রামসাগর – দিনাজপুর

রামসাগর শুধুমাত্র দিনাজপুর অঞ্চলেরই নয় বরং সারাদেশের একটি অতি পরিচিত আইকন। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্ন-তাত্ত্বিক দ্রষ্টব্যও বটে। বহুল আলোচিত দিনাজপুর রাজবংশের এক অনন্য কীর্তি – রামসাগর। শ্রীমন্ত দত্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ রাজবংশ সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও’র বিভিন্ন স্থানে তাদের অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। এ রাজবংশের সব থেকে কীর্তিমান ও প্রসিদ্ধ নৃপতি রাজা প্রাণনাথ। প্রাণনাথের পালক পুত্র রাজা রামনাথও তার পিতার মত ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে। রাজা রামনাথের নামানুসারে এ বিখ্যাত দিঘীর নামকরন করা হয়। ইতিহাসের পাতা খুঁজে দেখা যায়, ১৮০৮, ১৮৬০ ও ১৯১২ খ্রীঃ যথাক্রমে মিস্টার বুকানন, মেজর শেরউইল ও স্ট্রং তাদের রচনায়, মানচিত্রে ও গেজেটিয়ারে এ দিঘীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।

20150905_133920

রামসাগর – উত্তর পাড় থেকে

RAMSAGAR- 01-03 FEB 07

রামসাগর – পরিচিতিমূলক বোর্ড

20150717_121421

রামসাগর – দক্ষিন পাড় থেকে

অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন পর পর তিন বছর বৃষ্টিহীন দিন গেল তখন রাজা প্রাণনাথ এ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাত ১৭৫০-১৭৫৫ খ্রীঃ মধ্যে প্রজা সাধারণের কল্যানের জন্য বিশাল এক দিঘী খনন করালেন। আউলিয়াপুর ইউনিয়নের ততকালীন মুর্শিদাবাদ সড়কের পাশে তাজপুর গ্রামে খননকৃত এ দিঘী পাড়সহ আনুমানিক দৈর্ঘ্য-প্রস্থে যথাক্রমে ১.২২ কিলোমিটার ও ৫৪৫ মিটার। দিঘীর জলভাগের অংশ আনুমানিক দৈর্ঘ্য-প্রস্থে যথাক্রমে ১.০২ কিলোমিটার ও ৩১৫ মিটার। গভীরতা আনুমানিক ১০ মিটার, তবে উত্তরদিক তুলনামূলকভাবে বেশী গভীর। ৪,৩৭,৪৯২ মিটার বিশাল আয়তনের এ দিঘীকে অনেকে মনে করেন বাংলাদেশের দীর্ঘতম দিঘী। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায় বাংলাদেশের দীর্ঘতম দিঘীর (শুধুমাত্র জলকর বিবেচনায়) গৌরব নওগাঁর ‘আলতাদিঘী’র। তবে এ কথা সঠিক যে, পাড় ও অন্যান্য ভূমিসহ রামসাগর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আয়তনের দিঘী। দিঘীকে কেন্দ্র করেই দিঘীর পশ্চিমপাড়ের গ্রামের নাম দিঘীপাড়া হয়েছে।

20150717_121739

রামসাগর – দক্ষিন পাড় থেকে

দিঘীর পশ্চিমপাড়ে পাথর ও ইটের বিশাল একটি পাকা ঘাট দিঘী খননের সময় তৈরী করা হয়েছিল যা পাথরঘাটা নামেই পরিচিত, যদিও এখন দিঘীর তিনপাশ জুড়ে ৪টি ইট ও টাইলস দ্বারা নির্মিত পাকা ঘাট রয়েছে যা পরবর্তীতে সংযোজনকৃত। পাথরগুলো প্রাচীন বানগড় শহর (দিনাজপুরের সন্নিকটে কিন্তু বর্তমানে ভারতের অংশ) থেকে অথবা ভারতের রাজমহল থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকতে পারে। পাথরগ্রাত্রে বিভিন্ন মূর্তি ও নকশাকাটা আছে বলে স্থানীয়রা জানালেন। সে সবের দৃষ্টান্ত এখনো রয়েছে। ঘাটের প্রথম ধাপে এ রকম কিছু অলংকরণ চোখে পড়ে। এসব পাথর আসলে ঘাটের ভেঙ্গে যাওয়া অংশ থেকে পরবর্তীকালে সংগ্রহ করে এখানে সংস্কার করা হয়েছে, অর্থাত আদিতে অলংকৃত পাথর ঠিক এখানেই ছিল না তবে ঘাটের কোন না কোন অংশে ছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত/ভগ্ন স্থাপনা থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হয়ে থাকেতে পারে। উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ এ দিঘীর পাড়সমূহ সুউচ্চ যা আনুমানিক গড়ে ১৩ মিটারের মত এবং তা বেশ চওড়া। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় সাড়ে দশ লক্ষ/পনের লক্ষ শ্রমিকের কোদাল ব্যবহারের মাধ্যমে, ৩০,০০০ টাকার খনন ব্যায়ের মধ্য দিয়ে মাত্র ১৫ দিনে (ভিন্ন মতে ৫ বছর) মানুষ সৃষ্ট এ দিঘী সে সময় ছিল বিস্ময় জাগানিয়া এক কীর্তি।

20150905_140342

রামসাগর – পাথরঘাটা

20150905_140250

রামসাগর – পাথরঘাটা

ব্যাপক জনশ্রূতি থেকে জানা যায় যে, অনাবৃষ্টি আর খরার কারণে সৃষ্ট পানীয় জলের অভাব দূরীকরণের লক্ষ্যে রাজা প্রাণনাথ প্রথমে রাজবাড়ী সংলগ্ন ‘সুখসাগর’ নামে একটি দিঘী খনন করান। অদ্ভুদ কারণে সেখানে পানির কোন চিহ্ন দেখা গেল না। অনুপায় হয়ে রাজা একে একে ‘মাতাসাগর’, ‘জুলুমসাগর’ ও ‘আনন্দসাগর’ খনন করান। সেখানেও পানির দেখা মিললো না। অতপর, খনন করালেন আলোচিত এ দিঘীটিকে। কিন্তু বহু শ্রম ও অর্থের বিনিময়ে খননকৃত এ দিঘীতেও পানির কোন লেশ না থাকায়, রাজা প্রাণনাথ মারাত্মকভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। এমনই সময় কোন এক রাতে রাজা স্বপ্ন দেখলেন যে, তিনি যদি তার প্রাণপ্রিয় পুত্রকে এ দিঘীতে বিসর্জন দেন, তাহলেই কেবল দিঘীতে পানির দেখা মিলবে। অসহায় হয়ে পড়লেন রাজা। পুত্র রামনাথ পিতার এহেন মানসিক চাপ ও প্রজা সাধারনের পানীয় জলের কষ্ট নিবারনের জন্য নিজেই পিতার স্বপ্ন পূরণের সিদ্ধান্ত নিলেন। এক সকালে রাজা রামনাথ ঘোড়ায়/হাতিতে চড়ে দিঘীর কাছে গেলেন এবং দিঘী মধ্যবর্তী স্থানে আয়োজিত পূঁজা মঞ্চের দিকে দেবতার প্রতি অর্ঘ্য নিবেদনের জন্য উপস্থিত হলেন। এমন সময় চারিদিক হতে বানের মতো জল বের হয়ে এসে দিঘী পূর্ণ হয়ে গেল। উপস্থিত সকলে উত্তাল পানির আলোড়ন সামলে নিজেদের উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও অদৃষ্টের করূণ পরিনামের জন্য রাজা রামনাথের সলিল সমাধি হয়। পানির উপর ভেসে উঠলো শুধুই যুবরাজের সোনার মুকুট। সেই থেকে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে দিঘীর নাম ‘রামসাগর’ হয়ে প্রজা সাধারনের কাছে চির পরিচিত হয়ে খাকলো। অবাক করা বিষয় হল, দিঘীর পানির অপরিবর্তনশীলতা, না শুষ্ক মৌসুমে – না অধিক বৃষ্টিতে দিঘীর পানির হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে। অনেকের ধারনা, দিঘীর তলে বিশাল পানির আধার সংযুক্ত রয়েছে, ফলে এমনটি ঘটে থাকে।

20150905_140513

রামসাগর – পাথরঘাটায় পাথরে খোদিত কারুকাজ

20150905_140500

রামসাগর – পাথরঘাটায় পাথরে খোদিত কারুকাজ

20150905_140849

রামসাগর – পশ্চিম পাড়ের অপর ঘাট

20150905_141122

রামসাগর – দক্ষিণ পাড়ের ঘাট

দিঘী সংলগ্ন উত্তর পাড়ে বেশ কয়েকটি প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপনার নিদর্শন/অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে হাজারদুয়ারী/বারোদুয়ারী/লুকোচুরি খেলার ঘর (অনেকের মতে দেবমন্দির/দোলমন্দির) নামক একটি ভৌতকাঠামো রয়েছে। লাল ইট ও চুন সুরকীর তৈরী এ স্থাপনা আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন হবার পথে। হাজারদুয়ারীকে অনেকে বিশ্রামাগার বা রাজ-মহিষীদের অপেক্ষাগার বলে আখ্যায়িত করেছেন। অধিক সংখ্যক দরজা থাকার কারণে হাজারদুয়ারী/বারোদুয়ারী – এমন নাম হয়েছে বলেই মনে হয়। রাজ পরিবারের সদস্যরা স্নানের উদ্দেশ্যে দিঘীতে এলে ছোট ছোট বাচ্চারা বহু-কক্ষ বিশিষ্ট হাজারদুয়ারী/বারোদুয়ারীতে লুকোচুরি খেলতো বলে এর অপর নাম লুকোচুরি খেলার ঘর। সরেজমিন দেখা যায়, বর্তমানে এখানে যে ভৌত কাঠামোটি কোন রকমে টিকে আছে সেখানে সাকুল্যে ৮টি দরজা ও ৭টি কক্ষ রয়েছে। তবে অনুমান করি এ সংখ্যা আরও বেশী হবে। বর্তমানে ছাদহীন ও দরজা-জানালা বিহীন এ স্থাপনার দেওয়ালে ও দরজার খিলানসমূহ এক সময় যে চমতকার কারুকাজ ছিল তা এখনো বেশ স্পষ্ট। দরজার প্রকার ও আকারে পার্থক্য লক্ষণীয়। ছাদে ওঠার জন্য সম্ভবত সরু একটি সিঁড়িও ছিল।

20150905_134336

রামসাগর – হাজারদুয়ারী/বারোদুয়ারী/লুকোচুরি খেলার ঘর

20150905_134811

রামসাগর – হাজারদুয়ারী/বারোদুয়ারী/লুকোচুরি খেলার ঘর

20150905_135021

রামসাগর – হাজারদুয়ারী/বারোদুয়ারী/লুকোচুরি খেলার ঘর

20150905_134850

রামসাগর – হাজারদুয়ারী/বারোদুয়ারী/লুকোচুরি খেলা ঘরের সিঁড়ি ঘর

20150905_135231

রামসাগর – হাজারদুয়ারী/বারোদুয়ারী/লুকোচুরি খেলা ঘরের একটি ক্ষুদ্র কক্ষ

পর্যটকদের সুবিধার্তে আধুনিককালে এখানে সুরম্য ডাকবাংলো, চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, পর্যবেক্ষন চৌকি, কাঞ্চন ও মহুয়া নামের ২টি রেস্ট হাউজ ও আরণ্যক নামের একটি ক্যাফেটরিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পশ্চিমপাড়ে পাথরঘাটা বরাবর ১৯৪৮ খ্রীঃ প্রতিষ্ঠিত বায়তুল আকসা জামে মসজিদ রয়েছে। পূর্বপাড়ের মাঝ বরাবর সরস্বতী-মন্দির আছে যেখানে মাঘ মাসে বান্নীর মেলা বসে। অধুনা এ মন্দিরটি নবরূপে পূনঃনির্মান করা হচ্ছে। নীল স্বচ্ছ পানির এ আধারে শীত মৌসুমে এখনও ব্যাপক হারে অতিথি পাখির সমাগম হয়ে থাকে। দিঘীতে নৌকা ভ্রমণের সুযোগ আছে। ১৯৬০ খ্রীঃ থেকে দিঘীটি বন বিভাগের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে। পর্যটন সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে, ১৯৯৫-৯৬ খ্রীঃ এটিকে একটি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। তত-পরবর্তী ২০০১ খ্রীঃ ৩০ এপ্রিল থেকে রামসাগরের ২৭ হেক্টর জায়গাকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষনা করা হয়, বর্তমানে এটিই হল বাংলাদেশের ক্ষুদ্রতম জতীয় উদ্যান। উদ্যানকে কেন্দ্র করে ৭টি পিকনিক কর্ণারও প্রস্তুত করা হয়। বর্তমানে এ উদ্যানে ৪০০ প্রজাতির বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে।

20150905_135903

রামসাগর – বায়তুল আকসা জামে মসজিদ

20150905_141734

সরস্বতী-মন্দির

দেশের ঐতিহ্যবাহী এ দিঘীর রক্ষনাবেক্ষনের দিক থেকে অন্য অনেক দিঘী অপেক্ষা বেশ মানসম্মত। দিনে দিনে যে সমস্ত উটকো স্থাপনা/বসতি চারিদিকের পাড় জুড়ে জেকে বসছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে দিঘীর আদি প্রাকৃতিক রূপটি হয়তো বিসর্জনই দিতে হবে। হাজারদুয়ারী নামক স্থাপনাটি সংস্কার না করে পর্যটন আকর্ষনের যে অমূল্য সুযোগ আজ হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে, কাল হয়ত হাজার আক্ষেপ করলেও এ ক্ষতি কোনভাবেই পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না, লক্ষ-কোটি টাকার বিনিয়োগেও তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।

 

তথ্যসূত্রঃ

১. বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, পৃঃ ১৩০-১৩২/

২. বাংলায় ভ্রমণ, ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে (১৯৪০), পৃঃ ২২২/


২১ আগষ্ট ২০১৬/খোলাহাটি

৪ টি মন্তব্য : “রামসাগর – দিনাজপুর”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    ১৯৭৮-১৯৮০ সালে সৈয়দপুর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলাম। তখন বেশ কয়েকবার রামসাগরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। খুব ভালো লাগতো। মনে পড়ে এর কাছাকাছি হরিপুর নামে বোধ হয় একটা জায়গা ছিল, যেখানে বিডিআর এর একটা বিওপি ছিল।
    ভালো লেগেছে তোমার তথ্যসমৃদ্ধ এ লেখাটি।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।