“না” মানুষ !

আজো চোখ বন্ধ করলে যেন দেখতে পাই গলির মোড়ে মিলিয়ে যাওয়া বেলুনের ঝাঁক, কান পাতলেই শুনতে পাই দুপুরের ভাত ঘুমের ঘোর কাটিয়ে দিয়ে যাওয়া “গরম চানাআচুররর…এ্যাই যে চলে যাচ্ছি কিন্তু…” বা “জ্বালায় দিলাম,পুড়ায় দিলাম,হজজমিইই…” অথবা টিনের চাল আর বৃষ্টির ঐকতানে বেজে চলা রিমঝিম সুর। গভীর করে শ্বাস নিলে এখনো বুক ভরে যায় হাস্নাহেনা বা কাঁঠালচাপার ঘ্রাণে। এখনো আফসোস লাগে, টিফিনের ঘন্টাটা আরেকটু পড়ে পড়লেই দেবদারুর বিঁচি বা মাটির ঢেলা দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় হয়তো হারিয়ে দিতে পারতাম “খ” সেকশনকে; অন্ততঃ একবার। কী ভীষণ শান্ত ছিল টাউন মসজিদের পুকুর পাড়, কী ভীষণ উত্তাল ছিল বর্ষার রুপসা, খেলাভাংগার কী ভীষণ কষ্ট নিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা নামত, কী ভীষণ অনিচ্ছায় প্রতিদিন বড় হয়ে উঠতাম একটু একটু করে! সেই দিনগুলোতে পকেট হাতড়ে ঠিকই পেয়ে যেতাম শুকনো একমুঠো বকুল, অথচ স্বপ্ন বা সময় বা শৈশবের এক একটি মূহুর্ত হাত ফসকে ঠিকই উড়ে গেছে!

সবারই শৈশবের একটা ভীষণ প্রিয় গল্প থাকে, আমারও আছে। সে গল্প অন্তহীন,বারে বারে বলেও ফুরোবার না। আমাদের সে গল্পগুলো যার যার মতো এক এক রকম । কিন্তু অন্য অনেক গল্পের মতোই আমাদের গল্পেরও একটা ভিলেন আছে, যা আমাদের সবার গল্পেই এক ও অভিন্ন। তার নাম “সময়”। হ্যাঁচকা টানে শুধু শরীরের দৈর্ঘ্য বাড়িয়েই সে ক্ষান্ত হয় না, পলে পলে কেড়ে নেয় অতি প্রিয় শৈশবটাকে, জীবনের মাঝের জীবনটাকে। ঘাত প্রতিঘাতে সময় গড়িয়ে চলে, বয়ে চলে জীবন। না চাইতেও মেনে নিতে হয় বয়স বাড়ছে, বড় হচ্ছি। বড় হবার জন্য হয়তো একদিন তীব্র এক আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে পালিত ছিল,তবুও অবাক হয়ে বুঝতে থাকি এত সহজেই বড় হয়ে যাব; তা কোনদিনি ভাবিনি।

কিন্তু ক্রমাগত একঘেয়ে হয়ে ওঠা স্বপ্নহীন,সহায়হীন,উচ্ছ্বাসহীন জীবনের ভারে আজ বড় হবার আনন্দটা কোথায় যেন তলিয়ে গেছে! হু হু করে বাণ ডেকে যায় বুকের মাঝে, ঝরঝরিয়ে ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টিসীমা। সময়ের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে যখন রিক্ত হাতে মুখ ঢেকে গুমরে উঠি, বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আবিষ্কার করি; বড় হবার এই পুরোটা সময়ে আমরা তিলে তিলে নিজেদের মাঝের শিশুটাকে হত্যা করে চলেছি। টগবগে সেই শিশুটার কাছে আজ বৃষ্টি মানে এক বিড়ম্বনা, নতুন মানুষ মানে এক উটকো ঝামেলা, আর জীবন মানে এক নিরন্তর ঘানি। এটা করা যাবে না, তো এটা ভাবা যাবেনা , এটা জানা যাবেনা, তো এটা দেখা যাবেনা, এটা বলা যাবেনা, তো এটা নেয়া যাবেনা, সেটা দেয়া যাবেনা- এমন শত শত না’এর সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে নিতে আমরা প্রতি মূহুর্তে হয়ে উঠেছি “না” মানুষ। যে হাসবে না, কাঁদবে না, গাইবে না; তুমুল ভালবেসে সর্বস্ব হারাবে না। ক্রমশঃ ফাঁস হয়ে ওঠা একটা খাঁচাকে ভেবে নেই জীবনের গন্ডী, ক্রমশঃ ফুরিয়ে আসা জীবনটাকে মনে হয় ফিকে হতে থাকা রঙ্গীন কোন স্বপ্নের ভাঁজে ভাঁজে মলীন কোন প্রিয় মুখ। প্রেমহীন,বোধহীন এক মানবের বিচরণে নিষ্প্রাণ হয় চারিধার,জীবন হয়ে ওঠে ক্লান্তিকর। অথচ, হায়! কী ভীষণ সুন্দর তার আয়োজন!

(জীবন আমাকে ক্লান্ত করেনা, ক্লান্ত করে বেঁচে থাকা।
স্মৃতির বালুচরে আঁকিবুকি আঁকা,
আপন খেয়ালে নিজের মাঝে একলা হয়ে থাকা।
পিছুটানে বারে বারে পিছু ফিরে ডাকা,
বেঁচে থাকাটাই যেন এক নিদারুণ ধোঁকা।।
জীবন আমাকে ক্লান্ত করেনা, ক্লান্ত করে বেঁচে থাকা।
জীবন আমাকে ক্লান্ত করেনা, ক্লান্ত করে বেঁচে থাকা।)

৬৪৯ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : ““না” মানুষ !”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    অসাধারন লিখেছেন আসিফ ভাই, পুরো লেখাটাই কোট করার মত, বিশেষ করে শেষের প্যারাটা :boss: :boss: :boss:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    বাহ্‌! বাহ্‌!
    এমন স্বাদু গদ্য, শৈশবের ঝালমুড়ি আর স্কুলটাইমের আলতা আচারের জিভে-জল-স্বাদ নিয়ে হাজির।
    এ বিষয়টাকে সিরিজ করতে পারো।আমিও কর্ণফুলীর পাড়ে বড় হওয়া।রূপসা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো, গড়াইও।নদীর সাহচর্য্য কি আমাদের গল্প দেখতে শেখায়? কি জানি!

    জবাব দিন
    • আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

      নূপুর দা অনেকদিন পর আপনার মন্তব্য পেলাম। খুব ভাল লাগল। আশা করি ভাল আছেন।
      বিষয়টা নিয়ে ধারাবাহিক করার ইচ্ছা অবশ্যই আছে। দেখি কতটুকু পারি।
      খুলনা কিন্তু রুপসা এবং ভৈরব দুই নদীর সম্মিলনে সিক্ত।ভৈরবের পাড় নিয়ে অনেক গল্প আছে। সম্ভব হলে নিশ্চয়ই বলব।
      হ্যা, নদী অবশ্যই গল্প দেখতে শেখায়। শুধু নদী না, পাহাড়,সাগর, জ্যোৎস্না,ফুল,আকাশ সমগ্র প্রকৃতিই মানুষকে ভাবায়, শোনায়, বলায়।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আরেফিন (১৯৯৭ - ২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।