বাইকে দেশভ্রমনঃ দুই হুজুগের বাসিন্দার একটি প্রডাক্তিভ পাগ্লামি—(৩)…এবারে জাফ্লং রোডে

জাফলং পথে – যেন ২ ওয়েস্টার্ন কাউবয় আর বিচিত্র ট্রেইল।।

Jaflong e sunset

রাজশাহী থেকে ঢাকা হয়ে সিলেট এসে পওছেছিলাম। ১৫০০ কিলোমিটার এর প্রায় ৭০০ কিলোমিটার এখানে আসতেই। এই লেখা যখন লিখছি আমার এক বন্ধু আমাকে বলছিল মাথায় আঘাত পেয়েছিলাম নাকি ছুটি যাওয়ার আগে! হ্যাঁ, হয়ত তাইই, বা তা না হয়ে অন্য যা কিছুই হয়ে থাক। আমি বলবো ভাগ্য ভাল আঘাত টা পেয়েছিলাম। না হলে এই দেশে থেকে নিজেকে ওয়েস্টার্ন কোন গল্পের অজ্ঞাত কাউবয় ভাবার সৌভাগ্য কিভাবে সম্ভব ছিল!

সিলেট এসেই ভেবেছিলাম দুদিন তো আছিই এখানে। শুধু হবে বিশ্রাম। ঘুমের মধ্যে কোন আরেক রাজ্যে গিয়ে অভিযান করে আসবো। ঘাড়ে থাকবে কাউবয় হ্যাট, সাথে কালো স্ট্যালিয়ন, স্যাডল প্যাক এ কিছু খাবার এর সাথে অবশ্যই তামাক আর ধুম্পানের কাগজ। সপ্ন রাজ্যে আর যাওয়া হয়নি। বিকালেই সেনানিবাসে থাকা আমাদের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। একটাই জায়গা ছিল BCC (Basic Commando Course ) করা অফিসারদের মেস। নিহাব, তাসিন, বকর, আশিক, সাগর, তায়েফ, দাইয়ান সবার সাথে দেখা করেছিলাম। ওদের ছোট চুল আর প্রপার শেভ এর কারনেই হয়ত নিজেকে জংলি লাগছিল বেশ। পরে হয়ত আবারও দেখা হবে ওদের সাথে কিন্তু সেই দেখা এই সাত নদী তেরো সেতু বাইকে পার করে এসে দেখা করার মত বিশেষ কিছু হবে না। সোহেল এর কথাগুলো তা পরিস্কার করে দিয়েছিল যখন দূর থেকে আমায় দেখে কাছে এসে অবাক চোখে বলেছিল “ দোস্ত তুই এখানে, দূর থেকে দেখে তুইই মনে হচ্ছিল কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছিল না”।

রাতে নিহাব, সামিন, আমি আর কাইয়ুম গিয়েছিলাম শহরে; ভুড়িভোজের আসায়। কিন্তু গিয়ে দেখি আজ তো পয়লা মে, কেও আমাদের খাওয়া দেবে না। শেষে সিলেট মেডিকেল কলেজে গিয়ে আমাদের ময়ূর আসিফ তার ক্যান্টিন এ খিচুরি আর গরুর মাংস দিয়েছিল বলে বাঁচা, আসা ভঙ্গের উপোষ সর্বদাই ভয়াবহ হয়। মামা মামা বলে আসিফ ক্যান্টিন এর সর্বজন বিদিত মামাকে পটিয়ে যে খাবার খাইয়ে ছিল তার স্বাদ আমার মুখে হয়ত আরও কয়েকদিন থাকবে। সব ভালর মাঝে শেষ টা ছিল আমার ফেবারিট- বাইপাস রোডে সেই বাইকে পাগলামির টান আর শাহ পরান ব্রীজের মাঝখানে থেমে বন্ধু-আড্ডা-গান এর মতই বন্ধু-আড্ডা-ধুমপান। রাতে তামিল মুভিতে নায়িকা কাজল আগারওয়ালকে দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়েছিলাম জানিনা।

ঐ যে বলে না, জীবনের সবচেয়ে ভাল ব্যাপারগুলো সারপ্রাইজ এর মত করে আসে। সকালের বৃষ্টি আর আমাদের ১১ টার ঘুম ভাঙ্গা অলসতা আমাদের জাফলং যাওয়ার ইচ্ছাকে তো মিশিয়েই দিয়েছিল, দুপুরের হুজুগ আমাদের জাফলং এর পথে নিয়ে গিয়ে এই রকমেরই এক সারপ্রাইজ দিয়েছিল। জায়গাটাকে নিয়ে আগেই শুনেছিলাম। সবচেয়ে common comment ছিল BORING, আহা মরি কিছুই নয়। চিটাগং এ ২ বছর ট্রেনিং এর পাহাড় সম্পর্কে তিক্ততা ছাপিয়ে যখন পথে নামি ঘড়িতে তখন বাজে বিকাল ৪টা।

প্রথম ৫-৬ কিলোমিটার রাস্তাটা একটু কম চওড়ার বৈশিষ্ট্য বাদ দিয়ে অন্যান্য রাস্তার মতই ছিল। মজা শুরু হল যখন দূরের পাহাড় চোখে পড়ল। পথে গাড়ি ছিল না মোটেই, একটু পর পর দুই একটা Car, লেগুনা ছাড়া আমরা ছিলাম একরকম নির্জনতায়। পরে খেয়াল হয়েছিল যে পথের দুপাশে ধান খেত ছিল কিন্তু তখন চোখে ছিল একটা জিনিসই; সামনের ছায়ার মত পাহাড়, হাল্কা কুয়াশা ঘেরা দিগন্ত।

tamabil border

আকাশ একটু মেঘলা, বিকেলের পড়ন্ত রোদ, অজানা পথ আর দূরে পাহাড়ের হাতছানি; আমাদের কেমন মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেছিল । সামিন এর বার বার করে বলে দেয়া পথের মাঝের চা বাগান দেখার কথা কখন ভুলেছিলাম! ভুলেছিলাম সবকিছুই। দুরের পাহাড় কখন কাছে আসবে আর যেন তর সইছিল না।

প্রায় ৩০ কিলমিটার পার করে যখন বিষ পানের বিরতি নিলাম! তখন হাতের ডান পাশে দিগন্তজুড়ে পাহাড় আর পাহাড়। বেশ কিছু ছবি তুল্লাম চটপট, তারপর স্বপ্নের ওয়েস্টার্ন কাউবয় এর মত স্যাডল প্যাক থেকে না ত কি হয়েছে, সিগারেট এর প্যাকেট থেকেই কাইয়ুম এর তথাকথিত স্বর্ণ পত্রে বিষপান শুরু করলাম। দূরে পাহাড়ের গায়ে ছোট এক্ ঝরনা ছিল, খুব হাল্কা মিষ্টি একটা রোদ, পুরপুরি অজানা পাহাড় ঘেরা পথ আর পথের মাঝে বসে আমরা দুই ভবঘুরে। উদাস হয়ে যাওয়ার জন্য এর চেয়ে ভাল কোন পরিবেশ আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। হয়েছিলামও তাই, প্রায় ১৫ টা মিনিট বসেছিলাম একটাও কথা না বলে।

নিজের মনের মধ্যেই একটা অহংকার এসে জমে ছিল। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে ঐ মুহূর্ত টাকে অর্জন করতে পারার জন্য। “Man Against the Sea ” মুভির সেই নৌকা নিয়ে সাগরের মাঝে নাবিক, হিমালয়ের শিখরে দাড়িয়ে থেকে হিলারির অনুভুতি (বইতে পড়া) কিম্বা যে কোন ওয়েস্টার্ন নায়কের horse riding অথবা আর সব কিছু, যেসবের প্রতি হিংসা ছিল কখনো, সেই হিংসা থেকে মুক্তি মিলেছিল তখনই।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই খুব emotional হয়ে গিয়েছিলাম। বুক ভারি হয়ে এসেছিল। আমাদের হুজুগের বসে দেশ ভ্রমন্ টা করে ফেলার সিদ্ধান্তের জন্য নিজের মাথার crack part টার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ হয়ে ছিলাম। বহু জনকে মিথ্যা বলে, কারো নিষেধ অমান্য করে, শত বিপদের আশংকাকে মাথা থেকে বিতাড়িত করে এই freaking venture এ আসার জন্য যে কিঞ্চিৎ guilty feelings ছিল মনে তা নিমেশে উধাও হয়ে গিয়েছিল।

India at the back

কাইয়ুম এর দিকে চেয়েছিলাম একবার। চুপ করে বসে ছিল। জানি ছটফট করছে ও যে কখন লেখা শুরু করবে। ওর লেখার নেশা আছে। । মনের কথা গুলোকে অসাধারন সুন্দর করে প্রকাশ করতে পারে। একেবারে অন্যরকম স্টাইল। আমাদের এই অভিযান নিয়েও ও লিখেছে “ভাদাইম্যের দেশভ্রমন”।

কখন বাইকে চেপে তামাবিলের সামনে পওছে গেলাম টেরই পাইনি। সেখানে দু কাপ চা খেয়েই রওনা দিয়েছিলাম। তবে ভারত ০০ কিলোমিটার বোর্ডের সামনের দাড়িয়ে ছবি তুলতে ভুলিনি কিন্তু। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই জাফলং এর ডাউকি নদীর পাড়ে গিয়ে বাইক থামালাম। ওখানে এসে জানলাম আমরা পুরো পথ যেসব পাহাড় দেখে এসেছি সেসব ভারত এর। অনেকটা হতাশ হয়েছিলাম বইকি।

বাইক থেকে নেমে চারপাশে দেখে নিলাম। তাহলে এই হল জাফলং। একটা নদী, যা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে, নদীর ধারে পাথর তোলার কাজ চলছে সরগরম ভাবে, কিছু লোকজন আমাদের মতই ভ্রমন করতে এসে নৌকাতে চড়েছে আর দূরে পাহাড়ের গায়ে অস্তমিত সূর্য। অসাধারন কিছুই নয়। সামনের ডাউকি নদীতে পানি খুব বেশি ছিল না। নৌকা চলছিল বেশ কিছু। দূরে পাহাড় এর গায়ে ডাউকি শহর (ভারতের মধ্যে)ঠিক যেমন ছবিতে দেখা নেপাল এর পাহাড়ি শহর গুলো। আমরা উপরের রাস্তা থেকে নিচে নামলাম। দেখলাম দূরে এক নির্দিষ্ট স্থানের পরে আর নৌকা গুলো যাচ্ছে না। লোক মুখে শুনলাম ওখানে বাংলাদেশ এর সীমানা শেষ।

সূর্যাস্তের সময় হয়ে গিয়েছিল। এর আগেও অনেক সূর্যাস্ত দেখেছি অন্য কোন নদীর বুকে বা সমুদ্রের বুকে কিম্বা পাহাড়ের গায়ে তাই আমার চোখ সেদিকে ছিল না। আমি চেয়েছিলাম ঐ দুই পাহাড়ের কোনায় যেখানে ডাউকি নদী হারিয়ে গেছে ভারতের মধ্যে। একই নদী, সীমানার ওপারে হয়ত একই রকম পাহাড়, মানুষ জনও একই। কিন্তু কেমন যেন ভুতুড়ে লাগছিল দূর থেকে। আমার দেখতে ইচ্ছা করছিল নদীটা সেখানে কেমন! হয়ত এই কারনে যে ওপাশে গমন নিষেধ। আর মানুষের সুলভ জিনিসের চেয়ে…।।নিসিদ্ধের প্রতি টান বেশি।

আবারো বিষপান, সাথে চা। তারপর ফিরতি পথে। আমাদের freaking অভিযানের প্রথম ফিরতি পথ। সামনে কোন পাহাড় ছিল না এবার যা তার দিকে টেনে নিয়ে যাবে, ছিল না কোন অজানা পথ, ছিল পথটা শেষ করে সামিনের ঘরে পওছানোর অগত্যা ব্যস্ততা। আর ছিল চিন্তা আগামীর পথের। কাল যে আমরা আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ পথে নামবো। সিলেট থেকে কুমিল্লা হয়ে চট্টগ্রাম।

সামিনের মেসে পওছেই আমি নিহাব দের ওখানে গিয়ে সবার কাছে বিদায় নিয়ে আসলাম। বাইকে চড়ে যখন accelaretor ঘুরাচ্ছি, তখন কেমন যেন অস্থির লাগছিল। কিসের যেন দুঃখ ভর করেছিল মনে। যে দুঃখের কারণ বা যৌক্তিকতা কখন বিচার করার চেষ্টা করিনি , করে লাভ ও নেই। মানুস তার সবকিছুকে যুক্তির জালে জড়িয়ে রাখতে পারে না…………।।

The Road Back

to be continued…

১,০৩১ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “বাইকে দেশভ্রমনঃ দুই হুজুগের বাসিন্দার একটি প্রডাক্তিভ পাগ্লামি—(৩)…এবারে জাফ্লং রোডে”

মওন্তব্য করুন : শহীদ (১৯৯৪-২০০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।