অনলাইনে বিবিসি ম্যাগাজিনের একটি প্রবন্ধ পড়ছিলাম। শিরোনাম ছিল ‘১০০ বছর পরের কুড়িটি ভবিষ্যদ্বাণী’। শিরোনাম দেখে মনে হলো এমন প্রবন্ধ অনেকেই লিখতে পারে। তবে একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। চমৎকার লাগলো। তারপর গুগলের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম বিশ্বের কোথাও কেউ ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করছে কিনা। দেখলাম, সেখানে চার কোটিরও বেশি বিভিন্ন রকমের লেখা আছে। তাহলে অন্যান্য দেশে প্রায় সবাই এ নিয়ে ভাবছেন। মনে হলো দেখি বাংলাদেশে কে ভাবছেন। খুঁজলাম ‘বাংলাদেশ একশো বছর পর’। একমাত্র রেজাউদ্দিন ষ্ট্যালিনের ‘একশো বছর পর’ শিরোনামে একটি কবিতা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না। বিবিসির প্রবন্ধটি পড়ে এতোটাই ভালো লাগলো যে সেটা আবারও পড়লাম। কয়েকটি বিষয় নিয়ে বেশ খানিকটা চিন্তাও করলাম। বলা হচ্ছে, তখন দশ বিলিয়ন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে হলে আমাদের মহাসাগরগুলোতে মাছ ছাড়াও আরও অনেককিছুরই চাষাবাদ করতে হবে এবং তা করাও হবে।
বলা হচ্ছে, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশকে ব্যাবসার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেলের খনি নাকি সেখানেই। প্রবন্ধটি থেকে আরও জানলাম, মানুষ তখন এক বছরের বেশি বিবাহিত জীবনযাপন করবে না। বিয়ে ব্যাপারটাই তখন একটি এক বছরের চুক্তি’তে পরিণত হবে। মানুষ তখন এতবেশি বছর বাঁচবে যে তারা আর একজনের সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে চাইবে না। ধরুন, কেউ কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে করলো এবং একশো বছর বাঁচলো। তাহলে সে কি আশিবছর একজনের সঙ্গে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেবে? না; তখনকার মানুষ তা চাইবে না। আমি অবাক হইনি; কিন্তু ব্যাপারটা ভালোও লাগেনি।
গুগলে আবারও বাংলাদেশ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। এবার ইংরেজি ভাষায়। একশো বছর আগেকার অনেক তথ্য আছে, কিন্তু একশো বছর পরের কিছু নেই। মনে হলো, আমরা বাংলাদেশিরা আসলেই এ বিষয়ে কিছু ভাবছি না, এবং সেই কারণেই বোধহয় আমরা দূরদৃষ্টি নিয়ে অনেক কাজই করতে পারছি না। আমরা জানি, আমাদের নাতি-নাতনি ও তাদের ছেলেমেয়েরা সেই সময়কালের বাসিন্দা হবে, কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবেছি তারা কী ধরনের পরিবেশে বসবাস করবে? আমি পরিবেশবিদদের মতো করে কিছু বলছি না। তখনকার প্রযুক্তি কতদূর যাবে? তারাই বা কেমন জীবনযাপন করবে?
বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম। আমি একশ বছরের কথা ভাবতে চাই না। পঞ্চাশ বছরই সই। দুই হাজার সাতষট্টি সালে আমাদের নদীগুলোর কি হবে? বাঁচবে তো? আমাদের ধানিজমিগুলোর কি হবে? থাকবে তো? নাকি সেখানে ঘরবাড়ি উঠে চাষাবাদ সব বন্ধ হয়ে যাবে? তখন মাছের চাষই বা কোথায় করবো? বঙ্গোপসাগরে? আমাদের খেলাধুলার মাঠগুলো থাকবে তো? আমরা কি তখনো খেলাধুলা করবো? সারাদেশের মানুষ খাবার পানি কোথায় পাবেন? বাংলাদেশ কি তখন পারমাণবিক বোমা বানাবে? আমাদের বাংলা ভাষার তখন কি পরিণতি হবে?
প্রায়ই এমন অনেক কথাই ভাবি। এগুলোর সম্ভাব্য উত্তর আমার এখনও জানা নেই।
আমরা এরই মধ্যে দেখেছি যে, অনেক বদলে গেছি আমরা। যখন ছোট ছিলাম, বাড়িতে থাকলে ঘরের দরজা কখনও বন্ধ করতাম না। আমাদের বাড়িতে যন্ত্র বলতে ছিল টেলিভিশন, ফ্রিজ আর টেলিফোন। এখন এয়ার-কন্ডিশনার থাকে, ল্যাপটপ থাকে, মোবাইল ফোন ও ট্যাব থাকে, ওয়াশিং মেশিন থাকে- আরও কতো কি! এয়ার-কন্ডিশনার চালালে তো দরজা বন্ধ করতেই হয়। মোবাইল ফোনের পানে তাকিয়ে থাকলে তো আর কোনোদিকে তাকানোই যায় না! আমরা আমাদের বাবা-মা’কেও দেখতাম তারা বই পড়েন; আমরাও পড়তাম। যে আমরা একসময় বই পড়তাম, এখন আর পড়ি না। বাবা-মা হিসেবে আমরাও যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি; ছেলে-মেয়ের দিকে তাকাই না। তো ছেলে-মেয়েরা বা কী করবে? তারাও যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে! আমরা যন্ত্রের উপনিবেশ হয়ে গেছি।
ঢাকা শহরের কথাই ধরি না কেন! এক সময় এই শহরের বেশিরভাগ বাড়িগুলোই ছিলো দো’তলা। চারতলা বাড়ি তৈরি শুরু হয় আশির দশকে। তখন এক বাড়িতে চারটি পরিবার থাকতো। এখন দশ পরিবারের বসবাস; কোন কোন ক্ষেত্রে বসবাস করে পঞ্চাশ পরিবার। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এরপর কী হবে? কতগুলো পরিবার একবাড়িতে বাস করবে? তখন কি আমরা এই বাড়িগুলো ভেঙে আবারও নতুন বাড়ি বানাবো?
পঞ্চাশ বছর পর আমাদের শহরগুলোর ট্র্যাফিকের অবস্থা কেমন হবে? আমাদের শহরগুলো কি ফ্লাই-ওভারে ছেয়ে যাবে? আমরা কি ট্রেনে চড়ে চলাচল করবো?
শুনতে পাচ্ছি, বিশ্বজুড়ে সাগরের নিচে তৈরি হবে শহর। কিছু এলাকায় সাগরতলে এরই মধ্যে ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে। তবে আমাদের সমুদ্রের নিচে শহর তৈরি উচিত হবে কিনা তা ভাবতে পারছি না। যে ‘সততা’ দিয়ে আমরা রাস্তা বা অন্য কোনো কিছু নির্মাণ করি, সেই সততা দিয়েই যদি সাগরতলের শহর তৈরি হয়; তাহলে সে শহর দু’দিনও টিকবে না। তবে আমার দেশের বিশেষজ্ঞরা অবশ্যই সে শহর বানানোর চিন্তা করবেন।
চাষাবাদের জমি যখন কমে যাবে, আমাদের গ্রামগুলো সব শহর হয়ে যাবে আর আমরা সবাই শহরে বসবাস করবো। পঞ্চাশ বছর পর আর কোন মুদি দোকানই হয়তো থাকবে না। আমাদের ফ্রিজগুলো সব অনলাইন বাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। আমাদের হাসপাতালগুলো প্রযুক্তিতে এতোটাই উন্নত হবে যে আমরা অসুস্থ্য হওয়ামাত্রই সবচেয়ে কাছের হাসপাতাল থেকে এসে হাজির হবে অ্যাম্বুল্যান্স। অথবা সেই অ্যাম্বুল্যান্সে আইসিইউ সরঞ্জাম থাকবে। এমন বাংলাদেশ কী আগামী পঞ্চাশ বছরে তৈরি হবে।
মানব জাতি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যত এগোবে, হাজারো পরিবর্তন আসবে সারাবিশ্বে। আমার দেশেও। তবে এটাও ঠিক যে তার সঙ্গে হাজারো দুঃশ্চিন্তাও এসে হাজির হবে। আমাদের সুন্দরবন বোধহয় আর থাকবে না। দু’হাজার একাত্তর সালে স্বাধীনতার একশ বছরে সবাই সুন্দরবন দেখতে যাবে জাদুঘরে। অথবা চোখে একটি জাদুর চশমা লাগিয়ে সুন্দরবনে ভ্রমণ করা যাবে। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া হয়তো আর করা হবে না। যদি একসঙ্গে ক্লাসই করা না হয়; তাহলে হয়তো আড্ডাও আর হবে না। আমরা পঞ্চাশ বছর পর কার সঙ্গে আড্ডা দেবো? রোবটের সঙ্গে? একেবারে ঠিক। বাংলাদেশেও হয়তো পাওয়া যাবে সেই রোবটগুলো। জলাবদ্ধতা থাকুক আর নাইবা থাকুক, এই দেশে রোবট বিক্রি হবেই। সুখ-দুঃখের কথা তার সঙ্গেই হবে।
বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে, এগুলো আসছে। রোবটরা আসছে। হয়তো পঞ্চাশ বছরও অপেক্ষা করতে হবে না। আমার মনে মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগে; যখন ‘রোবট’রা আসবে, তখনকার মানুষ কেমন হবে?