দিনাজপুর – দিনাজপুর রাজবাড়ি

রাজবাড়ির বহিঃঅঙ্গন

রাজবাড়ির মূল অংশ পেরিয়ে দ্বিতীয়াংশে রাজবাড়ির চতুর্পাশে দীর্ঘ ও প্রশস্ত পরিখার মধ্যে শুকসাগর, মাতাসাগর, আনন্দসাগর, ফুলবাগ, সব্জিবাগ, রাজ কর্মচারীদের আবাসস্থল ইত্যাদি ছিল। সুদৃঢ় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্যই রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে চারিদিকে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। সে সব নিদর্শনের চিহ্ন এখনো কোথাও কোথাও দেখতে পাওয়া যায়।

পদ্ম পুকুর

রাজবাড়ির সদরমহল ও শুকসাগরের মধ্যবর্তী অংশে পদ্ম পুকুর অবস্থিত। পদ্ম পুকুরের পশ্চিম পাড়ে সদরমহল আর পূর্বপাড়ে শুকসাগর। রাজবাড়ির ভিতর থেকে পদ্ম পুকুর যাবার সরাসরি কোন পথ নেই। পুকুরের দক্ষিণপাড় ঘেঁষে একটি সরু পাকা রাস্তা একে-বেঁকে দু’দিকে চলে গেছে। পূর্ব দিকেরটি শুকসাগরের ভিতর দিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেছে আর পশ্চিমেরটি মহারাজার মোড় থেকে রাজবাড়ির ভূতনাথ মন্দিরের সামনের সংযোগ সড়কের সাথে গিয়ে মিশেছে। পদ্ম পুকুরে যেতে হলে এখন এ পথই অনুসরন করতে হবে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় পুকুরটি সদর উপজেলার ৬ নং ইউনিয়নের রাজবাড়ি গ্রামে অবস্থিত।

রাজবংশের কোন রাজা কোন সময়ে যে পদ্মপুকুর খনন করেছিলেন তা জানা যায় না। পুকুরটি উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ। এর দৈর্ঘ্য আনুমানিক ২১০ মিটার ও প্রস্থ ৭৭ মিটার। গভীরতা আনুমানিক ১ থেকে ১.৫ মিটার। চতুর্দিকের পাড় এখন ভূমি সমান্তরাল হলেও পূর্বে তা উচুঁ ছিল বলে মনে হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পুকুরে কোন ঘাট এখন নেই, তবে পূর্বে মনে হয় ছিল।

IMG_2755 IMG_2757 IMG_2760

রাজবাড়ি ও ততসংলগ্ন এলাকায় কমপক্ষে পাঁচটি মন্দির ছিল। সেখানে নিয়মিত পূঁজা-অর্চনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করা হত, আর সে কারণে প্রয়োজন পড়ত প্রচুর পরিমানের ফুল। শোনা যায়, নিত্য সে সব পূঁজার জন্য প্রচুর পরিমানে পদ্ম ফুলের চাহিদা ছিল। ফুল যোগান নিয়মিত রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবে এ পুকুরে তাই পদ্ম ফুলের চাষ করা হত। ফুলও ফুটতো অনেক। আর সে থেকে পুকুরের নামই হলে গেল পদ্ম পুকুর।

পুকুরের পানি গোসল করার উপযোগী তথাপি সচারচার কেউ আর এখানে গোসল করে না, তবে বাড়ির বউরা নিয়মিত হাঁড়ি-পাতিল মাজা-ধোয়া ও সাবান ব্যবহার করে কাপড় ধোলাই করে থাকেন। পুকুরটি এখন বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বপাড়ে জনবসতি গড়ে উঠেছে। পশ্চিমপাড়ে এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম ও স্কুল গড়ে ওঠায় সীমানা প্রাচীর দ্বারা পদ্ম পুকুরকে রাজবাড়ির মূল চত্বর থেকে এখন বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। রাস্তা রক্ষার জন্য দক্ষিণ পাড় ও পূর্বপাড়ের খানিকটা অংশ ইট-সিমেন্ট দ্বারা বাঁধানো হয়েছে।

পাড়গুলোতে গাছের আধিক্য নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের বিলুপ্ত প্রায় তমাল গাছের একটি পদ্ম পুকুর পাড়ে ছিল বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় কিন্তু সেটিও এখন আর দেখছি না।

শুকসাগর

দিনাজপুর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা শুকদেব রায় (১৬৪৪-১৬৮১ খ্রীঃ) তার শাসনামলের কোন এক সময় রাজবাড়ির সম্মুখে অর্থাত পশ্চিম দিকে একটি বিশাল দিঘী খনন করে নিজ নামে নামকরন করেন। সেই থেকে দিঘীর নাম শুকসাগর। অনেকেই অজ্ঞতাবশতঃ বলে থাকেন যে, রাজা এখানে এসে সুখ পেতেন তাই তিনি এর এমন নাম রেখেছিলেন। তারা ‘সুখ’ ‍ও ‘শুক’ এর পার্থক্য টানতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। শুকসাগরের পশ্চিমে পদ্ম পুকুর অবস্থিত।

পরিখাসমূহ বাদ দিলে রাজবাড়ির সর্ব-পশ্চিমের নিদর্শন শুকসাগর। উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ দিঘীটি রাজবাড়ির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আনুমানিক ২৬ একর ভূমির উপর বিন্যাস্ত প্রাচীন দিঘীটির পাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে এখন ৩৩ একরে পরিনত হয়েছে। দিঘীটির জলকর ও পাড়সহ যথাক্রমে দৈর্ঘ্য ৪৭৬ ও ৬৩০ মিটার ও প্রস্থ ১৯৫ ও ৩৫০ মিটার। গভীরতা তলদেশ জুড়ে সমান না হলেও সর্বোচ্চ ৪ মিটারের মত হবে। দিঘীর কোথাও আদিতে কোন ঘাট ছিল কিনা তার হদিস করতে পারলাম না। স্থানীয়রাও এ ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারলেন না। দিঘীর পাড় পাহাড় সমান উঁচু ছিল। পশ্চিম দিকে জনবসতি গড়ে উঠায় পাড় ভূমি সমান্তরাল হলেও বাকী তিন দিকের পাড় এখনো বেশ উঁচু। কোথাও কোথাও এ উচ্চতা ৩ মিটারের কাছাকাছি।

IMG_2713 IMG_2715 IMG_2730

দিঘীর পশ্চিম পাশ ব্যতীত বাকী তিন দিকে রাজবাড়ি সুরক্ষার জন্য প্রায় ৫০ মিটার পরিমান প্রশস্ত পরিখা রয়েছে। আজ আর সে সবের পুরোটা টিকে নেই তবে কোথাও কোথাও পরিখার চিহ্ন এখনো দৃশ্যমান। কথিত আছে যে, পরিখাগুলোতো সর্বদা পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এ দিঘী সংরক্ষিত জলাধার হিসাবে ব্যবহৃত হত। উত্তরমুখী পরিখা দিয়ে নৌকাযোগে রাজা পঞ্চগড় অবধি যাতায়াত করতেন এমন গল্প বয়স্করা তাদের বাবা-দাদাদের কাছে শুনেছেন। পরিখাগুলো ভরাট হয়ে বাড়ি-ঘর ও ধানক্ষেতে পরিনত হলেও হালফিল সে সবের অস্তিত্বের চিহ্ন একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। কোন কোন পরিখা নাগরিক সুবিধার্তে ব্যবহার করার লক্ষ্যে সংস্কার করাও হয়েছিল। রাজবাড়ির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে এ সব পরিখা খনন করা হয়েছিল। শুকসাগর পরিকল্পিতভাবে খনন করা হয়েছিল যাতে ভরা বর্ষা মৌসুমে আশে পাশের পানি প্লাবিত হয়ে এ দিঘীতে প্রবেশ করতে পারে। ভূমি ও খনন নকশা কৌশলগত কারণে, তিন দিক হতে পানি দিঘীতে প্রবেশ করতে পারতো আর পূর্বদিক থেকে তা আবার বের হয়ে পরিখায় চলে যেতে পারতো। এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে বলে স্থানীয়রা নিশ্চিত করলেন।

IMG_2744 IMG_2749 IMG_2750

শুকসাগর থেকে ৮৫০ মিটার দূরত্বে মাতা সাগর অবস্থিত। এ দু’সাগরকে সংযোগ করে দু’টি সমান্তরাল খাল ছিল এবং এমন গল্প চালু আছে যে, রাজা-রাণী সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে একই সময়ে নিজ নিজ নৌকাযোগে পৃথকভাবে শুকসাগর থেকে মাতাসাগর আসা-যাওয়া করতেন। স্থানীয়রা ধানক্ষেতের দিকে নির্দেশ করে সে সব নিদর্শনের প্রমান দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। আদৌ তেমনটি ছিল কিনা তা এখন আর বলার জো নেই। দিঘীর দক্ষিণ পাড়ের প্রায় কেন্দ্র বরাবর একটি সংযোগ খাল রয়েছে। মাছ চাষের সুবিধার্তে হাল আমলে সিমেন্ট ও লোহা দ্বারা এর সংযোগ মুখটি পানি প্রতিবন্ধকহীন করা হয়েছে। শুকসাগরের দক্ষিণ পাড় ঘেঁষে কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম পাড়কে ভেদ করে একটি রাস্তা পদ্মপুকুর থেকে এসে পূর্ব দিকের গ্রামের মধ্যে চলে গেছে। রাস্তাটি নাকি রাজার আমল থেকেই ছিল। বৃটিশ আমলে সংযোগ খাল ও দিঘীর মধ্যকার পানি চলাচলের জন্য উক্ত রাস্তার উপর একটি ‘কালভার্ট’ তৈরী করা হয়েছিল যা আজ আর নেই। সেখানে পরবর্তী সময়ে নতুন আরেকটি ‘কালভার্ট’ তৈরী করা হয়েছে। রাজবাড়ির বিভিন্ন মন্দিরের পূঁজার অংশ হিসাবে প্রতিমা বিসর্জন শুকসাগরেই সম্পন্ন করা হত এমন শ্রূতি লোকমুখে প্রচলিত আছে।

IMG_2718 IMG_2720 IMG_2739

শুকসাগরের পাড়ে আগে শালবন ছিল। কিন্তু এখন সে সব শালগাছ আর নেই, তবে পরিকল্পিতভাবে সেখানে বনায়ন করা হয়েছে। ইদানিং বনভোজনের জন্যে উতসাহীদের নিকট এ স্থান বেশ পরিচিতি পেয়েছে। দিঘীর দক্ষিণ ও পশ্চিম পাড় ঘেঁষে অধুনা ভ্রমণ ও দর্শনার্থীদের বসার জন্য আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দক্ষিণ পাড়ের উঁচু ভূমিতে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন রকমের বিনোদনের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে খাবার-দাবারের দোকান, বাচ্চাদের খেলাধূলার আয়োজন, গোলঘর ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছে। এমনকি স্বল্প পরিসরে নৌকা বিহারেরও ব্যবস্থা আছে। সরকারের নিকট থেকে ‘লিজ’ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষকারী ঠিকাদার দক্ষিণপাড়ে পানি ঘেঁষে নিজস্ব প্রয়োজনে একটি একতলা ‘পর্যবেক্ষন চৌকি’ স্থাপন করেছেন। পাশেই একটি টংঘর জাতীয় খাবারের দোকানে চা-কোমল পানীয়, চিপস-বিস্কুট বিক্রি হচ্ছে। এ সব আয়োজন জন-কল্যাণ, পর্যটক-বান্ধব ও পরিবেশ-সচেতন হয়ে উঠুক এ প্রত্যাশা আমাদের সকলের।

IMG_2716 IMG_2728 IMG_2731

মাতাসাগর

দিনাজপুর – ফুলবাড়ি বা্পইস ও দিনাজপুর – পার্বতীপুর সড়কের সংযোগস্থল হতে পার্বতীপুর অভিমুখে আনুমানিক ৭০০ মিটার পথ অতিক্রম করলে রাস্তার উত্তর পাশ ঘেঁষে যে বিশাল দিঘীটি চোখে পড়ে তা মাতাসাগর। মহারাজ প্রাননাথ রায় দিঘীটি খনন করে তার বিমাতা রামদেব রায় ও জয়দেব রায়ের মাতা’র উদ্দেশ্যে উতসর্গ করেন বিধায় এ দিঘীর নাম ‘মাতা সাগর’। তবে অনেকে মনে করেন দিনাজপুর রাজবংশের প্রধান পুরুষ রাজা শুকদেব প্রজা সাধারনের পানীয় জলের কষ্ট নিবারনের জন্য এ দিঘী খনন করে তার মায়ের নামে উতসর্গ করেন বলে এ দিঘীর নাম মাতাসাগর যা ঐতিহাসিকভাবে সঠিক নয়।

সদর উপজেলার সদর ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের সীমানায় দিঘীটি অবস্থিত। এর উত্তরে আদর্শপাড়া, দক্ষিণে পানুয়াপাড়া, পূর্বে রাজারামপুর ও পশ্চিমে মহারাজার মোড়। ঠিক কবে দিঘীটি রাজা প্রাণনাথ খনন করেছিলেন তা সঠিকভাবে আজ বলার জো নেই। তবে যহেতেু রাজা প্রাণনাথের রাজত্ব্যকাল ১৬৮৭ খ্রীঃ থেকে ১৭১৮ খ্রীঃ পর্যন্ত, সুতরাং এর মধ্যে কোন এক সময় হয়ত এটি খনন করা হয়ে থাকবে। খননকালে কোন ঘাট ছিল কিনা তা কোন সূত্র থেকে উদ্ধার করতে পারলাম না এবং এখনো সেখানে কোন ঘাট নেই।

IMG_2332 IMG_2355 IMG_2379

দিঘীর পাড়গুলো খনন উত্তর পাহাড় সমান উঁচু ছিল, তার প্রমান এখনো পাড়ের কোন কোন অংশে দেখতে পাওয়া যায়। পশ্চিম ও উত্তর পাড়ের মাটি কোথাও কোথাও কেটে ভূমি সমান করে ফেলা হয়েছে, আর দক্ষিণ পাড়তো ভূমি সমান্তরাল করে গড়ে উঠেছে ‘লাইভ স্টক এন্ড পোলট্রি ফার্ম’ নামের একটি মুরগীর খামার। উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ দিঘীর মোট ভূমির পরিমান এখন প্রায় ১০০ একর। পাড়সহ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে আনুমানিক ৬৩০ মিটার ও ৩০০ মিটার এবং শুধু জলকরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে আনুমানিক ৫১০ মিটার ও ১৬৪ মিটার। খননকালে গভীরতা যা ছিল আজ আর তা নেই, কিন্তু এখনো যা আছে তা প্রায় এক মানুষ সমান হবে বলে জানালেন স্থানীয়রা। দক্ষিণ অংশ অপেক্ষা উত্তরের অংশ তুলনামূলকভাবে বেশী গভীর।

IMG_2331IMG_2336IMG_2356

মাতাসাগরের উত্তরে আনুমানিক ১ কিলোমিটার দূরে রাজবাড়ি আর ৮৫০ মিটার দূরে শুকসাগর অবস্থিত। রাজবাড়ির চতুর্দিকের খালের মত পরিখাগুলো যা রামদাঁড়া নামে অধিক পরিচিত তার পূর্বাংশ শুকসাগর ও মাতাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। যদিও এ অংশটির অস্তিত্ব এখন আর বোঝার কোন উপায় নেই। তবে মাতাসাগর থেকে আনন্দসাগর পর্যন্ত যে অংশটি মাতাসাগরের দক্ষিণ-পূর্বাংশ থেকে বের হয়েছে তার অস্তিত্ব এখনো বিরাজমান। পার্বতীপুর সড়কটি বেরসিকের মত মাতাসাগর আর রামদাঁড়াকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে দিনাজপুরের সাথে গিয়ে মিশেছে। শুনেছি রামদাঁড়া দিয়ে রাজা-রাণী রাজবাড়ি থেকে বের হয়ে বৈকালিক ভ্রমণে বের হতেন।

IMG_2363IMG_2374

দিঘীকে ঘিরে তেমন কোন অলিক গল্প-কাহিনী চালু নেই। তবে জনশ্রূতি থেকে জানা যায় যে, দিঘীতে গোসল করতে গিয়ে অনেকে জ্বীন-পরীদের খপ্পরে পড়ে অকালে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। কিছুদিন আগে একসাথে তিন জন গোসল করতে নেমেছিলেন কিন্তু দু’জন ঐ কারণে মারা গেছেনে, জানালেন একজন স্থানীয়। দিঘীর উত্তর দিকে জ্বীন-পরীদের আছর অনেক বেশী, তাই ঐ দিকটায় ভয়ও বেশী। যদিও উত্তর-পশ্চিমপাড়ে এক দল উচ্ছল তরুণকে দাপাদাপি-লাফালাফি করে গোসল করতে দেখে বেশ পুলকিত হলাম।

IMG_2361

দিঘীর আশে-পাশে এককালে জঙ্গল ছিল। পাড়ে প্রাচীন কোন গাছের অস্তিত্ব লক্ষ্য করলাম না। তবে পূর্বপাড়ে সারিবদ্ধভাবে একাশিয়া ও দক্ষিণপাড়ে একটি লিচু বাগান করা হয়েছে। বর্তমানে এখানে মাছ চাষ করা হচ্ছে। গ্রামের বা স্থানীয় কেউ তেমন করে এখানে গোসল করতে আসে না। তবে এর পানি এখনো গোসলের উপযোগী।

মাতাসাগর দেখতে অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকেরা এখানে আসেন। অনায়াসে প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন এ দিঘীকে আকর্ষনীয় এক পর্যটন স্থানে পরিনত করা সম্ভব।

আনন্দসাগর

দিনাজপুর – ফুলবাড়ি মহাসড়কের ফুলবাড়ি বাস স্টান্ড থেকে ২ কি.মি. এর সামান্য বেশী দূরত্বে এবং রাজবাড়ি থেকে সরাসরি ৪ কি.মি. দূরে সদর উপজেলার শশরা ইউনিয়নের নেমতারা গ্রামে আনন্দ সাগর অবস্থিত। মহারাজ বৈদ্যনাথ রায় তার কীর্তিমান পির্তৃপুরুষদের মত একটি বড় দিঘী খনন করার উদ্যোগ নিলে সে সময় রাজ্যে দূর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ায় প্রথম দফায় খনন কাজে বিফল হন। উপযুক্ত সময়ে তিনি পুনরায় দিঘী খনন করান এবং তার স্ত্রী রাণী স্বরসতী বা আনন্দময়ীকে তা উতসর্গ করেন। আনন্দময়ীর নামে উতসর্গকৃত দিঘীর নাম তাই ‘আনন্দসাগর’। যদিও স্থানীয়রা মনে করেন রাজারা রাজবাড়ি থেকে এখানে এসে আনন্দ করতেন তাই দিঘীর নাম আনন্দসাগর যা নিছক তাদের কল্পনাপ্রসূত।

দিঘীটি উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ। পাড়সহ দৈর্ঘ্য প্রায় ৩২০ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় ২১০ মিটার। জলকরের আয়তন আনুমানিক ২৫৫X১১০ বর্গ মিটার। দিঘীর গভীরতা পূর্বে অনেক বেশী ছিল বলেই অনুমিত হয় এবং এখন তা সাকুল্যে ২ থেকে ২.৫ মিটার হবে। দিঘীতে খনন উত্তর কোন ঘাট ছিল কিনা তা আজ বোঝার উপায় নেই। স্থানীয়রা জানালেন কোন ঘাট ছিল না বলেই তারা জেনে এসেছেন। কিন্তু দিঘীর উত্তরে ১৫০ মিটার দূরে রাজার আমলে প্রতিষ্ঠিত গোষ্টধাম শিব মন্দির থাকায় দিঘীতে ঘাট থাকার সম্ভাবনাকে জোরালো করে তুলছে।

IMG_3095 IMG_3099IMG_3475

এরূপ দিঘীসমূহের প্রচলিত প্রথানুযায়ী দিঘীর পাড়গুলো বেশ উঁচু হয়ে থাকে। এটিও তার ব্যতীক্রম ছিল না। কিন্তু কালের প্রবাহে জন-জীবনের অমোঘ প্রয়োজনে সে সব আজ ভূমি সমান্তরাল। এসব পাড়ের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশে মাত্রাতিরিক্ত ঘনবসতি লক্ষ্যনীয়। আর পূর্বপাড় এখন ধানক্ষেত। উল্লেখ্য যে, পাড়সমূহ এখনো বেশ প্রশস্ত। উত্তর ও পূর্বপাড়ের উপর দিয়ে নাগরিক প্রয়োজনে অপ্রশস্ত মাটির পথ তৈরী হয়েছে। আর নির্মম হলেও সত্য যে, অবিবেচকের মত দিনাজপুর – ফুলবাড়ি মহা সড়কটি নিশ্চিতভাবেই এ দিঘীর দক্ষিণ – পশ্চিম পাড়ের কোণার উপর দিয়ে নির্মিত।

উত্তর পাড়ের দু’পাশের প্রান্তসীমা থেকে উত্তরমূখী দু’টি খাল প্রবাহিত হয়ে মাতাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। এ খালদ্বয় রামদাঁড়া নামে অধিক পরিচিত। প্রবাদ আছে যে, এ রামদাঁড়ার একটি দিয়ে রাজা ও অন্যটি দিয়ে রাণী রাজবাড়ি থেকে সরাসরি আনন্দ করার জন্য আনন্দ সাগরে আসতেন। সরেজমিন দেখা গেল, রামাদাঁড়াদ্বয় এখন আনন্দ সাগর থেকে বিচ্ছিন্ন। মাটি ফেলে ঘর-বাড়ি তৈরী করে বসবাস উপযোগী করা হয়েছে, তথাপি রামাদাঁড়ার চিহ্ন এখনো বেশ বোঝা যায়। গোষ্টধাম শিব মন্দিরের উত্তর ভূ-ভাগ থেকে উত্তরে প্রবাহিত রামদাঁড়ার অংশটির অস্তিত্ব প্রায় ২ কি.মি. পর্যন্ত স্পষ্টভাবে দৃষ্ট হয়। এ অংশটি মাতাসাগরের সাথে সংযুক্ত ছিল, কিন্তু দিনাজপুর – পার্বতীপুর সড়কটি নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠ দেখিয়ে মাতাসাগর ও রামদাঁড়াদ্বয়কে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করেছে। বর্তমানে দীর্ঘ রামদাঁড়ার জলকরে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা হচ্ছে।

IMG_3103 IMG_3169 IMG_3171

আনন্দসাগরের হালফিল চিত্র হৃদয় বিদারক। সাধারনতঃ প্রাচীন ও বিখ্যাত জলাশয়গুলো কোন না কোন ভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারি বা বেসরকারি যে কোন ব্যবস্থাপনাতেই এক ধরনের সংরক্ষণের চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু আনন্দসাগর এ তালিকা থেকে মনে হয় ছিটকে পড়েছে। সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষন বিহীন অবস্থায় থাকতে থাকতে আজ এর বেহাল অবস্থা। আশু উন্নতিরও সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

গোষ্টধাম শিব মন্দির

আনন্দসাগরের উত্তর প্রান্ত থেকে আনুমানিক ২৫০X২০০ ব.মিটার আয়তনের একটি দ্বীপ সদৃশ ভূমি আছে। এ ভূভাগের দক্ষিণ দিক বাদে বাকী তিন দিক রামদাঁড়া দ্বারা বেষ্টিত। আর দক্ষিণ দিকে রয়েছে আনন্দসাগর। এখানে একটি প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে যা গোষ্টধাম শিব মন্দির নামে পরিচিত।

মন্দিরটি কে প্রতিষ্ঠা করেছিল তা জানি না, তবে রাজবংশের বংশ লতিকা ও রাজাদের কীর্তি পর্যালোচনা করে অনুমান করি এটি মহারাজ বৈদ্যনাথের আমলে নির্মিত। ছাদহীন ভগ্ন স্থাপনাটি সম্ভবত একতলা বিশিষ্ট এবং আয়তকার। মূল মন্দিরটি কমপক্ষে দু’টি অংশে বিভক্ত ছিল – মূল মন্দির ও ভোগ ঘর। মূল মন্দিরটি আনুমানিক এক মিটার উচ্চতার একটি ইটের তৈরী বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। তিন কক্ষবিশিষ্ট মন্দিরটির দক্ষিণে টানা বারান্দা আছে। বারান্দার পূর্ব ও পশ্চিম দিক উম্মুক্ত, সেখান দিয়েও মন্দিরের সব কক্ষে প্রবেশ করা যায়।

বারান্দার দু’টি খিলানের মধ্যবর্তী অংশটি মন্দিরের প্রধান প্রবেশ পথ হিসাবে ব্যবহৃত হত। প্রবেশ পথের সামনেই মন্দিরের মাঝের কক্ষ যা মূলতঃ এ মন্দিরের গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহের দু’পাশে দু’টি সম আকৃতির কক্ষ আছে যা গর্ভগৃহ থেকে আকারে ছোট। গর্ভগৃহের পূর্ব ও পশ্চিম দেওয়ালে দু’টি জানালা আছে। পাশ্ববর্তী কক্ষদ্বয়েও অনুরূপ জানালা ও দরজা আছে। প্রতিটি কক্ষের দেওয়ালে কুলঙ্গি আছে। দেওয়ালে যে পলেস্তারা ছিল তা বেশ বোঝা যায়, যদিও এর টিকে থাকা অস্তিত্ব এখন নগন্য। প্রতিটি দেওয়াল প্রায় এক মিটারের মত পুরু। ইটের মাপ ৮X৮ ইঞ্চি।

গর্ভগৃহের উত্তর দেওয়াল সংলগ্ন মাটির মঞ্চের উপর কৃষ্ণকে বসিয়ে পূঁজা নিবেদন করা হয়। অপর কক্ষদ্বয় কি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত তা জানা যায়নি। এ সময় মন্দিরের অনতি দূরে (আনুমানিক ৫০ মিটার) উত্তর-পশ্চিম কোণার গাছের ছায়ায় মাটির বেদীর উপর রাধাকে স্থাপন করা হয়। কৃষ্ণ এখানে লবন খাওয়ানো হয়। এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। কান্তজীর মন্দিরের রাধা-কৃষ্ণ বিগ্রটি রাজবাড়ি ছেড়ে ফিরতি পথে পুনরায় যখন নিজ অবস্থানে ফেরত নেওয়া হয় ঠিক সেদিন সকালে তারা এখানে আসে ও বিকালে পূঁজার অনুষ্ঠানাদি সমাপনান্তে বিদায় নেয়। কান্তজীর মন্দিরে ফিরে গেলে সে রাতে সেখানে রাসমেলা উতযাপিত হয়।

IMG_3106 IMG_3116IMG_3126

এ স্থাপনার পূর্বপাশে আরেকটি ছোট ভগ্ন স্থাপনা দৃষ্ট হয় যা মন্দিরের ভোগঘর হিসাবে পরিচিত। এটিও সম্ভবত একতলা বিশিষ্ট ছিল এবং এর স্থাপত্য গঠন মূল মন্দিরের ন্যায়। ইটের তৈরী, পলেস্তরা দ্বারা আবৃত ও দেওয়ালে কুলঙ্গি দেখতে পাওয়া যায়। স্থাপনাটি এতটাই ভাঙ্গা যে খনন ব্যতীত বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা সম্ভব নয়।

IMG_3141 IMG_3143 IMG_3146

ভগ্ন মন্দিরের ঠিক উত্তরে ১৫ মিটার দূরে আরেকটি অষ্টকোনাকার এক গম্বুজ বিশিষ্ট একতলা শিব মন্দির রয়েছে। ‘শ্রী শ্রী গোষ্ট ধাম শিব মন্দীর’ নামে এটি পরিচিত। এক কক্ষ বিশিষ্ট মন্দিরের গর্ভগৃহে শিব লিঙ্গ উপবিষ্ট আছে। আনুমানিক এক মিটার উচ্চতার একটি বেদীর উপর মন্দিরটি স্থাপিত। বেদী অতিক্রম করার জন্য সিড়ি রয়েছে। মন্দিরের পূর্ব ও দক্ষিণে প্রবেশ পথ রয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম দেওয়ালে দু’টি জানালা রয়েছে। সম্প্রতি মন্দিরের বেদীমূল থেকে ছাদ পর্যন্ত সংস্কার করে এমনভাবে টাইলস বসানো হয়েছে যার ফলে এর আদি রূপ বিসর্জিত হয়েছে। তবে ছাদের অংশটি এখনো অবিকৃত আছে। স্থানীয়রা জানালেন অচিরেই এটি ভেঙ্গে সংস্কার করা হবে। যুক্তি হিসাবে তারা জানালেন, বয়স হবার কারণে মন্দিরটি ঝুঁকিপূর্ন ও অব্যবহার্য্য হয়ে পড়ছিল বিধায় সংস্কার কাজ করতে হয়েছে।

IMG_3151 IMG_3154 IMG_3158

স্থানীয়রা আরো জানালেন যে, এ মন্দিরটি দিনাজপুরের ‘আইকন’ হিসাবে পরিচিত। দিনাজপুরকে উপস্থাপন করার জন্য যে সব মাধ্যম ব্যবহার করা হয় যেমন দূরদর্শন যন্ত্র, সেখানেও এ মন্দিরটিকে কান্তজীর মন্দিরের পাশাপাশি দেখানো হয়ে থাকে। এ মন্দিরের প্রতি বাহুতে দু’টি করে খিলান রয়েছে এবং খিলান শীর্ষে ছোট আকারের অষ্টকোনাকার গম্বুজ বসানো আছে। এ সব গম্বুজের চূঁড়ায় লৌহদন্ডের সাথে ধর্মীয় চিহ্নযুক্ত ত্রিকোন আকৃতির কাপড়ের নিশানা রয়েছে। কেন্দ্রীয় গম্বুজ চূঁড়া কলস ফিনায়েল দ্বারা অলংকৃত এবং সেখানেও নিশানা যুক্ত আছে। নিশ্চিতভাবেই স্থাপনাটি মুঘল স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য ধারন করে আছে। স্থানীয়রা জানালেন, মন্দির গাত্রে টেরাকোটার ফলক ছিল যা মুঘল আমলের মন্দির বৈশিষ্ট্যের ধারক।

এখানে সনাতনি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বছরে দু’বার মেলা উতযাপন করে থাকে। বৈশাখ ও অগ্রাহায়ণে বসে এ মেলা। মেলার নাম গৌষ্ঠ মেলা। এলাকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তারাসহ স্থানীয়রা এ মেলা উপভোগ করে, যদিও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সকলেই তাদের নিজস্ব ধর্ম এখনো পালন করে থাকে। রাজার আমলে এখানে অনেক আম গাছ ছিল। প্রাচীন সে সব গাছের কিছু নমুনা এখনো সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্ন-স্থাপনাগুলোর ভূমি বিন্যাস জ্যামিতিক নকশা দ্বারা এমনভাবে অলংকৃত যে, পাখির চোখে দেখতে তা বেশ মনোরম।

প্রতিরক্ষা

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজবাড়ির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ সুদৃঢ় ছিল। দু’স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম স্তরে রাজবাড়ির অট্টালিকাসমূহের জন্য সু-উচ্চ পাঁচিল ও দ্বিতীয় স্তরে পরিখাসহ মাটির বাঁধ দ্বারা চারিদিক বেষ্টিত ছিল। পরিখাগুলো ‘রামদাঁড়া’ নামে অধিক পরিচিত যা মূলতঃ শুকসাগর-মাতাসাগর-আনন্দসাগর দ্বারা সংযুক্ত ছিল। রাজা বৈদ্যনাথের রাজত্বকালে তার শ্যালক-কাম-ম্যানেজার জানকী রাম মাতাসাগর-আনন্দসাগরের মধ্যবর্তী রামদাঁড়ার খনন কাজ সম্পাদন করেন। তাহলে কি রামদাঁড়া নামকরণ জানকী রামের নাম থেকেই সৃজিত? মাতাসাগর ও আনন্দসাগরের মধ্যবর্তী রামদাঁড়াটির চিহ্ন এখনো বিরাজমান। তবে তারও পূর্বে মহারাজ রামনাথ দূর্ভেদ্য প্রাচীর ও পরিখা দ্বারা রাজবাড়িকে সুরক্ষিত করেন। মহারাজ রামনাথ রায় দেওয়ান মুর্শিদকুলী খাঁকে যথাযথ কর ও প্রচুর উপঢৌকন উপহার দিলে সৌজন্যবশে দেওয়ানও মহারাজকে বেশ কয়েকটি কামান ও অস্ত্র-শস্ত্র উপহার দেন। এর মধ্যে দু’টি কামান মূল দেউড়ীতে ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু আজ সেগুলো যে কোথায়? কে জানে!

শিকার

রাজারা নিশ্চয় শিকার ভালবাসতেন। রাজকীয় শিকারের আয়োজনও করা হতো। সূত্রের অভাবে এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা সম্ভব না হলেও জানা যায়, দিনাজপুর শহরের পশ্চিমে প্রায় ৭ ব.কি.মি. আয়তনের একটি সংরক্ষিত শালবন ছিল যেখানে রাজারা শিকারে যেতেন। রাজবাড়ির বহিস্থঃ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাইরে ছিল এ বন।

শেষ কথা

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন সুবা বাংলার দেওয়ানী লাভ করে তখনও দিনাজপুর রাজ পরিবারের কাছে ১২১ টি পরগণার ২,১১৯ ব.মা. আয়তনের বিশাল এলাকা জমিদারির আয়ত্তাধীন ছিল। আর তা পরিচালিত হত এ রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে। ১৮৯৭ খ্রীঃ অর্থাত রাজা গিরিজানাথের আমলে সমগ্র বাংলায় যে মারাত্মক ভূমিকম্প হয় তাতে রাজবাড়িরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে সে সময় রাজবাড়ির আধুনিকায়নও করা হয়েছিল। প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পে রাজবাড়ির যা না ক্ষতি করেছিল ১৯৭১ খ্রীঃ মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী তার থেকে অধিক ক্ষতিসাধন করেছে, আর বাকীটা হয়েছে আমাদের হাত ধরে।

প্রাচীন ও বিশালায়তনের দিনাজপুর রাজবাড়ির গৌরব, কৌলিন্য আর বৈশিষ্ট্য যতটা না এর নান্দনিকতায় তা থেকে অধিক এর মৌলিক প্রাচীনত্ব। ১৯৪৭ খ্রীঃ দেশভাগের পর পরই এ রাজবংশের চির যবনিকাপাত ঘটে। ১৯৫১ খ্রীঃ জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পূর্বে আক্ষরিক অর্থে রাজবংশের উচ্ছেদ সম্পন্ন হয়। মহারাজা জগদীশনাথই কার্যতঃ এ রাজবংশের প্রজ্বল্লিত মশালটি শেষতক বহন করে চলেন এবং এক কাপড়ে রাজবাড়ি ত্যাগ করে বাস্তুহারা ও নিরুদ্দেশ হন।

——————————————— সমাপ্ত

০২ জুলাই ২০১৬/খোলাহাটি

http://দিনাজপুর – দিনাজপুর রাজবাড়ি

 

তথ্যসূত্রঃ

১. দিনাজপুরের লোকসংস্কৃতি, এ.বি.এম. আব্দুস সাত্তার, পৃঃ ১০৯-১১০/

২. আলোকচিত্রে ইতিহাস, পৃঃ ৩১/

৩. দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র-৫, মেহরাব আলী, পৃঃ ২৩/২৪/২৫/২৮/৪৭/৬০-৭৩/১৪৭/

৪. দিনাজপুরের ইতিহাস, ড. মুহম্মদ মনিরুজ্জামান, পৃঃ ১৬-১৯/৫২/১৪২/১৪৪-১৪৫/১৬৯/২৩৭/২৫৬/২৬৪-২৬৫/২৬৭-২৬৮/২৭০- ২৭৩/২৭৭/২৮০/২৮৩/২৯৭/২৯৯/৩০১/

৫. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লিয়াকত হোসেন খোকন, পৃঃ ৪১৮/

৬. বাংলায় ভ্রমণ, ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে (১৯৪০), পৃঃ ২২১/

৭. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ২২২-২২৬/

৮. কান্তজীর মন্দির, মেহরাব আলী, পৃঃ ১৯/২৫/

৯. বাঙ্গালার ইতিহাস, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃঃ ১৫৩-১৫৪/

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।