শরীয়তের দৃষ্টিতে “হরতাল”

শরীয়তের দৃষ্টিতে “হরতাল”
=======================================
(অনুরোধ, আগে এই পোষ্টটি সম্পূর্ণ পড়ুন, পরে মন্তব্য করুন, আর হ্যাঁ এই পোষ্টটি কোন রাজনৈতিক দলের ফায়দার জন্য দেয়া হয়নি, যারাই হরতাল করুক না কেন তাদের উপর বর্তাবে, ধন্যবাদ)

হরতাল শব্দের অর্থ বিশৃঙ্খলা, অত্যাচার, স্বেচ্ছাচার, অবাধ্যতা, অরাজকতা, প্রতিবন্ধকতা, প্রতিরোধ ইত্যাদি।
হরতালের ব্যাখ্যায় বলা হয়, বিক্ষোভ প্রকাশের জন্য যানবাহন, হাটবাজার, দোকানপাট, আফিস-আদালত ইত্যাদি বন্ধ করা।
হরতাল গুজরাটি শব্দ। ‘হর’ অর্থ প্রত্যেক। ‘তাল’ অর্থ তালা। অর্থাৎ প্রতি দরজায় তালা।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীন
কাল হতেই দাবী আদায়ের কৌশল হিসেবে নানা প্রকার পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। যেমন- আমেরিকার ফিলাডেলফিয়াতে ১৭৮৬ সালে ছাপাখানার কর্মচারীরা, জার্মানে ১৯২০ সালে রাজনৈতিক কারণে, বৃটেনে ১৯২৬ সালে কয়লা শ্রমিকরা, এছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকার নানা স্থানে বিভিন্ন গোষ্ঠি তাদের দাবী আদায় করার জন্য যে কৌশল অবলম্বন করেছিল, তার নাম দেওয়া হয়েছে স্ট্রাইক।

ভারত উপমহাদেশে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, বৃটিশদের রাউলাট আইন বাতিল করার জন্য, তার প্রতিবাদে যে পদ্ধতি অবলম্বন করে, তার নাম দেয়া হয় হরতাল। এই হরতাল পালিত হওয়ার কথা ছিল ১৯১৮ সালের ৩০শে মার্চ। পরে এই তারিখ পিছিয়ে ৬ই এপ্রিল করা হয়। ফলে কোন স্থানে ৩০শে মার্চ আবার কোন স্থানে ৬ই এপ্রিল সর্ব প্রথম হরতাল পালিত হয়।

আমাদের দেশে যে হরতাল করা হয়, তা শরীয়ত সম্মত নয়। এ হরতাল নাজায়েয, হারাম। ইসলামী দল বা অনৈসলামী দল অর্থাৎ যে কোন দলই হোক না কেন, তারা যদি গণতন্ত্রের নামেই হোক আর ইসলামের নামেই হোক, হরতাল আহ্বান করে, তা শরীয়ত সম্মত হবে না। হরতাল গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিক্ষোভ প্রকাশের একটি প্রক্রিয়া বিশেষ।

হরতাল হারাম হওয়ার উৎস ও কারণ হলোঃ-
—————————————–

(১) জন-জীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি।
(২) জান-মালের ক্ষতি।
(৩) একজনের অন্যায়ের শাস্তি অন্যকে দেয়া।

(১) জন-জীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টিঃ
————————–
হরতাল হারাম হওয়ার একটি কারণ হলো- এতে মানুষের স্বাভাবিক কাজ-কর্ম ব্যহত করে, জনজীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। আল্লাহ পাক বলেন,
ولا تفسدوا فى الارض.
“তোমরা জমীনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করোনা।”
আল্লাহ পাক আরো বলেন,
الفتنة اشد من القتل.
“ফিৎনা-ফাসাদ কতলের চেয়েও খারাপ।”
হরতালের ফলে যারা দিন-মজুর, রোজ কামাই করে রোজ খায়, তাদের কষ্ট হয়। বরং কষ্টে দিনাতিপাত করে, রোগীদের জন্য কষ্টদায়ক হয়ে যায়। অথচ হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
ايذاء المسلم كفر
“কোন মুসলমানকে কষ্ট দেয়া কুফরী।”
হরতাল এক ধরণের জুলুম, যা শুধু ব্যক্তি পর্যায়েই নয় বরং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও হয়।
আল্লাহ পাক বলেন, “আল্লাহ্ পাক জালিমদেরকে পছন্দ করেন না।” (সূরা আল্ ইমরান/৫৭)

এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন, “তোমরা অত্যাচার করোনা এবং অত্যাচারিত হইওয়া।” (সূরা আল ইমরান্/১৪০)
যে সমস্ত জালিমরা গোমরাহীর মধ্যে দৃঢ়, তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন, “আর আল্লাহ পাক জালিমদেরকে হিদায়াত দেন না।” (সূরা আল ইমরান্/৮৬)
অর্থাৎ যে সমস্ত জালিম সম্প্রদায় তাদের জুলুমের মধ্যে দৃঢ় থাকে, তারা কখনো আল্লাহ পাক-এর হিদায়েত লাভ করতে পারবে না।
মূলতঃ হরতাল আর জুলুম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাজেই যেখানে হরতাল হবে, সেখানেই জুলুম হবে। জুলুম ব্যতীত কোন হরতাল সংঘটিত হতে পারে না। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযুরে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীস শরীফে জুলুম করতে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করেছেন। অতএব, হরতাল করা জায়েয নেই, তা সম্পূর্ণরূপে হারাম।

(২) জান-মালের ক্ষতিঃ
—————-
হরতালের ফলে জান-মালের ক্ষতি হয়, মানুষের সম্পদের ক্ষতি হয়, গাড়ী ভাংচুর করা হয়, গরীব সাধারণের আয়ের সম্বল রিক্সা ভেঙ্গে দিয়ে আয়ের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। হরতালের ফলে হতাহতও সংঘটিত হয়ে থাকে। যাদের হরতাল ডাকার কারণে এ সমস্ত নিহত-আহত হবে, তারাই হত্যাকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে ও দায়ী হবে। পবিত্র কুরআন শরীফে আছে, “যে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই চিরকাল থাকবে।” (সূরা নিসা/৯৩)
আর পবিত্র হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, “কোন মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসেকী, আর কতল করা কুফরী।” (পবিত্র বুখারি শরীফ)
বিদায় হজ্বের পবিত্র খুতবায় হুযূরে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “একজনের জান-মাল, সম্পদ, রক্ত অন্যজনের জন্য হারাম।”
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা মু’মিনদের নিকট থেকে জান ও মালকে বিহিশতের বিণিময়ে খরিদ করেছেন।” (সূরা তওবা/১১১)
হরতালকারীরা স্বাভাবিক কাজ কর্মে বাঁধা দেয়ার জন্য স্থানে স্থানে একত্র হয়ে যে পদক্ষেপ নেয়, (যেমন- ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, চড়াও ইত্যাদি) তাকে পিকেটিং বলা হয়ে থাকে। ১৮৫৯ সালে গ্রেট বৃটেনে পিকেটিং প্রথার প্রবর্তন হয়। যদিও তখনকার পিকেটিংকে শান্তিপূর্ণ পিকেটিং বলে অভিহিত করা হয়। মূলতঃ এটা খৃষ্টানদের প্রথা, তাই পিকেটিং করাও জুলুম করার শামিল, যা সম্পূর্ণ হারাম জান ও মালের ক্ষতি তো হয়ই বরং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে। কাজেই হরতাল করা সম্পূর্ণরূপে নাজায়েয ও হারাম।

(৩) একজনের অন্যায়ের শাস্তি অন্যকে দেয়াঃ
————————————-
মূলতঃ হরতাল যে কারণে করা হয় অর্থাৎ অপরাধীকে শাস্তি দেয়া তা মোটেই হয়না। অপরাধী অর্থনৈতিক ও মানবিক সব দিক থেকেই বহাল তবিয়তে অবস্থান করে থাকে। কিন্তু শাস্তি ভোগ করে জনসাধাণ, যারা অপরাধী নয়। অথচ হরতালের ফলে একজনের অপরাধের শাস্তি অন্যজনকে চাপিয়ে দেয়া হয়, এটা ইসলামের বিধান নয়। বরং মহান আল্লাহ পাক-এর হুকুম হলো, “একজনের গুণাহের বোঝা অন্যজন বহন করবে না।” (সূরা আনআম/১৬৪)
অর্থাৎ একজনের অপরাধের শাস্তি আরেকজনকে দেয়া যাবেনা, যা মূলতঃ নিষেধ। কাজেই শরীয়তের দৃষ্টিতে হরতাল সম্পূর্ণ হারাম।

অতএব, হরতাল করলে জনজীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, জান-মালের ক্ষতি হয় এবং একজনের শাস্তি অন্যজনের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তাই হরতাল করা সম্পূর্ণরূপে হারাম।
কাজেই আজকাল যারা হরতালের মত জঘণ্য হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে তারা ইসলামের ভিতরে কতটুকু রয়েছে, আর কতটুকু ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছে, তা ভাববার বিষয়?



১,০৩৯ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “শরীয়তের দৃষ্টিতে “হরতাল””

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    চমৎকার লেখা বেগ।
    ব্লগে স্বাগতম।
    এর আগে অনেক ধর্মগাধা ইসলামকে ভুল ভাবে রিপ্রেজেন্ট করেছে। ফলে ওই লেখক বা লেখাকে বিদ্রূপ সইতে হয়েছে।
    এতে হয়তো ধর্মগাধাদের কিছুটা সোজা করা গেছে কিন্তু ক্ষতি টা হয়েছে যে এর ফলে কিছু কিছু ক্যাডেটরা ভেবে বসে আছে বা এইরকম ধারণা পোষণ করে যে সিসিবি নাস্তিকদের আড্ডা। যা খুবই দুঃখজনক।

    আশা করছি তোর লেখার মাধ্যমে ধর্মের বা ইসলামের পজিটিভ দিকগুলা উঠে আসবে সুন্দরভাবে।
    আর ১ম লেখার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম কানুন আছে। জেনে নিস তোর ক্লাসমেটদের কাছ থেকে।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।