দেউল – সম্মৃদ্ধ জনপদ ও বৌদ্ধ ধর্মকেন্দ্র

দেউল অর্থ দেবালয়। স্বর্গের দেবতারা স্ব-শরীরে আদৌ মর্ত্যে নেমে এসেছিলেন কিনা আমার জানা নেই…কিন্তু একটু সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় দেবতাদের অর্ঘ্য দানে মানুষ কি না করেছে!! দেবতাদের নিশ্চয় স্বর্গে নিজস্ব আবাস রয়েছে। তারপরও ভক্তকুলের আকুল আবেদনে সাড়া দিতে মাঝে মাঝে মর্ত্যে তো আসতেই হয়। দেউলেও নিশ্চয় আসতেন যেমন তারা আসেন ভাটিক্যান নগরের হর্ম্য-প্রাসাদে, জেরুজালেমের মরুভূমিতে, গ্রীসের পর্বত চূড়ায় কিংবা মেসোডোনিয়ার তটরেখায়। পার্বতীপুর উপজেলার একটি গ্রামের নাম দেউল – এক সময়ের জন কোলাহলময় সভ্য নগরীর পানে দেবতাদের আজ কেন যে এহেন বিমুখতা…!!!

‍অনেক অনেক দিন আগে গ্রামের বিস্তৃর্ণ এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন এক জনপদ। তা সে পাল আমলের কথা হবে, অন্তত আজ থেকে ১,২০০ বছর আগে। কঙ্করা আর চিরামতি(বা চৈতা) নদীর মিলনস্থলে সম্ভবত ছিল সে সভ্যতার আদি নিদর্শন। নদীর অস্তিত্ব এখন বিলীন – চর জেগেছে। আর সে চরে প্রকৃতির সহজাত নিয়মে নতুন নতুন বসতিও গড়ে উঠেছে। মাটির নীচে চাপা পড়া সভ্যতার হাড়-কংকাল খানিকটা রেখে মোটামুটি সমুদয় সম্পদই নানা কায়দায় আত্মস্যাৎ করে তৈরী হয়েছে নতুন বসতি। গ্রামে এমন কোন ভিটে নেই যেখানে প্রাপ্ত ইটের ব্যবহার না হয়েছে, বলা চলে প্রায় ৭০ ভাগ বাড়ি এসব ইট দ্বারা তৈরী। কোন কোন বাড়িতে তা সৌন্দর্য্যবর্ধনের জন্য হোক কিংবা চিরাচরিত কারনেই হোক, সে সব ইটের উপর ঘটা করে মাটির প্রলেপও দেওয়া হয়েছে।

পুরো গ্রাম জুড়ে প্রাচীন ইটের টুকরোর মাত্রাতিরিক্ত সমাহার অনায়াসেই আজ এর প্রাচীনত্বকে প্রশ্নাতীত করেছে। মোঘল আমলের ‘দেওপাড়া’ আর বৃটিশামলের ‘দেওরার’ যত্রতত্র এতো পরিমান প্রাচীন ইট ও ইটের টুকরোর ছড়াছড়ি যে, তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবার জো নয়। বাড়ির নীচে, পুকুর পাড়ে, শষ্যক্ষেতে, বাঁশঝাড়ে সর্বত্র অসংখ্য পরিমানে তা এখনো দৃষ্ট হয়। কাছাকাছি এত অগনিত ঢিবির অবস্থানও বাংলাদেশের অন্য আর কোন স্থানে আছে কিনা তা আমার জানা নেই। প্রাপ্ত ইট বিভিন্ন মাপের, আকার ও আকৃতির ছিল – তা প্রায় ৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত হবে। সাধারনতঃ আনাম ও বড় বড় ইটগুলো নতুন স্থাপনা তৈরীতে বিশেষ করে বাড়ি-ঘরে ব্যবহৃত হয়েছে আর টুকরো-আদলাগুলো ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে যেখানে সেখানে পড়ে রয়েছে।

এখানে প্রাপ্ত প্রত্ন-নিদর্শনের মধ্যে বেলে পাথরের প্রায় ৪ ফুট উচ্চতার একটি বৃষ(ষাড়)-মূর্তি, বেলে পাথর, কালো পাথর, কালো পাথরের শিবলিঙ্গ, কালো ব্যসল্ট পাথরের গৌরীপট্ট, ট্রাংক সদৃশ বাক্স, মহিলাদের ব্যবহৃত বাজু, মাটির খুঁটি ও বিভিন্ন আকারের ইট বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাক্সের মধ্যে শাড়ীর মতো কিছু কাপড় নাকি পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু ধরা মাত্রই তা ছাইয়ের মতো ঝুরঝুর করে ঝরে গেছে বলে জানালেন স্থানীয়রা। সম্ভবত দীর্ঘদিন যাবত বাক্সবন্দী থাকার ফলে এমন দশা হয়েছে।

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কে বা কারা যেন পাথরগুলো এখান থেকে নিয়ে গেছে। গ্রামবাসীরা জানে সে সব পাথর রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত আছে। পাথর দু’টি প্রায় ৪.৫ – ৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু, খানিকটা দরজার চৌকাঠের মত দেখতে ছিল বলে প্রতক্ষদর্শীরা জানালেন। পাথরগুলোতে মনোরম কারুকাজ করা ছিল। কয়েকটি পাথর স্থানীয় বাড়িতে এখনো ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। এলাকার কোন একটি পুকুরে অল্প কিছু দিন আগে একটি কষ্টিপাথরের (গ্রামবাসীর মতে) মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু পরে আর তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি, গোপনে আত্মস্যাত কিংবা এতোদিন তা পাচার হয়ে গেছে বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন স্থানীয়রা।

আদতে কি ছিল এখানে? সত্যি বলতে কি, ছিল অনেক কিছুই। ইতিহাস ও প্রত্ন-বেত্তারা বলেন, পাশের বেলাইচন্ডী গ্রামে যে পৌরানিক ‘বিরাট’ রাজা ছিল তার প্রধান সেনাপতি মদন রায়ের বসতবাড়ি বা একটি দূর্গ ছিল এখানে। ৮০০ ব.মি. আয়তন বিশিষ্ট মাটির তৈরী একটি দূর্গের অস্তিত্ব প্রত্ন-তাত্বিকরা সনাক্ত করেছিলেন বটে, তবে সেটি মদন রায়ের কিনা তা বিবেচ্য। দূর্গের আশে-পাশে অগনিত ইমারতের অস্তিত্ব লক্ষ্যনীয়। ধারনা করি, এই সব ছিল একেকটি বৌদ্ধ-স্তুপ, মন্দিরও হতে পারে বা এই দু’য়ের সম্মন্নয়। স্থানে স্থানে এই সব স্থাপনার ২.৫ – ৩ হাত পর্যন্ত পুরুত্বের দেওয়ালের ভগ্ন অস্তিত্ব এখনো দেখতে পাওয়া যায়।

এখানে একটি বিহারের অস্তিত্বের বিষয়ও খানিকটা নিশ্চিত হওয়া যায়। বর্গাকার বিহারের প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ৬০ মিটারের মত এবং এটি খানিকটা দূর্গের বৈশিষ্ট্যও ধারন করে। এই ইমারতের মধ্যবর্তী অংশ উম্মুক্ত প্রাঙ্গন, যার প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য আনুমানিক ২০ মিটার। প্রাণ ভোমরার মত কোন কোন ঢিবিতে এই গুলোর দেওয়ালের অস্তিত্ব এখনো মেলে। তবে স্বীকার করতেই হবে যে, ক্রমবর্ধমান নাগরিক চাপে আজ তার প্রায় সবই বিলুপ্ত।

‘১৮ গন্ডা (১ গন্ডায় ৪টি, ১৮*৪=৭২টি) পুকুর আছে আমাদের গ্রামে’ – গর্বের সাথে জানালেন গ্রামবাসীরা। পুকুরগুলোর বেশ বাহারী নামও আছে। দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে ক্রমান্নয়ে কয়েকটি পুকুর হলঃ হাড়ি পুকুর, কাশি পুকুর, ভেলা কুবা/কোপা, বাঁশি হারা, পাঁচরতন (পঞ্চরতন), খুনিয়া, মুখ/মধু ধোয়া, হাতিরাম, গরু ডাঙ্গা, পোকা পাড়ী/পরী, আম ধোয়া, যোগী পুকুর, মধ্য দামুয়া, কোনা দামুয়া, বড় চুনিয়াল, ছোট চুনিয়াল, ছোট আউতাল, বড় আউতাল। এসব পুকুরের ৪ পাড়ে ৪টি করে ঘাটও নাকি ছিল। উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ পুকুরগুলো যে মুসলিম পূর্ব যুগের তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সরেজমিন দেখা গেল, স্থানীয় জন-প্রতিনিধির তত্বাবধানে ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাতিরাম ও মুখ/মধু ধোয়া নামের প্রায় মজে যাওয়া পুকুর দু’টির পুনঃখনন চলছে। প্রায় প্রতিটি পুকুরের পাড় বেশ প্রশস্থ আর কোন কোনটির পাড় এখনো বেশ খানিকটা উঁচু, তবে অধিকাংশই এখন ভূমি সমান্তরাল। আগে গাছপালার আধিক্য থাকলেও এখন তেমনটি আর নেই। আমার ধারনা, যে ৭২টি পুকুরের কথা গ্রামবাসীরা উল্লেখ করছেন তা দেউল ও পাশ্ববর্তী বেলাইচন্ডি গ্রামের পুকুরগুলোসহ হতে পারে। এই দু’গ্রামে অসংখ্য পুকুরের অস্তিত্ব সর্বজনবিদিত। সম্ভবত, পাল ও সেন আমলে এই দু’গ্রাম জুড়ে যে বৃহৎ এক জনপদ গড়ে উঠেছিল এই সব তারই নিদর্শন।

বেশ কয়েকটি পুকুরপাড়জুড়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আবাসন তৈরী করা হয়েছে এবং সেখানে এখন মানুষজন বসবাস করছে (এই রকম একটি আবাসন প্রকল্পের সাথে প্রকল্প কর্মকর্তা হিসাবে আমি নিজেও ২০০৬ খ্রীস্টাব্দে সরাসরি জড়িত ছিলাম। ৩০ জানুয়ারী ২০১৬ খ্রীঃ গরু ডাঙ্গা পুকুর পাড়ের আবাসনের বাসিন্দাদের দেখে ভাল লাগল এই কারণে যে, ভূমিহীন এই সব দরিদ্র মানুষের খানিকটা স্বস্তি হয়েছে দেখে)। যেসব পুকুরকে কেন্দ্র করে আবাসন হয়েছে সেখানে সরকারিভাবে পরবর্তীতে ঘাট তৈরী করে দেওয়া হয়েছে। সব পুকুরগুলোতেই এখন মাছ চাষ হয়।

সত্য এবং জনশ্রূতি মিলে নানা গল্প এখানে চালু আছে বেশ। সত্য হল, ‘কুমারী মাটি’র প্রসঙ্গ – এখানকার পুকুরগুলোতে বিশেষ করে ভেলা কুবা/কোপা ও বাঁশি হারা পুকুরদ্বয়ের কেন্দ্রস্থলে যে মাটি আছে তা নাকি সাবানের ন্যায় কাজ করে। স্থানীয় জনগন বিশেষ করে বাড়ির মহিলারা এই বিস্ময়কর মাটি বেশ ব্যবহার করে থাকেন। মাটি পুকুর থেকে সংগ্রহ করে প্রথমে রৌদ্রে শুকানো হয় এবং তারপর তা সাবানের মত গায়ে মাখা হয়, তাতে নাকি শরীর চকচক করে। শুকনো এই মাটি বেশ শক্তও হয়ে থাকে। জনশ্রূতি হল, এখানে যে ৭২ টি পুকুর আছে তা পূর্বে উল্লেখিত সেনাপতি মদনের ৭২ জন চাকর দ্বারা এক রাতে খননকৃত।

ভেলা কুবা/কোপা ও হাড়ি পুকুরের পশ্চিমে আনুমানিক ২০০ মিটার দূরত্বে পাঁচরতন দিঘী। এলাকার আম ধোয়া দিঘীর পরই ২০ একর আয়তনের এই দিঘী দ্বিতীয় সর্ব-বৃহৎ দিঘী। দিঘীর উত্তর পাড়ে প্রাচীন একটি মন্দিরের কথা গ্রামবাসীরা উল্লেখ করে থাকেন। মন্দিরটি পাঁচরতন মন্দির নামেই পরিচিত। মন্দিরের নামে দিঘী না দিঘীর নামে মন্দির তা এখন গবেষণার বিষয়। তবে অনুমান করি, আদি মন্দিরটিতে পাঁচটি রত্ন বা চূড়া ছিল বিধায় মন্দিরের নাম পাঁচরতন এবং সেখান থেকে দিঘীর নামও তেমনটি হয়েছে। গ্রামের বয়োবৃদ্ধরা জানালেন, ১৮৯৭ খ্রীঃ ভূমিকম্পে এই মন্দিরের চূড়া ও স্থাপনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। নির্মাণ সামগ্রী হিসাবে ইট-চুন-সুরকি ব্যবহার করা হয়েছিল। এটি সেন আমলের অর্থাৎ ১২ শতাব্দীর কোন ধর্মীয় স্থাপনা হতে পারে।

সরেজমিন দেখা গেল, সেখানে মন্দির নামের যে স্থাপনাটি এখন দন্ডায়মান তা এমনই আনাড়ি হাতে সাম্প্রতিক কালে তৈরী করা যে, আদি কাঠামোর সাথে বর্তমানের জরাজীর্ণ স্থাপনাটির তুলনা করলে দেবতাদের কাছে এটি এখন প্রহসন বলেই মনে হতে পারে। ‘দেবতারা থাকেন ঐ ভদ্র পাড়ায়….’ মানিক বন্দোপাধ্যায় কি দূরদর্শীই না ছিলেন!! আনুমানিক ১০ ফুট ও ৫ ফুট আয়তনের ইমারতটিতে প্রাচীন ইট সংগ্রহ করে অথবা আদি কাঠামোটি ভেঙ্গে যাওয়ার পরে সে সব ইট পুনরায় ব্যবহার করা হয়েছে। মন্দিরের বাহিরের দিক পলেস্তার বিহীন হলেও ভিতরের অংশ পলেস্তার করা, যদিও কোথাও কোথাও তাও খসে পড়ে প্রাচীন ইটের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। ৮/১০ বছর আগেও এই ঘরের উপর ছনের ছাউনি ছিল কিন্তু এখন সেখানে টিনের চালা দেয়া হয়েছে। এর আশে-পাশেও প্রাচীন ইটের ছড়াছড়ি। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের ২য়/৩য় সপ্তাহ থেকে পরবর্তী এক মাস সে সুপ্রাচীন কাল থেকে এখনো মহা উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে মেলা উৎযাপন করা হয়।

মুসহর শিব মন্দির নামে আরেকটি মন্দিরও এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসাবে বিবেচিত। দিনাজপুর জেলায় মোট ৫টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। সাঁওতাল ও ওঁরাও ছাড়াও এখানে মুসহর নামক আদিবাসী রয়েছে। জন-সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম মুসহর জাতির মধ্যে উল্লেখ করার মত কোন গোত্র-বিভক্তি নেই। এদের জ্ঞাতি ভায়েরা আশে-পাশের অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের অনেকেই যীশুর মহিমায় আলোকিত হয়ে আর বৃটিশ বেনিয়া-মিশনারীর চাতুর্য্য-প্রলোভনে নিজেদের ঐতিহ্যমন্ডিত ধর্মকে ইতিমধ্যেই বিসর্জন দিয়েছেন। তবে সনাতনি ধর্মের অনুসারীও রয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু আদিবাসীর মৌলিক ধর্ম পালন করার মত এখন আর কেউ নেই।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় এদের পূর্ব-পুরুষেরা ভারতের পাটনার ছাপড়া অঞ্চল থেকে এখানে এসেছিলো, ট্রেনে করে সেখানে যেতে ৭ দিন ৭ রাত লাগে – এমনটাই তারা জানেন। ৩০/৩৫ ঘর কমতে কমতে এখনও ১৮টি পরিবারের বাস রয়েছে এখানে। নিজেদেরকে তারা কায়স্থ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। কৃষিকাজ ও সাপ ধরে তাদের জীবণ চলে। সাপ ধরে তারা যে সব সাপুড়েরা মজমা দেখায় বেড়ায় তাদের কাছে বিক্রি করে থাকে।

১৭৬৫ খ্রীঃ মুঘল শাসিত ঘোড়াঘাট পতনের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চল বৃটিশ শাসনাধীন হয়ে পড়ে। নগর উন্নয়ন ও বিস্তৃতির সাথে সাথে নগর ও নাগরিক জঞ্জাল ছাফ-সুতরো করার প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। সে সময় ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে কিছু কিছু আদিবাসী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়। মুঘোলামলে ঢাকার কুট্টি কিংবা বৃটিশামলে দিনাজপুরের মুসহর সম্প্রদায় তেমন স্থানান্তরের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে মুসহরদের বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে, তারা কেবল সেই মহেন্দ্রক্ষণেই স্থানান্তরিত হয়েছিল নাকি তারা এই মাটিরই সন্তান।

মুসহর শিব মন্দিরটি বারো বলিয়ার মন্ডপ নামেও পরিচিত। এখানে শিব লিঙ্গের বিগ্রহ আছে এবং তাতে নিত্য পুঁজা হয়। আদি বিগ্রহের কালো ব্যসল্ট পাথরের ৩টি গৌরীপট্টে ৩টি শিব লিঙ্গ ছিল। বর্তমানে শিব লিঙ্গগুলো চুরি হয়ে গেছে। শেষ সম্বল হিসাবে এখন কেবল গৌরীপট্টগুলো রয়েছে। সেগুলোও যাতে বেহাত হয়ে না যায় সে জন্য মূল মন্দির ছেড়ে পাশের বাড়িতে অস্থায়ী মন্দির বানিয়ে তা রেখে দেয়া হয়েছে। প্রাচীন মাটির তৈরী শিব মন্দিরটি নিশ্চিহ্ন হয়েছে অনেক কাল আগেই। পূণঃনির্মাণের চেষ্টা চলছে মন্দিরটি নিশ্চিহ্ন হবার পর থেকেই, কিন্তু দরিদ্রতা যে বড়ই নিষ্ঠুর…

এলাকার তাবৎ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখনো এখানে পুঁজা দিতে আসেন, বিশেষ করে মেয়ে বিয়ে দেবার সময় প্রথানুযায়ী এখানে আসতেই হবে নইলে নব-দম্পতির অকল্যাণ হবে – এই এক ধরনের সংস্কার যা এখনো স্থানীয়দের মাঝে বিরাজমান। জনশ্রূতি আছে, এই গ্রামে একটি কালো রংয়ের শিল (শিব লিঙ্গ) আর অন্য গ্রামে সাদা রংয়ের আরেকটি শিল ছিল। একদিন যথা নিয়মে পুঁজাচার শেষ হলে বলা নেই কওয়া নেই, কালো ও সাদা শিলদ্বয়ের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বেঁধে যায়। সে এক এলাহীকান্ড। কোনভাবেই তাদেরকে আর থামানো যায় না। হাজার মন্ত্র-জপ-তপ সব প্রায় বিফলে যাবার জোগাড়। কাছে ভেড়ারও জো নেই। এক সময় তারা থম ধরে বসে পড়ল। সময় বুঝে গ্রামের এক প্রাচীন বৃদ্ধ সাহস সঞ্চার ও হাত জোড় করে বিনম্র শ্রদ্ধা ও মিনতি জানালে তারা সে যাত্রায় ক্ষান্ত দেয়।

কেন তারা এমন বৈরী হয়ে উঠলেন, জানতে চাইলে শিলদ্বয় বলল – ‘প্রসাদ বিতরনে কেন বৈষম্য হল?’ এতে তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিল তাই তো এত কান্ড, এত মারামারি। এরপর সাদা শিলটি কালো হয়ে গেল আর এখানেই রয়ে গেল। আর প্রসাদ কি ছিল? মুড়কি, হ্যাঁ সামন্য মুড়ি-মুড়কি … যা বিতরনে পক্ষপাত্বিত্ত করা হয়েছিল, সকলকে সমান ভাগ দেওয়া হয়নি। হায়রে জীবন!!! ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রূটি’।

দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার মম্মথপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত দেউল নামের গ্রামটি এক সময় জঙ্গলাকীর্ণ ছিল, সেখানে বাঘ অবাধে বিচরন করতো। কিন্তু তারও বহু … বহু পূর্বে এখানে একটি সভ্য নগর সভ্যতার পত্তন ঘটিয়েছিল আমাদের আলোকিত পূর্ব-পুরুষেরা। হিংস্র বাঘের কথা আমরা এখনো ভুলি নাই কিন্তু সভ্য পিতৃ-পুরুষদের কথা বেমালুম ভুলে গেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ‘কেয়ার বাংলাদেশ’ তাদের প্রথম প্রজেক্ট হিসাবে এখানে কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করে, কিন্তু অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি, এখনো রাস্তাগুলো সে রকমই আছে। তথাকথিত গ্রাম উন্নয়নের কোমল স্পর্শে হাজার বছরের সম্মৃদ্ধশালী একটি জনপদ ও বৌদ্ধ ধর্মকেন্দ্র কিভাবে অবলীলায় আমাদের সকলের চোখের সামনে দিয়ে হারিয়ে গেল, তাই না..!!??

 

০১ মার্চ ২০১৭/খোলাহাটি

 

তথ্যসূত্রঃ

১. বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আ, ক. ম. যাকারিয়া পৃঃ ৮৪-৮৫/

২. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান পৃঃ ৫৫৯-৫৬০/

৩. দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র-৫, মেহরাব আলী পৃঃ ৩৮৮-৩৮৯/

৪. প্রাচীন বাংলার আনাচে কানাচে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান পৃঃ ৩৭-৩৯/

৫. আলোকচিত্রে প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান পৃঃ ৫৫৯-৫৬০/

৬. আলোকচিত্রে ইতিহাস, পৃঃ ৫/

৭. দিনাজপুরের লোকসংস্কৃতি ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার, সম্পাদনা এ.বি.এম আব্দুস সাত্তার, পৃঃ ১১১/

 

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।