তাজহাট জমিদার বাড়ি – রংপুর

দিল্লীর ময়ূর সিংহাসন তখন মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রী) অধীন। তার শাসনামলে শিখ সম্প্রদায়ের তীর্থভূমি পাঞ্জাব শহরে মোঘলদের সাথে শিখদের সংঘাত বেঁধে যায়। তুমুল লড়াই হয়, শহর পরিনত হয় ধ্বংসস্তুপে, অধিকার রক্ষায় আত্মবির্সজন দেয় অগনিত শিখ। বাংলায় তখন মুর্শিদকুলি খাঁ (১৭০৭-২৭ খ্রীঃ) দাপটের সাথে মোঘল প্রতিনিধিত্ব করছে। এমনই এক উত্তাল সময়ে নিজ ভূমি পাঞ্জাব শহর ত্যাগ করে মান্না লাল রায় ও রতন লাল রায় নিজেদেরকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় বাংলায় আগমন করে। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় তারা রংপুর শহরের মোল্লাবাড়ি নামক স্থানে বসতি গাড়ে। দু’জনই তাদের আদি শিখ ধর্ম পরিত্যাগ করে সনাতনি হিন্দু ধর্মে নিজেদেরকে সমার্পন করে ক্ষত্রিয় গোত্রভূক্ত হয়।

মান্না লাল রায় স্বর্ণাকার হিসাবে জীবন নির্বাহ করতেন। একজন দক্ষ স্বর্ণের কারিগর হিসাবে অতি অল্প দিনেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। বিশেষ করে তার হাতের তৈরী মুকুট বা তাজ এক শৈল্পিক পর্যায়ে পৌঁছে যায় আর অচিরেই তা সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়। ক্রমেই স্বর্ণাকার মান্না লাল খ্যাতি ও অর্থ-বিত্তে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। স্থানীয় জমিদারদের জায়গা-জমি-তালুক কিনে বিশেষ করে বৃটিশ আমলে পুরো একটি পরগনার মালিক হয়ে ক্রমেই ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও ভারতের পূর্ণিয়া, জলপাইগুড়ি ইত্যাদি জায়গার জমিদার হয়ে যান। মান্না লাল রায়ের তাজের সুবাধে মোঘল আমলে তৎকালীন রংপুরের কেন্দ্রস্থল মাহিগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত টুপির হাটটির প্রচার ও প্রসার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং সেখান থেকেই এই এলাকার নাম হয় তাজহাট। মান্না লাল রায়ের জমিদারীর কেন্দ্রস্থল – কাচারী ও বসতি তাজহাট জমিদার বাড়ি হিসাবে এলাকায় এখনো পরিগনিত হয়ে আসছে।

তাজহাট জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা মান্না লাল রায়ের নাতি ধনপদ লাল রায়। তিনি বিয়ে করেন রতন লাল রায়ের নাতনিকে। ধনপদ লাল রায়ের নাতি উপেন্দ্র লাল রায়। তিনি অতি অল্প বয়সে দেহ ত্যাগ করলে জমিদারীর উত্তাধিকার তার জ্যাঠা গীরিধারী লাল রায়ের (ভিন্ন মতে তিনি মান্না লাল রায়ের পুত্র) উপর বর্তায়। এই দিকে গীরিধারী লাল রায় আবার নিঃসন্তান। জমিদারী রক্ষার জন্য তাই তিনি কলকাতা থেকে গোবিন্দ লাল’কে দত্তক হিসাবে গ্রহন করেন।গোবিন্দ লাল রায় ১৮৭৯ খ্রীঃ উত্তাধিকার সূত্রে জমিদারী লাভ করে। তিনি ব্যাক্তি জীবনে বেশ আমুদে ও ফূর্তিবাজ মানুষ ছিলেন। ইংরেজ তাবেদারী ও দেদারছে খরচ করার কারণে তার চারপাশ ঘিরে বন্ধুদের আনাগোনাও ছিল বেশ। ইংরেজ তাবেদারীর ফল হয়েছিল, তাকে সুবিধাবাদী ইংরেজরা ১৮৮৫/৮ খ্রীঃ প্রথমে রাজা, ১৮৯২ খ্রীঃ রাজাবাহাদুর ও ১৮৯৬ খ্রীঃ মহারাজা তকমা দিয়ে উৎসাহিত করে। কিন্তু ১৮৯৭ খ্রীঃ ‘বেঙ্গল আর্থকোয়েক’র মহা তান্ডবে সাবেক বাড়ির ধ্বংসস্তুপের নীচে চাপা পড়ে তিনি মৃত্যু মুখে পতিত হন।

গোবিন্দ লাল রায়ের মৃত্যুর ১১ বছর পর ১৯০৮ খ্রীঃ তার পুত্র মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় জমিদারীর দায়িত্ব পান। গোপাল লাল রায় তার পিতার মত বৃটিশদের নিকট হতে ১৯১২ খ্রীঃ রাজা ও ১৯১৮ খ্রীঃ রাজাবাহাদুর খেতাবে ভূষিত হন। তিনি এই বংশের শেষ জমিদার হিসাবে স্বীকৃতি পান। মহারাজা গোপাল লাল রায় প্রায় ১০ বছর যাবৎ সময় নিয়ে ১৯১৭ খ্রীঃ সুরম্য এই প্রাসাদটির নির্মান কাজ সমাপ্ত করেন। ইউরোপিয়ান গোথিক ও মোঘল স্থাপত্যকলার সম্বন্নয়ে অসাধারন শৈল্পিক ধাচে প্রাসাদটি এক অনন্য স্থাপত্য বৈশিষ্ঠ্য ধারন করে আছে।

৫৬ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত জমিদার বাড়িটির প্রায় তিন দিক শ্যামা সুন্দরী খাল দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং এর পশ্চিম দিক থেকে রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়ক চলে গেছে। ইংরেজী ইউ বর্ণের ন্যায় বিন্যাস্ত বাড়ির চারিদিক প্রায় ১.৯ মিটার উঁচু পাকা প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। প্রাচীরের উত্তর দিকের পূর্ব প্রান্তের প্রধান ফটক দিয়ে মূল চত্বরে প্রবেশ করতে হয়। বাড়ির চৌহদ্দিতে প্রবেশের জন্য দক্ষিনে আরেকটি প্রবেশ পথ রয়েছে। এই পথ দিয়ে প্রবেশ করলেই প্রথমে নজরে আসবে একটি ঝর্ণা। বাড়িটির নান্দনিক সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য ও রাণীর সৌখিনতার নিদর্শন হিসাবে ত্রিকোণাকার ভূমির উপর সুন্দর এই ফোয়ারা/ঝর্ণাটি তৈরী করা হয়েছিল। ইতালীয় শ্বেত পাথরের সবুজাভ নকশায় পরিস্ফুটিত ঝর্ণাটি কালের করাল গ্রাসে খানিকটা মলিন হলেও এখনো আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে স্বগর্বে দাঁড়িয়ে আছে অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য। ঝর্ণা অতিক্রম করে এগোলে দ্বিতল এই অট্টালিকার প্রধান আকর্ষন প্রসারিত কেন্দ্রীয় সিঁড়িটি মুগ্ধতায় ব্যাকুল করে তুলবে। সাদা ও কালো মার্বেল পাথরে মোড়ানো সিঁড়িটি আনুমানিক ২০.১২ ‍মিটার দীর্ঘ ও ১০.১০ মিটার প্রশস্ত যা উর্ধ্বমুখী হয়ে ৩ স্তরে ৩২টি ধাপ অতিক্রম করে সরাসরি দোতলায় উঠে গেছে। এককালে সিঁড়ির উভয় পাশে ইতালীয় মার্বেল পাথরের রোমান দেব-দেবীর মূর্তি শোভা বৃদ্ধি করত। সেই সবের কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। তবে সিঁড়ির রেলিং বরাবর সুসজ্জিত বাতিদানির কোন কোনটি এখনো টিকে আছে।

২৮ কক্ষ বিশিষ্ট সুরম্য প্রাসাদটি পূর্বমুখী যার দৈর্ঘ্য ৪৪.২০ মিটার এবং প্রস্থ আনুমানিক ৩৬.৫৬ মিটার ও উচ্চতা প্রায় ১২ মিটারের মত বা ৪ তলার সমান। বাড়িটির পশ্চিম দিক উম্মুক্ত। বাড়ির সম্মুখভাগে ও একতলার সাথে সংযুক্ত কেন্দ্রীয় সিঁড়ির নিচে ১০ মিটার দীর্ঘ গাড়ী বারান্দা আছে। বারান্দার ছাদ ৪টি স্তম্ভের উপর স্থিত। গাড়ী বারান্দা ও বাড়ীর প্রবেশ পথের সাথে বিশাল এক ‘হল রুম’ আছে যার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১৮.২৯ মিটার ও ১৩.৭২ মিটার। হল রুমের দু’পাশে একটি করে কক্ষ আছে। সম্মুখ বারান্দায় কারুকাজ করা লোহার জালি রয়েছে। বাড়ির উত্তর ও দক্ষিণ বাহুর পূর্বপাশে প্রবেশ পথসহ প্রলম্ভিত সুসজ্জিত অংশ আছে এবং তিন দিক জুড়ে আছে তিন মিটার প্রশস্থ টানা বারান্দা।

বাড়ির উত্তর ও দক্ষিণ বাহুর বারান্দার সাথে বেশ কয়েকটি কক্ষ আছে। সমুদয় ভবনের প্রতিটি কক্ষে কাঠের তৈরী মজবুত দরজা ও জানালা আছে। মেঝে পাকা ও ছাদ লোহার বীম ও কড়ি-বরগা দ্বারা গঠিত। দোতলার ছাদের দু’প্রান্তে ২টি ও মাঝখানে একটি ক্ষুদ্র কক্ষ আছে যা হাওয়া ভবন ও রাণী ভবন নামে পরিচিত। প্রাসাদের উপরিস্থ ছাদের কেন্দ্রস্থলে অষ্ট কোনাকার স্তম্ভের উপর একটি আকর্ষনীয় রেঁনেসা গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজ তৈরীতে সেমি করিন্থীয় পদ্ধত্তি অবলম্বন করা হয়েছে যেখানে স্তম্ভগুলো অষ্টকোনাকার ড্রামের উপর স্থাপিত এবং এটি আংশিকভাবে সরু স্তম্ভের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

উত্তর বাহুর কক্ষগুলোর মধ্যবর্তী অংশে নীচ থেকে উপরে উঠার জন্য কাঠের তৈরী একটি সিঁড়ি রয়েছে। ২২ ধাপ বিশিষ্ট কাঠের সিঁড়িটি দেখতে বেশ চমৎকার। দক্ষিণ বাহুর পশ্চিম কোণার বারান্দায় লোহার তৈরী নকশা করা, প্যাঁচানো ও ঝুলন্ত আরেকটি সিঁড়ি রয়েছে। উত্তর বাহুর যেখানে সিঁড়িঘর ঠিক তার বিপরীত দিকে অর্থাৎ দক্ষিণ বাহুর সেই অংশে আরেকটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। পশ্চিমমূখী তিন দিকের বারান্দা থেকে বাগানে বের হবার জন্য সিঁড়ি বিশিষ্ট তিনটি বহিঃগমন পথ আছে। সম্ভবত বৃটিশ অট্টালিকার আদলে বাড়ির আদি রং ছিল লাল কিন্তু জাদুঘর হিসাবে রুপান্তরের সময় এর রং সাদা করা হয়।

জমিদার বাড়ির পিছনে একটি গুপ্ত সিঁড়ির জনশ্রূতি রয়েছে যা সুড়ংগের মাধ্যমে ঘাঘট নদীর সাথে যুক্ত এমনটাই সাধারন মানুষের ধারনা। বর্তমানে ঘাঘট নদী প্রাসাদ থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এই ঘাঘট নদীর তীরেই মাহিগঞ্জে মোঘলামলের সমসাময়িক ও বৃটিশামলে পুরোনো রংপুর সদর গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে ঘাঘট নদী নাব্যতা হারালে ক্রমান্নয়ে সদর ধাপ এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। রংপুর জেলা গেজেটিয়ারের তথ্য থেকে জানা যায়, মোঘল সেনাপতি শাহ ইসমাইল গাজীর সমসাময়িক শাহজালাল বোখারী নামে একজন পীর মাছের পিঠে সওয়ার হয়ে প্রথমে এখানে আগমন করেন ও বসতি গাড়েন আর সেই সূত্র থেকে এলাকার নাম হয় মাহীগঞ্জ।

নিঃসন্দেহে জমিদার বাড়ির আঙিনাটি ছিল বিশাল। পূর্ব আঙিনার ৩৫ একর জমি কৃষি ইনস্টিটিউটকে (বর্তমানে এগ্রিকালচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউশন) হস্তান্তর করার পর এখন এর আয়তন সাকুল্যে ১৬ একর। সম্পূর্ণ জায়গাটি পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো। সারি-সারি গাছের সমাহার, ফুলের কেরী ও দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য ‘ওয়াক-ওয়ে’ আছে। এই চৌহদ্দির মধ্যে আছে ৩টি বিভিন্ন মাপের পুকুর। জমিদার বাড়ির অপর আরেকটি পুকুর এখন কৃষি ইনস্টিটিউটের সীমানার মধ্যে। দক্ষিণের প্রবেশ পথের দু’ধারে ঐ ৩টি পুকুরের দু’টি অবস্থিত। উত্তর পাশেরটির তুলনায় দক্ষিন পাশেরটি আকারে বড়। বড় পুকুরটির দক্ষিন পাড়ে পারিবারিক জৈন মন্দিরটি ছিল। ১৮৯৭ খ্রীঃ ভূমিকম্পে মন্দিরটি ধ্বসে পড়ে। এই মন্দিরের ইট-পাথর এখনো প্রাসাদের বিভিন্ন স্থানে ইতঃস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। মন্দিরের পশ্চিমে প্রায় বর্গাকার আরেকটি ছোট্ট পুকুর আছে যা রাণীর পুকুর নামে পরিচিত। এই পুকুরের উত্তর পাশে একটি শান বাঁধানো ঘাট আছে। পুকুরগুলো বর্তমানে পানিহীনতায় ভূগছে।

রাণী পুকুরের পশ্চিমে ও প্রাসাদের দক্ষিণে গোপাল লাল রায় আারেকটি বাড়ি নির্মান করেছিলেন যেখানে তার রাণী বসবাস করতেন (সম্ভবত আঁতুড় ঘর)। গোপাল লাল রায়ের রবি ও ভৈরব নামে দু’পুত্র ছিল। দূর্ভাগ্যবশতঃ রবি’র অকাল মৃত্যু হলে তার মা মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। যাহোক, ‘রাণী মা’র সেই বাড়িটির কোনো চিহ্নই এখন আর সেখানে নেই। ১৯৫০ খ্রীঃ জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে মহারাজা ভৈরব পিতার সম্পত্তির একক মালিক হন। কিন্তু জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে পর তারা সপরিবারে ভারতের কোলকাতায় অভিবাসিত হন। গোবিন্দলালের পরিবার-পরিজনেরা বাড়ি ত্যাগ করে চলে যাবার পর সরকার কর্তৃক বাড়িটি অধিগ্রহন করা হয়। এরপর বাড়িটি সরকারের নানা সংস্থার কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। প্রথমে ১৯৫২ খ্রীঃ কৃষি প্রশিক্ষায়াতন, ১৯৮৪-৯১ খ্রীঃ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চ এবং ২০০২ খ্রীঃ সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্থানীয় গনগ্রন্থাগার চত্বর থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ২০০৫ খ্রীঃ হতে অদ্যাবধি রংপুর জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

জাদুঘরে দর্শনীয় প্রায় ৪০-৫০ প্রকারের প্রত্ন সম্পদ রয়েছে যেমনঃ জমিদারদের ব্যবহার্য্য টেবিল-চেয়ার, সেগুন কাঠের তৈরী বাক্স, ঝাড়বাতি, দাড়িপাল্লা ইত্যাদি। এছাড়াও আছে, সম্রাট নাসির উদ্দিন, সম্রাট আওরঙ্গজেব, শেখ সাদী ও বেগম রোকেয়ার স্বহস্তে লিখিত যথাক্রমে পবিত্র কোরআন শরীফ, জুম্মার নামাজের খুৎবা, ফার্সী কবিতা ও চিঠি। পাথরের খোদাই করা বিভিন্ন ধরনের মূর্তি যথাঃ বিষ্ণু, পার্বতী, আক্রমনরত যোদ্ধা, শিবলিঙ্গ, নারী, লাল পাথরের খন্ড, পাথরের নোড়া, দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা, মৃৎ পাত্র, লোহার দ্রব্য সামগ্রী, পোড়ামাটির শিলিং, সাঁওতালদের ব্যবহৃত তীর, সংস্কৃত ও আরবী ভাষায় তুলট কাগজ ও গাছের বাঁকলে লিখিত প্রাচীন হস্তলিপি/পান্ডুলিপি, রামায়ন ও মহাভারত, মহাস্থানগড় থেকে প্রাপ্ত পোড়া মাটির ফলক, বদনা এমনকি মুদ্রাও আছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক।

১৯৮২ খ্রীঃ সরকারি তত্বাবধানে জমিদার বাড়িটির সংস্কার কাজ করা হয়। ১৯৯৫ খ্রীঃ বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জমিদার বাড়িটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে অধিগ্রহন করে। বর্তমানে অধিদপ্তরের ‘কাস্টডিয়ান অফিস’ এর ১২ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাড়িটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে। ১৯৭১ খ্রীঃ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়িটির বেশ ক্ষয়-ক্ষতি ও মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রীর লুটপাট হয়। তথাপি, রংপুর জাদুঘর প্রতিষ্ঠা এবং স্থাপত্যের একক শৈল্পিক গুনের কারণে প্রায় সারা বছর জুড়েই দর্শনার্থীদের ভীড় লেগেই থাকে। এই সব দর্শনার্থীদের মধ্যে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা ও যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূতসহ বিদেশী পর্যটকরাও রয়েছেন। এখানে বনভোজনের সুবিধা আছে, আর তাই প্রতিদিনের দর্শনার্থীর পাশাপাশি পিকনিক মৌসুমে দেশের নানা স্থান থেকে হাজারো মানুষের আগমন ঘটে থাকে। তাজহাট জমিদার বাড়ি রংপুর শহরের উপকন্ঠে মাহীগঞ্জের তাজহাট নামক স্থানে অবস্থিত। আহা!!!! বাংলাদেশের প্রতিটি প্রত্ন-নিদর্শন যদি এমন ভাবে রক্ষণাবেক্ষন করা সম্ভব হতো!!!!

———————————————————————————————————————————————-

২২ জানুয়ারী ২০১৭/বীর উত্তম শহীদ মাহাবুব সেনানিবাস/খোলাহাটি

 

তথ্যসূত্রঃ

১. আলোকচিত্রে ইতিহাস, বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর, এরিয়া সদর দপ্তর, রংপুর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পৃঃ ১৯৬-১৯৭/

২. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ৩৭৪-৩৭৫/৩৮৪/

৩. রংপুরের প্রত্নসম্পদ, রঙ্গপুর গবেষণা পরিষদ, পৃঃ ২৫-২৬/

৪. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লিয়াকত হোসেন খোকন, পৃঃ ৩৯৮/৪০০-৪০১/

৫. রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ি, সামুয়েল ইকবাল, দৈনিক প্রথম আলো, ২৩ এপ্রিল ২০০২/

৬. Tajhat Jamidar Bari, Tanim-Prodip-Likhon & Moni, The Daily Star, 24 Oct 2006/

৭. রংপুর তাজহাট জমিদার বাড়ি, রমজান বিন মোজাম্মেল, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ আগষ্ট ২০০৭/

৮. তাজহাট জমিদার বাড়িতে একদিন, কাজী শফিকুল আাযম, দৈনিক যুগান্তর, ৫ অক্টোবর ২০১২/

৯. উইকিপিডিয়া

১০. তাজহাট জমিদার বাড়ি নিয়ে মহাপরিকল্পনা, উত্তর বাংলা, ২১ মে ২০১৬/

১১. তাজহাট জমিদার বাড়িঃ মান্নালাল রায়ের অনন্য কীর্তি, এইবেলা, ১৭ জুন ২০১৭/

৪ টি মন্তব্য : “তাজহাট জমিদার বাড়ি – রংপুর”

  1. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    এই মাছের পিঠে করে আসার কাহিনীটা সারা বাংলাদেশ জুড়েই মনে হয় প্রচলিত। আরো অনেক জায়গায় শুনেছি। 'গেজেটিয়ার' সম্পর্কে ধারণা নেই। এটি যদি প্রাতিষ্ঠানিক কোন তথ্যের উৎস হয়ে থাকে তবে এমন গালগপ্পো সেখান থেকে বাদ দেয়াটাই সমীচীন বলে মনে করি।

    বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষনে বরাবরই কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা চোখে পড়ার মত। দেখিনি। তবে লেখা পড়ে আর ছবি দেখে মনে হচ্ছে সেই উদাসীনতা টুকু অনুপস্থিত। পুকুরগুলোতে পানি দিয়ে রাখতে পারে।

    চমৎকার লিখেছেন ভাই। চোখ বন্ধ করে মনে হলো ইতিহাস আর জমিদার বাড়ী দুটোই ঘুরে এলাম। :boss: :boss: :boss:


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
    • কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

      মাহমুদুল-সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। মাছের পিঠে সওয়ার হয়ে ইসলাম প্রচারের এই কেরামতি বহু জায়গায় প্রচলিত আছে, তবে এক্ষেত্রে বগুড়ার মহাস্থান গড়ের সুলতান মাহমুদ শাহ বলখী মাহীসাওয়ার সবচেয়ে বেশী প্রচারিত। বাস্তববাদী বিজ্ঞ জনেরা বলেন, মাছের পিঠে নয়, বরং মাছের ন্যায় নৌকায় চডে আগমন করেছিল। যেমন প্রচলন আছে ময়ূরপক্ষী নৌকার। তবে লোকশ্রূতিকে অবলম্বন করে রচিত এই সব কাহিনী যতটা না বিজ্ঞানভিত্তক তারচেয়ে বেশী ধর্মীয় অশিক্ষা।
      সত্যিই বাংলাদেশের বিশাল প্রত্ন-ভান্ডারের অতি সামান্যই প্রকৃত সংরক্ষনের আওতায় আছে। কেবলমাত্র সচেতনতাই পারে অবস্থার আশু পরিবর্তনের।
      ভীষন অনুপ্রানীত হলাম। শুভ কামনা রইল।

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।