উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গার মতো বাংলাদেশের নানা স্থানে পাট গাছের মতো দেখতে নীল গাছও জম্মাতো। ভারতীয় নীল গাছ থেকে উৎপাদিত নীল ইউরোপের নানা দেশে রপ্তানী হতো বলে ইউরোপীয়রা একে ইন্ডিগো নামে চেনে। বৃটিশ উপনিবেশ আমলে বিশেষ করে কোম্পানী আমলে (১৭৫৭ – ১৮৫৭ খ্রীঃ) সারা বাংলায় (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) নীল চাষের ব্যাপক আবাদ শুরু হয়। ১৭৯৫ খ্রীঃ পরপরই এর মাত্রা তীব্রতর আকার ধারন করে যশোহর, খুলনা, কুষ্টিয়া, পাবনা ও ফরিদপুর অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়। বাংলার উত্তরাঞ্চলও নীলের কোপানলের বাহিরে ছিল না। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার নানা স্থানে বিশেষ করে চাকলা-কাকিনা পরগনার ‘বাগডুগরা’য় নীল চাষের ব্যাপক প্রসার লাভ করে।
নীল গাছকে কারাখানায় প্রক্রিয়াজাত করে নীল উৎপাদিত হতো। নীল চাষ হতো বাংলার কৃষকের জমিতে আর প্রক্রিয়াকরণ করা হতো ইংরেজ মালিকাধীন কারখানায়। এদেরকে বলা হতো নীলকর আর কারখানাকে নীলকুঠি। মক্ষীর মতো একে একে বৃটিশ বি মার্স, বাফটন, আর ব্রাউড, ডব্লিউ টেরানিক্স নীল মধুর সন্ধানে জড়ো হলো এই বাগডুগরা ও তার আশে পাশের এলাকায়। অল্পদিনেই দরওয়ানী, সঙ্গলসী, নটখানা, তরনীবাড়ি, কচুকাটা, রামনগর, শীলকুঠি, বাহালীপাড়া, ইটাখোলা, গোড়গ্রাম, মারকলা, খোকসাবাড়ি, চড়াইখোলা, পানিয়ালপুকুর, বেড়াডাঙ্গা, দলিরাম ইত্যাদি স্থানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়ে গেল।
উৎপাদিত নীল সহজে রপ্তানী বা ইংল্যান্ডে পাচার করার জন্য মহাকুমার সর্বমঙ্গলা নদীর নিকটস্থ ‘সাকা’ ও ‘মাছা’ নামক যে দু’টি বিল ছিল তার পাশে ‘সাকামাছাবন্দর’ নামে একটি বন্দর নীলকররা সহজেই স্থাপন করে ফেললো। বন্দরের নিকটেই নটখানা নামক স্থানে প্রতিষ্ঠা করা হলো বিশাল এক নীল ‘ফার্ম’ বা নীলের খামার। নীল চাষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হওয়ায় নীল কুঠিয়ালরা এর চারিদিকে গড়ে তোলে অগনিত নীল খামার। নীলের খামার বা ফার্মের জন্য অচিরেই খ্যাতি লাভ করে সাকামাছা বন্দর। এতটাই খ্যাতি লাভ করে যে সাকামাছাবন্দর এলাকার নাম প্রথমে ‘নীলখামারী’ ও পরে ‘নীলফামারী’ হয়ে যায়।
কর্কটক্রান্তি রেখার সামান্য উত্তরে অবস্থিত আজকের নীলফামারী ১৮৭০ খ্রীঃ প্রথমে থানা ও ১৮৭৫ খ্রীঃ মহাকুমা এবং ১ ফেব্রূয়ারী ১৯৮৪ খ্রীঃ জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। যে জমির উর্বরতা কাল হয়ে অত্যাচারের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে নীল বিষের কাল থাবা রূপে কৃষকের পর্ণ-কুটিরে ঢুকে পড়েছিল, ৬৫ বছর পর ১৮৫৯-৬০ খ্রীঃ বাংলার আপামর কৃষকদের প্রতিরোধে তা চিরতরে বন্ধ করতে বাধ্য হয় দখলদার বৃটিশ উপনিবেশকারীরা। আজ এই সুযোগে স্মরণ করি সেই সব বীর কৃষকদের যাদের আত্ম-বলিদানের মাধ্যমে আরেকবার প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতার অগ্নি-মশাল।
—————————————————————-
১৫ মে ২০১৭/খোলাহাটি
তথ্যসূত্রঃ
১. রঙ্গপুরের প্রত্নসম্পদ, রঙ্গপুর গবেষণা পরিষদ, পৃঃ ১০০/১০৪/
২. আলোকচিত্রে ইতিহাস, বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর, এরিয়া সদর দপ্তর, রংপুর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পৃঃ ১০৯/১২৮/
৩. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লিয়াকত হোসেন খোকন, পৃঃ ৪০৩/৪০৫/
৪. স্মৃতিবিজড়িত নীলকুঠি, দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ জুন ২০১৫/
৫. ইতিহাসে বাংলাদেশ, সুব্রত বড়ুয়া, পৃঃ ৬৩-৬৪/
৬. পুরাতত্ত্বের বাংলাদেশ ঐতিহ্যের বাংলাদেশ, মোহা. মোশাররফ হোসেন, পৃঃ ১৯৩/
৭. বৃহত্তর রংপুরের ইতিহাস, মোস্তফা তোফায়েল হোসেন, পৃঃ ৮৬-৮৮/৯৩-৯৪/
৮. নীলফামারীর নীলকুঠি, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ এপ্রিল ২০১৫/
৯. নীল বেদনার নীল (নীলফামারী), পাভেল চৌধুরী/
১০. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন/
১১. স্মৃতিবিজড়িত নীলকুঠি, দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ জুন ২০১৫/
Etto informative lekhai kono comment nai...asolei amader durvaggo
Anyway, thank you so much for this article and others. If possible could you please publish them on a newspaper so that more people can be familiar with our roots ?
Thanks a lot for your nice comment and inspiring words. I am honored and solely motivated. My best wishes to you.