মুসলিম ইন আমেরিকা-৩: সেরা ব্যক্তিত্বঃ হামযা ইউসুফ

স্থানঃ লেকচার হল, ইউনিভার্সিটি অফ হিউস্টন।
তিল ধারনের জায়গা নেই লেকচার হলটিতে, এমনকি লেকচার হলের বাইরেও উপচে পরা ভিড়। স্টেজের উপর দাঁড়িয়ে একজন বক্তা স্পষ্ট আরবী এবং নির্ভূল কুরানিক ভাষায় যে বক্তব্য রাখলেন, তা শুনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে তাঁর জন্ম মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে নয়। তিনি হলেন শেখ হামযা ইউসুফ, জন্মসুত্রে আমেরিকান এবং কনভার্টেড মুসলিম। গোটি স্টাইলের দাড়ি ও স্পোর্টস জ্যাকেট পরিহিত হামযা ইউসুফ দেখতে অনেকটা আমেরিকান কলেজ প্রফেসরের মত। নিজে কোন কলেজের ফুলটাইম প্রফেসর না হলেও, জ্ঞান-গরিমায় তিনি একজন প্রফেসরের তুলনায় কোন অংশেই কম নন। তাঁর জ্ঞানের বিষয়ঃ ইসলাম। শেখ হামযা ইউসুফ ইতিমধ্যেই আমেরিকায় এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাঁর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হল তাঁর জ্ঞানগর্ভ লেকচারসূহ এবং ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র নিন্দা। কুরান-হাদিসের উক্তি ছাড়াও তিনি সাধারণত তাঁর লেকচারগুলোতে St. Augustine, Patton, Eric Erikson, Jung, Solzhenitsyn, Auden, Robert Bly, Gen. William C. Westmoreland প্রমুখ এবং বাইবেলের রেফারেন্স দিয়ে থাকেন।

শেখ হামযা ইউসুফের জন্ম ১৯৬০ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটন রাজ্যের “ওয়ালা ওয়ালা” শহরে। তখন তাঁর নাম ছিল মার্ক হ্যানসন। তিনি জীবনের প্রথম অংশ কাটিয়েছেন উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় এবং তাঁর পরিবার ছিল খ্রীষ্টান (গ্রীক অর্থডক্স) ধর্মালম্বী। তাঁর বাবা ছিলেন একজন প্রফেসর ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেটারেন এবং মা একজন anti-war activist. ১৯৭৭ সালে হামযা ইউসুফ (তখন মার্ক হ্যানসন) গাড়ি দূর্ঘটনায় গুরুতর ভাবে আহত হন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে এইরকম নিকটমৃত্যুর অভিজ্ঞতা তাঁকে পরকাল সম্পর্কে ভাবতে উৎসাহিত করে তুলে এবং তিনি মৃত্যু বিষয়ে বিভিন্ন মতবাদের দৃষ্টিভংগী জানতে আগ্রহী হন। কুরান শরীফে মৃত্যু
ও পরকাল বিষয়ে বিষদ বিবরণ দেখে তিনি ইসলাম ধর্মের ব্যপারে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহন করেন।

তিনি ইসলাম বিষয়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রথমে চার বছর কাটান মধ্যপ্রাচ্যে, এবং পরবর্তীতে পশ্চিম আফ্রিকার মৌরিতানিয়া, মেদিনা, আলজেরিয়া, ও মরক্কোতে। ইসলাম শিক্ষার উদ্দ্যেশ্যে দেশের বাইরে একদশকের বেশী সময় অতিবাহিত করে তিনি আমেরিকাতে ফিরে যান, এবং নার্সিং ও ধর্মবিদ্যায় ডিগ্রী আর্জন করেন যথাক্রমে Imperial Valley College ও San José State University থেকে। ক্যালিফোর্নিয়ায় আবস্থিত যায়তূনা ইনস্টিটিউট এর একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি। যায়তূনা ইনস্টিটিউট এর প্রধান উদ্দেশ্য হল, ইসলামিক বিজ্ঞানচর্চার পূনর্জন্ম ও ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক শিক্ষাপদ্ধতির সংরক্ষন। বার্কলিতে বর্তমানে একটি ইসলামিক সেমিনারি (ধর্মীয় শিক্ষার স্কুল) প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হামযা ইউসুফের মতে বর্তমান দুনিয়ায় মুসলিমদের দূর্দশার প্রধান কারণ হল তাদের ধর্মীয় জ্ঞানের আভাব। হামযা ইউসুফ দুঃখ প্রকাশ করেন এই বলে যে, মুসলিম বিশ্বের বেশীরভাগ সেমিনারিগুলো বর্তমানে বৌদ্ধিকভাবে মৃত (intellectually dead) এবং মুসলিম দেশের ভাল ভাল ছাত্রগুলো আজ ধর্মবিদ্যার পরিবর্তে ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত প্রযুক্তিগত বিষয়ে শিক্ষা গ্রহন করছে। (এর ফলাফল হিসেবে আজকে আমাদের মুসলিম বিশ্বে ভাল ভাল নেতার অভাব। এরই ফলস্বরূপ স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা নিজেদের নেতা বলে পরিচয় দিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ইসলামকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ শুন্য স্থান কখন খালি থাকে না, ভাল নেতারা যদি শুন্য স্থান পূরণ না করে, তবে খারাপরাই তা পূরণ করতে হয়-আমার মতামত)।

ইসলাম বিষয়ক লেকচার দেবার জন্য হামযা ইউসুফকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমন করতে হয়। এছাড়াও তিনি বই লেখেন, আরবী পদ্য আনুবাদ করেন, সিডি ও টেলিভিশন শো রেকর্ড করেন, নিয়মিত র‌্যবাই, পাদ্রীদের সাথে আলোচনায় অংশ নেন, এবং সুইজারল্যন্ডের World Economic Forum প্রতিবছর যোগদান করেন। “রিহলা (ভ্রমন) উইথ শেখ হামযা” নামক একটি টিভি সিরিজের তিনটি সিজনে তিনি হোষ্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সিরিজটি আরবিক স্যাটেলাইট চ্যানেল NBC তে প্রচারিত হয়।

১১ই সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ার হামলার মাত্র ৯ দিনের মাথায় আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এক বিশেষ মিটিং ডাকেন বিভিন্ন ধর্মের ৬ জন ধর্মীয় নেতাকে নিয়ে এবং সেই মিটিংএ মুসলিমদের প্রতিনিধি হিসেবে হামযা ইউসুফ আমন্ত্রিত হন। তাঁর উপদেশ মোতাবেক জর্জ বুশ আফগানিস্থানে মার্কিন মিশনের নাম “Infinite Justice” থেকে বদলে “Operation Enduring Freedom” রাখা হয়, কারণ ইসলাম ধর্মঅনুযায়ী, “Infinite Justice” এর মালিক একমাত্র আল্লাহ। তৎকালীন সময়ে তাঁকে আমেরিকান সংবাদ মাধ্যমগুলো “প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা” হিসেবেও সংবধন করেছিল। কিন্তু দঃখজনকভাবে এর পরে হামযা ইউসুফের আর কোন উপদেশই জর্জ বুশ শুনেন নি।

বর্তমানে শেখ হামযা ইউসুফ বসবাস করেন ক্যালিফোর্নিয়ার ড্যানভিলে তাঁর স্ত্রী ও ৫ সন্তানকে নিয়ে। তাঁর স্ত্রী লিলিয়ানা জন্ম একটি ক্যাথলিক-হিস্পানিক পরিবারে ও তিনি ইসলাম গ্রহন করেন কলেজে হামযা ইউসুফের সাথে পরিচিত হবার পর।

হামযা ইউসুফের ব্যতিক্রমধর্মী লেকচারসমুহের উধাহরণ হিসেবে নিচের ভিডিওগুলো দেখতে পারেনঃ
লেকচার-এ টাইম টু চেইঞ্জঃ লিঙ্ক
বিবিসি হার্ডটক (২০০১)ঃ , ,
বিবিসি ইন্টারভিউ উইথ মার্ক লসনঃ,
ইন্টারভিউ উইথ রিজ খানঃ লিঙ্ক
যায়তুনা মাসিক পডকাষ্ট (পোপের করা মন্তব্য, ইসলাম ছড়িয়েছে তরবারীর মাধ্যমে, এর প্রতিউত্তরে)ঃ লিঙ্ক
লেকচার-চেঞ্জিং দা টাইডঃ লিঙ্ক
লেকচার-ফ্রম প্রটেস্ট টু এনগেজমেন্ট (লন্ডন)ঃ , , ,

তাঁর লেখা বইসমূহঃ
* The State We Are In: Identity, Terror, and the Law of Jihad (contributing Author), 2006.
* Educating your Child in Modern Times
* Agenda To Change Our Condition (Co-authored with Imam Zaid Shakir)


এই লেখায় ব্যবহৃত সূত্রসমূহঃ
1. Wikipedia
2. All Experts
3. Zaytuna Institute
4. The New York Times

২,৭৭৭ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “মুসলিম ইন আমেরিকা-৩: সেরা ব্যক্তিত্বঃ হামযা ইউসুফ”

  1. তৌফিক (৯৬-০২)

    বার্কলের একজন পিএইচডিধারী আমি যে শহরে থাকি তার একমাত্র মসজিদের ইমাম। একাধারে তিনি আমার ফ্যাকাল্টির একজন প্রফেসরও। কিন্তু মুসলিম কমিউনিটিতে তার জনপ্রিয়তা যতোটুকু হওয়া দরকার, ততোটুকু নয়। একমাত্র কারণ, তিনি বহু বিষয়ে উদারনৈতিক বক্তব্য দেন। লোক হিসাবে তিনি অনেক ভালো। নেহায়েত আমার ফিল্ডের লোক না, নাহলে পটায়ে পুটায়ে তারে সুপারভাইজার বানায়ে ফেলতাম।

    লেখাটা তৈরী করার সময় কষ্ট করছো বুঝা যায়। আর নির্মোহ বর্ণনাভংগিটা ধরে রেখো, প্রেজুডিশিয়াল যেন না হয়ে যায় কখনো। 🙂

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)
    পইড়া ভাল্লাগ্লো। কিন্তু ভিডিও গুলা দেখতে পারতেছি না, নেটের যা স্পীড… মাশাল্লাহ


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।