ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের বাড়িতে ২

ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের বাড়িতে ১

হেনরী ওয়ালেস ভিসিটর’স সেন্টারের লবি যেখান থেকে আমাদের গাইডেড ট্যূরের সূচনা সেখানে মেঝের মোজাইকে আঁকা Pictorial Map এ পুরো স্প্রিংউড এস্টেটটিকে এক পলকে দেখা যায়। এস্টেটের পশ্চিম সীমানা ঘেঁষে অবিরাম বয়ে চলেছে হাডসন নদী। তবে শীতকালে প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই বরফ জমে থির হয়ে থাকে। হাডসনস্নাত এই এবং তদ্‌সংলগ্ন এলাকাটি হাডসন ভ্যালী নামেই সমধিক পরিচিত। পূর্বমুখী মিউসিয়াম,লাইব্রেরী আর বাড়ির অবস্হান পশ্চিম তীরের বেশ কাছাকাছিতে। গাইডের কাছে জানা গেল ফ্রাঙ্কলিনের বাবা জেমস রুজভেল্ট এই সুবিশাল এস্টেটটি কিনেছিলেন মূলত আস্তাবল আর ঘোড়দৌড়ের মাঠ হিসেবে ব্যবহারের অভিপ্রায়ে। এর আগে পুরো এলাকা জুড়েই ছিল খামারবাড়ি যার অল্প কিছু অংশ পূর্ব দিকে অবশিষ্ট আছে। পরবর্তী সময়ে তিনি বাড়ি সম্প্রসারণের (Remodeling) উদ্যোগ নেন। মূলতঃ ১৯১৫ সালের পরেই ফ্রাঙ্কলিন এবং মা সারা’র যৌথ প্রচেষ্টায় বাড়ির মূল সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়।

আরও জানতে পারলাম স্প্রিংউড এস্টেটের দু মাইল উত্তরে ভাল-কিল কটেজ (Val-Kill Cottage) নামে ফার্স্ট লেডী এলিনর রুজভেল্টের নিজস্ব বাসভবন ছিল। এখান থেকে এলিনর শুরু করেছিলেন Val-Kill Industries যা সেই এলাকার নারীদের তৈরি হস্তশিল্পজাত পণ্য বাজারজাত করত এবং গ্রেট ডিপ্রেসনের মতো দুঃসময়ে খামারবাড়ির পরিবারগুলোকে কিছুটা অর্থনৈতিক সহায়তা যোগাত। সেই কটেজ আবার আলাদা ট্যূরের অংশ এবং ভিসিটর’স সেন্টার থেকে শাটলে যেতে হয়। সেদিনের মত শেষ শাটলের সময় পেরিয়ে যাওয়ায় সংগত কারণেই সেটিকে আপাতত ভবিষ্যতের ফর্দতে রেখে দিলাম। তবে এলিনরের নিজস্ব বাসভবনে থাকার পেছনে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ফ্রাঙ্কলিনের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনও অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৪৫ সালে ফ্রাঙ্কলিনের মৃত্যুর পর স্প্রিংউড এস্টেট জাতীয় দর্শনীয় স্হান (National Historic Site) এবং জাদুঘরে রূপ নিলে এলিনর ভাল-কিল কটেজেই স্হায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

এছাড়া এস্টেটের একেবারে পূর্বদিকে ফ্রাঙ্কলিন নিজের জন্য তৈরি করেছিলেন টপ কটেজ (Top Cottage) যা ছিল মূলতঃ তাঁর Summer Retreat। তবে এই কটেজ তৈরির পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় টার্ম শেষ করে সমস্ত কোলাহল থেকে দূরে একান্তে সময় কাটানো। হুইল চেয়ারে চলাফেরার সমস্ত আধুনিক সুবিধের কথা মাথায় রেখেই কটেজটি তৈরি করা হয়। কিন্তু ১৯৪০ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট মনোনীত হওয়ায় এবং শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে সেটি আর সেভাবে কখনই হয়ে ওঠেনি ফ্রাঙ্কলিনের। মাঝে মাঝে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে আর রাজনৈতিক মিত্রদের সাথে আলোচনায় সময় কাটাতে টপ কটেজে আসতেন। উল্লেখযোগ্য অতিথির মধ্যে আছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটোন চার্চিল। তবে এই কটেজটি অবশ্য শুরু থেকে হিস্টোরিক সাইটের অংশ হিসেবে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। ২০০১ সাল থেকে শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালে কিছুটা সময়ের জন্য সেটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

গাইডের পিছু পিছু ফ্রাঙ্কলিনের দ্বিতল ভবনের মূল ফটক দিয়ে ঢুকেই দেখলাম বেশ বড়সড় একটা এন্ট্রেন্স হলওয়ে (Entrance Hallway)। নীচতলা আবার নর্থ উইং আর সাউথ উইং এই দুইভাগে বিভক্ত। সাউথ উইং এ লিভিং রুম, মিউজিক রুম, ডাইনিং রুম এবং সারা’র বৈঠকখানা (Snuggery)। নর্থ উইং এ আছে ফ্রাঙ্কলিনের স্টাডি রুম,রান্নাঘর,ভৃত্যদের ঘর এবং ছোট ছোট আরও কিছু কক্ষ।

হলওয়েতে প্রবেশের মুখেই তরুণ ফ্রাঙ্কলিনের আধ-বসা এক প্রতিকৃতি। আদতে প্লাস্টারে তৈরি এবং পরে ব্রোঞ্জে রূপান্তরিত এই প্রতিকৃতিটি ফ্রাঙ্কলিনের কন্যা আনা উপহার দিয়েছিলেন এই হিস্টোরিক সাইট কতৃপক্ষকে। পুরো এন্ট্রেন্স হলজুড়ে ফ্রাঙ্কলিনের ব্যক্তিগত সংগ্রহের বিভিন্ন ছোট ছোট জাহাজ, যুদ্ধজাহাজ,সাবমেরিনের প্রতিকৃতি যার অনেকগুলোর গায়েই উৎকীর্ণ “U. S. Navy”। দেয়ালজ়ুড়ে তেমনি অসংখ্য পেইন্টিং যার মূল ঊপজীব্য সমুদ্র আর জাহাজ। আরও আছে অগুণতি মুদ্রা,ডাকটিকিট, স্মারক,সম্মাননা (Medallion)এদিক ওদিক সাজানো। তাঁর সংগ্রহের জাহাজের পেইন্টিং এর সংখ্যা নাকি ২০০০ ছাড়িয়ে যাবে আর ডাকটিকিটের সংগ্রহ ঈর্ষণীয় ১.২ মিলিয়ন!! ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে সহজেই অনুমেয় তাঁর জীবনে নেভী বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ১৯১৩ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উইড্রো উইলসন ফ্রাঙ্কলিনকে নেভীর এসিস্টেন্ট সেক্রেটারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। মূলতঃ সেখান থেকেই ফ্রাঙ্কলিনের সফল রাজনৈতিক জীবনের গোড়াপত্তন। সাবমেরিন নির্মাণ এবং উত্তর ইউরোপে জার্মান সাবমেরিন আগ্রাসন প্রতিহত করার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ১৯১৮ সালে ফ্রান্স এবং ইংল্যাণ্ড ভ্রমণের সময়ে প্রথম পরিচয় হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটোন চার্চিলের সাথে। তাঁদের এই দীর্ঘ ঘনিষ্ঠতার স্মারক হিসেবে বাগানের পাশেই দুজনের দুটি আবক্ষ প্রতিকৃতি পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে। ১৯২০ সালে নেভী থেকে অবসর এবং শারীরিক অসুস্থতার (পোলিও) কারণে পাবলিক অফিস থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছিলেন ফ্রাঙ্কলিন। পরবর্তীতে ১৯৩২ সালে প্রেসিডেন্ট মনোনীত হবার আগ পর্যন্ত তিনি নিউ ইয়র্কের গভর্নর (১৯২৯-১৯৩২) ছিলেন।

সাউথ উইং হলওয়ে ধরে বামদিকে সোজা চলে গেছে লিভিং রুম পর্যন্ত। হলওয়ে ধরে বাঁদিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল লিভিং রুমে নেমে যাওয়ার পাটাতন (Movable Ramp)। বলাই বাহুল্য ফ্রাঙ্কলিনের হুইল চেয়ারে অবাধ চলাচলের সুবিধে করে দেবার জন্যই এ ব্যবস্থা। লিভিং রুমের বিভিন্ন স্থানে টেবিলে এবং ফায়ারপ্লেসের ওপরে পরিবারের পূর্বসূরীদের পোর্ট্রেট সাজানো। পরিপাটি সোফাগুলোর পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছিল সঙ্গীহীন বিষণ্ণ হুইল চেয়ারটি। তবে ছোটখাট হুইল চেয়ারটির সাথে বিশাল গড়নের ফ্রাঙ্কলিনের আকৃতির বৈপরীত্যের ব্যাপারটির সহজেই চোখে পড়ে। ফ্রাঙ্কলিনের উদ্দেশ্য ছিল সেটিকে যতটা সম্ভব সবার অলক্ষ্যে রাখা। ফ্রাঙ্কলিন তাঁর চলনক্ষমতার সীমাবদ্ধতার ব্যাপারটি প্রকাশে প্রচণ্ড অনীহা পোষণ করতেন । ভয় ছিল এর বিরূপ প্রভাবে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে সংশয় দেখা দেবে। তাই প্রকাশ্যে কখনও তিনি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতেন না। হুইল চেয়ারে বসা ফ্রাঙ্কলিনের ছবি অত্যন্ত বিরল। পায়ে ধাতব সহায়ক বন্ধনী (Leg brace)পরে দাঁড়ানো এবং অতি স্বল্প দূরত্ব অতিক্রমের কায়দা তিনি বেশ ভালভাবেই রপ্ত করে নিয়েছিলেন। দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করার সময় একজন ব্যক্তিগত সহযোগী সবসময় তাঁর পাশে থাকত। এই ধাতব বন্ধনীটি মিউসিয়ামে দেখেছিলাম সযতনে রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য।
এই রুমে ফ্রাঙ্কলিনের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর শেলফগুলিতে থরে থরে সাজানো অসংখ্য বই। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৪,০০০ এর মত হবে যার বেশীরভাগই অবশ্য আইন বিষয়ক। বাকি বইগুলো রাখা আছে নর্থ উইং এ ফ্রাঙ্কলিনের নিজস্ব স্টাডি রুমে। শেলফের পাশেই রাখা আছে ফ্রাঙ্কলিনের বড় একটা পোর্ট্রেট। এই লিভিং রুম লাইব্রেরীটি ফ্রাঙ্কলিনের ঐতিহাসিক অনেক বেতার ভাষণের সাক্ষী হয়ে আছে।

লিভিং রুম থেকে বের হয়ে হলওয়ে ধরে চলে আসলাম মিউজিক রুমে যেটি মূলতঃ ছিল গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাগতদের বসবার ঘর। ফ্রাঙ্কলিন এবং সারা দুজনই পিয়ানোতে বেশ পারঙ্গম ছিলেন। ঘরটিতে পিয়ানোর ওপরে রাখা বিভিন্ন সময়ের অভ্যাগতদের নিজ স্বাক্ষরিত ছবি। উল্লেখযোগ্য অতিথিরা হলেন ব্রিটেনের রাজা জর্জ VI রাণী এলিজাবেথ, প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিল, কানাডার প্রধানমন্ত্রী, ডাচ প্রিন্সেস, নরওয়ের প্রিন্স এবং প্রিন্সেসসহ আরও অনেকে। এই রুমের আরও একটা নাম আছে, সেটি হল ড্রেসডেন রুম।
নামকরণের ইতিহাস হল এই রুমে রাখা সৌখীন মোমবাতিদানী,কাঠের ঘড়িসহ অনেক কিছুই জার্মানীর ড্রেসডেন শহর থেকে কিনেছিলেন জেমস রুজভেল্ট। এছাড়াও সারা’র চীন ভ্রমণের সুবাদে এবং পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত পোর্সেলীনের কিছু সৌখীন পাত্র চোখে পড়ে ড্রেসডেন এবং তাঁর লাগোয়া ডাইনিং রুমে। বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখলাম ডাইনিং রুমে দুটি আলাদা টেবিল – একটি ছোট আরেকটা বড়। গাইডের কাছে জানতে পারলাম পরিবারের নতুন সদস্যরা প্রথমে এই ছোট টেবিলেই তাদের যাত্রা শুরু করত। একসাথে খাওয়ার সব আদব কায়দা (Etiquette) শিখে তবেই বড় মূল টেবিলে অন্যান্য সদস্যদের সাথে বসার উপযুক্ততা অর্জন করা যেত।

ডাইনিং রুম পার হয়ে এলাম সারা রুজভেল্টের বৈঠকখানা বা স্নাগারীতে (Snuggery)। এটিই ছিল মূলতঃ তাঁর অফিসকক্ষ আর এখান থেকেই বাড়ি সংক্রান্ত বিল থেকে শুরু করে যাবতীয় সাংসারিক ব্যাপার সামলাতেন সারা। তবে এ কক্ষের মূল আকর্ষণ হল সেই আমলের মজার একটি টেলিভিশন। আজকের দিনের টেলিভিশনের সাথে এর মূল পার্থক্য হল এর স্ক্রীনটি (screen) ভূমির সমান্তরালে রাখা। কৌণিকভাবে দর্শকের দিকে থাকা আয়না দিয়েই ছবি দেখার একমাত্র ব্যবস্থা।এর অর্থ স্ক্রীনে ছবি পুরোপুরি উল্টোভাবেই দেখা যেত।

নীচতলার কক্ষ দর্শনের আপাত সমাপ্তি টেনে থেকে আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম।
[ক্রমশঃ]

তথ্যসূত্রঃ
1. Home of Franklin D. Roosevelt National Historic Site
2. Wikipedia
3. National Park Service

১,৯১০ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের বাড়িতে ২”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    নীলোৎপল ভাই, জটিল লিখছেন বস্‌ :boss: আপনার সাথে সাথেই মনে হয় রুজভেল্টের বাড়িতে ঘুরছি :clap: দুর্দান্ত :salute:
    ইতিহাসটাও গল্প এবং ভ্রমণের গদ্যে চমৎকার জানা হয়ে যাচ্ছে :thumbup:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    পড়লাম, দেরীতে হলেও। খুব ভাল লিখেছেন।
    আচ্ছা চার্চিলের সাথে যখন রুজভেল্টের প্রথম দেখা হয় তখন চার্চিল কি করতেন বা তিনি কি পদে ছিলেন? উইকি ঘেটেই দেখা যেত অবশ্য। তাও এখানেই প্রশ্নটা করলাম।

    জবাব দিন
    • নীলোৎপল (১৯৯১ - ৯৭)

      অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
      চার্চিল সে সময়ে সম্ভবত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অস্ত্র মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
      http://en.wikipedia.org/wiki/Minister_of_Munitions উইকি ঘেটেই দিলাম 🙂
      নেভীতে এসিস্টেন্ট সেক্রেটারী থাকার সময়ে রুজভেল্টের যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণে বিশেষ আগ্রহের কারণেই চার্চিলের সাথে আলাপচারিতা হয়। তবে রুজভেল্টের ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটেন এবং ফ্রান্সে যুক্তরাষ্ট্রের Naval Facility পরিদর্শন।

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।