চিকলী নদীর পাড়ে দিলালপুর গ্রাম। গ্রামে আছে একটি প্রত্ন-নিদর্শন। এককালের প্রাচীর ঘেরা এই নিদর্শন অযত্ন আর অবহেলায় কালের নীরব স্বাক্ষী হয়ে আজ কোন রকমে টিকে আছে। প্রাচীর ঘেরা এই আঙিনায় প্রবেশের জন্য এর দক্ষিণ প্রাচীরে একটি দরজা ছিল। প্রাচীর এবং প্রবেশ পথের দরজা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এখনো এর স্তম্ভদ্বয় আংশিকভাবে টিকে আছে। দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই কাচারি ঘর। এক তলা, আয়তকার ইমারতটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা, দক্ষিণমূখী ও তিন কক্ষ বিশিষ্ট। দু’পাশের কক্ষ দুটি থেকে মাঝেরটি খানিকটা বড় আকৃতির। দালানের সামনের অংশে আয়তকার ও মধ্যভাগে পঞ্চভূজাকৃতির বারান্দা রয়েছে। পঞ্চভূজাকৃতির বারান্দায় গোলাকার আটটি খিলানের উপর ছাদ নির্মান করা হয়েছে। আনুমানিক তিন ফুট উচ্চতার একটি মঞ্চের উপর দালানটি দাঁড়িয়ে আছে। কাচারি ঘরে প্রবেশের জন্য সামনের বর্ধিত তিনটি বাহুতে তিন ধাপের সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে। মূল বাড়িটিতে প্রবেশ করতে হলে খিলানাকৃতির তিনটি দরজা দিয়ে প্রবেশ করা যাবে। পশ্চিম দিকের ঘরের উত্তর দিকে একটি ও পশ্চিম দিকে দু’টি ছোট জানালা রয়েছে। মাঝের ঘরের উত্তর দিকে দু’টি জানালা রয়েছে। পূর্ব দিকের ঘরের উত্তর দিকে কোনো জানালা নেই, কিন্তু দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে একটি করে জানালা রয়েছে। এই দক্ষিণ দিকের জানালাটি অন্যান্য জানালাগুলো থেকে আকারে খানিকটা বড়।
ইমারতের চারিদিকে রীতিবদ্ধ মোঘল ব্রাকেট বিহীন ছাদের প্রলম্বিত অংশ সরলরেখায় নির্মিত। কার্ণিশের নীচেই ইটের বর্ধিত অংশ ব্যবহার করে নকশা করা হয়েছে। পঞ্চভূজাকৃতির বারান্দার ছাদের উপর পাতার ন্যায় উর্দ্ধমূখী একটি দেওয়াল আছে যার কেন্দ্র আবার গোলাকার গর্তযুক্ত। বায়ু চলাচলের জন্য বারান্দার কার্ণিশের নীচের দিকে সিমেন্টের তৈরী ‘লুভর’ রয়েছে। সমস্ত দালানটি পলেস্তরা করা এবং কারুকাজবিহীন। কাচারি ঘরের উত্তর-পূর্ব দিকে নদীর কোল ঘেঁষে জোড় মন্দির অবস্থিত।
পরস্পর থেকে আনুমানিক ছয় ফুট দূরত্বে অবস্থিত মন্দিরদ্বয়ের বাম পাশেরটি শিব মন্দির আর ডান পাশেরটি কালী মন্দির। মাটির নীচে খানিকটা দেবে যাওয়া অংশসহ আনুমানিক তিন ফুট একক পাকা বেদীর উপর পূর্ব-পশ্চিমে মন্দিরদ্বয় নির্মিত। উভয় মন্দিরে যাবার জন্য তিনধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ি রয়েছে। চার কোণার চারটি মিনারের উপর এক চূড়াবিশিষ্ট মন্দিরগুলোর নির্মাণশৈলী দৃষ্টিনন্দন ও একই ধাঁচের। চারকোণাকার শিব মন্দিরের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে একটি করে দু’টি দরজা আছে। দরজার চৌকাঠ কালো পাথরের। দক্ষিণের দরজার দু’পাশে নীচ থেকে উপরে খাড়াভাবে সাতটি করে ও দরজার উপরে ধনুক বক্রাকৃতির ন্যায় সাজানো আরো সাতটি টেরাকোটার ফলক লাগানো ছিল। দেব-দেবীর মূর্তিখচিত ফলকসমূহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। দরজার উপরের ফলকগুলোর উপর আরেক সারি পলেস্তরা করা ফুলেল নকশা রয়েছে। পশ্চিমের দরজাটি দক্ষিণের তুলনায় খানিকটা খাটো। এই দরজার উপরের অংশ পলেস্তরার ফুলেল নকশা কাটা।
গর্ভগৃহের দেওয়ালের সবটাই চুনের পলেস্তর দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। তবে জায়গায় জায়গায় পলেস্তরা খসে পড়েছে। রাতে বাতি জ্বালাবার জন্য গর্ভগৃহের পশ্চিম দেওয়ালে একটি ও বিপরীত দেওয়ালে দু’টি করে কুলঙ্গি আছে। কুলঙ্গিগুলো কালী মন্দিরের তুলনায় খানিকটা আকার-আকৃতিতে বড়। বর্তমানে এখানে কোনো বিগ্রহ নেই। মন্দিরটি কালী মন্দির অপেক্ষা বেশী ক্ষতিগ্রস্থ, বিশেষ করে এর উত্তর-পশ্চিম মিনার সংলগ্ন দেওয়ালটি। আর বাহিরের দেওয়ালের প্রায় পুরোটা পলেস্তরা খসে ইট বের হয়ে পড়েছে। চূড়ায় শেওলা জমেছে।
কালী মন্দিরটির অবস্থা শিব মন্দির থেকে খানিকটা ভাল। এরও দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে একটি করে দরজা আছে। পশ্চিমের দরজাটি খানিকটা ছোট এবং এখন কোনো কপাট নেই, কিন্তু দক্ষিণেরটিতে কাঠের কপাট আছে। টেরাকোটার অলঙ্করণও প্রায় একই রকম। শুধু দক্ষিণের দরজার দু’পাশে খাড়া ভাবে ছয়টি ও দরজার উপরে পাঁচটি করে ফলক আছে। পশ্চিমের দরজার উপরের কারুকাজ দৃশ্যমান। দক্ষিণ দরজার টেরাকোটার ফলকগুলোর পাশে আরেক সারি ফুলেল নকশা করা টেরাকোটার অলঙ্করন লক্ষ্য করা যায়। গর্ভগৃহের উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে যথাক্রমে একটি ও দু’টি করে কুলঙ্গি আছে। চুঁড়ার উপর একটি বট গাছ জম্মেছে। চূঁড়ার বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে। বাহিরের চারিদিকের দেওয়ালে পলেস্তরা প্রায় অক্ষত আছে, তবে বটের শিকড় ধীরে ধীরে গ্রাস করার পায়তারা করছে। মন্দিরদ্বয়ের বেদীর সামনে মাঝ বরাবর একটি চারকোণা অনুচ্চ স্তম্ভ আছে। ধারনা করি সেখানে তুলশী গাছ রোপন করা ছিল।
স্থানীয়রা জানালেন যে, মন্দিরের ঠাকুরের ‘মাথা খারাপ’ ছিল, তাই সে কষ্টিপাথরের প্রতিমা বিক্রি করে দেয়। চিকলী নদী দিয়ে নৌকাযোগে প্রতিমা পাচার করা হয়। জানা গেল এখানকার বিগ্রহ (গৌরীপট্ট, শিবলিঙ্গ ও কালী মূর্তি) এখন বদরগঞ্জ উপজেলার কালী মন্দিরে (গৌরীপট্ট ব্যতীত) রক্ষিত আছে।
মন্দিরদ্বয়ের উত্তরে ইটের তৈরী পাকা কুয়া ছিল। ইটের তৈরী কুয়াটি মন্দিরের পূঁজারীদের জন্য ব্যবহৃত হতো যা এখন অব্যবহার্য্য। এই কুয়ার পশ্চিমে একটি স্থাপনার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভিত্তিমূলের অবস্থান বিবেচনা করে মনে হয় এটি মন্দিরদ্বয়ের ভোগঘর ছিল। মন্দিরগুলো দক্ষিণমূখী আর ইট-চুন-সুরকীর মশলা দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। মন্দিরের দরজার চৌকাঠে ব্যবহৃত কালো পাথরখন্ডগুলো সম্ভবতঃ অন্য কোনো পুরোনো দালানের ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগ্রহীত।
এই জোড় মন্দিরের পূর্ব কোণায় পাঁচ পীরের মাযার আছে। নাপাক অবস্থায় মাযারে প্রবেশ করলে চিরতরে বন্দী হয়ে যেতে হবে – আর কখনো সেখান থেকে বের হওয়া যাবে না, স্থানীয়দের মাঝে এমন জনশ্রূতি রয়েছে। স্থানীয়রা আরো বিশ্বাস করেন যে, মন্দির দু’টি নিজ থেকে হয়েছে, কোনো মানুষ এটা তৈরী করেনি।
জরাজীর্ণ মন্দিরদ্বয়ে এখন কোনো পূজা অর্চনা হয় না। ফলে অদূর ভবিষ্যতে সংস্কার করারও কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। তবে এমন করূন হাল ছিল না কিছু কাল আগেও, ঘটা করে জাঁকজমকের সাথে পূঁজা নিবেদন আর চৈত্র পূর্ণিমায় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, বাদ্য-বাজনাসহ শোভাযাত্রা হতো। কে, কবে, কখন এই সব ইমারতাদি নির্মাণ করেছিলেন তার ইতিহাস আজ বিস্মৃত!! নির্মাণ সামগ্রী, কাঠামো ও গঠনশৈলী পর্যালোচনা করে ধারনা করি এই সব আঠারো শতকের প্রত্ন-নিদর্শন। রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার দিলালপুর গ্রামে অবস্থিত জোড় মন্দিরের কারুকাজ বিশেষ করে টেরাকোটার অলঙ্করন বাংলার টেরাকোটা শিল্পের এক উজ্জ্বল অতীতেরই শুধু জানান দেয় না, বরং আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের স্পষ্ট স্বাক্ষী।
————————————————————————————————————————————————
০৫ এপ্রিল ২০১৭/খোলাহাটি
তথ্যসূত্রঃ
১. দিলালপুরের প্ররনো মন্দির, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, দৈনিক সমকাল ২৪ নভেম্বর ২০১২ খ্রীঃ/
২. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ৩৭৬-৩৭৮/
বাহ! আপনার সাবলীল লেখনীর মাধ্যমে দারুণ একটি প্রত্ন-নিদর্শন স্থান সম্পর্কে জানতে পারলাম!
দুঃখের বিষয় এগুলোর সংস্কার ও সংরক্ষণ করার ব্যাপারে আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বড়ই উদাসীন! 🙁
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রাচীন নিদর্শন সংরক্ষনে আমাদের বেজায় অনিহা। নানাবিধ কারনে তা আরো প্রকট থেকে প্রকটতর আকার ধারন করছে। মানুষের মনে সচেতনা বৃদ্ধি পাক, সংরক্ষনে আমাদের আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটুক এই শুভ কামনায়...
ভাই, আমি আপনার চেয়ে ১০ বছর ছোট!
আমাকে তুমি/তুই সম্ভোধন করবেন, প্লিজ! O:-)
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ