ঈদের একাল-সেকাল

সময় পাল্টিয়েছে, বদলে গেছে ঈদের আমেজও। যখন ছোট ছিলাম, তখন হাট বসার আগেই একটা উত্তেজনা কাজ করত- কবে হাট বসবে, কবে এলাকার প্রথম গরু কেনা হবে, ওদের গরুটা কেমন হলো, রোমানা পেইন্ট- সোহাগ পরিবহন কত বড় গরু কিনলো, ঈদের দিন আগে ইমরানদের গরু ফালানো আগে দেখবো, নাকি রোমানা-পেইন্ট এর গরু ফালানোর কসরত দেখবো? এইরকম বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে ঈদ ঘিরে থাকত।

ঈদ নিয়ে আমার স্মৃতির একটা অংশ জুড়ে আছে হাসপাতাল! আব্বু যখন বেঁচে ছিলেন, তখন ঈদের আগে কিভাবে কিভাবে যেন আব্বু অসুস্থ হয়ে পড়তেন, যার ফলে কিছু ঈদ কাটাতে হয়েছে হলি-ফ্যামিলি হাসপাতালে। হাসপাতালের-ঈদ এর থেকে জঘন্য জিনিস কিছু পৃথিবীতে কমই আছে। এখনো মনে আছে, একদিন ঈদের সকালে আমরা নামাজ পড়ে বাসায় এসে দেখি, আব্বু হাসপাতালে কিছু না জানায়ে , ঈদের নামাজ পড়ে সোজা বাসায় চলে আসছে। তবে সবচেয়ে দুঃসহ ঈদ ছিল যেবার হাসপাতাল থেকে আব্বুর মানিব্যাগ চুরি গেলো। কোরবানীর ঈদের আগের দুইদিন কি তিনদিন আগে আব্বু হাসপাতালে ভর্তি হলেন, যেদিন ভর্তি হলেন সেইদিনই রুম থেকে মানিব্যাগ হাপিশ হয়ে গেলো। মানিব্যাগ এর ভেতর ছিলো কোরবানীর টাকা। চরম মন খারাপের মধ্য দিয়ে সেইবার ঈদটা যায়।

হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের একটা নিয়ম ছিল, সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে বাচ্চাদের ঢুকতে হাসপাতালে ঢুকতে দেয়া হতো না। সেইজন্য চুরি করে হাসপাতালের আরেকটা প্রবেশপথ বের করেছিলাম। এখনো ঈদ আসলে হাসপাতালের ঈদ্গুলোর কথা একবার করে হলেও মনে পড়ে। ঈদের দিন হাসপাতালে ইম্প্রুভ ডায়েট দেয়া হয়, তবে সেই খাবারে মেশানো থাকে একরাশ বিষন্নতা। শুভাকাংখীরা ঈদের দিন দেখতে আসতেন, স্বান্ত্বনা দিতেন। মোদ্দাকথায়, ঈদের দিনেও গুমোট পরিবেশ দেখতে হলে হাসপাতালের থেকে ভালো জায়গা আর হয়না।

যেই ঈদ্গুলোতে আব্বু বাসায় থাকতো, দেখতাম আরামসে ঘুম দিচ্ছেন। আমি এবং ভাইয়া ভাবতাম, “এইডা কিছু হইলো? ঈদের দিন মানুষ ঘুমায় কেম্নে?” সেই ঘুমের কারণটা আবিষ্কার হলো, যখন নিজে অফিস করা শুরু করলাম। ঈদের দিন এর মত ঘুমানোর জন্য চমৎকার দিন খুব কমই আছে। তাই, বড় হয়ে বুঝতে পারলাম, ঈদের দিনে ঘুমের মাজেজা। তবে সেই মাজেজা শেয়ার করার সুযোগ আব্বুর সাথে আর হয়নি। যাইহোক, ঈদের আমেজ কবে থেকে পাল্টে যাওয়া শুরু করলো, সেই স্মৃতি পুনরোদ্ধার করি।

আমি যখন ক্লাস সেভেনে তখনো কোরবানীর সেই আমেজভ আর উত্তেজনা কাজ করত। আমার বড় ভাই সামিউল ইসলাম তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে; ক্লাস টেন থেকেই দেখি ভাইয়ার মধ্য ঈদের সেই জোশ আর নাই। আমি ভাবি, ব্যাটা এইরকম হয়ে গেলো কেন? সমস্যা কই? তখন তো আর 9gag ছিলোনা, থাকলে একটা meme বানায় ফেলতাম। আসলে নিজে যখন ক্লাস টেনে উঠলাম, তখন দেখলাম আমারো একই অবস্থা। আমি নিজেকে নিয়ে হতাশ। বোধহয়, যখন থেকে “বিরাট গরু-ছাগলের হাট” এর মধ্য ব্যাকরণজনিত কারণে ভুল চোখে পড়লো তখন থেকেই মনে হয় ঈদের আমেজ পালটে যেতে লাগলো।

মোবাইল আসলো, এসএমএস আসলো। অনেক কাব্য-কাহিনী করে এসএমএস পাঠানোটা একটা স্টাইল এর মধ্যে আসলো। টিনেজ বয়েসে আমিও সেই কাতারে শামিল হলাম। এরপর আসলো ফেইসবুক। দূরদেশে বসে থাকা আত্মীয়দের জন্যে গরুর ছবি তুলে আপ্লোড করা একটা দায়িত্বের মধ্য পড়ে গেলো। সাথে আছে স্কাইপে। মা-খালারা ধানমন্ডি-মালিবাগ ভিডিও কল করে কথা বলে। “দিন আসলেই বদলাইছে”। আমরা গরু পেয়ে সেই কাহিনী লিখে স্ট্যাটাস দিই, কমেন্টে দাম জিজ্ঞেস করা হয়। গরু ভালো হইসে, গরুটা অনেক সুইট টাইপ মন্তব্য আসে। এবছর আসে গ্যাংনাম স্টাইলের অনুকরণে কুরবানী স্টাইল! ঈদ আসে, ঈদ যায়। এখন ঈদ মানে ভার্সিটির ছুটি, অফিসের চাপমুক্ত কিছু দিন। তবে আগের আমেজটা পাইনা। ফেইসবুকের মাধ্যমে মানুষের স্ট্যাটাসটা পড়ে বুঝতে পারি, অনেকেরই একই অবস্থা। তাই ওল্ড স্কুলের গানের কথার মাঝে এই পাল্টে দেয়ার কারিগরদের খুঁজে ফিরিঃ

“সময়টা আজ কেমন যেন,

বড় হয়ে গিয়েছি আমি,

তারাগুলো আজো মেঘের আড়াল, কোথায় গিয়ে নামি?

কেড়ে নিল কে সে আজব সময়, আমার কাজলা দিদি,

কেড়ে তুই, কোন দত্য-দানো, সবযে কেড়ে নিলি??”

সবার ঈদ সুন্দর হোক। ঈদ মোবারক।

২৬ অক্টোবর,২০১২।

৬৬২ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “ঈদের একাল-সেকাল”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।