
সব ঝাঁকি মানুষকে কিছু একটা শিক্ষা দিয়ে যায়। আংটিটা একটা বাহানা ছিল মাত্র। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম নিজেকে আগে যে ভাবেই হোক প্রতিষ্ঠিত করব। এ ঘটনার পর জেরিন আর আমার মধ্যে আর কোন কথা হয় নি। ক্যাম্পাসে আমাকে দেখলেই এড়িয়ে যেত। আমিও জোর করে দেখা করার চেষ্টা করি নি। কারন আমি সব সময় বিশ্বাস করতাম, এখনো করি, জোর করে আর যাই হোক, কখনও ভালোবাসা হয় না, কোনো সম্পর্ক হয় না।
জেরিন তার ফার্স্ট প্রফেশনাল পরীক্ষা আর আমি ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ছেঁকে’র বড়ই জোড়। আমাকে সার্জারি পরীক্ষায় টেনে ধরল। কিছুতেই পাশ করতে পারলাম না। সবচে বেশী আঘাত পেল বাবা। বাবা তখন সবে মাত্র রিটায়ার করেছে। আশা ছিল, আমি তাড়াতাড়ি চাকরি ধরে সংসারে সাপোর্ট দিব। আমার সেই দিন গুলো ছিল সবচে কষ্টের। কিন্তু এত কষ্টের মাঝেও কখনো অনেকের মত নেশার মাঝে আশ্রয় খুঁজি নি। একটাই লক্ষ্য নিজেকে যে ভাবেই হোক প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেই নেশায় ইউরোপ হয়ে শেষ পর্যন্ত আমেরিকার আসা। আজ এ সব কথা কেন মনে আসছে কে জানে। পরে বন্ধুদের কাছ থেকে খবর পেয়েছি, জেরিন বিয়ে করেছে বিশাল বড়লোকের এক ছেলেকে। বেশ ভালোই আছে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই আছে। জেরিনকেও দোষ দেই না। এই পৃথিবীতে প্রত্যেকেরই অধিকার আছে জীবনকে নিজের মত করে সাজানোর। আমি কি জেরিন্কে ওর মত করে আজ সে যে অবস্থায় আছে সে রকম একটা জীবন উপহার দিতে পারতাম?
সবচে বেশী খারাপ লাগে বাবার জন্যে। আমি আমেরিকায় আসার পাঁচ মাসের মাথায় হঠাৎ একদিন বলা নেই কওয়া নেই বাবা হার্ট-এটাক করে বসল। কাউকে কোন ডাক্তার বা ক্লিনিকের সুযোগ না দিয়ে বাবা মাত্র পনের থেকে বিশ মিনিটের মাথায় আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বাবার জন্য কিছুই করতে পারিনি। পৃথিবীর সব বাবা’রাই বোধ হয় তাই। সন্তানের থেকে কিছু পাবার আশায় বসে থাকে না। পৃথিবীতে সবচে কঠিন মহৌষধ হচ্ছে সময়। সব তীব্র যন্ত্রনাকে এক সময় সহনীয় করে দেয়। এন্যা-বরিগো ডেযারটের আকাশের তারাগুলো কেন আমার অতীতকে সামনে নিয়ে এলো কে জানে। মনটা অনেক বিষন্ন করে দিল। চারি দিকে ভীষন নিশ্চুপ। এমন কি কোন ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক পর্যন্ত নেই। মনে হচ্ছে পৃথিবী বুঝি থেমে গেছে। এক সময় কখন যে ঘুমিয়ে পড়ছি খোলা আসমানের নীচে বলতে পারব না।
ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। আকাশ সবে মাত্র ফর্সা হতে শুরু করেছে। আসিফ আর ফারুক ভাই তখনো ঘুমে। বেলা ৯টা ১০টার আগে উঠবে না। মনে মনে ভাবলাম, বাংলাদেশে এ ভাবে খোলা আকাশের নীচে ঘুমালে নিশ্চত লুংগি সহ হাওয়া করে দিত। হায়রে আমার দেশ। কি ছিল আর কি হয়ে গেলো। থাক এ সব কথা মনে করে এত চমৎকার একটা সকাল মাটি করতে চাই না।
এ রকম অসাধারন সুন্দর সকাল দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মনে হচ্ছে পৃথিবী এইমাত্র গোসল করে সারাদিনের কর্ম-ব্যস্ততার জন্য তৈরী হচ্ছে। চারিদিকে কেমন যেন একটা স্নিদ্ধ ভাব। ভাবলাম এমন সুন্দর পরিবেশে একটু সাঁতার কাটলে মন্দ হয় না। লেকের পানিতে ফ্রেশ হয়ে আসা যাবে। ধীরে ধীরে অলস ভঙ্গিতে অপরূপ প্রকৃতি দেখতে দেখতে লেকের দিকে হাঁটতে শুরু লাগলাম। মনে মনে আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম পৃথিবীকে এত সুন্দর করে বানানোর জন্য। আর আমাকে সেই সৌন্দয্যের কিছু অংশ উপভোগ করতে দেবার জন্য।
ক্যাম্প থেকে পাথরের পাহাড়ের পাশ ঘেঁসে কিছুদূর হাঁটার পর ডান দিকে বাঁক নিয়ে একটা খোলা মত একটা জায়গায় এলাম। এখান থেকে হাল্কা দু-একটা গাছ পালা শুরু হয়েছে। আরেকটু দূরেই বেশকিছু গাছ পালা একসাথে জটলা পাকিয়ে একটা ছোট জংগলের মত হয়েছে। গাছ পালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে লেকের পানি দেখা যাচ্ছে। আরেকটু এগুতেই হঠাৎ চোখে যা পড়ল তা দেখে আমি ভীষণ চমকে গেলাম। অনেকটা ভয়ও পেলাম। সারা গায়ে কেমন যেন একটা শিরশিরে অনুভূতির সাথে সাথে গায়ের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেল। দেখি একটা মেয়ে গাছের ছায়ায় একটা বড়সড় পাথরের উপর বসে আছে। ছায়ার জন্যই হয়ত এতক্ষন চোখে পড়ে নি। এই নির্জন জায়গায় আর যাই আশা করি একজন মানুষ অন্তত আশা করি নি।
হঠাৎ এতটাই ভয় পেলাম যে পা আড়ষ্ঠ হয়ে গেছে। কদম ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে পা বুঝি সুপার-গ্লু দিয়ে মাটির সাথে আটকে রয়েছে। মেয়েটা আমার থেকে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ গজ মত দূরে, লেকের দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারাটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। দুরু দুরু বুকে আরও কয়েক কদম এগুনোর পর খেয়াল করলাম, বেশ পরিপাটি করে ড্রেস-আপ করা করা। রয়েল ব্লু জিনসের সাথে একটা লাইট গ্রীন টি-সার্ট পরা। লম্বা এস্ট্রেইট চুল প্রায় মাঝ পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। চুলের কালারটা একটু ভিন্ন। অনেকটা রৌদে-পড়া তামাটে রং। হঠাৎ এই নির্জন জায়গায় একটা মেয়ে কোথায় থেকে আসতে পারে তা কিছুতেই চিন্তা করে কূলকিনারা করতে পারছি না। একটা লজিকেল সম্ভাব্যতা হল সেও হয়ত আমাদের মত ক্যাম্পিং করতে এসেছে। তবে গতকাল আশে পাশে কোন ক্যাম্প চোখে পড়ে নি। তা ছাড়া এ রকম জায়গায় একটা মেয়ে একলা ক্যাম্পিং করতে আসাটাও অতটা যুক্তিযুক্ত নয়, তবে একদম অসম্ভবও নয়।
যা হোক, ইত্যাদি সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বালি-নূড়ির উপর দিয়ে আরেকটু এগুতেই হাটাঁর শব্দে মেয়েটা এবার আমার দিকে ফিরে তাকালো। দ্বিতীয় বার ধাক্কা খেলাম। একটু নয়, যথেষ্ট সুন্দরী। গায়েঁর রং খুব সুন্দর। সাদা আমেরিকান নয়। স্পেনিশ হতে পারে। আমার দিকে তাকিয়েই একটু মৃদু হাস্ল। প্রত্তোতরে আমিও একটু হাসলাম। এটাই আমেরিকার রীতি। কি জিজ্ঞেস করব, কি দিয়ে কথা শুরু করব তা ভাবতেই মেয়েটি উঠে দাড়াল। তারপর লেকের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। ভারী অবাক হলাম। এভাবে সাধারণত কেউ এদেশে এড়িয়ে যায় না। খেয়াল করলাম মেয়েটা খালি পায়ে নূড়ি-পাথরের এই পথ দিয়ে বেশ স্বাছন্দে কোন রকম অসুবিধা ছাড়াই বেশ তাড়াতাড়িই হেঁটে যেতে পারছে। ব্যাপারটা ভারী অদ্ভুত। কৌতুহলটা বেশ বেড়ে গেল। দেখতে হবে কোথায় যায়। একটু তাড়াতাড়ি কদম বাড়ালাম। দেখতে দেখতে গাছ-পালার ভিতর দিয়ে লেকের দিকে মেয়েটা হারিয়ে গেলো। হারিয়ে না বলে হাওয়া হয়ে গেল বলাই ভালো। আমি হাপাঁতে হাপাঁতে কোন মতে লেক পর্যন্ত পৌঁছে কাউকে দেখতে পেলাম না। অবাক হলাম, ভাবলাম আমাকে এড়ানোর জন্য হয়ত অন্য কোনদিকে দিকে চলে গেছে।
যা হোক, লেকে পৌঁছে চারিদিকের স্নিগ্ধতায় মনটা জুড়িয়ে গেল। প্যান্টের পা টা গুটিয়ে লেকের পানিতে কিছুক্ষন পা ভিজিয়ে বসে থাকলাম। এত সুন্দর নীলাভ টলটলে পানি, এ পানিতে গোসল না করলে জীবনই বৃথা। চারিদিকে একবার ভালোকরে দেখে নিয়ে নিশ্চত হয়ে নিলাম, আশে পাশে কেউ নেই। কাপড়-চোপড় খুলে পানিতে নেমে কিছুক্ষন সাঁতার কাটলাম। পানিটা বেশী গরমও না আবার বেশী ঠান্ডাও না। গত কালকের জার্নির সমস্ত ক্লান্তি মুছে গেছে। টাওয়েল দিয়ে মুছে আবার কাপড় পড়ে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে আবার ক্যাম্পের দিকে হাটঁতে শুরু করলাম। গাছ-পালাওয়ালা জায়গাটায় আসতে আসতে গাঁ টা কেমন যেন ছম্ছম্করতে লাগলো। যদিও আমি জানি মেয়েটা এখানে আর নেই তারপর একটু এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করলাম যদি মেয়েটাকে আবার দেখা যায়। ঠিক এমন সময় পিছন থেকে একটা মেয়েলী কন্ঠ বাংলায় বলে উঠলঃ কি আমায় খুঁজছো?
সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। প্রথমতঃ কাউকে আশা করি নি, তার উপর আবার কথা বলছে বাংলায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করতে লাগলাম। মেয়েটা একদম আমার পিছনে। কখন এসেছে একদম টের পাই নি।
কোনমতে ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি বাংলাদেশী?
মেয়েটি বলল, না, তবে আমি বাংলা জানি। আমাকে তুমি করে বললেই চলবে। আমি অতটা আই বুঁড়ো নই।
আমি বললাম, তুমি তো দেখতে বাংলাদেশীদের মত না। বাংলা শিখলে কি করে?
মেয়েটি বলল, আমার বাবা বাংলাদেশী। ছোট বেলায় বাবার কাছে শিখছি। মা স্পেনিশ। তাই আমি দুটা ভাষাই খুব ভাল করে বলতে পারি।
আমি বললাম, তোমার বাংলা উচ্চারন কিন্তু খুব শুদ্ধ। কোন বিদেশীকে আমি এত পরিস্কার শুদ্ধ উচ্চারনে বাংলা বলতে কখনো শুনি নি।
মেয়েটি বলল, আমি বিদেশী না। যদিও আমি কোনদিন বাংলাদেশে যাই নি তবে আমি তোমার চেয়েও খাঁটি বাংলাদেশী। তা…… আমি কিন্তু তোমার নাম জানি। তোমার নাম অনু না?
এবার আমার মাথায় আকাশ ভেংগে পড়ার মত অবস্থা। জীবনে এ মেয়েকে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। এমন সুন্দর একটা মেয়ে সাথে কখনো পরিচয় হয়ে থাকলে নিশ্চয় মনে থাকতো। নাকি স্মৃতি শক্তি আমার সাথে বিট্রে করছে?
মেয়েটি হাঁসতে হাঁসতে বলল, ভাবছ আমি কিভাবে তোমার নাম জানলাম?
আমি বললাম, হ্যাঁ, তোমার সাথে তো এর আগে আমার কখনো দেখা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। তা হলে আমার নাম জানলে কি করে?
মেয়েটি বলল, আমি তোমার সব খবর জানি… বলেই খিলখিল করে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল।
আমি আরও বেশী নার্ভাস আর বেকুপ হয়ে গেলাম। কিছুই চিন্তা করতে পারছি না।
মেয়েটি বলল, কাল রাতে তোমাদের ক্যাম্পের পাশ দিয়ে যাবার সময় তোমাদের কথাবার্তা শুনে তোমার নাম জেনেছি। দেখলে তোমাকে কেমন অবাক করে দিলাম।
আমি বললাম, আমি আসলেই বেশ অবাক হয়েছি। তা তুমি এখানে কি করছ?
মেয়েটি একটু ইস্ততস্থত হয়ে বলল, আমিও ক্যাম্পিং-এ এসেছি।
আমি বললাম, তা হলে কাল রাতে আমাদেরকে হ্যালো বললেই তো পারতে।
মেয়েটি বলল, আমি একটা একা মেয়ে তোমাদের ক্যাম্পে হালুম বলে হাজির হলে তো তোমরা তিনজনই ভয়ে পালিয়ে যেতে। বলেই আরও জোরে হাঁসতে হাঁসতে লাগল।
আমি বললাম, তুমি একা কেম্পিং-এ এসেছো, তোমার ভয় লাগে না?
মেয়েটি বলল, না আমার ভয় লাগে না। বরং উল্টা সবাই আমাকে ভয় পায়। এই যেমন তুমি প্রথম ভয় পেয়েছিলে।
আমি বললাম, আমি মোটেই ভয় পাই নি। একটু চম্কে গিয়েছিলাম আর কি। তা তোমার নামটা কি?
মেয়েটি বলল, আমার নাম মারিয়া, বাবা শখ করে রেখেছিলো। তা তোমার নাম অনু অব্রয় হলো হলো কিভাবে?
আবারও অবাক হলাম আমার পুরা নাম জানার কারনে। এটা সহজে কারো জানার কথা নয়। তার মানে আমার সম্বন্ধে আরো অনেক কিছুই জানে। কিন্তু কিভাবে? ব্যাপারটা ভারী রহস্যময়।
আমি বললাম, মা আদর করে অনু রেখেছিলো। অব্রয় অংশটুকু বাবা’র দেয়া।
মারিয়া বলল, তোমরা কয়দিন থাকবে?
আমি বললাম, কালই চলে যাব। তুমি ?
মারিয়া বলল, আমার ঠিক নাই, ভালো লাগলে কয়েকদিন থাকতে পারি।
আমি আর কৌতুহল চেপে রাখতে পারলাম না। বললাম, তোমার কতগুলো ব্যাপার ভারী অদ্ভুত লাগছে। এই যেমন তুমি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানো অথচ কিভাবে জানো তা বুঝতে পারছি না।
মারিয়া কেমন যেন একটু ইস্থতস্ত করতে লাগল। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে আমার অনেক কাছে এগিয়ে এলো। একটা মিষ্টি হালকা গন্ধ ভেসে এলো। ভারী মিষ্টি গন্ধটা। কোন পরিচিত পারফিউমের গন্ধ নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে ঠিক মনে করতে পারছি না এই গন্ধ এর আগে কোথায় পেয়েছি।
মারিয়া চোখে চোখ রেখে বলল, অনু আমি কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি তুমি আমার ব্যাপারে কোতুহলী হয়ে উঠেছ। একটা অনুরোধ আমার ব্যাপারে বেশী কোতুহলী হয়ো না।
ধরা খেয়ে আমি একটু কাঁচুমাঁচু হয়ে গেলাম। বুঝতে পারছি না ও আমার মনের কথা জানল কি করে। সামলে নিয়ে বললাম, তুমি আমার মনের কথা বুঝলে কি করে? টেলিপেথি জানো নাকি? আর কোতুহলী হলেই বা অসুবিধা কি?
মারিয়া আমার চোখে চোখ রেখে একটু তীব্র ভাবে তাকাল। মনে হচ্ছে, আমার ভিতরটা পড়ার চেষ্টা করছে। তারপর খুব সহজ হয়ে বলল, আমায় বেশী জানলে শেষে অনেক কষ্ট পাবে। আর আমি সেটা চাই না।
আমি বললাম, মারিয়া তুমি খুব অদ্ভুত আর রহস্যময়ী। আর সে জন্যই হয়ত তোমার প্রতি একটা আকর্ষন অনুভব করছি।
মারিয়া কিছু বলল না, একটু মিষ্টি করে হাসল।
আমরা দু’জনই আস্তে আস্তে হাটতে শুরু করলাম। কোনো এক অজানা কারনে মারিয়াকে আমার কেন যেন খুব ভালো লেগে গেছে। এমন একটা মেয়েকে প্রেমিকা হিসেবে পাশে পেলে বাকীটা জীবন এমনিতে কাটিয়ে দেয়া যায়। সত্যি বলতে কি জেরিনের পর কোনো মেয়ের প্রতি এতটা আকর্ষন অনুভব করেছি বলে মনে পড়ে না।
কিছুক্ষন হাটাঁর পর মারিয়াই নিরবতা ভাঙ্গল, বলল, অনু তোমার সাথে গল্প করে খুব ভালো লেগেছে। এমনভাবে কারো সাথে কখনো গল্প করার সুযোগ হয় নি।
আমি বললাম, কি বলছ? ওকে জানার তীব্র আকাংক্ষা আমাকে আরও সাহসী করে তুলল। বললাম, তোমার মত চমৎকার একটা মেয়ে যে কোনো পুরুষের স্বপ্নের নায়িকা হতে পারে।
মারিয়া বলল, তাই বুঝি, তা তুমি কয়টা মেয়েকে জানো?
আমি বললাম, দেখো আমি বাংলাদেশের ছেলে। আমেরিকার মত কো-এডুকেশন সিস্টেম আমাদের দেশে অতটা প্রচলিত নয়। তাই খুব বেশী মেয়েকে জানার সুযোগ হয় নি। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি তুমি অনেক ডিফারেন্ট।
মারিয়া বলল, ডিফারেন্ট বলতে কি বুঝাচ্ছ? আমি মোটেই ডিফারেন্ট নই।
আমি বললাম, না, সেটা ঠিক নয়। এই যেমন ধর তুমি কিভাবে যেন মনের কথা ধরে ফেল। তোমার মনে হয় টেলিপ্যাতি জাতীয় কোনো গুন আছে।
মারিয়া বলল, সব মেয়েরই একটা সিক্স্থ সেন্স থাকে। যে কোনো পুরুষের চোখের দিকে তাকালে আমরা অনেক কিছু বুঝতে পারি, ভিতরটা পড়তে পারি। সে তুমি বুঝবে না। ও সব কথা বাদ দাও।
একটু থেমে আমাকে অবাক করে বলল, অনু, আমি যদি দৌঁড় দেই, তুমি আমাকে ধরতে পারবে? মারিয়ার চোখে মুখে একটা মিষ্টি চেলেঞ্জের অভিব্যাক্তি ফুটে উঠেছে।
আমি অবাক হলাম, এ ধরনের চেলেঞ্জের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তারপর ও বললাম, চেষ্টা করে দেখতে পারি। তবে আমি কিন্তু খুবই ভালো দৌঁড়াতে পারি। তুমি পরবে বলে মনে হয় না।
মারিয়া বলল, তাই বুঝি? এটা বলেই মারিয়া হঠাৎ সজোরে দৌড় দিল।
আমি ছোট বেলা থেকেই অনেক খেলাধূলা করেছি। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল কোনোটাই বাদ দেই নি। কেডেট কলেজে থাকতে বহুবার একশ আর দু’শ মিটার স্প্রিন্টে ফার্স্ট, সেকেন্ড হয়েছি। তবে মারিয়া যে খুব জোরে দৌরাতে পারে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাও আবার খালি পায়ে দৌড়াচ্ছে। আমিও ওর পেছন পেছন দৌড় দিলাম। বালি আর ছোট ছোট নূড়ি-পাথরের উপরের দিয়ে দৌড়াতে বেশ কষ্ট হলেও কিছুদূর দৌড়ানোর পর মারিয়াকে শেষ পর্যন্ত ধরতে পারলাম।
দুজনই হাটুঁর উপর ভর দিয়ে বেশ হাপাঁতে লাগলাম। মারিয়া ক্রমাগত হেসেই যাচ্ছিল। বলল, আমি ভাবি নি তুমি আমায় ধরতে পারবে।
আমি বললাম, বহুদিন প্রেক্টিস করিনা, স্টেমিনা বলতে কিছু নেই।
ঠিক তখনই আমার ডান পায়ের কাফ্ম্যাসেল্টা পুল করে বসল। তীব্র ব্যাথায় আমি বালির উপর বসে পরলাম। পা টাকে সোজা করে রাখার চেষ্টা করছি অথচ ব্যাথার কারনে পারছি না। কাফ্ম্যাসেল্টা সংকোচিত হয়ে উপরের দিকে উঠে আসার চেষ্টা করছে। মারিয়া প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ম্যাসেল্পুলের কথা বলতেই তাড়াতাড়ি আমার ডান পায়ের জুতাটা খুলে পায়ের আঙ্গুলসহ পা’টাকে উপরের দিকে চেপে ধরল। কাফ্ম্যাসেল্টা আস্তে আস্তে ছাড়তে শুরু করেছে। আমি বসে দু’হাতে কাফ্ম্যাসেল্টা ম্যাসেজ করার চেষ্টা করছি। মারিয়া আমার হাত সরিয়ে নিজেই ম্যাসেজ করা শুরু করাতে আমি বেশ অসস্থি বোধ করতে লাগলাম।
মারিয়া বলল, একটু রিলাক্সড হয়ে বস, নইলে ম্যাসেল্পুল্টা সহজে যাবে না।
আমি এক দৃষ্টিতে মারিয়াকে দেখতে লাগলাম। ও শুধু সুন্দরী নয়, এ ধরনের সুন্দরীকে মনে হয় ফাটাফাটি সুন্দরী বলা যায়। মুখের উপর জমে উঠা বিন্দু বিন্দু ঘাম আর ওর লম্বা চুল বার বার মুখের উপর এসে পরায় ওকে আরও বেশী আকর্ষনীয় লাগছে। মারিয়া মুখ তুলে আমার দিকে তাকাতেই দু’জনের দৃষ্টি হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। কয়েক মুহূতের জন্য ও আমার চোখের ভিতর কি যেন খুজলো। শেষে নিজেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
প্রসঙ্গ অন্য দিকে ঘুরাবার জন্য আমি বললাম, ছাড়ো, ম্যাসল্পুলটা চলে গেছে।
দু’জনই উঠে দাড়াঁলাম। মারিয়া বারবার সরি বলতে লাগল। বলল, আমি বুঝতে পারি নি তোমার এভাবে ম্যাসল্পুল হবে। আমি সরি, তোমাকে এভাবে কষ্ট দেবার জন্য। আমি দৌড়াতে না বললে তোমার ম্যাসল্পুল হত না।
আমি বললাম, এতে তোমার কোন দোষ নেই। অনেক দিন খেলাধূলা করা হয় না, বডির একদম ফিটনেস্নেই। তাই হঠাৎ ম্যাসল্পুল হয়েছে। তোমার সরি হবার মত কোন কারন হয় নি।
আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
মারিয়া বলল, তোমার কি অনেক ব্যাথা করছে? আমি কি কিছু করতে পারি?
ওর এত কেয়ারিং ভাবটা আমার খুব ভালো লাগলো। আমি বললাম, না, বেশী ব্যাথা করছে না। তবে তুমি একটা কাজ করলে ব্যাথাটা একদম চলে যাবে।
মারিয়া বলল, বল, আমায় কি করতে হবে?
ওর কথার ভঙ্গিতেই বুঝলাম, মারিয়া এ মুহূর্তে আমার জন্য যে কোন কিছু করতে রাজি। আমারও আজ সাহসের কমতি নেই। বললাম, তোমাকে আমার ভীষন ভালো লেগেছে। আমি তোমাকে আরও ভালো ভাবে জানতে চাই। তোমার কন্টাক্ট ইনফরমেশনটা আমায় দেবে, তোমার সেল ফোন নাম্বার।
মারিয়া হঠাৎ থেমে দাড়াঁল, আমার দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি করে হেসে বলল, আমার কোন সেল ফোন নেই। তবে আমার যখন প্রয়োজন হবে আমিই তোমায় খুঁজে নেব।
কি বুঝাতে চাইল ঠিক বুঝলাম না। ভাবলাম হয়ত সেল ফোন নাম্বার দিতে চাইছে না। একটু হতাশ হলাম। বললাম, তা হলে কি আমাদের আর দেখা হবে না?
মারিয়া বলল, হু………হবে, আমি তো এখানে আরও কয়েক দিন থাকব। সন্ধ্যায় ঐ লেকের পাশে এসো, তখন দেখা হবে।
আমি বললাম, তোমার সাথে এ ভাবে এখানে দেখা হওয়াটা প্রায় অবিশ্বাস্য, অনেকটা অলৌকিক বলতে পারো। জানি না তোমার সাথে জীবনে আর কখনো দেখা হবে কিনা। আমার এই সুন্দর স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে আমার সাথে কি একটা ফটো তুলবে?……… অবশ্য তোমার যদি আপত্তি না থাকে।
মারিয়া কাছে এসে আমার ডান হাতটা ধরল, বলল, তোমার সাথে ফটো তুলতে আমার অবশ্যই আপত্তি আছে, ভীষন আপত্তি, কই তোমার ফটোগ্রাফার কই?
আমি বললাম, এই যে আমার ফটোগ্রাফার। প্যান্টের পকেট থেকে আই-ফোন্টা বের করে বাঁ’হাত দিয়ে নিজেদের ছবি নিজেই তোলার চেষ্টা করলাম। মারিয়া আমাকে অবাক করে আরও নিবিড় হয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলো। ওর মধ্যে কোন আড়ষ্ঠতাই লক্ষ করলাম না। যেন আমার বহু দিনের পরিচত, একদম আপন জন। এ সময় আবার সেই মিষ্টি হালকা গন্ধটা আবারও পেলাম। ফটো তোলা শেষে মারিয়া আমায় আবার হঠাৎ ছেড়ে দিল, মনে হল একটু লজ্জা পেল। নীচের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। আনমনে দূরে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল।
আমি বললাম, মারিয়া তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করব, একটু ব্যক্তিগত, কিছু মনে করবে না তো। তুমি কি তোমার মনের নৌকা কোনো ঘাটে ভিঁড়িয়েছ?
মারিয়া এবার একটু সজোরে হেসে উঠল, মনে হলো কথাটা শুনে খুব মজা পেয়েছে। কপট না বোঝার ভান করে বলল, মনের নৌকা আবার কি? এত কিছু বুঝি না। বলেই দৌড়াতে শুরু করল, বললঃ বাই, পরে আবার দেখা হবে।
আমি বললাম, কোথায় যাচ্ছ?
মারিয়া বলল, আমার ক্যাম্পে যাচ্ছি, লেকের পাড়ে এসো।
দেখতে দেখতে আমাদের ক্যাম্পের আগের পাহাড়ের বাঁক ঘেষে ভিতরের দিকে চলে গেল আর দেখতেই পেলাম না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলাম। ভাবছিলাম, কি অবাক কান্ড, এমন একটা জায়গায় এ রকম একটা অদ্ভুত মেয়ের সাথে পরিচয় হলো। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, নাকি স্বপ্ন দেখছিলাম কে জানে। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে পরে গেলাম।
কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। সম্বিত ফিরে পেয়ে আস্তে আস্তে আবার ক্যাম্পের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ভীষন একটা ভাল লাগায় মনটা ছেয়ে গেল।
ক্যাম্পে পৌঁছে দেখি আসিফ আর ফারুক ভাই তখনও ঘুম থেকে উঠে নি। গত রাতের ক্যাম্প-ফায়ারের আগুনটা নিভে গেলেও কিছুটা উত্তাপ এখনও আছে। তার পাশে বসে হালকা ঠান্ডার ঝিরি ঝিরি হাওয়া টা বেশ লাগছিল। বার বার মারিয়ার কথা মনে পড়ছে। কিছুতেই ওকে মন থেকে সরাতে পারছি না। সরাতে ইচ্ছেও করছে না। কিছুক্ষন পর একে একে আসিফ আর ফারুক ভাই ঘুম থেকে উঠলেন। ডিম মামলেট, হমুজ-এর সাথে এরাবিয়ান রুটি দিয়ে চমৎকার সকালের নাস্তা হলো। কেন যেন ক্ষিধাও পেয়েছিল অনেক, তাই খাওয়া হলো প্রচুর।
আমায় চুপচাপ দেখে ফারুক ভাই জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার এত চুপচাপ কেন?
বলব কি বলব না ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত মারিয়া’র সাথে দেখা হওয়ার পুরা ব্যাপারটা আসিফ আর ফারুক ভাইকে খুলে বললাম। শুনে ফারুক ভাই খুবই উৎসাহিত হয়ে পড়লেন। বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন মারিয়া দেখতে কেমন।
বললেন, অনু তোমায় যতটুকু চিনি আর জানি, কথা শুনে তো মনে হচ্ছে মারিয়াকে তোমার যথেষ্ট পছন্দ হয়েছে। আর বয়সও তোমার কম হয় নি। আমার মনে হয়, এ মেয়ের জন্য তোমার উঠে পরে লাগা উচিত।
আমি বললাম, ফারুক ভাই, মিথ্যে বলব না, মারিয়া চমৎকার মেয়ে। যে কারো পছন্দ হবে। কিন্তু ওকে না জেনে, না শুনে কিভাবে প্রেম-ভালোবাসা হবে? তা ছাড়া ও তো আমাকে কোন ফোন নাম্বার এড্ড্রেস কিছুই তো দেয় নি। তা হলে যোগাযোগটা কিভাবে হবে?
ফারুক ভাই বললেন, আরে তোমার কি মাথা নষ্ট? একটা মেয়ে তোমার সাথে দেখা হবার সাথে সাথে তার সমস্ত ইনফরমেশন দিয়ে দেবে এটা তুমি ভাবলে কি করে? তা হলে তুমি ওকে চিপ্ভাববে না। এটা হল মেয়েদের একটা খেলা। ও সব তুমি বুঝবে না। এ লাইনে আমার অনেক অভিজ্ঞতা।
আসিফ অনেকক্ষন ধরে চুপচাপ। কি যেন ভাবছে। শেষে মুখ খুলল, আমার কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, অনুর সাথে মারিয়ার দেখা হয়েছে।
ফারুক ভাই বললেন, তোমার তো সব কিছুতেই কেমন যেন সন্দেহ। কোনো কিছু বিশ্বাস করতে পারো না। এখানে রহস্যটা কোথায়?
আসিফ বলল, আমরা যেখানে গাড়ী পার্কিং করেছি সেটাই একমাত্র পার্কিং স্পট। কাল তো ওখানে কোন গাড়ী দেখিনি। এরকম নির্জন জায়গায় একটা ইয়াং মেয়ে একা একা ক্যাম্পিং করতে আসবে এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
ফারুক ভাই বললেন, আমেরিকা অনেক বড় দেশ। এখানে বাচ্চারা আমাদের মত ভূত-প্রেতের ভয় নিয়ে বড় হয় না। তাই এরা অনেক সাহসী। যদিও একটু নির্জন তবে একা একা ক্যাম্পিং আসাটা অসম্ভব কোন ব্যাপার না।
দেখতে দেখতে দু’জনের মধ্যে ভালই তর্কাতর্কি লেগে গেল। শেষে ঠিক হলো আমার তিনজনই মারিয়ার ক্যাম্পে যেয়ে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি হবে। মারিয়াকে আবার দেখার লোভে আমিও যাবার ব্যাপারে সম্মতি দিলাম।
ফারুক ভাই বললেন, বেশ ভাল হবে। হাইকিং ও হবে আবার মারিয়ার সাথে পরিচয়ও হবে।
আমার হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের যে বাঁকটার দিকে মারিয়া গিয়েছিল সে দিকে এগুতে শুরু করলাম। কিন্ত অনেক দূর এগানোর পরও কোনো ক্যাম্পের নাম নিশানা পর্যন্ত দেখতে পেলাম না।
ফারুক ভাই বললেন, তুমি সিওর যে মারিয়া এদিকে ক্যাম্পিং করেছে?
আমি বললাম, আমি একশ পারসেন্ট সিওর। আমার কিছুতেই ভূল হতে পারে না। মারিয়াকে আমি নিজে এদিকেই আসতে দেখেছি।
আমরা তিন জন একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাটতে লাগলাম। এ দিকটা অনেকটা গিরি পথের মত। দু’দিকে বিশাল খাঁড়া পাহাড়। রৌদ ও প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করে আমরা হাটঁতে হাঁটতে প্রায় আঁধা ঘন্টা হাটার পর গিরি পথের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছালাম। আমাদের সামনে বিশাল খাঁড়া পাহাড়। যাবার আর কোন পথ নেই। আসার সময় ফারুক ভাই কয়েক বার মারিয়া বলে ডাক দিলেন। সে ডাক পাহাড়ে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসল এবং বহু দূর পর্যন্ত শোনা যাবার কথা। ঘামে তিন জনই ভিজে জ্যাব-জ্যাবে অবস্থা। সবচে বেশী অবাক হচ্ছি আমি। বার বার হিসেব কস্চি কোথাও ভুল হল কিনা। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব, মাত্র ঘন্টা খানেক আগেই আমি নিজ চোখে মারিয়াকে এদিকে আসতে দেখেছি। নাকি আমার কোন ভুল হলো মারিয়া কোন দিকে গেছে সেটা ভাল করে খেয়াল করতে পারি নি।
যা হোক, আমরা আবার হাঁটতে হাঁটতে গিরি পথের শুরু’র জায়গাটায় এলাম। এদিক সেদিক তাকিয়ে আবার ঠিক করে নিলাম, নাহ্মারিয়াকে আমি এদিকেই আসতে দেখছি। আমি মোটামুটি কনফার্ম। সেখান থেকে আবার লেকের কাছে গেলাম। আসার পথে কিভাবে কোথায় মারিয়ার সাথে দেখা হয়েছে নিখুঁত ভাবে চিহ্নিত করতে পারলাম। মারিয়ার সাথে কোন জায়গাটায় শেষ কথা হয়েছে, সেখান থেকে যে গিরিপথের দিকে গেছে সবই ঠিক আছে শুধু মারিয়া নেই। ফারুক ভাই আর আসিফের প্রশ্নবানে আমার মাথা আরও খারাপ হবার দশা। কিছুতেই বুঝতে পারছি না। ইতিমধ্যে সূয্য আরও তেঁতে উঠেছে। অবশেষে আবার ক্লান্ত দেহে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। এখন আর কেউই খুব একটা কথাবার্তা বলছি না।
ফারুক ভাই বললেন, আমার মনে হয় মারিয়ার ক্যাম্প অন্য দিকে। হয়ত তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চায় না বলেই ইচ্ছা করে তোমাকে ঘোল খাইয়েছে।
আসিফ বলল, আমার মনে হয় আসলে মারিয়া নামে কারো সাথে ওর দেখা হয় নি। কাল রাতে বিয়ার খেয়ে ওর মাথা ঠিক নেই। আমি নিশ্চিত ওর ভিজুয়াল হেলুসিনেশ্ন হয়েছে। কাল রাতে আমি বিয়ার খেয়েছি একটা, বিয়ারের খালি ক্যান থাকার কথা একটা অথচ এখানে কালি ক্যান পরে আছে তিনটা। বাকী দুটা তা হলে খেল কে?
ফারুক ভাই বললেনঃ আসিফ, আমরা দুজনই ভাল করে জানি অনু বিয়ার খায় না। হয়ত প্রথম বিয়ারের নেশাতে বাকী দু’টা তুমি নিজেই খেয়েছ যে হিসাব রাখতে পারো নি।
আসিফ বলল, আজব, আমি বিয়ার খেলাম আর আমি জানলাম না!
ঠিক তখনই আমার মনে পড়ল, মারিয়ার সাথে আই’ফোনে তোলা ফটোর কথা। এতক্ষন বেমালুম ভূলে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি পকেট হাতঁড়ে আইফোনটা বের করলাম। ফটো সেক্সেনে মারিয়ার সাথে তোলা আমার ক্লোজ্আপ ফটোটা দারুন হয়েছে যদিও আমার চেহারার কিছু অংশ কেটে গেছে। কিন্তু মারিয়ার ছবিটা দারুন হয়েছে। মনে হচ্ছে একদম জীবন্ত। মনে মনে আই’ফোনের জনক ইস্টিভ জব্কে ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা ফারুক ভাইয়ের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলাম।
ফারুক ভাই কিছুক্ষন দেখে বললেন, দিন-তারিখ সময় অ্যান্ড ব্যাকগ্রাউন্ড সব দেখে তো মনে হচ্ছে ফটোটা এখানেই তোলা হয়েছে। ফোনটা ফারুক ভাই আসিফকে এগিয়ে দিলেন।
আসিফ অনেকক্ষন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলল, ব্যাপারটা ভারী অদ্ভুত লাগছে। চলেন আমরা লোকাল ভিজিটার সেন্টারে খোঁজ নিয়ে দেখি। মারিয়া নামের কোনো মেয়ে যদি এদিকে ক্যাম্পিং-এ এসে থাকে তা হলে ওদের কাছে ইনফরমেশন থাকতে পারে।
আমরা ক্যাম্পিং-এর সমস্ত জিনিষপত্র গুছিয়ে নিলাম। চড়াই-উৎরাই পাড় হয়ে জিনিষপত্র টেনে-টুনে আবার গাড়িতে তুললাম। ফোনের ইন্টারনেট থেকে ডাইরেক্সন নিয়ে যখন ভিজিটার সেন্টারে এসে পৌছঁলাম তখন প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। ভিজিটার সেন্টারে তেমন কোন লোক নেই, কাউন্টারে একজন বৃদ্ধ লোক বসে নিউজ পেপার পড়ছে আর এক সাইডের কর্নারে দু’জন উষ্কখুষ্ক চুল, অপরিপাটি কাপড় পড়া লোক দাবা খেলছে। কাউন্টারের ভদ্র-লোককে মারিয়ার ফটো দেখিয়ে তার ব্যাপারে জানতে চাইলাম। প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও জানতে চাইল কেন খুজছি। বিস্তারিত সবকিছু খুলে বলার পর জানালো এ নামের কাউকে সে ভিজিটার সেন্টারে দেখেনি। আর তার ধারনা এ রকম নির্জন এলাকায় একটা মেয়ে কিছুতেই একা ক্যাম্পিং করতে পারে না। খেয়াল করলাম, কর্নারে বসা দু’জন তাদের খেলা বাদ দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছে। যা হোক, কিছুটা হতাশ হলাম।
আমরা ভিজিটার সেন্টার থেকে বের হতেই কর্নারে বসা দু’জনের একজন আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। পুরানো ছেঁড়া কাপড়, মনে হয় বহু দিন ধোয়া হয় নি। লোকটার গাঁ থেকে এক ধরনের বাজে গন্ধ বের হচ্ছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। খুব সম্ভবত হোম্লেস হতে পারে। হয়ত কোন সাহায্য চাইতে আসছে।
লোকটা বলল, দেখো, আমি এ এলাকার ভবঘুরে। নূতন কে এলো, কে গেল সবার খবরই রাখি। তোমরা যাকে খুঁজছ, তার সন্ধান দিতে পারলে আমাকে ম্যাকডোনাল্ড থেকে একটা ডিনার কিনে দিও। রাতে খাওয়া জুঁটবে কিনা জানি না।
আসিফ বলল, আমাদের আর বিরক্ত করো না। সারাদিন এমনিতেই অনেক ধকল গেছে।
আমরা তাকে উপেক্ষা করে গাড়ীতে উঠে বসলাম। ফারুক ভাই গাড়ী স্টার্ট দিয়ে ব্যাক করতেই বললাম, ফারুক ভাই একটু দাঁড়ান, আমি আসছি। বলেই গাড়ী থেকে নেমে গেলাম।
লোকটা ততক্ষনে ভিজিটর সেন্টারে ঢুকতে শুরু করেছে। হ্যালো বলে ডাক দিতেই ফিরে তাকালো। মারিয়ার কোন খোঁজ বের করতে না পারাতে মনটা এমনেই খারাপ হয়ে আছে। এ দেশে তেমন একটা ফকির দেখা যায় না। তাই মনটা একটু নরম হয়ে গেল। আমি যদি সাহায্যের হাত না বাড়াই একটা লোক আজ হয়ত না খেয়ে অভূক্ত থাকবে।
আমি বললাম, এই নাও পাঁচ ডলার। আশা করি এতে তোমার ডিনার হয়ে যাবে।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। ‘মে গড্ব্লেস উয়ু’ বলে হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল। আমি চলে আসতেই বলল, তুমি যদি কিছু মনে না করো আমাকে কি মারিয়ার ছবিটা একবার দেখাবে?
আমি নেভার মাইন্ড বলে কিছুটা এগিয়ে এলাম। গাড়ীতে উঠতে যাবার ঠিক আগ মুহুর্তে হঠাৎ মনে হল, হোয়াট দা হ্যাক, নাথিং টু লুজ। আবার ফিরে গেলাম লোকটার কাছে। ফোন থেকে ফটোটা বের করে দেখালাম। লোকটা ভ্রু আর চোখ কুঁচকে ছবিটা দেখার চেষ্টা করছে। মনে হয় চোখে কম দেখে। হঠাৎ লোকটা দেখি কাঁপতে শুরু করেছে। আমার দিকে আর ফটোর দিকে বার বার তাকাচ্ছে। চোখ বিস্ফোরিত। আমিও একটু ঘাবড়ে গেলাম। ভাবছি কোন এপিলেপ্সির রোগী কিনা।
লোকটা বললঃ এটা অসম্ভব, হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না। এগিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরল। বলল, প্লিজ আমাকে বল, একে তুমি কোথায় দেখেছো? প্লিজ, তোমার খোদা’র দোহাই লাগে।
আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। বুঝতে পারছি না কি বলতে চাইছে। ইতিমধ্যে গাড়ী থেকে ফারুক ভাই আর আসিফ নেমে এসেছে।
ভালো করে জিজ্ঞেস করতেই বলল, আগে একটু পানি খাবে। পাশেই ম্যাকডোনালস্এ নিয়ে বসালাম। লোকটার জন্য পানি আর একটা হ্যাম-বার্গার, আর আমাদের জন্য কফি নিয়ে বসলাম। মারিয়ার সাথে কোথায় কি ভাবে দেখা হয়েছে পুরোটা খুলে বললাম। লোকটা চোখে মুখে অবিশ্বাস। বললঃ এটা কিছুতেই হতে পারে না, কিভাবে সম্ভব? আমি বললাম পুরানো ঘটনাটা খুলে বলতে।
বলল, আজ থেকে প্রায় দশ-বারো বৎসর আগের ঘটনা। তার নাম দিয়াগো, থাকতো মেক্সিকোর কাপালুয়া শহরে। মারিয়ার বাবা নজরুলের সাথে পরিচয় বহু বছর আগে যখন দালালের হাত ধরে প্রথম মিডেল ইষ্ট থেকে তাদের শহরে আসে। নজরুলের উদ্দেশ্য ছিলো দালাল ধরে আমেরিকা চলে যাবে। কফির দোকানে পরিচয়ের সূত্র ধরে পরে সখ্যতা বাড়ে। দুজনই ট্যাক্সি চালিয়ে ভালোই আয় করতো। টুরিষ্ট শহর হওয়াতে ভালো বক্শিশ পাওয়া যেতো বলে নজরুল আমেরিকা যাবার প্ল্যান বাদ দেয়। এক সময় ট্যাক্সি চালাতে গিয়েই মারিয়ার মায়ের সাথে নজরুলের প্রেম হয়। সেখান থেকে বিয়ে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মারিয়ার জন্ম। মারিয়া খুব ছোটবেলা থেকেই ছিল ভীষন ডানপিঠে। সারা পাড়া মাতিয়ে রাখত। দেখতে দেখতে মারিয়া হাই স্কুলের গন্ডি পেরুতে না পেরুতেই পাড়ার বখাটেদের নজরে পরতে শুরু করে। মেয়েটা মায়ের মতই সুন্দরী হয়েছিল। আর এ রূপই সবার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এ সময়টায় আস্তে আস্তে পাড়ার পরিবেশও নষ্ট হতে শুরু করে। ড্রাগস আর স্মাগ্লিং গ্যাং-এর দাপটে কারো মুখ খোলার সাহস ছিল না। মারিয়া এক সময় এক ড্রাগ স্মাগ্লিং গ্যাং-এর লিডারের বখাটে সন্তানের নজরে পড়ে যায়। নজরুলের ইচ্ছা ছিল মারিয়া লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। তাই মারিয়াকে বাঁচাতে একমাত্র রাস্তা খোলা ছিল এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া। পরে নজরুল আর আমরা কয়েক পরিবার মেক্সিকো থেকে আমেরিকা আসার সিদ্ধান্ত নেই।
দালালের হাত ধরে আমরা মেক্সিকো-আমেরিকার বর্ডারে মরুভূমি অতিক্রম করে আমেরিকায় প্রবেশ করি। বিশ-পঁচিশ জনের এ দলটা চার-পাঁচ দিন এক নাগাড়ে মরুভূমির উপর দিয়ে হাঁটার ফলে দলের সবাই বেশ দূর্বল হয়ে পড়ে। এক সময় দালালরা আমেরিকান বর্ডার-পুলিশের আনাগোনা দেখে দলের সবাইকে ফেলে পালিয়ে যায়। মরূভূমির মধ্যে আমরা দিশেহারা হয়ে যাই। খাওয়া আর পানির অভাবে দূর্বল শরীর নিয়ে লোকজন একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরতে থাকে। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। আমরা বুঝতে পারছিলাম আমাদের সবার সময় ঘনিয়ে আসছে। কারো আর হাঁটার শক্তি ছিল না। এ সময় মারিয়া তার বাবা-মা আর দলের সবাইকে বাঁচাতে রওনা হয় পানি আর জনপদের উদ্দেশ্যে। সেটাই মারিয়ার সাথে আমার শেষ দেখা। ক্ষুধা আর অনহারে সবার মরমর অবস্থা। এক সময় মনে হয় আমিও জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে জ্ঞান ফিরে আসলে নিজেকে আবিষ্কার করি হাসপাতালে। আমেরিকান বর্ড়ার-পেট্রল একসময় আমাদের দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে হাস্পাতালে নিয়ে আসে। আমি আর দলের আরেকজন ছাড়া কেউই বেঁচে ছিল না। মারিয়ার লাশ কখনো পাওয়া যায় নি। এখানকার পুলিশও এটা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। প্রতি বছর এ রকম কত হাজার হাজার ঘটনা ঘটছে। ওরা কয় জনকে খুঁজবে? পরিবার পরিজন সব হারিয়ে এ ঘটনার ভয়াবহতায় আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি। হাস্পাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর থেকে রাস্তাকেই নিজের বাড়ী বানিয়ে এখন আমি হোম্লেস্দের সাথেই থাকি। স্বপ্নের আমেরিকা জীবনের সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। কথার সাথে দিয়াগোর দু’চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সেটা যেন আমাদেরকেও স্পর্শ করলো। কেউই কিছু বলতে পারছিলাম না। গলাটা ধরে আসছিলো। নিজেদেরকে সামলে নিয়ে দিয়াগোর কাছ থেকে আমরা বিদায় নিলাম।
বিদায় বেলায় দিয়াগো বলল, আমি ভাবতেই পারছি না মারিয়া এখনো বেঁচে আছে। তবে এ দশ-বারো বৎসরে মেয়েটা একটুকুও বদলায় নি। ওকে পেলে আমার কথা বলো। আমি এ এলাকাতেই থাকি।
গাড়ীতে করে আমরা আবার এপেল ভ্যালির উদ্দেশ্যে যখন রওনা হলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। সবার মনের মাঝে একটা থমথমে ভাব। তেমন আর খুব একটা কথা বার্তাও হলো না। রাত প্রায় সাড়ে দশটার দিকে আমাকে গ্যাস ইস্টসনে নামিয়ে ফারুক ভাই আর আসিফ চলে গেলো।
আমি কাপড় বদলে হাত-মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেস হয়ে চুলায় চা বসিয়ে দিলাম। এখন আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। কি মুড নিয়ে বেড়াতে বের হয়ে ছিলাম আর কি মুড নিয়ে ফিরে এলাম। মারিয়ার ভূতটা আবার মাথায় চেপে বসল। ফোনটা বের করে মারিয়ার ছবিটা অনেকক্ষন দেখলাম। কিন্তু কিছু ব্যাপারের হিসাব কিছুতেই মিলছে না। আমার সম্বন্ধে মারিয়া এত কিছু জানল কি করে? আর আমাকে অমন ভাবে ঘোল খাইয়ে এড়িয়ে গেলো কেন? হতে পারে তার হয়ত কোনো বয়-ফ্রেন্ড আছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তো সরাসরি বললেই পারতো। যে কোন মেয়ে এ ক্ষেত্রে তাই করতো। হতে পারে এ দেশে তার থাকার লিগাল স্টেটাস্নেই, তাই হয়ত কোন উট্কো ঝামেলায় জড়াতে চায় নি। তবে ওকে হোম্লেস মনে হয় নি বরং কাপড়-চোপড় আর আচার ব্যবহারে যথেষ্ট মার্জিত ও শিক্ষিত মনে হয়েছে। তার মানে হয়ত আশে পাশেই কোথাও থাকে, ভাল কোন কাজ করে। ইত্যাদি সাঁত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আর তেমন ভালো করে ঘুম হল না। সকালে উঠলাম অনেক দেরী করে।
নাস্তা সেরে আবার অফিসে বসলাম। এখনো কোন কাস্টমার আসে নি। মনটা উশ্কুশ্করছে, মারিয়ার একটা খোঁজ বের করা দরকার। ইন্টারনেট, ফেইস-বুক তন্ন তন্ন করে খুজেঁও মারিয়ার কোন হদিস বের করতে পারলাম না। কিছুটা হতাশ হলাম বটে। মারিয়ার ফটোটা ফোন থেকে ইমেলের মাধ্যমে কম্পিউটারে সেভ করে রাখলাম। কম্পিউটারের বড় স্ক্রিনে দেখতে আরও অনেক বেশী ভাল লাগছিল। মনে হচ্ছে আমার সমস্ত স্বত্বা জুঁড়ে সারাক্ষণ মারিয়া বিচরণ করছে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেকে কল্পনার জগত থেকে বাস্তবে নিয়ে আসতে চাইলাম। খুব চেষ্টা করছি আগের সেই সাদা-মাটা জীবনে ফিরে যাবার জন্য। মারিয়া সংক্রান্ত যাবতীয় সব স্মৃ্তি মুছে ফেলতে চাই। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ঠিক তার ঊল্টাটা। যতই ভুলতে চাচ্ছি যেন তত বেশী মাথায় চেপে বসছে। মনে হচ্ছে আমার যাবতীয় চিন্তা শক্তি সহ মনকে হাইজ্যাক করেছে মারিয়া। ভাবতে ভয় হচ্ছে, তবে আমি কি মারিয়ার প্রেমে পরে গেছি? এক দিন দুই করে প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। অথচ এ অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, মনের উপর মানুষের সব সময় নিয়ন্ত্রন থাকে না। হয়ত এটাই প্রথম দর্শনে প্রেমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু আন্দাজে আমি তাকে কোথায় খুঁজব।
ইতিমধ্যে ফারুকভাই আর আসিফ ফোন করে খবর নিলেন আমি ভালো আছি কিনা, নূতন কোন খবর আছে কিনা ইত্যাদি। মারিয়াকে একবার দেখার ইচ্ছেটা কেন যেন ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে। শেষ পর্যন্ত ইচ্ছের কাছে হার মেনে সিন্ধান্ত নিলাম, অন্ততঃ একবার চেষ্টা করে দেখি মারিয়ার দেখা পাওয়া যায় কিনা। তা হলে নিজের কাছে এই ভেবে সান্ত্বনা পাব যে আমি চেষ্টা করেছিলাম। শনিবার ছুটির দিন, প্রয়োজনীয় কিছু জিনিষপত্র গুছিয়ে সকাল সাড়ে দশ’টার মধ্যে গাড়ী নিয়ে আবার রওনা হয়ে গেলাম এনযা-বরিগো ডেযার্ট’এর উদ্দেশ্যে। ফারুকভাই আর আসিফকে কেন যেন জানাতে ইচ্ছে করলো না। এ ভাবে নির্জন জায়গা দিয়ে একলা গাড়ী চালাতে আমার বেশ লাগে। মনে হয় কোন অজানার উদ্দেশ্যে হারিয়ে যাই।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক গাড়ী চালিয়ে শেষ পর্যন্ত এনযা-বরিগো পৌছে গেলাম। সারাদিন শপিং- মল টু মলে অযথাই এদিক সেদিক গুড়ে বেড়ালাম, কথাও মারিয়া’র দেখা পেলাম না। কেন যেন মনে হচ্ছিল দেখা হবে না। এভাবে একজন মানুষকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলাম বাড়ীর দিকে রওনা হওয়া প্রয়োজন। রাস্তায় কিছুদূর আসতে না আসতেই হঠাৎ মনে হলো এতদূর এসে ফন্ট-পয়েন্টের সেই লেইকটা দেখে না গেলে মনে একটা আফসোস থাকে যাবে। আবার কবে আসা হবে কে জানে, হয়ত আর কোনোদিন এদিকে আর আসা হবে না।
জীবনে আছে কি, মরে গেলে হাড্ডি। অতএব, গাড়ী গুরিয়ে আবার ফন্ট-পয়েন্টের দিকে রওনা হলাম। পৌঁছতে বেশীক্ষন লাগলো না। তখন সূয্য আস্তে আস্তে হেলতে শুরু করেছে। চেনা সেই পথ ধরে আঁকাবাঁকা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে আস্তে আস্তে লেকের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। অপরূপ প্রকৃতি দেখে হাঁটতে বেশ লাগছে। আরো কিছুদূর এগুতেই বুকের ভেতর কেমন যেন ছ্যাঁত করে উঠল। হঠাৎ দেখতে পেলাম কে যেন লেকের পাশে বসে গভীর মনোযোগের সাথে পানিতে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। একটু তাড়াতাড়ি পা চালালাম। আরেকটু এগুতেই দেখলাম পানির পাশে বসে কেউ একজন একটা লম্বা কাঠি নিয়ে পানির মধ্যে এলেবেলে কাটছে। মুখটা পাশ থেকে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না কিন্তু পিঠের উপর চমৎকার ছড়ানো চুল দেখে হঠাৎ মনে হল মারিয়া নয় তো। । হাত পা একদম ঠান্ডা হয়ে যাবার অবস্থা। মনে মনে দোয়া করছি যেন এটা মারিয়া হয়। তবে আমার ইন্টুইসন সবসময় আমাকে হতাশা করেছে। আমি যা ভাবি হয় তার উল্টা। একটু ধাতস্থ হয়ে মনে মনে সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি গিয়ে পাশ থেকে বললাম, হাই।
আমার সমস্ত স্বত্বাকে ফ্রিজ করে আমার দিকে যখন তাকালো দেখলাম, মেয়েটা অন্য কেউ নয়, স্বয়ং মারিয়া। উত্তরে বলল, হাই। ভয়, টেনশন আর এক্সসাইটমেন্টে আর হাত-পা একেবারে আড়ষ্ট অবস্থা। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললামঃ কি ব্যাপার তুমি এখানে?
মারিয়ার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখলাম না, যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। খুব শান্ত গলায় বললঃ কেমন আছো। উত্তরের তোয়াক্কা না করেই পাশে বসতে বলল।
যদিও খুব পাশে বসতে ইচ্ছে করছিলো তারপরও মাঝে একটু জায়গা রেখে বসলাম, বললামঃ তোমাকে এখানে দেখব ভাবতেই পারি নি, আমাকে চিনতে পেরেছ?
উত্তরে কিছু বলল না, আমার দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি করে হাসল। একটু ভ্যাবাচ্যাখ্যা খেয়ে গেলাম, মনে হলো মারিয়া আমার দিকে তাকিয়েই আমার অন্তরের সমস্ত কথা বুঝে গেছে যে আমি শুধু ওকে দেখার জন্যই এতদূর ছুটে এসেছি। চারিদিকে প্রকৃতির এমন শান্ত-সুন্দর পরিবেশ মনকে কেমন যেন উদাস করে দেয়, অনেক না বলা কথা বলে দেয়। কথা বলে ব্যাপারটা একটু সহজ করে নেয়া দরকার।
আমি বললামঃ তোমাকে পেয়ে ভালই হলো, একটা কথা বলা হয় নি। গতবার তোমার সাথে দেখা হবার পর, এখান থেকে যাবার পথে তোমার বাবার বন্ধু মিস্টার দিয়াগো’র সাথে দেখা হয়েছিলো। উনার কাছ থেকে তোমার সব কথা শুনেছি। কিভাবে এখানে আসলে, কিভাবে দুর্গম মরুভূমি পার হতে গিয়ে বাবা-মা সবাইকে হারিয়েছ…… আমি খুব সরি, তোমার লাইফে অনেক ঝড়-ঝাপ্টা গেছে, অনেক ট্র্যাজেডির ভিতর দিয়ে তোমাকে এতদূর আসতে হয়েছে।
মারিয়া কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেলো, উদাস হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলো। হতে পারে সযত্নে বেদনার নীল-অশ্রু লুকাতে চেষ্টা করছে।
আমার নিজেরই হঠাৎ খারাপ লাগতে শুরু করলো, কেন যে এই প্রসঙ্গটা আনতে গেলাম। আবারও সরি বলে নিজের বোকামির জন্য ক্ষমা চাইলাম।
মারিয়া কিছুক্ষন পর নিজেকে সামলে নিলো, বললঃ তুমি কি জানো, তুমি একজন খুব ভাল মানুষ।
আমি বললামঃ কি করে বুঝলে? তোমার তো ভুলও হতে পারে।
মারিয়া বললঃ না, আমার ভুল হয় নি। তুমি কি জানো, মানুষের যে হার্ট আছে, তার ইলেক্ট্রিক্যাল এক্টিভিটির ফোর্স অব ফিল্ড, ব্রেইন ওয়েভের ইলেক্ট্রিক্যাল এক্টিভিটির ফোর্স অব ফিল্ডের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। কিন্তু মানুষ সবকিছু ব্রেইন দিয়ে সবসময় এমনভাবে যাচাই করে, বাহ্যিক আর বৈষয়িক ব্যাপারগুলোকে এমন মুখ্য করে দেখে, হৃদয়ের উপলব্দি করার সে ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যায়। অনেকটা ব্যাহার না করার ফলে মরচে ধরার অবস্থা। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে অন্তরের কথা মুখে না বললে বুঝতে পারে না। তুমি আর তোমার ফ্রেন্ডরা মিলে যেদিন এখানে প্রথম এলে আমি দূর থেকে তোমাদের দেখছিলাম। তুমি অনেক কষ্ট নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলে। আমি দূর থেকে তোমার কষ্টের কিছুটা আভাস পেয়েছিলাম।
আমি বললামঃ হু……এইবার বুঝতে পারলাম, আমার ফ্রেন্ডরা যখন আমাকে ডাকছিল তুমি নিশ্চয় তখন আমার নামটা জেনেছ। আমি প্রথমবার তোমার মুখে আমার নাম শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম।
মারিয়া একটু মুচকি হাসল কিন্তু কিছুই বলল না।
আমি বললামঃ মারিয়া, আমি আসলে তোমাকে একটা কথা বলার জন্য এতদূর থেকে এসেছি। অনেক বৎসর পর এই প্রথম কাউকে দেখে আমার অনেক বেশী ভালো লেগেছে। গত সাতটা দিন আমি তোমার কথা অনেক ভেবেছি। কোন রকম ভনিতা না করেই বলছি, আমার মনে হয় আমি নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে তোমাকে ভালবাসতে শুরু করেছি।
আমি ভাবছিলাম কথাটা শুনে মারিয়া লাফিয়ে উঠবে, খুব অবাক হয়ে বড় বড় চোখে আমার দিকে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকবে। তা না করে খুব শান্ত গলায় নীচের দিকে তাকিয়ে বললঃ আমি জানি।
ওর এভাবে অবাক না হওয়াটা আমাকে আরো বেশী অবাক করলো। বললামঃ কি ভাবে জানো, আমি তো তোমাকে আগে কিছুই বলিনি।
মারিয়া বললঃ ওই যে তোমাকে বললাম না, হার্ট দিয়ে উপলব্দ করার চেষ্টা করলে সব কথা মুখে বলার প্রয়োজন নেই। মন ঠিকই বুঝে নিতে পারে। বলেই হেসে উঠল।
এ কথা সে কথায় আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হয়ে এলো। কিভাবে কিভাবে যে এতটা সময় পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি। বললাম, চল, উঠা দরকার। যাবার আগে তোমার ফোন নাম্বারটা দেবে না? নইলে তোমার সাথে যোগাযোগ করব কিভাবে?
মারিয়া হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো । এমনভাবে হাতধরে আমার পাশে দাঁড়ালো যেন আমার কত দিনের পরিচিত। ওর মধ্যে কোনো আড়ষ্টতা নেই দেখে আরো অনেক বেশী ভালো লাগলো। বললঃ ঠিক আছে, একটা কলম দাও।
জিন্সের লেফট ব্যাক-পকেটে ভাগ্যিস একটা বলপেন ছিলো। তাই বাড়িয়ে দিলাম।
মারিয়া আমার বা হাতটা ধরে বললঃ একটা শর্ত, বাসায় পৌঁছার আগ পর্যন্ত হাত খুলতে পারবে না।
আমি তাতেই রাজি হলাম। মারিয়া আমার হাতে কি যেন লিখলো। চোখ বন্ধ করে নাম্বার গুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করেও পারলাম না। একটু আড়চোখে তাকাতেই মারিয়া বলে উঠলঃ অ্যাই, এখন তাকাবে না।
হাল ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে হাটতে শুরু করলাম। মারিয়া আমার হাত ধরে একটু সাপোর্ট নিয়ে বালির উপর দিয়ে আমার সাথে হেঁটে গাড়ী পর্যন্ত আসলো। বললামঃ গাড়ী আনোনি?
মারিয়া বললঃ না, আমি কাছেই থাকি। আমাকে কি একটু কষ্ট করে আমার এপার্টমেন্টের কাছে নামিয়ে দেবে?
আমি বললামঃ কষ্ট হবার প্রশ্নই ঊঠে না, তুমি গাড়ীতে উঠ।
গাড়ী স্টার্ট দিতেই মারিয়ার ডাইরেকশ্ন মত গাড়ী চালাতে থাকলাম। এমন সময় সেই মিষ্টি হাল্কা গন্ধটা আবার নাকে এসে লাগলো। সম্পূর্ন ভিন্ন একটা গন্ধ কিন্তু আমার পরিচিত। মারিয়ার সাথে যখন আমার প্রথম দেখা হয় তখন এ গন্ধটা পেয়েছিলাম। মারিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, একটা খুব মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি, এটা কি তোমার বিশেষ কোন ব্র্যান্ডের পারফিউমের গন্ধ?
মারিয়া বললঃ নাহ্, আমি কোনো পারফিঊম আজ লাগাই নি। তবে গন্ধটা আমিও পাচ্ছি। একটা অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো, আমার জীবনে যখন গুরুত্তপূর্ন কিছু ঘটে তখন আমি এই গন্ধটা পাই। আগেও কয়েকবার পেয়েছি। আমি ভাবেছিলাম হয়ত আমার কোন মিস-পারসেপ্সেশ্ন হচ্ছে। পরে কোনো এক্সপ্লেনেশন না পেয়ে চিন্তা করা বাদ দিয়েছি।
এই গল্প সেই গল্প করতে করতে আমরা একটা এপার্টমেন্ট-কমপ্লেক্সের ভেতর ঢুকলাম। মারিয়ার দেখানো ডি-১২ পার্কিং স্পটে গাড়ী পার্ক করলাম। পারকিং বরাবর ওর এপার্টমেন্ট। ওকে এখনই ছাড়তে ইচ্ছে করছিলো না, আরও অনেক গল্প করার ইচ্ছে ছিল। জানতে ইচ্ছে করছিলো ও আমার সম্পর্কে কি ভাবছে। কথায় কথায় বুঝতে পারলাম ও আমার সম্পর্কে আরও ভালভাবে জানতে চায় যেটা এ সময় খুবই স্বাভাবিক। যাবার আগে আমার কাছ থেকে ফোন নাম্বার আর এড্রেস নিয়ে নিল, আগামী সপ্তাহে আবার দেখা হবে এমনটাই ঠিক হলো কিন্তু ও আমাকে ফোন করে সময় আর কোথায় দেখা হবে সেটা জানাবে। গাড়ীতে বসে ওর চলে যাওয়া দেখছিলাম কিন্তু কয়েক কদম যাবার পর আবার ঘুরে দাঁড়াল। ভাবলাম হয়ত কিছু বলবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে গাড়ীর ড্রাভিং সাইডে এসে আমার বা’গালে আলতো করে একটা চুমি দিয়ে মাথায় চুলের মধ্যে একটু বিলি কেটে বললঃ সি ইয়ু সুন, বাই। ওর চোখগুলো কেমন যেন ছলছল, কষ্টের ছায়া দেখতে পেলাম।
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটলো যার জন্যে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কি বলব, না বলব বা কি বলা উচিত সেটা চিন্তা করতে করতেই মারিয়া হেঁটে ওর এপার্টমেন্ট পর্যন্ত চলে গেলো। একবার হাত নেড়ে বাই বলে মিষ্টি করে হেসে দরজা বন্ধ করে দিলো।
ও যাবার পর মনে হয় আমার হুঁশ হলো। একটু নড়েচড়ে বসলাম। ভাবলাম, নাহ্এবার রওনা হওয়া দরকার। গাড়ী সার্ট দিয়ে ঘুরিয়ে এপার্টমেন্ট-কমপ্লেক্স থেকে দুই ব্লক আসতেই হঠাৎ রাস্তার পাশে ফুল বিক্রেতাকে দেখে গাড়ী থামালাম। চমৎকার নানা রংয়ের টিউলিপের বু-কেই বিক্রি করছে মাত্র সাত ডলার করে। হঠাৎ মনে পড়লো আজ তো মারিয়ার জন্য কিছুই আনা হয় নি। আমার খুব পছন্দের রং, একটা নীল আর একটা লালচে-গোলাপী রংয়ের দু’টা বু-কেই একসাথে কেনাতে দশ ডলারেই দিলো। ভাবলাম, ফুলের তোড়াটা মারিয়াকে নামিয়ে দিয়ে যাই। গাড়ী ঘুরিয়ে আবার মারিয়ার এপার্টমেন্ট-কমপ্লেক্সে ফিরে এসে যথাস্থানে পার্কিং করে ওর এপার্টমেন্টে ডোরবেল বাজালাম। মনে মনে ভাবছি মারিয়া নিশ্চয়ই অনেক খুশী হবে। দরজার সামনে কিছুক্ষন অপেক্ষা করে কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। ভাবছি কি ব্যাপার, মাত্র দু-তিন মিনিট আগেই তো ওকে নামিয়ে গেলাম। কোথাও গেলো কিনা। হয়ত কিচেনে বা সাওয়ারে আছে। আরও কয়েকবার বেল বাজালাম কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা কর্কর্শ নারী কন্ঠ শুনে ঘুরে দাড়ালাম। বললঃ কাকে চাই? আমি এই এপার্টমেন্ট-কমপ্লেক্সের ম্যানেজার। তুমি কি কাউকে খুঁজছ?
আমি মারিয়ার কথা বললাম। আমার কথায় বিশাল বপুর ম্যানেজার এদিক-ওদিক মাথা নাড়ে জানালো সেটা সম্ভব নয়। বললঃ ওই ডি-১২ এপার্টমেন্টে কেউ থাকে না।
আমি বললামঃ সেটা কি করে সম্ভব, আমি কয়েক মিনিট আগেই মারিয়া এখানে নামিয়ে গেছি। আমি নিজ চোখে ওকে এ এপার্টমেন্টে ঢুকতে দেখেছি।
আমাদের কথোপথনে আরও কয়েকজন জমে গেলো। তাদের একজন বললঃ আমি পাশের এপার্টমেন্ট ডি-৯ এ থাকি। আমি তোমাকে একটু আগে এখানে ঢুকতে দেখেছি কিন্তু তোমাকে কাউকে নামিয়ে দিতে দেখিনি।
আমি তাদের কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। বললামঃ দেখো, হয়তঃ তোমাদের হয়ত কোথাও ভুল হচ্ছে।
শেষে ম্যানেজার তার চাবির তোড়া থেকে চাবি বের করে এপার্টমেন্টটা খুলে দিয়ে বললঃ তুমি নিজেই ঢুকে দেখো কেউ এখানে থাকে কিনা।
আমার পেছন পেছন ওরা সবাই এপার্টমেন্টে ঢুকল। ছোট্ট ছিমছাম করে গোছানো ওয়ান-বেড রুমের একটা এপার্টমেন্ট। পরিপাটি করে সাজানো। সব রুম খালি। জানালা গুলোও বন্ধ। এমন কি বহুদিন চুলা জ্বলেছে বলেও মনে হয় না।
ম্যানেজার বললঃ দেখো, তোমাকে তো নেহায়েত ভদ্র-মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। এ এপার্টমেন্টটা গত দু-তিন বৎসর ধরে খালি পড়ে আছে। আমি কয়েকবার ভাড়া দেবার চেষ্টা করেছলাম। কিন্তু কেউই এক রাতের বেশী থাকে নি। তারা নাকি রাতে ঘুমাতে পারে না। বিচিত্র সব শব্দ শুনতে পায়। মনে হয় কে যেন সারারাত ঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাই ভাড়াটে না পেয়ে আমি খালিই ফেলে রেখেছি।
আমার মাথা কেমন যেন ঝিম ঝিম করে উঠল। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় মনে হয় আমার বাস্তবতার ভিতটাও একটু নড়ে ঊঠেছে। আমি আর কথা বেশী বাড়ালাম না, পাছে আমাকে আবার না বোতলি ভেবে বসে। ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে আসলাম।
হাইওয়েতে উঠেই ঝড়ের গতিতে গাড়ী ছোটালাম। স্পিডোমিটার প্রায় ৯০ মাইল ছুঁই ছুঁই। কোনোকিছু ঠিকমত চিন্তা করতে পারছি না। কোনো হিসেব, যুক্তি কিছুই মিলছে না। হঠাৎ বা’হাতে স্টেয়ারিং ছেড়ে ডান হাতে স্টেয়ারিং ধরেতেই বা’হাতে মারিয়ার লেখাটা চোখে পড়লো। পড়েই আমার হাত-পা কেমন যেন অসাড় হয়ে গেলো। লিখেছেঃ লাভ ইউ, মারিয়া। পড়ে রীতি মত হাত কাঁপতে শুরু করেছে। এভাবে কিছু সময় যাবার পর ধীরে ধীরে আমার সমস্ত আসড়তা কেমন যেন দূর হয়ে গেলো। সবকিছুকে অনেক শান্ত মনে হলো, যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছড়লো। মনে হলো, পৃথিবীর কয়টা রহস্যই আমরা ঠিকভাবে এক্সপ্লেইন করতে পেরেছি? কিছু ব্যাপার এক্সপ্লেইন না করার চেষ্টা করাই কি ভালো নয়? প্রতিদিন আমাদের আশে পাশে, এমন কি আমাদের নিজ জীবনেও কত অদ্ভুত ঘটনাই না ঘটে। তার সবকিছু কি আমরা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি? যদিও এই ঘটনাটাকে অডিটরি আর ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন বলে ব্যাখ্যার চেষ্টার করা যায়, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় একজন সুস্থ-সবল মানুষ, যার কোনো ব্যাপারে হ্যালুসিনেশন হয় না, কোনো মানসিক সমস্যা নেই, শুধু এ ব্যাপারে তার হ্যালুসিনেশন হবে কেন?
এমন সময় সেই অদ্ভুত মিষ্টি হাল্কা গন্ধটা আবার নাকে এসে লাগলো। এখন আর ভয় লাগছে না। জানি গাড়ীতে কেউ নেই, তারপরও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললামঃ মারিয়া…… কোনো উত্তর এলো না। গাড়ীর গতি আরও বাড়িয়ে দিলাম। আজ স্পিডিং টিকেট খেলেও ক্ষতি নেই। পৃথিবীতে ভালোবাসা হারিয়ে আবার ফিরে পাবার মত আনন্দায়ক অনুভূতি খুব বেশী নেই। এমন সময় মনে হোল কে যেন ফিস ফিস করে বললঃ ওয়েল্ কাম টু বরিগো-স্প্রিংক্স।______________________________________________
এজাজ ভাই,
স্বাগতম সিসিবিতে। মাঝে খুব ব্যস্ত ছিলাম বলে দেখতেই পাইনি আপনি এখানে এসেছেন। গল্পটা পড়তে খুব ভালো লাগছে। তবে পর্বে ভেঙে দিলে ভালো হত। একটা পোস্টের জন্যে দীর্ঘ লাগছে। আমি পরে এসে আবার পড়ব। আপনার গল্প ফেসবুকে পড়েছিলাম কিছু।
গল্প বলিয়ে হিসেবে আপনার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। একদম তরতর করে কাহিনীকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন।
🙂
ভাই তোমাকে অনেক ধন্যবাদ সুন্দর কমেন্টের জন্য।