বাংলাদেশের আর দশটা সাধারন গ্রামের মতই রামদাস গ্রামটির ভূমি বিন্যাস সমতল। ফোঁড়ার মত জেগে উঠা টিলাটি তাই স্বাভাবিকভাবেই কেমন যেন বেক্ষ্যাপ্পা লাগে। জায়গাটি আবার জঙ্গলে পরিপূর্ণ। চারিদিকের গায়ে গা ঘেষে থাকা বৃক্ষরাজির মাঝে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভূতুড়ে পরিবেশ ও তার সাথে নানা জীবজন্তুর ক্ষনে ক্ষনে নির্জনতা ভঙ্গ – কেমন যেন থমথমে ভাব। মানুষ অন্ধকার ভয় পায় কিন্তু তাতে লুকিয়ে থাকা রহস্যকে বড্ড ভালবাসে। ‘লালসালু’র মজিদের মাযারের মত তাই সহজাত কারনেই টিলার পাদদেশে মোমবাতি-আগরবাতি-ধুপ-ধুনো পড়তে থাকে। দেখতে দেখতে জঙ্গলে পরিপূর্ণ টিলাটি একদিন মোস্তের আড়া বা মজদের আড়া (জঙ্গলময় স্থানকে স্থানীয়রা ‘আড়া’ বলে থাকে) নামে পরিচিতি পেয়ে যায়।
প্রায় ২০০ বছর আগে রামদাস গ্রামে নতুন এক বসতি গড়ে উঠেছিল। সময়ের তালে শুরু হয়েছিল সেই নতুন জনপদের পথচলা – সেই সময় পচা দালালের পিতৃ-পুরুষেরাও এখানে বসতি গেড়েছিল। মোস্তের আড়া জায়গাটির মালিক ছিল পচা দালাল। পচা দালালের কাছ থেকে জায়গাটি জনৈক ইয়াকুব আলী কিনে তার উত্তর পুরুষ নবাব আলীকে দিয়ে যান। কালের পরিক্রমায় ও জীবনের প্রয়োজনে অনাবাদি জমি আবাদ করা দরকার। নবাব আলী ১৯৮৩-৮৪ খ্রীঃ দিকে মোস্তের আড়ায় তাই খোঁড়া-খুঁড়ি শুরু করেন। খোঁড়া-খুঁড়ি করার সময় টিলায় প্রচুর ইট পাওয়া যেতে থাকে। সবাই ধারনা করল, এখানে হয়ত কোন জমিদার বা রাজবাড়ি আছে। একে পরিত্যাক্ত সম্পত্তি, তার ওপর ফাও ইট দিয়ে ভিটে তৈরীর সুপ্ত খায়েশ মেটাতে গিয়ে গ্রামবাসীর সাঁড়াশি আক্রমনে অতি অল্প সময়েই জরাজীর্ণ স্থাপনাটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ল।
অজানা প্রাচীন স্থাপত্যটি থেকে ইট সংগ্রহের দৌরাত্ব যখন চলছিল তখন গ্রামের তথাকথিত এক গৃহস্থ আইয়ুব আলী ঐ একই উদ্দেশ্যে সেখানে হানা দেয়। যথা সম্ভব ইট কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরেই কলের পাড়ে বসে তা পরিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমন সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে, ইটের গাদা থেকে একটি ইট অকস্ম্যাৎ আলাদাভাবে যেন ছিটকে পড়ল!! তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। কৌতুহলের চরম পর্যায়ে দুরু দুরু বুকে ইটটি তুলে নিয়ে অভিভুত হয়ে পড়েন, কেননা সেখানে স্পষ্ট করে কালেমায় তাইয়্যেবা ও একটি সংখ্যা ৬৯ লেখা আছে। তিনি নিশ্চিত হলেন এই ইট (যার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৬ ইঞ্চি আর উচ্চতা ২ ইঞ্চি) নিশ্চয় কোন মসজিদের হবে, গ্রামবাসীদেরও সেই রকমই ধারনা।
১০ মহররমের (১৯৮৬ খ্রীঃ) শেষ রাতের দিকে গ্রামের জনৈক আফছার আলী তার ভায়রা নওয়াব আলীর কন্ঠ শুনে জেগে ওঠেন। নওয়াব আলী তাকে মোস্তার আড়ায় নামাজ আদায়ের জন্য ডেকে যান। আফছার আলী ওযু করে নওয়াব আলীর সাথে একসঙ্গে সেখানে নামাজ আদায়ের জন্য তার বাড়িতে যান। অনেক হাক-ডাকের পর নওয়াব আলী সদ্য ঘুম থেকে উঠে এত রাতে তাকে ডাকার কারন জিঙ্গাসা করলে জানতে পারেন আফছার আলীকে ডাকার ঘটনাটি। বিস্ময়কর এই ঘটনায় দু’জনই তাজ্জব বনে যান। দিনের মধ্যেই ঘটনাটি সকলের কাছে জানাজানি হয়ে গেলে গ্রামবাসীরা সেই দিন থেকেইে এখানে নামাজ আদায় করা শুরু করেন … আর ঠিক এভাবেই মসজিদটি খুঁজে পাওয়া যায়। এতদিন মসজিদটি সকলের অগোচরে হারিয়ে ছিল বলে, মসজিদের নাম – ‘হারানো মসজিদ’। পরবর্তীতে নবাব আলী হারানো মসজিদের জন্য তার সম্পত্তির এই জায়গাটি দান করেন।
স্থানীয়রা বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছেন যে, হযরত মুহম্মদ (সঃ) এর এক সাহাবী আবু আক্কাস (রাঃ) সুদূর আরব দেশ থেকে এই পথ পাড়ি দিয়ে চীন দেশে যাচ্ছিলেন। সেই সময় এই জলপথ ব্যবহার করে সিকিম ও চিলমারী বন্দর হয়ে চীন, বাংলা, আরব ও রোমনদের বানিজ্য জাহাজ যাতায়াত করত। পথিমধ্যে কিছুকাল এখানে অবস্থানের সময় এই মসজিদ নির্মান করেন। চীনের কোয়াংটা শহরে তার নির্মিত মসজিদ ও সমাধিও নাকি আছে। উক্ত সাহাবীর সম্মানার্থে মসজিদটিকে ‘সাহাবায়ে কেরাম মসজিদ’ নামেও অবিহিত করা হয়ে থাকে।
রংপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থের তথ্যানুযায়ী, ‘রাসূল (সঃ) এর মামা বিবি আমেনার চাচাতো ভাই আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) ৬২০-৬২৬ খ্রীঃ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন। এর সূত্র ধরে অনেকে অনুমান করেন যে, আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) ৬৯০ খ্রীঃ মসজিদটি নির্মান করেছিলেন।’ কারন ৬৯ সংখ্যাটি যদি হিজরী সন ধরি তাহলে তা ৬৯০ খ্রীঃ হয়। গৌড়ে রাজধানী স্থাপন করে বাংলায় তখন রাজা শশাঙ্ক মহাসমারোহে রাজ্য শাসন করছিলেন। কোচ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ও সনাতনি হিন্দু রাজার বাংলার এই রাজত্ব্যে আদৌ ইসলাম প্রচারের সুযোগ তৈরী হয়েছিল কিনা তা গবেষনা ব্যতীরেখে নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল।
প্রাচীন মসজিদের হালফিল চিত্রটি বড়ই হৃদয়বিদারক। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ২১ ফুট ও পূর্ব-পশ্চিমে ১০ ফুট আকারের। পূর্ব দিকের দেওয়ালের কিছু অংশ এখনো টিকে আছে। এই দেওয়ালের পুরুত্ব আনুমানিক ৪ ফুটের মত হবে। পূর্ব দেওয়ালের মধ্যভাগে একটি প্রবেশপথ ছিল। আর এই দরজার উত্তর দিকে অর্থাৎ পূর্ব দেওয়ালের বাইরের দিকে পলেস্তরা করা একটি মিম্বার রয়েছে। দু’ধাপ বিশিষ্ট মিম্বারটি থেকে ধারনা করা সমীচিন যে, এই অংশে একটি ঈদগাঁহ ছিল। দেওয়ালের দু’প্রান্তে মিনারের ভিত্তিমূল এখনো বেশ বোঝা যায়। সম্ভবত মসজিদের চার কোনায় ৪টি অষ্ট কোনাকার মিনারও ছিল।
আদি মসজিদটি এক কাতার বিশিষ্ট ছিল। বর্তমানে ভগ্ন মসজিদটিকে অন্তর্ভূক্ত করে পাঁচ কাতারের নতুন একটি মসজিদ সুকৌশলে নির্মান করা হয়েছে। অর্থাৎ নতুন মসজিদের ভিতর পুরোনো মসজিদটি সংরক্ষন করা হয়েছে এবং প্রাচীন মসজিদের যে অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে সেখানে কাঠের পাটাতন দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছে যাতে কাতারের কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। ধারনা করি মসজিদটি কারুকাজখচিত ছিল। ফুলেল নকশা, পরিমিত মাপের খাঁজকাটা ইটের নকশা, গম্বুজের ভগ্নাংশ ও অন্যান্য নিদর্শন দেখে এমনটা আঁচ করা যায়। প্রায় অক্ষত ফুলেল ও আরবী লেখা ফলকটি এখন রংপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এই দু’টি ফলকের বাঁধাই করা একটি ছবি দর্শনার্থীদের জন্য মসজিদে রেখে দেওয়া হয়েছে। ইসলামিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি নূরানীয়া ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা করা হচ্ছে।
আরবী হরফে লেখা মৃত্তিকা-ফলকটিতে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)’ ও নীচের সারিতে ৬৯ সংখ্যাটি বোঝা যায়। এর থেকে ধারনা করা হয় যে, হুজুর (সঃ)’র ওফাতের প্রায় অর্ধ-শতক বছর পরই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রত্ন-তাত্বিক গবেষণার অভাবে মসজিদের প্রাচীনত্ব নিরূপন করা সম্ভবপর হয়নি। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ঐ সময় এই সব এলাকায় ইসলাম ধর্ম প্রচারক বা পীর-দরবেশ-আউলিয়াদের আগমনের তথ্য মেলে না। আবার, ১২০৪/৫ খ্রীঃ তুর্কী বংশোদ্বুধ মালিক-উল-গাজী ইখতিয়ার-উদ-দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী নদীয়ায় সেন রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করার আগে বাংলায় মুসলিম শাসন কায়েম করা সম্ভব হয়নি – এমনটাই আমরা জানি। অর্থাৎ তৎপরবর্তী সময়ে এখানে মুসলমান কর্তৃক ইসলাম প্রচারের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হয়। তাহলে, প্রচলিত ধারনার আরো ৬০০ বছর আগে কি বাংলায় ইসলামের সুমহান বানী পৌঁছেছিল?
আমরা জানি, সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীতে আরব অঞ্চল থেকে যারা বাংলায় আগমন করেছিলেন তারা মূলতঃ ছিলেন বনিক এবং স্বীকৃতভাবেই তারা সমুদ্রপথ অনুসরণ করেছিলেন। সমুদ্রতট থেকে বাংলার এই অঞ্চল যদিও বেশ দূরে, তথাপি ভৌগলিক নিয়ামকসমূহ বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র-করতোয়া-তিস্তার মত বড় নদী দ্বারা এই অঞ্চল বিধৌত ছিল। এই বিষয়টিও সর্বজন স্বীকৃত যে, ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকা পৃথিবীর প্রাচীনতম অববাহিকাগুলোর অন্যতম। আজ যদিও তিস্তা নদীর অবস্থান মসজিদ প্রান্ত থেকে প্রায় ৮ কি.মি. পশ্চিমে কিন্তু ধারনা করা অমূলক নয় যে, অতীতে এরা হয়ত আরো কাছাকাছি দূরত্বে ছিল। মসজিদের পশ্চিমের যে অংশে আজ অবারিত ধানক্ষেত তা এক সময় ছিল জলে টইটুম্বর এক বিল, নাম ছিল ‘চকচকার বিল’। কালের গর্ভে নামটি হারিয়ে গেলেও মরা বিলটির অস্তিত্ব সমূলে হারিয়ে যায়নি। লোকমুখে তা এখনও ‘সাগরের ছড়া’ নামে পরিচিত। কামরূপ-কামাক্ষা ও কোচবিহারে প্রবেশের জন্য এখানে এককালে একটি নদী বন্দরও ছিল। মুঘলামলে এখানে ‘তীরের গড়’ নামে একটি দূর্গের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এককালে সভ্য এক জনপদই গড়ে উঠেছিল।
এই সব সূত্র পর্যালোচনা করে, বাংলার এই অঞ্চলের কোনো কোনো অংশে বিশেষ করে বৃহত্তর দিনাজপুরের খ্রীঃ পূর্বাব্দের সভ্যতার নিদর্শন আর প্রাচীন আরবের অ্যাসেরীয়-ব্যবিলনীয়-রোমান সভ্যতার মধ্যে কোন যোগসূত্র অস্বাভাবিক কি? এই মতের বিপক্ষে নানা মতামত থাকলেও বৃটিশ প্রত্নতাত্বিক মিস্টার টিম স্টীল এক মত পোষন করেন এবং ধারনা করেন যে, মসজিদটি আরব বনিকদের দ্বারই সম্ভবত ১৩৬৮ বছর আগে নির্মিত হয়েছিল। তাছাড়া, ‘আল জাজিরা’ ও জার্মানভিত্তিক বেতার ‘রেডিও ডয়েচে ভেল’র প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম মসজিদটি লালমনিরহাট সদরের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রামে অবস্থিত। হারানো মসজিদের প্রকৃত ইতিহাস উম্মোচিত হলে নিঃসন্দেহে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস তথা ইসলামিক সভ্যতার অজানা অনেক তথ্য বের হয়ে আসবে। সেই সুদিনের প্রতীক্ষায়…
১০ ডিসেম্বর ২০১৬/বীর উত্তম শহীদ মাহাবুব সেনানিবাস/খোলাহাটি
তথ্যসূত্রঃ
১. রংপুরের প্রত্নসম্পদ, রংপুর গবেষণা পরিষদ, পৃঃ ১৩০/
২. আলোকচিত্রে ইতিহাস, বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর, এরিয়া সদর দপ্তর, রংপুর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পৃঃ ৮৯/
৩. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লিয়াকত হোসেন খোকন, পৃঃ ৪১১/
৪. পাল্টে যাবে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমদের আগমনের ইতিহাসঃ সাড়ে তেরো শ বছর আগের মসজিদ, দৈনিক প্রথম আলো ১৯ অক্টোবর ২০১২/
৫. লালমনিরহাটে এশিয়ার প্রাচীনতম মসজিদ, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৮ আগষ্ট ২০১২/
৬. বাংলাদেশের কয়েকটি প্রাচীন মসজিদ, গোলাম আশরাফ খান উজ্জল, দৈনিক ইত্তেফাক, ০২ অক্টোবর ২০১৫/
স্থাপনার বয়স পরীক্ষা করে বিষয়টা নিশ্চিত করা দরকার। ইটে উৎকীর্ণ "৬৯" হিজরী সন নির্দেশক না হয়ে অন্য কিছুও হতে পারে।
জাহিদ, মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমার বক্তব্যের সাথে সহমত। অভিজ্ঞজনেরাও তাই বলছেন যে, ৬৯ হিজরী সন নয়। কার্বন ১৪ বা অন্য কোন বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করা সম্ভব। সেই সুদিনের অপেক্ষায়...