কুড়িগ্রাম
মানব সভ্যতার বিস্তৃতির আদি পর্বে বাঙলায় যে সব স্থানে প্রথম বসতি গড়ে উঠেছিল ধরলা নদী তীরের কুড়িগ্রাম তাদের মধ্যে অন্যতম। নেগ্রিটো আর অষ্ট্রিকদের হাত ধরে বাঙলায় মানব সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। আমাদের আদিতম গর্বিত অনার্য পুরুষদের অন্যতম অষ্ট্রিক ভাষাভাষি ‘কোল’ নৃগোষ্ঠীর সভ্যতার অস্তিত্ব এখানে বিরাজমান। এদেরই একটি ক্ষুদ্র ধারা ‘কিরাত/কুরি’ নামে পরিচিত। অষ্ট্রিক ভাষায় ‘কোর বা কুর’ শব্দের অর্থ ‘মানুষ’। এই কুরি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এখনো বসবাস রয়েছে কুড়িগ্রামে। এরা গননা পদ্ধতির একক হিসাবে ‘কুড়ি’র(হাতের ৫ আঙ্গুলের সাহায্যে-৫, ১০, ১৫, ২০ গননা করতো) প্রচলন করেছিল(যেমনঃ১ কুড়ি=২০, ২ কুড়ি=৪০ ইত্যাদি) যা এখনো তাদের মাঝে এবং বাঙলার কোথাও কোথাও প্রচলিত আছে। ধারনা করা সঙ্গত যে, এই ‘কোল/কোর/কুর/কুড়ি’ থেকে ‘কুরিবাড়ি/কুরিগাঁও/কয়েরগঞ্জ/কুরিগঞ্জ’ হয়ে কুড়িগ্রাম নামকরণ হয়েছে।
বাঙলা সুলতানী ও মোঘল দখলে যাবার পূর্ব পর্যন্ত বৃহত্তর রংপুর, কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। মাছ ধরা ও বিক্রি করা পেশাজীবী ‘কোচ’ সম্প্রদায়ের কুড়িটি পরিবার কোচবিহার থেকে এসে প্রথমে এখানে বসতি গাড়ে বলে স্থানের নাম হয় ‘কুড়িগ্রাম’ – এমন লোকশ্রূতি রয়েছে।
বড়ো ভাষাভাষীর ইন্দো-মঙ্গোলীয় ‘মেচ’ নৃগোষ্ঠীর আদি নিবাস কোচবিহারের ‘কুচওয়ারা’ এলাকা মধ্যযুগে মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হলে সেখান থেকে কুড়িটি পরিবার এখানে অভিবাসিত হয়, ফলে এলাকার নাম ‘কুড়িগ্রাম’ – অনেকের এমন ধারনাও রয়েছে।
কোচবিহারের মহারাজ বিশ্বসিংহ (১৪৯৬ – ১৫৩৩ খ্রীঃ) কুড়িটি জেলে পরিবারকে এখানে পুনর্বাসন করেন। তিনি এই কুড়িটি পরিবারকে উন্নত শ্রেণীর হিন্দুরূপে স্বীকৃতি দেন এবং তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে এই অঞ্চলকে একটি জেলে অঞ্চলে পরিনত করেন । কুড়িটি পরিবারের আগমনের কারন ও তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের ফলে এই এলাকার নাম হয় ‘কুড়িগ্রাম’।
বৃটিশ বেনিয়াদের দখলে থাকার সময় উইলিয়াম হান্টার, ডাঃ বুকানন হ্যামিলটন, মিস্টার ভাস প্রমুখের লেখনী ও বিবরনীতে এলাকার নাম ‘কুরিগঞ্জ’ হিসাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১৭ শতাব্দীর মানচিত্রেও কুড়িগ্রাম উল্লেখ রয়েছে। যাহোক, ২২ এপ্রিল ১৮৭৫ খ্রীঃ ৮টি থানা নিয়ে মহাকুমা হিসাবে এবং ১ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ খ্রীঃ ৯টি উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, আয়তন বিবেচনায় এই জেলা বাংলাদেশের ৩০ তম বৃহত্তম জেলা।
রাণী সত্যবতীর প্রত্নকীর্তি
প্রাগৌতিহাসিক যুগ থেকে প্রাগজ্যোতিষ তথা কামরূপ রাজ্যের অধীন ছিল বাঙলার উত্তারঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর। পাঠান দখলদারিত্বের সময় বৃহত্তর রংপুরের অংশ বা প্রাচীন ‘বাঙ্গালভূম’র কোচবিহার রাজ্য ভিতরবন্দ, বাহারবন্দ, পাতিলদহ ও স্বরূপপুর পরগনায় বিভক্ত হয়ে যায়। পাঠান দখলদাররা জনৈক জগৎরায়কে উক্ত ৪টি পরগনা প্রদান করে। পাঠানকুল শিরোমনি শের শাহের (১৪৮৬-১৫৪৫ খ্রীঃ) মৃত্যূর পর পরগনাসমূহ মোঘল অধিকারে আসে। সম্রাট শাহজাহানের (১৫৯২-১৬৬৬ খ্রীঃ) দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রীঃ) যখন বাঙলার সুবাহদার তখন বাহারবন্দ পরগনার জায়গীরদারী অর্পন করা হয় চান্দ রায়ের উপর। পরবর্তীতে এই জায়গীরদারী বৃহত্তর রংপুর-গাঁইবান্ধার বিখ্যাত বর্ধনকুঠির রাজাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬১৮-১৭০৭ খ্রীঃ) সিদ্ধান্তে তাদের কুক্ষিগত হয়। এই বংশের রাজা রঘুনাথ রায় বাহারবন্দ পরগনায় তার জমিদারী প্রতিষ্ঠা করে। নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষন করে ধারনা করি, সতের শতকের শেষ দিকে কিংবা আঠারো শতকের শুরুর দিকে তিনি বাঙলার অর্ধবঙ্গেশ্বরী খ্যাত রাণী ভবানীর (১৭১৬-১৮০২ খ্রীঃ) ছোট খালা শ্রী সত্যবতী দেবী চৌধুরাণীকে বিবাহ করে নিজ রাজ্যে নিয়ে আসেন। রাণী সত্যবতী ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। বিবাহের পর নিজ সংসারে এসে তিনি মন্দির নির্মানের জন্য রাজাকে উৎসাহিত করেন। পৌরানিক উপকথার উপর ভিত্তি করে পরগনার আপামর জনগন বিশ্বাস করতো যে, তাদের এই অঞ্চল পান্ডব-বর্জিত এলাকা; নেই কোনো ব্রাহ্মণ, নেই কোনো উচ্চস্থানীয় হিন্দু জাতের মানুষ। মন্দির ও পূঁজার্চনার জন্য সব দিক বিবেচনা করে রাজা তাই তার কুলগুরু রামকিশোর ভট্টাচার্য মহাশয়কে নিজ গ্রামে আমন্ত্রণ জানান।
ভট্টাচার্য মহাশয় রাজার আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহন করে ভারতের বর্ধমানের কটোয়া থেকে এখানে চলে আসেন। রাজা তাকে যথেষ্ট পরিমান নিষ্কন্টক জমি দান করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সকল ব্যবস্থা করে দেন। রাজার পৃষ্ঠপোষকতায়, রাণীর ইচ্ছায় এবং ভট্টাচার্য মহাশয়ের তত্বাবধানে অচিরেই গোবিন্দধাম, শিবধাম, চন্ডীধাম, ভৈরবধাম, গুরুধাম, কালীধাম, সিদ্ধেশ্বরী ধাম, দূর্গাধামসহ কমপক্ষে ১৬টি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। সবগুলো ধাম/মন্দিরই এই সময় তৈরী হয়েছিল না তারও পূর্ব থেকে এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেননা অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায়, ১৫০৬ খ্রীঃ দিকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এখানে আধিপত্য বিস্তার করেছিল এবং তার প্রত্যাবর্তনের অব্যবহতির পরই কামতারাজ মহারাজ বিশ্বসিংহ (১৪৯৬ – ১৫৩৩ খ্রীঃ) বাহারবন্দ দখল করে নেয়। নিজের প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রমাণ করার জন্য মহারাজা ১৭টি মন্দির স্থাপন করেন। যে কারনেই হোক, পবিত্র বা তীর্থস্থান যেখানে অসংখ্য ধাম বা মন্দিরের আধিক্য রয়েছে, সেই স্থানের নাম ‘ধামশ্রেণী’ হওয়াই স্বাভাবিক। আবার অন্যরা বলছেন, ধামশ্রেণী নয় বরং এর আদি নাম ‘ধামসেনা’, কেননা এখানে সৈন্য-সামন্তদের আনাগোনা ও তাদের অবস্থানের নানাবিধ প্রমান রয়েছে। ধারনা করি, ধামশ্রেণীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং নামকরণের প্রেক্ষাপট আরো প্রাচীন। মধ্যযুগে বা বাংলায় মুসলিম শাসন কায়েম হবার সময়ও ধামশ্রেণীর উল্লেখ বিভিন্ন মাধ্যমে লক্ষ্য করা যায়। বাহারবন্দ পরগনার ধামশ্রেণী বর্তমানে কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার একটি প্রসিদ্ধ ইউনিয়ন। এখানে রয়েছে বেশ কিছু প্রত্ন-নিদর্শন।
জালাল দরবেশের দরগাহ
দরবেশ আর রাণী সত্যবতীকে নিয়ে একটি জনশ্রূতি প্রচলিত আছে। একদিন হঠাৎ করে রাজবাড়ির পাশে এক সাধুর আগমনের খবর আসে গ্রামবাসীর কাছে। শীতকাল – প্রচন্ড শীতের মধ্যে শীত নিবারনের জন্য সাধু খড়-কুটো-গাছের ডাল-পাতা জোগাড় করে আগুন তাপাচ্ছিল। সাধুর গায়ে কোনো গরম কাপড় ছিল না। রাণী সত্যবতী এই খবর জানতে পেরে তার গায়ে থাকা দামী চাদরটি সাথে সাথে খুলে সাধুর কাছে পাঠিয়ে দেন। সাধু চাদরখানি এক পলক দেখে অগ্নিকুন্ডে ছুড়ে মারেন। রাণীর কাছে সাধুর এহেন অশোভনীয় আচরনের কথা পৌঁছলে রাণী বলেন “ওর এত্ত সাহস! আমার দামী চাদর আগুনে পুড়ায়???” – এই বলে তিনি তার সেপাই-পেয়াদাদের পাঠান সাধুকে ধরে আনার জন্য।
সেপাইরা গন্তব্যে পৌঁছে দেখে সাধু সেখানে উপস্থিত নেই, কোথায় যেনো ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে। সাধুর এহেন অলৌকিক কাজের মর্তবা বুঝতে পেরে রাণী অনুতপ্ত ও অনুশোচনায় ভুগতে থাকেন। তিনি তো যে সে সাধু নন; রাণী তার ভুল বুঝতে পেরে সাধুকে উদ্দেশ্য করে ৮০ টি ঘাট, ৮০ টি হাট ও ৮০ টি মাঠ উৎসর্গ করেন। পরবর্তীতে তিনি সাধুর জন্য একটি আস্তানা গড়ে দেন। মৃত্যূর পর সেখানেই তার মাযার প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রাচীন একটি বট/পাকুর গাছের নীচে, প্রায় ৫ ফুট উচুঁ মঞ্চের উপর উম্মুক্ত মাযারটি বর্তমানে অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। মাযারটি হাল আমলের ইট দ্বারা নির্মিত এবং এর দক্ষিণে হাল আমলে একটি মসজিদও তৈরী করা হয়েছে।
শিব মন্দির
রাজবাড়ি প্রবেশের আগে একটি প্রাচীন শিব মন্দির ছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে শিব মন্দিরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিভিন্ন তথ্য থেকে বুঝতে পারি, চুন-সুরকী আর পাতলা ইটের তৈরী দক্ষিণমূখী দরজা বিশিষ্ট একতলা প্রাচীন মন্দিরটি ১৮৯৭ খ্রীঃ ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়েছে।
ভৈরবধাম
শিব মন্দিরের উত্তরে ছিল ভৈরবধাম যার কোনো অস্তিত্বই এখন আর সেখানে নেই। স্থানটি কেবল চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে।
শিব মন্দির ও ভৈরবধামের সাথে বিশাল খোলা মাঠ, প্রাচীন গাছ-গাছালি, পশ্চিমে ধর্মমন্ডপ/মন্দিরালয়, পূর্বে পদ্ম ও উত্তরে চাঁপা নামের পুকুর আছে। চাঁপা পুকুর পাড়ে চন্ডি মন্ডপ/মন্দির নামে আরেকটি মন্দির আছে।
ধর্মমন্ডপ
রাজবাড়ির মূল অংশ আজ টিকে না থাকলেও ধর্মমন্ডপ/মন্দিরালয়ে এখনও ৫টি মন্দির ও ১টি পাতকূয়া টিকে রয়েছে। ধর্মমন্ডপটি প্রাচীর ঘেরা। আধুনিককালে নির্মিত প্রাচীর দ্বারা এখানকার মন্দিরসমূহ সংরক্ষনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এই প্রাচীরের পূর্বদিকে দু’টি সদর দরজা রয়েছে। দক্ষিণ পূর্ব দিকেরটি প্রধান সদর দরজা হিসাবে তৈরী করা হলেও উত্তর-পূর্ব কোণারটি সব সময় ব্যবহারের জন্য খোলা থাকে। পাতকূয়াটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে। কূয়াটি সংস্কার করা হলেও ব্যবহার উপযোগী করা হয়নি।
কালী সিদ্ধেশ্বরী মন্দির
মন্দিরালয়ের প্রবেশে পথে পরিচয়জ্ঞাপক ফলকচিত্রে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৭৫২ খ্রীঃ ও প্রতিষ্ঠাতা রাণী সত্যবতীর নাম উল্লেখ আছে। ১৮৯৭ খ্রীঃ প্রবল ভূমিকম্পে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। কিন্তু এটি একেবারে নতুন করে ১৯১০ খ্রীঃ পুনঃসংস্কার করা হয়েছিল বলে জানা যায়। আয়তকার গর্ভগৃহের যে বেদীতে কালী বিগ্রহ অধিষ্ঠিত তা পরে তৈরী করা হয়েছে। বৈশাখ মাস জুড়ে এখানে সিদ্ধেশ্বরীর মেলা বসে। মন্দিরসমূহে নিয়মিত পূঁজার্চ্চনা হয়।
গোপাল জিউ মন্দির
শ্রী শ্রী গোপাল জিউ মন্দিরটি কালী সিদ্বেশ্বরী মন্দিরের পশ্চিম দেওয়াল সংলগ্ন। আদি মন্দিরের কোন চিহ্নই এখন আর অবশিষ্ট নেই। মন্দিরটি আনাড়িভাবে সংস্কার করা হয়েছে এবং এর আধুনিক রূপটিই কেবল বিদ্যমান।
মঙ্গলচন্ডী মন্দির
শ্রী শ্রী গোপাল জিউ মন্দিরের পশ্চিমে মঙ্গলচন্ডী মন্দির। একাধিক ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, মন্দিরটি মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব (১৬১৮-১৭০৭ খ্রীঃ)’র সময় নির্মিত। ১৮৯৭ খ্রীঃ প্রবল ভূমিকম্পে মন্দিরের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। তাহলে মঙ্গলচন্ডী মন্দিরটি প্রাচীন কিন্তু হাল আমলে সংস্কার করে অথবা সেস্থানে নতুন আরেকটি মন্দির তৈরী করা হয়েছে।
শিব মন্দির
ধর্মমন্ডপের প্রধান দরজা থেকে সোজা পশ্চিমে এবং মঙ্গলচন্ডী মন্দিরের দক্ষিণে শিব মন্দিরটি অবস্থিত। অষ্টভূজাকৃতির মন্দিরটি এখানকার প্রাচীনতম মন্দির। মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ লেখা থেকে জানা যায় মন্দিরটি ১২ চৈত্র ১৪১০ বঙ্গাব্দে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। চুন-সুরকী আর পাতলা ইটের তৈরী একতলা প্রাচীন মন্দিরটি ১৮৯৭ খ্রীঃ ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়ে। ধ্বসে পড়ার আগে মন্দিরের দেওয়াল কারুকাজ করা ছিল বলে জানা যায়। মন্দিরের দরজাটি পূর্বমুখী এবং এটি বেশ সরু ও ছোট আকৃতির। মন্দিরটি ভূমি থেকে শীর্ষ চূঁড়া পর্যন্ত আনুমানিক ১৬ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন আর আনুমানিক ৪ ফুট বেদীর উপর ৬ ফুট উপরে উঠে তীর্যক হয়ে চূঁড়ায় পরিনত হয়েছে। চূঁড়ার উপর কলশ নকশা, ছোট গম্বুজ ও লৌহদন্ড রয়েছে।
মন্দিরগুলোতে নিত্য পূঁজা নিবেদন করা হয়। রামকিশোর ভট্টাচার্য মহাশয়ের উত্তর পুরুষেরাই বংশ পরম্পরায় মন্দিরের পৌরহিত্য ও দেখভাল করে আসছেন। পূজারী বা দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগারও আছে। ধর্মন্ডপের বিভিন্ন স্থানে নানা আকৃতির পাথরখন্ড পড়ে রয়েছে যা চাপাতলা পুকুর থেকে সংগৃহীত বলে স্থানীয়রা জানালেন। নিঃসন্দেহে এই সব পাথরগুলো এখানকার বিভিন্ন ইমারতে/মন্দিরে ব্যবহার করা হয়েছিল, বর্তমানে পরিত্যাক্ত। পেশাদার হাতে খোদাই করা সূক্ষ, মসৃণ ও নান্দনিকভাবে অলংকৃত পাথরগুলো উন্নত রুচি ও শিল্পবোধেরই পরিচায়ক। এখানকার পাথরখন্ডগুলোর কোনো কোনোটি লম্বায় ৭-১২ ফুটের মত, ৬-৮ ইঞ্চির মত পুরু ও ৮-১২ ইঞ্চির মত চওড়া। এই সব পাথরের কয়েকটি দিয়ে আঙ্গিনায় বসার জন্য ‘বেঞ্চ’ বানানো হয়েছে।
চাঁপা পুকুর
ধর্মমন্ডপের অর্থাৎ রাণী সত্যবতীর কথিত রাজবাড়ির উত্তরে ৪ একর আয়তনের চাঁপা পুকুরটি অবস্থিত। ব্যাপক জনশ্রূতি থেকে জানা যায় যে, বিশ্বকর্মা এক রাতের মধ্যে পুকুরটি খনন করে দেন এবং পুকুরটি পাথর দ্বারা বাঁধানো ছিল। এটি অপর পুকুর অর্থাৎ পদ্ম পুকুর থেকে ছোট আকৃতির। পুকুরে প্রচুর পরিমানে পাথর পাওয়া গেছে। পুকুরের উত্তর পাড়ে ঘাট ছিল এবং এখনো একটি পাথর সেখানে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে। ধারনা করি, পুকুরের ঘাটে বা সংলগ্ন কোনো স্থাপনায় এই সব পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল। এই সব পাথরের একটি অংশ ধর্মমন্ডপের মধ্যে স্তুপকৃত অবস্থায় রয়েছে। পুকুরটি রাজবাড়ির মহিলারা ব্যবহার করতেন। জলকরের আনুমানিক দৈর্ঘ্য ৫৫ মিটার ও প্রস্থ ৫০ মিটার।
চন্ডিমন্দির
ধর্মমন্ডপের পূর্বপাশে, মূলতঃ চাঁপা পুকুরের পশ্চিমপাড়ে চন্ডিমন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত। ভগ্নপ্রায় মন্দিরটি এখন জঙ্গলে আচ্ছাদিত। ১৮৯৭ খ্রীঃ প্রবল ভূমিকম্পে মন্দিরের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। পুরো ইমারতটি বট-পাকুর গাছের শিকড় দ্বারা আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে, কোথাও কোথাও শিকড় ও ঝুরি দেওয়াল ভেদ করে চলে গেছে। দক্ষিণ দিকে ১টি দরজা ও দু’দিকে দু’টি জানালা রয়েছে, উত্তর দিকে কোনো জানালা নেই। জানালাগুলো বেশ ছোট আকৃতির। দরজাটি অলংকৃত ও কারুকাজ করা ছিল। মন্দিরটি ব্যবহার অনুপোযোগী হওয়া সত্বেও এখনো এখানে দূর্গাদেবীর (চন্ডী/দূর্গা) পূঁজা নিবেদন করা হয়।
গর্ভগৃহের উত্তরে ৩ ফুট উচ্চতার বেদীমূল ছিল। স্থানীয়রা জানেন যে মন্দিরটি রাণী সত্যবতী প্রতিষ্ঠা করেন কিন্তু সঠিক দিনক্ষণ তাদের অজানা। তারা মনে করেন প্রায় ৫/৬’শ বছরের পুরোনো তাদের এই মন্দির। প্রাচীন চ্যাপ্টা ইট-চুন-সুরকীর গাঁথুনীতে মন্দিরটি নির্মিত। সম্পূর্ণ স্থাপনাটির ভিতর-বাহির পলেস্তরা করা ছিল, যার নমুনা এখনো স্থানে স্থানে দেখা যায়।
মন্দিরের পূর্বপাশে একটি সমাধিসৌধ আছে যেখানে ঠাকুরবাড়ির পুরোহিতকে সমাহিত করা হয়েছে। জানা যায়, পুরোহিতের ছেলে এটি তৈরী করে দিয়েছে।
পদ্ম পুকুর
চন্ডিমন্দিরের পশ্চিমে রাজবাড়ির পদ্ম পুকুরটি অবস্থিত। ৮৫ একর আয়তনের বিশাল পুকুরটি রাণী সত্যবতী খনন করেছিলেন বলে স্থানীয়রা জানালেন। উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ পুকুরটির জলকরের দৈর্ঘ্য আনুমানিক ১২০ মিটার ও প্রস্থ ৬১ মিটার। অপ্রশস্ত পাড়সমূহ এখন ভূমি সমান্তরাল। পাড় জুড়ে নানা জাতের গাছ-গাছালি রয়েছে। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে সম্ভবত একটি ঘাট ছিল, বর্তমানে এর কোনো চিহ্ন এখন নাই। সাধারনতঃ পুরুষরা এই পুকুরটি ব্যবহার করতেন। পুকুরটির আদিরূপ নষ্ট করে বহুবার সংস্কার করা হয়েছে এবং এখন সেখানে মাছ চাষ করা হয়।
দোল মন্দির
রামকিশোর ভট্টাচার্য মহাশয়ের উত্তর পুরুষ টোরা ঠাকুরের বাড়ির সামনে যে মন্দিরটি আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত সেটি দোল মন্দির নামে পরিচিত ছিল, কিন্তু এটি দেখতে অনেকটা কালী মন্দিরের ন্যায়। আনুমানিক ৫০০ বছরের প্রাচীন মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রীঃ) আমলের মন্দিরটি একটি গোলাকার বেদীর উপর ৪টি জোড় স্তম্ভের দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছিল। জোড় স্তম্ভের তাৎপর্য এই যে, রাধা ও কৃষ্ণ যেন যুগলবন্দি অবস্থায় দন্ডায়মান বা অবস্থান করছে। কারুকাজ খচিত মন্দিরটির গর্ভগৃহের চারিদিকে পূঁজারীদের চলাচলের ব্যবস্থা ছিল। মন্দিরের পাশে একটি ছোট পুকুরও ছিল যা এখন মজে গেছে। মূলতঃ এই পুকুর পাড়েই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
স্থানীয় সর্বসাধারনের মুখে শোনা যায়, অনেক অনেক দিন আগে রাণী সত্যবতী কুমারী অবস্থায় গর্ভবতী হলে তার পিতা তাকে ‘পিপীলিকা বনে’ নির্বাসন দেয়। আর এখানেই ছিল সেই কথিত পিপীলিকা বন। রাণী সত্যবতী বিশ্বকর্মার সহায়তায় এখানে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন, তার রাজবাড়িও আছে এই নগরে… ইত্যাদি… ইত্যাদি। জনশ্রূতির সত্যবতী আর রঘুনাথ রায়ের স্ত্রী রাণী সত্যবতীর আখ্যান মহাভারতের হস্তিনাপুরের কুরুরাজ শান্তনুর রাজ-মহিষী সত্যবতী অথবা রাজা মহীদলনের কণ্যা সন্ধ্যাবতীর সাথে স্থানীয়রা তাল-গোল পাকিয়ে ফেলেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। শাপগ্রস্তা মৎস্যরুপিনী অপ্সরা অদ্রিকার কণ্যা সত্যবতী শাপগ্রস্তা হয়ে পৃথিবীতে জম্ম নেয় এবং ধীবর রাজ দাশরাজের কাছে প্রতিপালিত হয়। দাশরাজের আদেশে সত্যবতী যমুনার বুকে খেয়া পারাপার আর জেলেনীর কাজে ব্যাপ্ত হয়। একদিন ঋষি পরাশর তার নৌকায় উঠে মিলনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে ও সত্যবতী মিলনে সম্মত হলে বেদব্যাসের (কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস) জম্ম হয়, কিন্তু ঋষির কল্যাণে তার কুমারিত্ব অক্ষুন্ন থাকে। পরবর্তীতে রাজা শান্তনুর সাথে তার বিবাহ হয় এবং চিত্রঙ্গদা ও বিচিত্রবীর্য নামের দু’পুত্র জম্ম লাভ করে। শেষ জীবনে তিনি তার প্রথম পুত্র ব্যাসের আশ্রমে তপস্যারত অবস্থায় মারা যান। অপরদিকে রাণী সন্ধ্যাবতী কুমারী অবস্থায় গর্ভবতী হলে তার পিতা তাকে নির্বাসনে পাঠান এবং সেখানে তার একটি পুত্র সন্তান হয়, যিনি পরবর্তীতে সত্যপীর বা সত্যনারায়ণ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর এলাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাণী সত্যবতী/সন্ধ্যাবতীর এরূপ কেচ্ছা-কাহিনী কম-বেশী প্রচলিত আছে।
যাহোক, ধামশ্রেণীর ঠাকুরবাড়ি বাজারের উপরে ছিল একটি রাজবাড়ি, কিন্তু আজ তা মাটির সাথে মিশে গেছে। বিশাল এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত সেই রাজবাড়ির কোনো অস্তিত্ব এখন আর ভূমিতে নেই, আছে কেবল জনশ্রূতি, ইতিহাস কিংবা প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনে। জমিদার রঘুনাথ রায় অপুত্রক অবস্থায় দেহ ত্যাগ করলে তার স্ত্রী রাণী সত্যবতী জমিদারী লাভ করে। বাঙলায় ইংরেজ দেওয়ানী লাভ ও দখলদারিত্ব্যের কিছুকাল আগে রাণী সত্যবতী তার ভাগিনী রাণী ভবানীর কাছে রাজ্যভার অর্পন করে শেষ জীবনে কাশীবাসী হন। কুড়িগ্রামের প্রসিদ্ধ এই স্থানটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আমাদের অমূল্য প্রত্নকীর্তিসমূহের আশু সংরক্ষণ বা রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরী।
১২ মে ২০১৭/খোলাহাটি
তথ্যসূত্রঃ
১. কোচবিহারের ইতিহাস, খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লা আহমদ, পৃঃ ১৪৮/৩৪৭/
২. আলোকচিত্রে ইতিহাস, বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর, এরিয়া সদর দপ্তর, রংপুর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পৃঃ ৬৯/৭৩/
৩. বাংলাদেশের জেলা পরিচিতি, আন্তঃজাল (Internet)/
৪. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, কুড়িগ্রাম জেলা/
৫. কুড়িগ্রাম জেলার পরিচিতি ইতিহাস-ঐতিহ্য, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ জুন ২০১৩/
৬. বৃহত্তর রংপুরের ইতিহাস, মোস্তফা তোফায়েল হোসেন, পৃঃ ৪৯-৫৩/৫৫/
৭. উইকিপিডিয়া/
৮. ঐতিহাসিক ধামশ্রেণী ইউনিয়নের নামকরণ ও প্রাসঙ্গিক কিছু ইতিহাস (পর্ব-০১), উলিপুর উপজেলা ডট কম, মারুফ আহমেদ, সম্পাদক, ১৩ মার্চ ২০১৭
৯. রঙ্গপুরের প্রত্নসম্পদ, রঙ্গপুর গবেষণা পরিষদ, পৃঃ ৮২/৮৪-৮৫/
১০. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লিয়াকত হোসেন খোকন, পৃঃ ৪০৬/
অনেক আগে একবার কুড়িগ্রাম বেড়াতে গিয়েছিলাম। অবশ্য, সাইটসিয়িং করা হয় নি...
যাই হোক, আপনার লেখনীর মাধ্যমে এবার সেটাও হয়ে গেল।
ধন্যবাদ, আল-মামুন ভাই! 🙂
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
জুনায়েদ-মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ভীষনভাবে অনুপ্রানীত হলাম। ভাল থেকো।
অসাধারণ অসংখ্য ধন্যবাদ।
নিজের জেলার একটি ক্ষুদ্র অংশের ইতিহাস হলেও জানতে পারলাম।