ইটাখোলা মুড়া – কুমিল্লা

কুমিল্লা-কোটবাড়ি-কালির বাজার রাস্তা ধরে কালির বাজারের দিকে যেতে থাকলে বাংলাদেশ একাডেমী ফর রুরাল ডেভলপমেন্ট (BARD)’র প্রধান গেট অতিক্রম করে হাতের ডানে ক্যান্টনমেন্ট কলেজ দেখলেই থামুন। কলেজের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে একটি সরু রাস্তা উত্তরে এমনভাবে চলে গেছে যেন পাহাড়ে গিয়ে তা পথ হারিয়ে ফেলেছে। আপনি ঐ পথই ধরবেন, কিন্তু তার আগে উত্তরে আপনার দৃষ্টি প্রসারিত করুন। হ্যাঁ ইটের ভাটার মতো একটি স্থাপত্য দেখা যাচ্ছে নাহ!! সামনে ৫০ মিটার খানিক এগিয়ে চলুন, দেখবেন ওটা ইটের ভাটা নয় … এক হাজার বছরের পুরোনো এক প্রাচীন মন্দির – ‘চারিদিকে ভরা জঙ্গল, তার উপর সাপ-খোপের ভয় সব মিলিয়ে এক ভৌতিক পরিবেশ’; ইতিহাসের নীরব স্বাক্ষী কালের ধুলোবালিতে এমনিভাবেই নিজেকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল যাতে কষ্মিনকালেও সাধারন মানুষজন ওমুখো না হয়, কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঠিকাদাররা এখান থেকে নির্বিচারে ইট তোলা শুরু করলে পর এর উপরের মাংশল অস্তিত্বে হাড্ডিসার কঙ্কাল রূপটি অনাবৃত হয়ে পড়ে – দূর থেকে দেখলে মনে হতো এ যেনো এক ইটের ভাটা। স্থানীয়রা মাটির ঢিবিকে মুড়া বলে থাকেন, ইটের ভাটার মতো দেখতে ঢিবিটি তাই ‘ইটাখোলা মুড়া’ নামে সকলের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। এখান থেকে এত অগনিত ইট উত্তোলন করা হয়েছিল যে, সাধারন মানুষের বদ্ধমূল ধারনা হয়েছিলো এটা প্রাচীন কোন ইটের ভাটা। প্রাথমিক প্রত্নতাত্বিক পর্যবেক্ষণে ইটাখোলা মুড়া নামে ২টি স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছিল তাই এটাকে অনেকে বড় ইটাখোলা মুড়া নামেও অবিহিত করে থাকেন।

সমতল থেকে আনুমানিক ১৮-২০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত, ৭ম/৮ম শতকের কোনো এক সময় নির্মিত ইটাখোলা মুড়া মূলতঃ একটি বৌদ্ধ বিহার। এই বিহারের ভূমি পরিকল্পনা বাংলাদেশের বৃহৎ ‍বিহারগুলোর তুলনায় খানিকটা পৃথক। এখানকার মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী, ভূমি বিন্যাস, বৃহৎ আয়তনের মন্দিরের গঠন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য ও সমগ্র লালমাই-ময়নামতি পাহাড় শ্রেণির মধ্য ভাগে অবস্থিত হওয়ায় ধারনা করা সমীচিন যে স্থাপনাটি এখানকার অন্যান্য স্থাপনার তুলনায় প্রাচীন বা প্রথম দিককার নিদর্শন। চিরাচরিত নিয়মে বিহারের প্রধান দু’টি অংশ থাকে; কেন্দ্রীয় মন্দির ও আবাসন। বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরটি এর আবাসিক অংশ থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত। তাছাড়া এই বিহারের আবাসিক অংশ অপেক্ষা মন্দিরের আয়তন ও আকৃতি তুলনামূলকভাবে বড়। মন্দিরের আনুমানিক ৫০ মিটার উত্তরে ও ১৫০ মিটার পূর্বে দু’টি আাবাসিক অংশ/বিহার রয়েছে। উত্তরের অংশটি ইটাখোলা মুড়ার অংশ আর অপরটির নাম লোতিকোট মুড়া। লোতিকোট মুড়ায় কোনো মন্দির নেই। তাহলে উভয় আবাসিক অংশ/বিহার কি এই মন্দিরকে কেন্দ্র করেই তৈরী করা হয়েছিল?

এই বিহারের মূল আকর্ষণ এর মন্দিরটি। মন্দিরটি কত প্রাচীন তা নির্ণয় করা হয়নি তবে এটি যে অতি মনোরম ও আকর্ষনীয় একটি বৌদ্ধ মন্দির তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চারিদিকে প্রাচীর ঘেরা মন্দিরটি আয়তকার। প্রাচীরটির দৈর্ঘ্য ৮০.০ মিটার, প্রস্থ ৫৬.৩ মিটার ও চওড়া ১.৮৩ মিটার। কিন্তু ২য় নির্মাণ যুগে এসে এর প্রশস্ততা ০.৩০৪৮ মিটার কমিয়ে ফেলা হয়। পাশাপাশি প্রাচীরের বাহিরের অংশটি ‘বেন্ড’ ও ‘প্যানেল’ দ্বারা অলংকরণ করা হয়।

মন্দিরের প্রবেশ পথ পূর্বদিকে। প্রবেশ তোরণের ২২টি সিঁড়ি অতিক্রম করে উচুঁ প্লাটফর্মের উপর স্থাপিত মন্দিরে উঠতে হয়। প্রবেশ পথের ১২টি মেঝের অস্তিত্ব থেকে ধারনা করা হয় যে, বহু ব্যবহারের কারনে এটি বারবার সংস্কার বা পুনঃনির্মান করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ৪র্থ নির্মাণ যুগে প্রবেশ পথের সিঁড়ির সামনে বিভিন্ন নকশায় ৩টি স্তুপ তৈরী করা হয় যা অনুচ্চ প্রাচীর দিয়ে পরবর্তীতে ঘিরে রাখা হয়।

প্রবেশ পথের কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে পর আয়তকার ক্ষেত্রের মাঝখানে মূল মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের এই অংশের দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৪১.৬ মিটার ও প্রস্থ ৫৫.৬ মিটার। পূর্ব দিকের প্রাচীর হতে ১৬.৬ মিটার, পশ্চিম দিক হতে ১৮.৮ মিটার ও উত্তর দক্ষিণ উভয় দিক হতে ১৪.২ মিটার দূরে মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলে চারিদিক জুড়ে একটি প্রদক্ষিন পথ রয়েছে (যার দৈর্ঘ্য ৪১.৬৪ মিটার ও প্রস্থ ২৪.৯৯ মিটার)। প্রদক্ষিন পথকে বেষ্টন করে থাকা প্রাচীরটির প্রশস্ততা ১.১৯/১.২২ মিটার যা সব জায়গায় সমান নয়। প্রদক্ষিন পথে আলো বাতাস সঞ্চালনের জন্য বেষ্টনী প্রাচীরের মাঝে মাঝে জানালা ছিল।

প্রদক্ষিন পথের পূর্ব দিক হতে মন্দিরের দেওয়াল ঘেরা অংশে প্রবেশ করলে সরু লম্বা ৩টি পথ দক্ষিনমূখী হয়ে নিরেট গর্ভগৃহের দিকে চলে গেছে। এই প্রতিটি পথের মাঝেরটির প্রশস্ততা ৩.৮৪ মিটার হলেও পাশের ২টির প্রশস্ততা ৩.৯৩ মিটার। গলি পথের পশ্চিম প্রান্ত ১৩.১১ মিটার বাহু বিশিষ্ট একটি বর্গাকার মঞ্চের সাথে সংযুক্ত। ৩য় নির্মাণ যুগে এই মঞ্চের উত্তর ও দক্ষিন অংশে ৪.৩ মিটার বৃদ্ধি করে তা সম্প্রসারন করা হয়। এখানে আরো ৪টি মূর্তি প্রকোষ্ঠ নির্মাণ করা হয়। ফলে প্রদক্ষিন পথটি বন্ধ হয়ে যায়। স্বাভাবিক কারণেই বেষ্টনী প্রাচীরও তাই নতুন করে তৈরী করতে হয়।

২য় নির্মাণ যুগে মূর্তি প্রকোষ্ঠের সামনের পথের প্রশস্ততা বৃদ্ধি করা হয়। আর তা করার কারন সম্ভবতঃ এই যে সেই সময় এখানে ভিক্ষুদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা। ঠিক এই সময় আগের মেঝে প্রায় ০.৩০৪৮ মিটার উঁচু করে ৩য় মেঝে তৈরী করা হয়। ৩য় নির্মাণ যুগে ভিক্ষুদের আবাসিক এলাকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে আরেকটি দেওয়াল তৈরী করা হয় এবং আবাসিক কক্ষগুলোকে মূর্তি প্রকোষ্ঠে রূপান্তর করা হয়। ৪র্থ নির্মান যুগে মূল পথের দু’পাশের দেওয়াল আরো চওড়া করা হয়। একই সময় গর্ভগৃহের উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে কুলঙ্গি তৈরী করা হয় যাতে প্রদীপ রাখা যেতো। তবে ব্রোঞ্জের তৈরী মূর্তিও মনে হয় সেখানে রাখা হতো।

মঞ্চের পূর্ব দিকের মাঝে ও মধ্যবর্তী গলি পথের পশ্চিম প্রান্তে গর্ভগৃহের মূল বেদী বা মূর্তি প্রকোষ্ঠ (দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ২.৪৪ ও ২.১৩ মিটার) অবস্থিত। বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ১ম নির্মাণ যুগ হতে ৩য় নির্মাণ যুগ পর্যন্ত বর্তমান স্থানেই মূর্তি প্রকোষ্ঠটি বিদ্যমান ছিল। অর্থাৎ আমরা এখন যে প্রকোষ্ঠটি দেখছি তা ৩য় নির্মাণ যুগের। ১ম ও ২য় নির্মাণ যুগের মূর্তি প্রকোষ্ঠটি ৩য় টির নীচে চাপা পড়ে আছে। মূর্তি প্রকোষ্ঠটিতে খিলানযুক্ত নর্দমার চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। ৪র্থ নির্মাণ যুগে এই মঞ্চকে আরো উঁচু করে দ্বিতীয় বেদীতে রূপান্তর করা হয় যা দেখতে ভারী সুন্দর। এই সময়ই মূর্তিসহ মূর্তি প্রকোষ্ঠটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়, এমনকি সামনে একটি দেওয়ালও তুলে দেওয়া হয়। ফলে মূর্তি প্রকোষ্ঠের প্রবেশমূখটি সংকুচিত হয়ে পড়ে।

এই মন্দিরের প্রধান উপাস্য হলেন ধ্যানী বুদ্ধ অক্ষোভ্য। আদর্শ মানুষ পরিমাপের বুদ্ধের এই মূর্তিটি ৩য় নির্মাণ যুগে জমাটবদ্ধ চুনবালি দ্বারা তৈরী করে বেদীতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূর্তিটি মাথাবিহীন ও ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার আগে অর্থাৎ ৩য় নির্মাণ যুগের আগে বা ১ম ও ২য় যুগে এখানে অন্য কোনো মূর্তি ছিল কিনা তা খনন ব্যাতীরেখে বলা সম্ভব নয়।

৪র্থ নির্মাণ যুগে মন্দিরের পশ্চিমে বহিঃবেষ্টনীর ভিতরে একটি ক্রশাকৃতির স্তুপ অনুচ্চ প্রাচীর ঘেরা অবস্থায় নির্মাণ করা হয়। ৫ম নির্মাণ যুগে এসে এখানে একটি নতুন বেদীও স্থাপন করা হয়। ক্রশাকৃতির স্তুপটির দৈর্ঘ্য ৭.০১ মিটার ও প্রস্থ ৬.৭১ মিটার। অপরদিকে বেদীর আয়তন ২.৮৩-১.৫২-১.৫২ ঘনমিটার।

মন্দিরের বেষ্টনী প্রাচীরের ভিতরে উত্তর ও দক্ষিন দিকে ২টি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। বর্গাকার এই স্থাপনার প্রতিটি বাহু ৩.৯৬ মিটার এবং এর মাঝখানে ০.৯১ মিটারের একটি গর্ত আছে। তবে এটি যে কি উদ্দেশ্যে নির্মাণ ও ব্যবহার করা হতো তা জানা যায়নি। ধারনা করা হয় ১ম নির্মাণ যুগে এর মেঝে এবং ৩য় নির্মাণ যুগে স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। এই স্থাপনা ও পিছনের সিঁড়ির মধ্যবর্তী স্থানের উভয় পাশে আরো ২টি ছোট আকারের স্তুপ তৈরী করা হয়।

মন্দির ও বেষ্টনী প্রাচীরের মধ্যবর্তী খোলা অংশে ৫ম নির্মাণ যুগে নির্মিত বেশ কিছু দেওয়ালের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেলেও তা কি কারনে প্রয়োজন হয়েছিল তা বোঝা যায় না। মন্দিরের প্রাচীরের ‘প্যানেল’ অলংকরন ছাড়া আর কোথাও কোনো কারুকাজ দেখা যায় না। এমনকি মূল মন্দিরের গায়েও কোনো কারুকাজ নেই, বিষয়টি থানিকটা অস্বাভাবিকই বটে। যাহোক পুরো স্থাপনাটি কিন্তু ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল।

মন্দিরের উত্তরে এবং মন্দির থেকে আনুমানিক ২.১৩/২.৪৪ মিটার উচুঁতে অবস্থিত আবাসিক স্থাপনাটি বর্গাকার যার প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ মিটার করে। স্থাপনাটি পূর্বমূখী। আশ্চর্য্যজনকভাবে মন্দির ও আবাসন এলাকার মধ্যে কোনো পাকা সংযোগ সড়ক নেই। তবে পায়ে চলা পথ রয়েছে। বিষয়টি এমন হতে পারে যে, মন্দিরটি আবাসন এলাকা তৈরীর পূর্বেই নির্মাণ করা হয়েছিল। মন্দিরের উত্তরের দিকে কোনো প্রবেশ পথ রাখা হয়নি, ফলে আবাসনের দক্ষিণ দিকে কোনো পথ বা ফটক রাখা সম্ভব হয়নি। অনিবার্য কারণেই আাবসিক এলাকাটি পূর্বমূখী করে গড়ে তুলতে হয়েছে আর প্রয়োজনের তাগিদেই পায়ে চলার পথটিও তৈরী হয়েছে। প্রত্নতাত্বিক বিশ্লেষনে দেখা যায় আবাসিক এলাকাটি ৩য় নির্মাণ যুগে প্রতিষ্ঠিত, যে সময় মন্দিরের ভিক্ষুদের ঘরগুলোকে মূর্তি প্রকোষ্ঠে রূপান্তরিত করা হয়। স্বভাবতই আবাসনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ঘরগুলো স্থানান্তর করে বর্ধিতাকারে উত্তর দিকে বিহাররূপে সম্প্রসারন করা হয়।

আবাসিক এলাকাটি ২.৫৩ মিটার চওড়া দেওয়াল দিয়ে সুরক্ষিত। এই দেওয়ালের অপর দিকে চতুর্মূখী সারিবদ্ধ ২০টি ঘর রয়েছে। ঘরগুলো বিভিন্ন আকৃতির। মোট ২০টি ঘরের মধ্যে ১৯টি ঘরে ভিক্ষু/শ্রমণরা বসবাস করতেন, পূর্বদিকের ১টি ঘর প্রবেশ পথ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ২য় নির্মাণ যুগে পশ্চিম দিকের ১টি ঘর ভাগাড় ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কোন কোন ঘরে পূঁজার লক্ষ্যে বেদীর অবস্থানও পরিলক্ষিত হয়। দু’টো ঘরের মধ্যবর্তী দেওয়াল ১.৫২ – ২.১৩ মিটার পর্যন্ত পুরু। ঘরগুলোর অর্ন্তমূখী দরজা ২.৭১ মিটার চওড়া একটি টানা বারান্দায় গিয়ে উঠেছে। স্থাপনার ২য় নির্মাণ যুগে এই বারান্দার প্রশস্ততা খানিকটা সংকুচিত করা হয়। বারান্দার অপর দিকটি ০.৯৮ মিটার চওড়া একটি দেওয়ালে গিয়ে শেষ হয়। মূলতঃ সর্বশেষ দেওয়ালটি বর্গাকার (১৬.৪৬ মিটার) খোলা চত্বরকে ঘিরে রেখেছে। পশ্চিম দিকের দেওয়াল ঘেঁষে চত্বরে উঠা-নামার জন্য কয়েক ধাপের একটি সিঁড়ি আছে। খোলা চত্বরের উত্তর-পূর্ব দেওয়ালের দিকে বিহারের পানিয় জলের চাহিদা নিবারণের জন্য একটি কাঁচা কূপ তৈরী করা হয়। সমতল ভূমিতে এমন কূপের অস্তিত্ব স্বাভাবিক হলেও পাহাড় চূঁড়ায় অবস্থিত ছোট আকারের বিহারের এরূপ কূপের সন্ধান বাংলাদেশে বিরল।

পূর্বদিকের একমাত্র প্রবেশ পথ দিয়ে এই খোলা চত্বরে কিংবা আবাসিক এলাকার মূল ভবনে প্রবেশ করা যায়। প্রবেশপথটি পূর্বদিকে হওয়ায় এই দিকের ঘরের সংখ্যা একটি কম, যা প্রবেশ পথের সাথে মূল চত্বরের সংযোগ স্থাপন করেছে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ১ম নির্মান যুগে প্রবেশ তোরণে প্রহরী কক্ষ থাকলেও ২য় পর্যায়ে এসে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সাথে এর সামনের অংশও বর্ধিত করা হয়।

এখানে যে সমস্ত প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে সেই সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৮ তোলা ওজনের স্বর্ণ, মাটির পাতিলে রক্ষিত ৩টি সোনার বল, ১টি রূপা মুদ্রা, ১টি তাম্রশাসন, মাটির ফলকলিপি, ধ্যাণী বুদ্ধ মূর্তির আাবক্ষ অংশ, দুটি ক্ষুদ্রাকারের ধাতব ধ্যানীবুদ্ধ অক্ষোভ্য, দুটি ধাতব ধ্যানীবুদ্ধ অমিতাভ, একটি গণেশ মূর্তি, পাথরের টুকরো, অলংকৃত পোড়া মাটির ফলক, বাঁকানো ইট, বড় আকারের পাতিল, পাতিলের টুকরা, মাটির পাত্র, তেলের প্রদীপ, প্রদীপদানি/দন্ড, জাতাকল, জীবাষ্ম/অস্থিভস্ম কাঠ, কাঁচ, জমাটবদ্ধ বস্তু, লাল/গৈরিক মাটির খন্ড, লোহার টুকরো ইত্যাদি।

মন্দিরে ৫টি ও আবাসিক এলাকার ৩টি নির্মাণ যুগের মাধ্যমে উভয় স্থাপনা পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠা করা হয়। জীর্ণদশা বা রক্ষানাবেক্ষনের জন্যই সংস্কার/মেরামত কাজ করা হয়ে থাকে এবং যথেষ্ট পুরোনো হলেই তা করতে হয়। অথবা আঙ্গিকে পরিবর্তন আনার জন্য কিংবা ভেঙ্গে যাবার পর পুনরায় বানানোর প্রয়োজনেও তা করা হতে পারে। এই সবই স্থাপনার প্রাচীনতার প্রমান। যাহোক, আরো অন্যান্য অনেক কারণই থাকতে পারে কিন্তু শেষবার নির্মাণ/সংস্কার করার পর মন্দিরের রূপ যে কি রকম ছিল তা আজ আর জানার কোনো উপায় নেই কেননা ইট হরনকারীদের দৌরাত্ব্যে তা ধ্বংস হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত গবেষণা, বিজ্ঞানভিত্তিক উৎখনন, পর্যটন বান্ধব পরিবেশ, পরিকল্পিত ব্যাবস্থাপনা ও ব্যাপক প্রচার-প্রচারনার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে আমাদের নিদর্শনগুলো তুলে ধরতে হবে। তাহলে প্রকৃত তথ্যের সন্ধানে মিলবে, তবেই লুপ্ত হবে মনগড়া সব অমূলক কিচ্ছা কাহিনী। অতএবঃ লালমাই-ময়নামতি পাহাড় শ্রেণির প্রত্ন নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের আশু ব্যাবস্থা গ্রহণ করা না হলে অচিরেই হারিয়ে যাবে আমাদের অমূল্য এই সব সম্পদ।

————————————————————————————————————————————————

২৭ জানুয়ারী ২০১৮ খ্রীঃ/ঢাকা-১২৩০/

 

তথ্যসূত্রঃ

১. প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে ভ্রমন, খান মাহবুব, দৈনিক যুগান্তর, ১৫ জুন ২০১২ খ্রীঃ/

২. দেখুন ময়নামতিকে, মোহাম্মদ উল্লাহ রিপন/

৩. ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার এক ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যকীর্তির নাম, রমজান বিন মোজাম্মেল, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ আগষ্ট ২০০৭ খ্রীঃ/

৪. মনোলোভা শালবন বিহার, গাজীউল হক, দৈনিক প্রথম আলো, ০৮ জানুয়ারী ২০১৫ খ্রীঃ/

৫. কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু, মো. লুৎফুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ জানুয়ারী ২০১৬ খ্রীঃ/

৬. বাংলার প্রাচীন সভ্যতা ও পুরাকীর্তি, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ১৪৮/

৭. পুরাতত্ত্বের বাংলাদেশ ঐতিহ্যের বাংলাদেশ, মোহা. মোশাররফ হোসেন, পৃঃ ১৫৮/

৮. গ্রাফোসম্যানের ভ্রমণ ব্যবস্থাপনা, ড. ছন্দশ্রী পাল, পৃঃ ৯৪/

৯. হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, পৃঃ ৩৯৯/

১০. প্রাচীন বাংলার প্রত্নকীর্তি, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ৪৫/

১১. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ৬০/

১২. বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, পৃঃ ৬৫৬/

১৩. ইটাখোলা বিহার (৭ম-১৩শ শতক পর্যন্ত বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন), হাবিবুর রহমান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর/

১৪. Excavation report on Itakholamura, Mainamati, Comilla, Habibur Rahman/

১৫. মহাস্থান ময়নামতি পাহাড়পুর, ডক্টর নাজিমুদ্দিন আহমেদ, পৃঃ ৭৬-৭৭/

১৬. অন্তঃজাল

২ টি মন্তব্য : “ইটাখোলা মুড়া – কুমিল্লা”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।