বিতংস
লেখকঃ ওয়াহিদা নূর আফজা
প্রচ্ছদঃ সামিয়া হোসেন
প্রাকাশকঃ আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী ২০১৩ খ্রীঃ
পৃষ্ঠাঃ ২৮০
মূল্যঃ ৫৫০ টাকা
————————————————————
বিতংস এর ঘেরা টোপে পাঠক। লেখক তার স্বকীয়তায় সুনিপুণ রচনাশৈলী দিয়ে সুক্ষ সুক্ষ জালে আটকে ফেলবে পাঠককে – হ্যাঁ ওয়াহিদা নূর আফজার লেখা ‘বিতংস’ আগা-গোড়া পড়ে পাঠক হিসাবে এই আমার অভিমত।
শাশ্বত বাঙলার চিরাচরিত গ্রাম-নগরে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায়ের অতি সাধারন দিনলিপি প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। পাশাপাশি সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিখুঁত ও সত্যভাষণে অনুরণিত হয়েছে উপন্যাসের প্রতিটি পরতে-পরতে। বাংলার মফস্বল শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের এক সাদা-মাটা আখ্যান যেখানে লেখক আমাদের পরিচিত পরিবারের এক প্রতিচ্ছবি অত্যন্ত সফলতার সাথে অঙ্কন করেছেন। লেখক তার উপন্যাসের প্রভা ও বৈভবকে ভূগোল, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও মনোবৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে আধুনিক ছকে ফেলে ব্যাখা করার প্রয়াস নিয়েছেন। বিশেষ করে, সময়ের প্রেক্ষাপটকে তিনি সবক্ষেত্রেই মনে রাখতে চেয়েছেন।
জীবন বহমান – এ নতুন কিছু নয়, বরং প্রতিটি মানব জীবন এ সত্যের বাহিরে যাবার ক্ষমতা এখনো অর্জন করেনি। তাই তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সময়ের প্রলেপ পরে, শৈশব-কৈশরের ডানপিটে দাপাদাপি, যৌবনের প্রথম প্রেম, বাবা-মায়ের সংসারের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলী, লেখাপড়া ও পাঠ বহির্ভূত পাঠ্যক্রম, বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠার ধারাক্রম, সামাজিক অবস্থান, সমাজে বাসরত সবল ও দূর্বলের কোমল-নিষ্ঠুর আচার ব্যবহার এ সব কিছুই আমাদের কারোর অজানা নয়। তবুও কি আমরা সবাই সবটুকু অনুভব, উপলব্ধি বা আত্মস্থ করতে পারি? ওয়াহিদা সেটা পেরেছেন এবং সুললিত, সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় সফলভাবে তা উপস্থাপন করেছেন। লেখক হিসাবে এ তার অহংকার করার মত এক অর্জন।
‘বিতংস’ – মিষ্টি প্রেমের এক উপাখ্যানও বটে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দিয়া জীবনের প্রথম ভাগে প্রেম বিতংস-এ জরিয়ে পড়ে হিরণ নামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের যুবকের সাথে। দৈনন্দিন বাঁধা জীবনে দিয়ার প্রেমের ব্যক্ত-অব্যক্ত অনুভূতি মানবিক ঘেরাটোপে কেবল অস্থিরতা জাগায়, প্রকাশ আর পায় না। দোদুল্যমান অস্থির চিত্ত তাই খানিকটা সাময়িক ছিটকে পড়ে সমাজের তথাকথিত রাজনৈতিক নেতার পুত্র শাহেনশাহ এর উপর। কিন্তু শাহেনশাহ এর অনৈতিক ও অবন্ধুসুলভ আচরন দিয়ার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এমতাবস্থায় সামাজিক দীনতা পরিবারকে বাধ্য করে দিয়ার বিবাহের আয়োজন করতে। সে বিয়ে বন্ধনেও সৃষ্টি হয় জটিলতা। নিয়তির খড়গে আত্মহুতি দিয়ে নির্মম ভাগ্যকে মেনে নিতে হয় হিরণ নামের আদর্শবান প্রেমিককে। ফলে অন্তর্জ্বালা আর আত্মদ্বন্ধের অনলে পুড়তে পুড়তে অঙ্গার হয়ে পড়ে দিয়ার কোমল হৃদয়। তাতে কি? কি যায় আসে তাতে? এ সবে কার কি লাভ-ক্ষতি? তবুও কি জীবন থেমে থাকে? থাকে না। দিয়াও তার জীবনের অন্য ক্যানভাস কিংবা অজানা, অচেনা এক থিয়েটারের খোঁজে জগতের অমোঘ নিয়মে বাড়ী থেকে বের হয়ে পড়ে….
মোটামুটি এই হল এই উপন্যাসের উপাখ্যান। ঘটনা প্রবাহের যোগসূত্র ও বর্ণনার প্রয়োজনে প্রধান চরিত্রগুলোর পাশাপাশি আরো বেশ কিছু চরিত্র সংযোজিত হয়েছে। উপন্যাসটি পড়লেই কেবল পাঠক এর সম্পর্কগুলো অনুধাবন করতে পারবেন। লেখক চরিত্র সৃষ্টিতে যেমন মুনশিয়ানার পরিচয় দেখিয়েছেন তেমনি পরোক্ষ চরিত্র বর্নণায় চরিত্রগুলো জীবন্ত রূপ ধারন করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, চরিত্রগুলোর ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ়তা শুধু যে চরিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্যকেই ফুঁটিয়ে তুলেছে তা নয় বরং এসবের মধ্য দিয়ে লেখক সমাজের মনস্তাত্ত্বিক ও নীতিমূলক এক শুদ্ধ বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।
উপন্যাসটির উল্লেখযোগ্য একটি দিক হল, এর রূপকের ব্যবহার। ওয়াহিদা তার লেখার মধ্যে রূপকের যে ঝংকার তুলেছেন সেজন্য তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। যেমন: “অকেজো কাগজপত্রও অবেলায় ভারী হয়ে যায়। ঠিক যেন মানুষের মত।” কিংবা “সুখী হওয়ার প্রথম পাঠ ঋণমুক্ত হওয়া।” বা যখন মামুলীভাবে তিনি বলেন “ইটের প্রাচীর ডিঙোনো যায়, লোহার গারদ ভেঙে ফেলা যায়। কিন্তু অদৃশ্য শ্রেণীবৈষম্যের সীমারেখা কি অত সহজে অতিক্রম করা যায়?” – তখন বস্তুবাদী মানব চেতনা অজান্তেই আলোড়িত হয়। মনে হয়, এ যে আমারই কথা বলছে। আমার কিংবা আমাদের মত মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবিই ত দেখছি!!
উপন্যাসের বিছানো জমিনে দেশ, রাজনীতি, মানবজীবন চরিত, সময় বা কাল ইত্যাদির পাশাপাশি সমসাময়িক ঘটনা, ব্যক্তিত্ব, এমনকি ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্বিক নিদর্শনও সাবলীলভাবে স্থান করে নিয়েছে। এ সবের মধ্য দিয়ে তাই লেখকের জ্ঞানের গভীরতা পরখ করা যায়। নিঃসন্দেহে উপন্যাসটি সব দিক বিচারে পরিপূর্নতা পেয়েছে। আমাদের সমাজ-সংসারের আটপৌর মফস্বল জীবনের ছন্দোবদ্ধ ছকে ফেলা দিনগুলো প্রকৃতির নানা টানা-পোড়নে নিত্য বহমান। এই সহজ সরল অকপট জীবনকে লেখক চিত্তহারী ভাষায় সরস করে তুলেছেন।
ওয়াহিদা নূর আফজার লেখালেখির প্রতি অনুরাগ সেই ছোটবেলা থেকে। তিনি ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ এ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অধ্যায়ন করেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি তড়িৎকৌশল বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী প্রাপ্ত হন। অতপর যুক্তরাষ্ট্রের স্যান হোজে স্টেট ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া খেকে একই বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।
উপন্যাসটি সকল মহলে ইতিমধ্যেই বেশ প্রশংসিত হয়েছে। আশা করি এই ধারা চির অব্যাহত থাকবে। ওয়াহিদার জীবনের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।
১৯ সেপ্টেম্বর খ্রীঃ
mamun.380@gmail.com
ঢাকা-১২৩০
এই সময়ে সাহিত্য সমালোচনা বেশ দুর্লভ। কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুনের কাছ থেকে এরকম একটি সমালোচনা পেয়ে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে। সমালোচনার শুরুতে আমাকে লেখক উল্লেখ করাটা বেশ ভালো লেগেছে। লেখালেখির কাজটি জেন্ডার নিরপেক্ষ বলেই মনে করি। পাঠক হিসেবে সমালোচক কাজী মামুন বেশ মনোযোগী। বর্তমান সময়ে যেভাবে বই পড়ুয়াদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তা রোধ করতে হলে আমাদের দেশে বই সমালোচনা শাখাটিকে আরও বেগবান করতে হবে। সেক্ষেত্রে কাজী মামুন একজন আশা জাগানিয়া সমালোচক হিসেবে শূন্যস্থান পূরণের করলে তা বাংলা সাহিত্যের জন্য শুভময়। ধন্যবাদ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ওয়াহিদা। ভীষণ অনুপ্রাণীত হলাম।
পাঠ প্রতিক্রিয়া চমৎকার ভাষায় বিবৃত হয়েছে। তৃতীয় অনুচ্ছেদটি বিশেষভাবে ভাল লেগেছে। লেখক/পাঠক সততার সাথেই তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বলে প্রতীয়মান।
'বিতংস' শব্দটির মানেই জানতাম না। চমৎকার একটি নতুন শব্দ শিখলাম।
আলোচনার শেষে এসে ওয়াহিদা নূর আফজার শিক্ষাজীবনের উপর কিছুটা আলোকপাত করার জন্য ধন্যবাদ। কৃ্তি ছাত্রী, কৃ্তি এ লেখককে অভিনন্দন, ২৮০ পৃষ্ঠার চমৎকার একটি সফল উপন্যাস লেখার জন্য। তার প্রকাশিত অন্যান্য বই (যদি থাকে, আশাকরি আছে) সম্বন্ধেও জানার আগ্রহ রইলো।
আপনার মতামত সব সময় আমাকে অনুপ্রাণিত করে। এবারও ব্যতিক্রম নয়...
ওয়াহিদা নূর আফজা একজন শক্তিশালী লেখক। তার আরেকটি বই আমার সংগ্রহে আছে। সুযোগ মত প্রতিক্রিয়া জানাব ইনশাআল্লাহ। ভাল থাকবেন। আপনার সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করি।