বারো শিবালয় মন্দির – জয়পুরহাট

জয়পুরহাট জেলা সদরের হেলকুন্ডা গ্রামে বাস করতেন কান্ত মন্ডল ও তার পরিবার। পেশায় গন্ধ-বনিক কান্ত মন্ডল নবাবী আমলে (১৭০৭ – ১৭৫৭ খ্রীঃ) অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য্যে এতটাই সম্মৃদ্ধি অর্জন করেন যে, তাকে মূর্শিদাবাদের তৎকালীন ধন্যাঢ্য ব্যাক্তি জগৎশেঠের সাথে তুলনা করা হতো। এই বংশেরই অন্যতম সফল পুরুষ রাজীব লোচন মন্ডল।

সম্ভবতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে অথবা উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজীব লোচন মন্ডল জয়পুরহাট জেলার সদর উপজেলার বেল আমলা গ্রামে ‘বারো শিবালয় মন্দির’ নামে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। দীর্ঘদিন যাবৎ এটি তার এক অনন্য কীর্তি হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ধারনা করি, অপব্যবহার আর সঠিক রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ মন্দিরটি পাকিস্তানামলে (১৯৪৭ – ১৯৭১ খ্রীঃ) সংস্কার করে স্থানীয় মাড়োয়ারীরা চিরতরে ধ্বংসের হাত থেকে তা উদ্ধার করে।

চতুর্মূখী এই মন্দিরে প্রবেশের জন্য উত্তর ও পশ্চিম দিকে ২টি প্রবেশ পথ রয়েছে। প্রতি পাশে ২টি করে ৪ পাশে ৮টি ও প্রতি কোণায় ১টি করে ৪ কোণায় ৪টি, মোট ১২টি শিব মন্দির আছে। মন্দিরগুলো উঁচু মঞ্চের উপর স্থাপিত। খিলানাকৃতির ১টি করে দরজা দিয়ে ক্ষুদ্র আকৃতির মন্দিরগুলোতে প্রবেশ করতে হয়। প্রতিটি মন্দিরেই ১টি করে কালো পাথরের শিবলিঙ্গ বেদীমূলের উপর স্থাপিত যা এখানকার ধ্বংসস্তুপ হতে পূর্বে উদ্ধার করা হয়েছিল। মাঝখানে যে মন্দির আঙ্গিনা রয়েছে এর মধ্যখানে সাম্প্রতিককালে একটি নন্দীমূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়াও প্রতি বাহুর মন্দিরদ্বয়ের মাঝখানে শ্রী সেতু বন্ধন রামেশ্বর ধাম, শ্রী দুয়ারকাপুরী ধাম, শ্রী শ্রী রাধা গোবিন্দ মন্দির, শ্রী বদরীন ধাম, শ্রী জগন্নাথপুরী ধাম ইত্যাদি ধাম/মন্দিরও রয়েছে।

মন্দিরে ব্যবহৃত ইটের আকৃতির ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। স্থপতি অত্যন্ত নান্দনিকভাবে স্থাপত্যকে গড়ে তোলার জন্য এবং রাজমিস্ত্রী ও তার যোগানদারের কাজের সুবিধার খাতিরে এই সব ইটের উপর বিভিন্ন চিহ্ন ব্যবহার করেছেন যাতে খুব সহজেই তা শ্রেণিবদ্ধ করা যায়। এই সব চিহ্নের মধ্যে ঘট, পদ্ম, তরবারি ইত্যাদি ছাড়াও সংখ্যা যেমন ১, ২, ৩ ইত্যাদির নকশাকাটা/চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। এই কারুকাজের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, ইটের উপর নকশা করা চিত্রকর্মটি কোনো ছাঁচে তৈরী করা নয় বরং এগুলো ধারালো ছুরি বা এই জাতীয় কিছু দিয়ে অত্যন্ত নিপুণভাবে সূক্ষতার সাথে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। মন্দিরের শৈল্পিক দেওয়াল নানা কারুকাজে শোভিত যেখানে উৎকৃষ্ট মানের পোড়ামাটির ফলক ও দেওয়াল চিত্র ব্যবহৃত হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র দাবী করে যে, মন্দিরটি হাজার বছরের পুরোনো। কোন কোন তথ্য থেকে জানা যায়, মন্দিরটি ৭ম/৮ম শতাব্দীতে নির্মিত এবং পাল নৃপতি ধর্মপাল (৭৭০ – ৮১০ খ্রীঃ) নির্মাণ করে বলে জনশ্রূতি আছে। আবার অনেকের বিশ্বাস সেন নৃপতি বল্লাল সেন (১১৫৮ – ১১৭৯ খ্রীঃ) মন্দিরটি নির্মাণ করেছেন। তারা বলেন, বল্লাল সেন শৈব ধর্মাবলম্বী বা শিব উপাসক ছিলেন বিধায় তিনিই এর নির্মাণকর্তা। কিন্তু এসবের পক্ষে তেমন কোন জোরালো প্রমান নেই। এই স্থান/বেল আমলা গ্রাম থেকে বাসুদেব মূর্তি, চন্ডীমূর্তি, সূর্যমূর্তি ও বুদ্ধমূর্তি খোদিত চারকোণাকার একটি পাথর খন্ড উদ্ধার করা হয়। ‘রাজ্ঞীশ্রীগীতা ললিতা’-খোদিত চন্ডীমূর্তিটি যেখানে পাওয়া যায়, সেই স্থান খননকালে একটি মন্দিরের চূঁড়া বা সেই রকম কিছু একটা দৃষ্ট হয়, তাতে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন যে, এখানে প্রাচীন একটি মন্দির ছিল যা পরবর্তীকালে মাটির ভিতর দেবে যায়। প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, প্রাচীন মন্দিরের ভিত্তিমূলের উপর রাজীব লোচন বহু অর্থ ব্যায়ে মন্দিরটি পূনঃনির্মাণ করে। পাকিস্তান আমলে ও পরে হয়ত সংস্কার কাজ করা হয়। অধুনা সংস্কার করার সময় আধুনিক টাইলসেরও ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০৬ খ্রীঃ দিকে মন্দিরের চারপাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে।

মন্দিরে নিয়োজিত একজন পুরোহিত প্রতিদিন মন্দিরে পূঁজা নিবেদন করে থাকেন। তাছাড়া প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের চতুর্দশীতে শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে মন্দির চত্বরে মেলার আয়োজন করা হয় এবং শ্রাবণ মাসের শেষ পূর্ণিমার আগের সোমবার শিব-এর মাথায় পানি ঢালা হয়। এই সব উপলক্ষ্যে মন্দির এলাকায় দেশ-বিদেশের অগনিত ভক্ত ও দর্শনার্থীদের সমাগম হয়ে থাকে। শিবের মাথায় পানি ও দুধ ঢালা উপলক্ষ্যে কাউনর তোলার প্রথা এখনো মাড়োয়ারী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে চালু আছে। মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম কোল ঘেঁষে বয়ে চলা যমুনা নদীর তীরে শিবরাত্রির মেলা ৩ দিন ধরে চলে এবং এটি স্নানের মেলা নামেও স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। এই সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা মন্দির সংলগ্ন ঐ যমুনা নদীতে বারুণী স্নানে (গঙ্গার আরেক নাম বারুণী। বারুণী স্নান গঙ্গা স্নানের মতই তাৎপর্যপূর্ণ। এটি সনাতনি হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি স্নানোৎসব। স্নানের মধ্যে দিয়ে পাপের কালিমা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।)  অংশ গ্রহণ করে থাকেন। চিরাচরিত রীতিতে শিব-দর্শন, উলুধ্বনি, কীর্তন অনুষ্ঠান, মানত করা, গীতা পাঠ, অন্নভোগ বিতরন আর ঢাক-ঢোল বাজিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশে সকল অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়ে থাকে।

এই স্থানে আরো কয়েকটি প্রাচীন দেবালয়ের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। অন্যদিকে একই স্থানে মন্ডল পরিবারের বাড়ি, মালখানা ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষ ছিল বলে স্থানীয়রা দাবী করে থাকেন। আবার এখান থেকেই ৩৬০ টি মূর্তি খোদাই করা কারুকাজ সম্বলিত এক জোড়া কাঠের দরজা পাওয়া গেছে। লোক মুখে জানা যায়, দরজাটি ৭০’র দশকে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক অধিগ্রহন করা হয়। বিভিন্ন প্রত্ন-নিদর্শনের উপস্থিতি আলোচ্য অঞ্চলটির প্রাচীনতা নির্দেশ করে। ‘মন্ডল’ – একটি উপাধি বটে, তবে মনুসংহিতায় আছে মন্ডল অর্থ ক্ষুদ্র/শাখা রাজা/সামন্ত প্রভূ। গুপ্ত শাসনামলে (খ্রীঃ ৪র্থ – ৬ষ্ঠ শতক) ‘প্রাদেশিক’ শাসনকর্তাকে মন্ডল বলা হতো। পাল শাসনামলেও (৭৫০ – ১২০০ খ্রীঃ) মন্ডল’র ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। হেলকুন্ডা’র মন্ডল পরিবারের বংশ-পদবী, ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের পাশাপাশি গোষ্ঠীর-কোষ্ঠী বিচার করা সম্ভব হলে ও প্রাপ্ত নিদর্শনের কাল নির্ণয়ের বিজ্ঞান ভিত্তিক ফলাফল অর্জনের মাধ্যমে মন্দির তথা হারিয়ে যাওয়া এক সভ্যতার দ্বার উম্মোচন করা সম্ভবপর হতো।

মঠের মত দেখতে দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্যরীতির আদলে তৈরী এতগুলো শিব মন্দিরের একত্রে অবস্থান নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের একটি বিরল নিদর্শন। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার বরাত দিয়ে জানা যায় যে, চলতি বছরের মে মাসে দুর্বৃত্তরা মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করে ভেতরের ১২টি ও বাইরের ১টি শিবলিঙ্গ, গরুর মূর্তি, তুলশী গাছের বেদী ইত্যাদি ভেঙ্গে ফেলেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ৭২ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তির মাত্র ১২ বিঘা এখন মন্দিরের দখলে রয়েছে। জানা মতে, সুদৃশ্য প্রাচীন বারো শিবালয় মন্দিরের মতো ১২টি শিব মন্দির একত্রে জয়পুরহাটের সদর উপজেলার বেল আমলা গ্রাম ব্যতীত বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। এক ও অনন্য এই প্রাচীন প্রত্ন-কীর্তি রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের। ধর্মীয় গোড়ামী, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, অন্যের সম্পত্তির আত্মস্ম্যাৎ কোন জনগোষ্ঠীর জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না, বরং নিজেদের অমূল্য সম্পদ ‘বিবেক ও বুদ্ধি’ বিসর্জনের মাধ্যমে অর্জিত সকল সু-কীর্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আমাদের সকলেরই মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমরা আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী আমাদের পূর্ব-পুরুষদের কাছ থেকে উত্তারধিকার সূত্রে পাই নাই, বরং আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজম্মের কাছ থেকে ঋণ হিসাবে গ্রহণ করেছি …

————————————————————————————————————————————————

২০ জুলাই ২০১৭/ঢাকা-১২৩০

তথ্যসূত্রঃ

১. কোচবিহারের ইতিহাস, খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লা আহমদ, পৃঃ ১৪৩/

২. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ৫৪৫-৫৪৭/৫৫২/

৩. বগুড়ার ইতিকাহিনী, কাজী মোহাম্মদ মিছের, পৃঃ ৫৬/

৪. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন/

৫. বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, পৃঃ ২৩০-২৩১/

৬. বাংলায় ভ্রমণ, ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে (১৯৪০)/BANGLAY BHRAMAN, a `Travelogue on historical documents and legends by E. B. RAILWAY (1940), পৃঃ ৮৪/

৭. মনুসংহিতা, ড. মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, সপ্তম অধ্যায় শ্লোক ১৫৬, পৃঃ ২৫৫/

৮. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লিয়াকত হোসেন খোকন, পৃঃ ৩৭৪/৩৭৫/৪৪১/

৯. জয়পুরহাটে মন্দিরে ভাঙচুর, দৈনিক প্রথম আলো, ২৮ মে ২০১৭ খ্রীঃ/

১০. উইকিপিডিয়া/

১১. জয়পুরহাটে একই স্থানে ১২টি শিব মন্দির, দৈনিক ইত্তেফাক, ০৮ নভেম্বর ২০০৬ খ্রীঃ/

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।