ঠাকুরবাড়ি
আয়না ও রাণী মহলের পশ্চিমে মহলদ্বয় সংলগ্ন রাজবাড়ির ঠাকুরবাড়ি অবস্থিত। ঠাকুরবাড়িতে মোট তিনটি মন্দির। উত্তরে কৃষ্ণ মন্দির (কালিয়াকান্ত মন্দির নামে অধিক পরিচিত) ও দক্ষিণে দূর্গা মন্দির। দূর্গা মন্দিরের প্রধান ফটক সংলগ্ন পূর্বপাশে সন্ন্যাসী মন্দির অবস্থিত, যা মূলতঃ কাশী ঠাকুরের (মতান্তরে শ্রীমন্তের) সমাধি মন্দির। সুউচ্চ পাঁচিল দ্বারা পরিবেষ্টিত মন্দিরগুলোতে প্রবেশের জন্য সিংহ দেউড়ী ব্যবহার করতে হয়।
কালিয়াকান্তের মন্দির
কালিয়াকান্তের মন্দিরটি ১৭৬৩ খ্রীঃ বাংলার সনাতনি চৌচালা নকশায় হিন্দু ও মুঘল স্থাপত্যরীতিতে ছোট আকারে মহারাজ বৈদ্যনাথ কর্তৃক নির্মাণ করা হয়। ১৮৯৭ খ্রীঃ ভূমিকম্পে এ মন্দিরটিরও যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল। ভূমিকম্প উত্তর মহারাজা গিরিজানাথ ১৯০০ খ্রীঃ দিকে প্রায় সকল রাজ স্থাপনার সংস্কার কাজে হাত দেন এবং সে সুবাদে এ মন্দিরটিও সংস্কার করা হয়। সংস্কারের বিষয়টি তিনি একটি শিলালিপিতে স্মরনীয় করে রাখেন যা এখন এ মন্দিরের দক্ষিণ বেদীর কেন্দ্রে দেখা যায়। এ ছাড়াও পূর্ব বেদীতে আরো একটা শিলালিপি আছে।
মন্দিরটি বর্গাকার এবং এর প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ১২.২৪ মিটার। খাঁজ কাটা এক গম্বুজ বিশিষ্ট মন্দিরের প্রতি বাহুতে চারটি করে মিনার রয়েছে যার উপর চারচালা নকশা ও কলশ ফিনায়েল দৃষ্ট হয়। ছাদের চারিদিকে সর্প আকৃতির নকশা দ্বারা সুসজ্জিত। মন্দিরের মিনারসহ বহিঃদেওয়াল পুরোটা বিভিন্ন ফুলেল নকশা দ্বারা আবৃত। বেদীমূল নকশাকৃত এবং মন্দিরের ভিতরের ধুলো-বালি/পানি বহিঃ নিষ্কাশনের জন্য সম্মুখ দিক ব্যাতীত বাকী দিকগুলোতে নির্গমন নলকার ব্যবস্থা রয়েছে। এ সব নলকা লোহার তৈরী এবং মুখে বাঘের মূর্তি দ্বারা অলংকৃত।
প্রতি বছর ভাদ্র মাসে জম্মাষ্ঠমীর আগের দিন জল পথে কান্ত-বিগ্রহকে বাংলার বিখ্যাত কান্তজীর মন্দির থেকে এ মন্দিরে আনা হয়। এখানে তারা পরবর্তী তিন মাস অবস্থান করে এবং রাসলীলার আগে পুনরায় ওখানে প্রত্যাবর্তন করে। গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্য দক্ষিণ দিকে সম আকৃতির তিনটি দরজা রয়েছে এবং দরজাসমূহের উভয় পাশে একটি করে জানালা রয়েছে। দরজার সম্মুখে আয়তকার দোচালা বারান্দা রয়েছে। বর্গাকার গর্ভগৃহকে কেন্দ্র করে চার পাশে ৮টি কক্ষ আছে। অত্যন্ত কারুকার্যময় মন্দিরটি বেশ দর্শনীয়। অধুনা (২০১৫ খ্রীঃ) মন্দিরের আদিরূপ সংরক্ষণ করে বর্ণিল রংয়ে সাজানো হয়েছে। মন্দিরের দক্ষিণে চারচালার একটি ছাউনি রয়েছে যা সম্ভবত পূঁজারীদের বিশ্রামের জন্য ব্যবহৃত হয়। এর ঠিক দক্ষিণে এবং মন্দিরের প্রবেশ পথের পূর্বপাশে কারুকাজ করা একটি বেলে পাথরের স্তম্ভ রয়েছে যা বর্তমানে চতুর্কোনাকার অনুচ্চ একটি বেদীতে স্থাপিত। মন্দিরের পূর্বপাশে সারিবদ্ধ কক্ষ রয়েছে যা সম্ভবত পূঁজারীদের বিশ্রামের জন্য ব্যবহৃত হয়। মন্দিরের উত্তরে এ মন্দিরের ভোগ ঘর।
কালিয়াকান্তের মন্দির প্রাঙ্গনে প্রবেশের প্রধান ফটকটি আকর্ষনীয়। অনুপম স্থাপত্য নকশায় তৈরী ফটকটি মূলতঃ এক তলা বিশিষ্ট। প্রবেশ পথের দু’ধারে জানালাসহ ছোট কক্ষ আছে। প্রবেশ পথে কালো পাথরের ব্যবহার যে কারো নজর কাড়বে। পাথর খোদাই করে জ্যামিতিক ও ফুলেল কারুকাজ করা আছে দেখতে তা অসম্ভব সুন্দর। বর্তমানে পাথরগুলোতে কালো রং মাখানো হয়েছে যাতে দূর্বৃত্তরা তা যেন চুরি করে না নিতে পারে। যদিও কৃষ্ণ বিগ্রহটি প্রতি বছর তিন মাস এখানে অবস্থান করে আর বাকী নয় মাস থাকে কান্তজীর মন্দিরে, তথাপি মন্দিরে নিয়মিত পূঁজা হয়। বর্তমান কাল অবধি, এটি রাজবাড়ি প্রাঙ্গনের একমাত্র নিদর্শন যা নিয়ত ব্যবহার উপযোগী অবস্থায় টিকে আছে।
দূর্গামন্দির
কালিয়াকান্তের মন্দিরের দক্ষিণে কিংবা সিংহ দেউড়ী দিয়ে প্রবেশ করে হাতের ডানে দূর্গামন্দির অবস্থিত। দূর্গামন্দিরের প্রধান ফটক কালিয়াকান্তের মন্দিরের ন্যায় অতটা জমকালো নয়। এখানেও ফুলেল নকশা ও বেলে পাথরের ব্যবহার দেখা যায়। প্রধান ফটকের প্রবেশ পথ অতিক্রম করে সামনে এগোলে খোলা চত্বর, যাকে কেন্দ্র করে দূর্গামন্দির গঠিত। খোলা চত্বরের পূর্বপাশে এক তলা বিশিষ্ট মূল মন্দিরটি অবস্থিত। চারটি আধা-করেন্থিয়ান স্তম্ভ ও এর মাঝে অর্ধ চন্দ্রাকার তিনটি খিলান পথ প্রথমেই দর্শনার্থীর দৃষ্টি কেড়ে নেবে। মন্দিরের উপরের অংশের দু’ধারে সিমেন্টের তৈরী উদগত দু’টি মূর্তি আছে। একই মূর্তি দু’পাশে রয়েছে। প্রচলিত প্রবাদ থেকে জানা যায়, মূর্তিটি প্রধান রাজমিস্ত্রির যিনি কিনা এ মন্দির তৈরী করেছিলেন। মন্দিরের কাজ শেষ হবার পর তিনি রাজার কাছে আরজ করেন মন্দিরগাত্রে তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য, রাজা সে আর্জি পূরন করেন।
খিলান পথের বিপরীতে গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্যও অনুরূপ তিনটি পথ রয়েছে। মধ্যবর্তী অংশটি বারান্দা। গর্ভগৃহটির দু’পাশে দু’তলা বিশিষ্ট কক্ষ রয়েছে। দক্ষিণের দ্বিতল কক্ষে রাজা আর উত্তরেরটিতে রাণী বসে পূঁজা দেখতেন কিংবা পূঁজায় অংশ গ্রহণ করতেন। এ অংশের উভয় পাশের প্রথম তলায় পূঁজার সামগ্রী রাখা হত। এখানে নিয়মিত পূঁজা উতযাপন করা হয়ে থাকে। রাজাদের আমলে বাংলার সার্বজনীন দূর্গা উতসবের দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো রাজবাড়ি প্রাঙ্গনের শুকসাগরে।
মন্দিরের তিন দিকে এক তলা বিশিষ্ট সারিবদ্ধ ঘর রয়েছে যা সম্ভবত পূঁজারীদের বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করা হত। এ সব কক্ষের বেদীতে ফুল-পাতা-শেকলের নকশা কাটা। বেদীর প্রতি বাহুর কেন্দ্রে একটি করে সিঁড়ি রয়েছে। একটি খাঁজ কাটা বেলে পাথর খন্ড পশ্চিম পাশে এখনো বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মাটিতে পতিত অবস্থায় দেখা যায়। মন্দিরটি সময়ান্তর সংস্কার করা হয়ে থাকে।
এ মন্দিরের চারিদিকে সৈনিক ব্যারাক ছিল বলে অনেকে মন্দির সংলগ্ন ঘরগুলো দেখিয়ে থাকেন। দক্ষিণ দিকের বহিঃদেওয়ালে গোলা ছোড়ার/কামান দাগার মত ফোকর/ব্যবস্থা রয়েছে যেমন থাকে দূর্গ বা কেল্লায়। মন্দিরের দক্ষিণে চাপাতলী পুকুর, পূর্বে আয়ন্ মহল, পশ্চিমে প্রধান ফটক ও উত্তরে কালিয়াকান্তের মন্দির অবস্থিত।
সন্ন্যাসী মন্দির
দূর্গামন্দিরের ফটকের পশ্চিমে সন্ন্যাসী মন্দির অবস্থিত। এটি মূলতঃ একটি সমাধিসৌধ। অনেকেই মন্দিরটিকে দিনওয়াজ দরবেশ/সন্ন্যাসীর সমাধি/মন্দির বলে আখ্যায়িত করেছেন। সমাধিসৌধটি খুবই অনাকার্ষনীয় এবং সাধারন মানের। প্রথম দর্শনে সমাধিসৌধ/মন্দির বলে ঠাওর করাই দুস্কর। এখনো ভক্তরা দুধ, দই, কলা ও কাপড় দ্বারা ভক্তি সহকারে এখানে পূঁজা নিবেদন করে থাকে। একটি কাঁঠাল গাছের পাদপীঠে প্রাচীন কিছু ইটের স্তুপের উপর অনাদরে পূঁজার উপকরন পিলসুজ, ফুল ইত্যাদি পড়ে থাকতে দেখে মন্দিরের বিষয়টি মনে জেগে উঠবে – ‘ওহ! এই তো সন্ন্যাসী মন্দির’ বলে নিজেই আবিষ্কার করবেন মন্দিরটি। আমি প্রায় পাশ কাটিয়ে চলেই গেছিলাম, পাছে আমার সাথী আমার দৃষ্টি আকর্ষন না করলে হয়ত সেখানে আবার যেতে হতো।
ঠাকুরাড়িতে যে সব পাথর ব্যবহৃত হয়েছে তা বানগড় থেকে সংগৃহীত। এ সব পাথর খোদাই করা এবং তা দরজা ও সে সবের চৌকাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বানগড় থেকে আনীত পাথরসমূহের মধ্যে ‘নাগ দরজা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাথরটি অতীব কারুকার্য্যমন্ডিত। পাথরটি এমনভাবে খোদাই করা যা দেখলে মনে হবে দু’টি নাগ পরস্পর বেষ্টন করে উপরে উঠে গেছে। আমি নিজ চোখে তা দেখি নাই, কিন্তু ব্যাপারটি কল্পনা করে শিহরিত হই। রাজবাড়ির ঠাকুরবাড়ির মন্দিরগুলো কেবল রাজ পরিবারের সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। আপামর জনগনের এখানে কোন প্রবেশাধিকার ছিল না।
—————————————– চলবে
১৩ জুন ২০১৬/খোরাহাটি
দিনাজপুর – দিনাজপুর রাজবাড়ি