ভোজ বিহার-কুমিল্লা

ময়নামতি সেনানিবাসের দক্ষিণ প্রান্তে কোটবাড়ি মিলিটারী পুলিশ চেক পোস্টের উত্তর দিকে ভোজ বিহার অবস্থিত। কোটবাড়ি মিলিটারী পুলিশ চেক পোস্ট দিয়ে সেনানিবাসে প্রবেশ করে আনুমানিক আধা কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলে হাতের বাম পাশে বাংলার প্রাচীন এই বৌদ্ধ বিহারের দেখা মিলবে। খননের ফলে এখানে ব্রোঞ্জনির্মিত একটি বজ্রসত্ত্ব মূর্তি পাওয়া গেছে। সাধারনতঃ বজ্রসত্ত্ব মূর্তি মহাযান মার্গের অনুসারীদের উপাস্য এবং তা বাঙলায় ১০ম শতাব্দীর আগে প্রচলিত ছিল না। কিন্তু মূর্তি বিশ্লেষনের পর অনেক বিশেষজ্ঞই ধারনা করেন যে, মূর্তিটি ৮ম শতকে নির্মিত আর বিহারটিও তাই ৮ম শতক কিংবা এর আগেই নির্মিত হয়ে থাকতে পারে। আবার কেউ কেউ বলছেন মূর্তিটি আসলে ১০ম শতাব্দীর বা তৎ-পরবর্তী সময়ের। সুতরাং বিহারটি ৮ম থেকে ১০ম শতকের কোন এক সময় নির্মিত বলে ধরে নিলাম।
বিহারটিতে বিভিন্ন সময় খনন কাজ পরিচালনা করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে জানা যায় যে, বিহারটি বর্গাকার। প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ১৩৭.২ মিটার। বৌদ্ধবিহারের চিরাচরিত ধারায় এই বিহারের প্রবেশ পথটিও উত্তর দিকে। প্রতি বাহুর সাথে চারিদিক বেষ্টন করে ভিক্ষু ও শ্রমণদের আবাসনের জন্য ছোট ছোট ঘর আছে। ঘরের সংখ্যা এখনো নির্ণয় করা হয়নি আর এই ঘরগুলোর সব এক মাপেরও নয়, এর কোন কোনটির দৈর্ঘ্য ৩.৫ মিটার ও প্রস্থ ৩.৩ মিটার করে আর কতকগুলোর আবার ৩.১ ও ৩.২ মিটার পরিমাপের। বিহারের বাহিরের দেওয়ালের প্রশস্ততা আনুমানিক ৪.২৪ মিটার।
বিহারে কেন্দ্রীয় মন্দিরের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। সুগঠিত প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ও ক্রুশাকার মন্দিরটি বেশ প্রকান্ড বলেই মনে হয়। মন্দিরের প্রতি বাহুর পরিমাপ ৩৪ মিটার। গর্ভগৃহের দৈর্ঘ্য ৩.১ মিটার ও প্রস্থ ১,১ মিটার। গর্ভগৃহের চারিদিকে প্রদক্ষিন পথের প্রশস্ততা আনুমানিক ২.২ মিটার। মন্দিরের বাহিরের দেওয়ালের পরিমাপ আনুমানিক ২ মিটার। মন্দিরের নিম্নাংশ অলংকৃত ইট, পোড়ামাটির চিত্রফলক ইত্যাদি দ্বারা সুশোভিত ছিল। আদি নির্মাণকালসহ বিহারটিতে ২টি নির্মাণকালের চিহ্ন বিদ্যমান।
ভোজ বিহারে প্রাপ্ত প্রত্ন নিদর্শনের মধ্যে ১.৪ মিটার উঁচু ব্রোঞ্জের তৈরী একটি বজ্রসত্ত্ব মূর্তি, স্থানীয় মেটেপাথরের দ্বারা নির্মিত মাঝারি মাপের একটি ধ্যানীবুদ্ধ অমিতাভ ও একটি ধ্যানীবুদ্ধ অক্ষোভ্য মূর্তি, রুপার তৈরী হরিকেল মুদ্রা উল্লেখযোগ্য। মূর্তি ছাড়াও এখানে অতি সুন্দর পোড়ামাটির চিত্রফলক পাওয়া গেছে।
 
বিহারের দেওয়াল টেরাকোটার ফলকচিত্রে সুসজ্জিত। জীবজন্তুর ফলক চিত্র ছাড়াও গন্দর্ভা, কিন্নরা ও মানুষের বিভিন্ন অবস্থানের চিত্র্রও সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয়দের কাছে বিহারটি ‘ভোজরাজার বাড়ি’ নামেও পরিচিত।
 
———————————————————————————————————————————————–
 
১৬ মার্চ ২০১৮ খ্রীঃ/ঢাকা-১২৩০/
 
তথ্যসূত্রঃ
১. বেড়ানোঃ ঐতিহাসিক পুরাকীর্তির নগরী কুমিল্লা, দৈনিক আমার দেশ, ৩১ ডিসেম্বর ২০১২ খ্রীঃ/
২. Department of Archaeology of Bangladesh
৩. প্রত্নতাত্ত্বিক ঐম্বর্য্যে সম্মৃদ্ধ কুমিল্লা, ০৪ ফেব্রূয়ারী ২০১৪ খ্রীঃ/
৪. প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে ভ্রমন, খান মাহবুব, দৈনিক যুগান্তর, ১৫ জুন ২০১২ খ্রীঃ/
৫. কোটবাড়িতে দেখে আসুন ঐতিহাসিক নিদর্শন, শ্যামল রুদ্র, দৈনিক প্রথম আলো, ২৭ জানুয়ারী ২০০৪ খ্রীঃ/
৬. ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার এক ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যকীর্তির নাম, রমজান বিন মোজাম্মেল, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ আগষ্ট ২০০৭ খ্রীঃ/
৭. The Remains of a Rich & vibrant Past, Reema Islam, The Daily Star, 10 November 2006 AD/
৮. মনোলোভা শালবন বিহার, গাজীউল হক, দৈনিক প্রথম আলো, ০৮ জানুয়ারী ২০১৫ খ্রীঃ/
৯. কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু, মো. লুৎফুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ জানুয়ারী ২০১৬ খ্রীঃ/
১০. বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, পৃঃ ৬৪৮-৬৫০/
১১. Early Terracotta Figurines of Bangladesh, Saifuddin Chowdhury, পৃঃ ১৩১/
১২. পুরাতত্ত্বের বাংলাদেশ ঐতিহ্যের বাংলাদেশ, মোহা. মোশাররফ হোসেন, পৃঃ ১৫৮/
১৩. গ্রাফোসম্যানের ভ্রমণ ব্যবস্থাপনা, ড. ছন্দশ্রী পাল, পৃঃ ৯৪/
১৪. হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, পৃঃ ৩৯৯/
১৫. প্রাচীন বাংলার প্রত্নকীর্তি, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ৪৫/
১৬. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ৬০/
১৭. Excavations At Ananda Vihara, Mainamati, Comilla 1979 – 82, Md. Shafiqul Alam, Md. Abul Hashem Miah, পৃঃ ১/

২ টি মন্তব্য : “ভোজ বিহার-কুমিল্লা”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।