বাংলার পাল সাম্রাজ্যের (৭৫০ – ১২০০ খ্রীঃ) দ্বিতীয় নৃপতি ধর্মপালের (৭৭০ – ৮১০ খ্রীঃ) ভাই বাকপালের পুত্র জয়পাল। অনির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, ধর্মপালের অপর ভাই দেবপাল (৮১০ – ৮৫০ আনুঃ খ্রীঃ) তার শাসনামলে জয়পালকে তার প্রধান সেনাপতি হিসাবে নির্বাচিত করে। জয়পাল পরবর্তী কালে এই অঞ্চল শাসন করার সুযোগ/অধিকার পান। স্থানীয়রা খঞ্জনপুরের দক্ষিণ দিকে আনুমানিক ২.৪ কিলোমিটার দূরে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপত্যের নিদর্শনকে জয়পালের রাজবাড়ি বলে চিহ্নিত করে থাকেন। এই জয়পালের নামানুসারে ‘জয়পুরহাট’ নামকরণ করা হয়েছে।
জয়পুরহাট পাল ও সেন সাম্রাজ্যের (১০৯৭ – ১২২৩ খ্রীঃ) অন্তর্ভূক্ত ছিল বটে, কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চলের আর কোন প্রামানিক তথ্য পাওয়া যায় না। তাই ধারনা করা হয়, ১৮০০ খ্রীঃ পূর্বে বাংলাদেশের নানা স্থানের মতো এই স্থানও জঙ্গলেই পরিপূর্ণ ছিল। এখান থেকে মনুষ্য বসতির নিকটতম এলাকা ছিল গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ও মাদারগঞ্জ। এদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে জঙ্গল কমতে থাকে, বিস্তৃতি ঘটে নগর সভ্যতার। এক সময় যে সব এলাকায় রাজত্ব করতো বনের হিংস্র জন্তু-জানোয়ার, ক্রমে সেখানেই গড়ে উঠতে থাকে জনবসতি। জয়পুরহাটের এই সব অঞ্চলে সেই সময় বাঘের বিচরন ছিল বেশ, ধারনা করি জনবসতি গড়ে উঠার কালে তাই এলাকার নাম হয় ‘বাঘবাড়ি’। স্বাভাবিক নিয়মেই জনবসতি গড়ে উঠাতে প্রয়োজন হলো হাট-বাজারের। বসল একটি হাট – বাঘবাড়ির হাট।
মনে হয় অতি প্রাচীন কালে বাঘবাড়ির হাটকে কেন্দ্র করে যমুনা নদী তীরে একটি নৌ-বন্দর চালু হয়। বৃটিশ আমলেও সেই বন্দরের খ্যাতি ছিল বলে শোনা যায়। মূলতঃ এই বন্দরকে কেন্দ্র করেই খঞ্জনপুর ও লালবাজার এলাকায় বৃটিশরা প্রথমে নীলকরদের কুঠি ও পরে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলে। ১৮৮৪ খ্রীঃ এখানে রেললাইন বসানো হয় এবং বাঘবাড়ির হাটে একটি রেল ষ্টেশন স্থাপন করা হয়। ভারতের রাজস্থানের জয়পুর রাজ ষ্টেটের নামে এই ষ্টেশনের নামকরণ করা হয় ‘জয়পুরহাট রেল ষ্টেশন’ – প্রশ্ন হলো, কিন্তু কেনো? জয়পুর রাজ স্টেটের নামেই কেনো?
নদী-মার্তৃক বাংলাদেশে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ও সভ্যতার আদি নিয়ামক জলপথ; রেল লাইন বসানোর পর খানিকটা জৌলুস হারাতে বসে। যাত্রাপথে অধিক সময়, পথি-মধ্যে বিপদ-আপদ ও ব্যায়বহুল হবার কারণে নৌকার পাশাপাশি স্থলপথের ঘোড়ার গাড়ীর চাহিদাও ক্রমান্নয়ে কমতে থাকে। অন্যদিকে রেলের কল্যাণে রেল লাইন ও রেল ষ্টেশন চালু হলে পর নগর সভ্যতার দ্রুত বিস্তার ঘটতে থাকে। এই সময় বাণিজ্যের বেসাতি নিয়ে ভারতের রাজস্থান’র যোধপুর রাজ্যের মাড়োয়ার অঞ্চল থেকে বেশ কিছু মাড়োয়ারী এখানে এসে থিতু হন। এদের মধ্যে রামচন্দ্র কাজলা, রায়বিলাস আগরওয়ালা, রামাকিষণ আগরওয়ালা ইত্যাদি ব্যাক্তিত্ব উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে, নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি ও যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় স্থানীয় বিত্তশালীরাও রেল ষ্টেশন কেন্দ্রীক হয়ে পড়েন – অচিরেই গড়ে উঠে একটি শহরতলী। মনে হয়, মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভারতে তাদের নিজ শহর জয়পুরের আদলে/স্মরণে এলাকার নাম প্রথমে ‘জয়পুর’ রাখে। কিন্তু পরে ডাক বিভাগের বিভ্রান্তি এড়াতে নাম রাখা হয় ‘জয়পুরহাট’। যাহোক, ক্রমে বাঘবাড়ি হাট, খঞ্জনপুর ও লালবাজার এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠে আদি ‘জয়পুরহাট’। বৃটিশ আমলেই লালবাজার এলাকা যমুনা গর্ভে বিলীন হয়ে যায় এবং বাঘবাড়িরহাট গোপেন্দ্রগঞ্জহাট নামে (১৯০৭ খ্রীঃ পর) পরিচিতি পেতে থাকে।
দিনাজপুর, গাঁইবান্ধা, বগুড়া, নওগাঁ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাথে সীমানা ভাগাভাগি করে থাকা জয়পুরহাট জেলা দেশের ৫৯তম (আয়তন বিবেচনায়) বৃহত্তম জেলা। ১৮২১ খ্রীঃ বগুড়া জেলা গঠিত হবার আগ পর্যন্ত জয়পুরহাট দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত ছিল। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৭১ খ্রীঃ ০১ জানুয়ারীতে বগুড়া জেলার একমাত্র মহাকুমা ১৯৮৪ খ্রীঃ জেলার মর্যাদা লাভ করে।
অসংখ্য পুকুর-দিঘী বা জলাশয়, প্রাচীন মন্দির, নানা স্থাপত্যিক নিদর্শন ও ৩০ কিলোমিটার ব্যাসের মধ্যে সোমপুর বিহার, হলুদ বিহার ও পাঁচবিবি, চোর-চক্রবর্তী/বিরামপুর-নবাবগঞ্জ-ফুলবাড়ির মতো প্রাচীন সভ্যতা থাকার কারণে এই অঞ্চলের প্রাচীনতা সহজেই অনুমিত। তুলশীগঙ্গা নদীর জলে বিধৌত জয়পুরহাট পাল আমলের পূর্বেও বিশেষ করে গুপ্তামলে (খ্রীঃ ৪র্থ – ৬ষ্ঠ শতক) প্রসিদ্ধ নগর সভ্যতার ধারক ছিল – সেই প্রমাণও আছে। বন্দরীয় হাট আর স্বাস্থ্যকর স্থান হিসাবে এই সেদিনও জয়পুরহাটের সুখ্যাতি ছিল চারিদিকে। আজকের জয়পুরহাট নিজেদের খানদানি ঐতিহ্য বুকে ধারন করে সম্মৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে – এই প্রত্যাশায়।
———————————————————————————————————————————————-
১৭ জুলাই ২০১৭/ঢাকা-১২৩০
তথ্যসূত্রঃ
১. বগুড়ার ইতিকাহিনী, কাজী মোহাম্মদ মিছের, পৃঃ ২৮/৩১/৩৬/৫৪/৫৫/৭১/১৮৩/
২. বাংলাদেশের জেলা-উপজেলার নামকরণ ও ঐতিহ্য, মোহাম্মদ নূরুজ্জামান, পৃঃ ৭৮-৮১/
৩. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লিয়াকত হোসেন খোকন, পৃঃ ৩৭২-৩৭৪/৪৪৯/৪৬৬/
৪. অফরোড বাংলাদেশ ডট.কম
৫. উইকিপিডিয়া/
৬. বাংলাদেশের প্রাচীনতম পাথরের সেতু, দৈনিক প্রথম আলো, ১১ অক্টোবর ২০০২ খ্রীঃ/
৭. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন/
৮. বাংলা পিডিয়া
ঐতিহাসিক যেকোনো বর্ননাই আগ্রহ নিয়ে পড়ি।
এটাও পড়লাম।
ভাল লেগেছে...
🙂 🙂 🙂
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
স্যার, আগ্রহ নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভাল লেগেছে জেনে অনুপ্রাণীত হলাম। ভাল থাকুন সব সময় এই প্রত্যাশায়।