ইতিহাস প্রসঙ্গ: সত্য ও মিথ্যার মাপকাঠি – পর্ব ১

ইতিহাস প্রসঙ্গ: সত্য ও মিথ্যার মাপকাঠি – পর্ব ১
——————————- ড. রমিত আজাদ

ইতিহাস আমার প্রিয় বিষয়গুলোর একটি। বিষয়টির উপর আমার প্রথম আগ্রহ জন্মে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম মাজহারুল হক স্যারের প্রাঞ্জল লেকচার শুনে। আমরা তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, স্যার আমাদের পড়ানো শুরু করলেন সিন্ধু সভ্যতা থেকে। উনার কাছ থেকেই প্রথম জেনেছিলাম যে, আমাদের এই উপমহাদেশেই এতো পুরাতন একটি সভ্যতা ছিলো। স্যারের কাছ থেকেই প্রথম জেনেছিলাম যে আমাদের এই উপমহাদেশ আঠারো শতকের মাঝামাঝির (অর্থাৎ পলাশীর ট্রাজেডির আগে) আগ পর্যন্ত একটি ধণাঢ্য অঞ্চল ছিলো, ইউরোপের মানুষরা এই দেশ সম্পর্কে বলতো ‘A land where milk and honey flows’. স্যারের কাছ থেকে আরো জেনেছিলাম ‘what Bengal thinks today, India thinks tomorrow’ -গোপালকৃষ্ণ গোখলে। স্যারের কাছ থেকেই প্রথম শুনেছিলাম বিজয়ী মহাবীর আলেকজান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে পরাজিত ধৃত পুরু কেমন বীরের মতো বলেছিলেন “আপনার কাছ থেকে আমি সেই আচরণটিই আশা করি, যা একজন রাজার কাছ থেকে আরেকজন রাজা আশা করতে পারে।” নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ার জন্য আর পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের সাক্ষাৎ ঘটেনি। তাছাড়া আমাদের বাংলাদেশে এই বিষয়টি অনেকটাই অবহেলিত। তাই এরপর ছিটেফোটা যেটুকু পড়েছি, তা নিজ আগ্রহেই পড়েছি। বিষয়টির সাথে নতুন করে পুণরায় সাক্ষাৎ হয় ইউরোপে আন্ডারগ্রাজুয়েট কোর্সে পড়তে গিয়ে। ওখানে ছাত্র-ছাত্রী বিজ্ঞান, কলা বা ব্যবসা যেই বিভাগেরই হোক না কেন ইতিহাসের উপর একটি কোর্স তাকে বাধ্যতামূলক করতেই হবে। আমার নব সাক্ষাৎটি হয়েছিলো বেশ পাকাপোক্তভাবেই। কারণ লক্ষ্য করলাম বাধ্যতামূলক কোর্সটি ছাড়াও, সেখানে যে কোন বিষয় পড়ানোর আগে, ঐ বিষয়ের ইতিহাসটি তুলে ধরা হয়। কখনো কখনো কোন একটা টপিক পড়ানোর আগেও তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট-টি বোঝানো হয়। এর ফলে বিষয়টি একেবারেই পাহাড়ী ঝর্ণার জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে যায়।

মাঝে কিশোর বয়সে একবার একটি উপন্যাস পড়েছিলাম যার নাম ‘হৃদয়ের পথে খুঁজো’, যেখানে নায়ক একজন আত্মম্ভরী তরুণ কৌশুলী রাজনীতিবিদ, আর নায়িকা একজন সাদাসিদা মেধাবী তরুণী যে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ছাত্রী। বইয়ের পাতার লেখাগুলো সে মনযোগ দিয়ে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে উচ্চ নম্বর পেয়ে সবার গতানুগতিগ বাহবা কুড়ায়। আর তাতেই সে সন্তষ্ঠ! প্রাতিষ্ঠানিক বিচারে অমেধাবী তরুণ রাজনীতিবিদ ছেলেটি যখন তাদের তরুণ জীবনের প্রথম পরিচয়ের দিনে তাকে প্রশ্ন করেছিলো, “ইতিহাস পড়ছো? তুমি কি নিশ্চিত যে তুমি যা পড়ছো, তার পুরোটাই সত্য অথবা কতটুকু সত্য তুলে ধরতে পারছে, তোমার এই ইতিহাসের বইগুলো??” পরীক্ষার নম্বরের বিচারে মেধাবী তরুণীটি এমন একটি প্রশ্ন ইতিপূর্বে কখনো শোনেওনি, এই নিয়ে ভাবেও নি, তাই তরুণের এই বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন শুনে মুগ্ধ হয়েছিলো। আর মিষ্টি মধুর প্রেম ও পরিশেষে ট্র্যাজিক এই উপন্যাসটির এই পর্যায়ে এসে আমিও একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। আমার মনেও সহসাই প্রশ্ন জেগেছিলো, ‘তবে কি ইতিহাসে আমরা যা পড়ছি, তার সবটুকু সত্যি নয়?’ তবে ধাক্কাটা খুব জোড়েসোরে লাগেনি বা মনের গভীরে ক্ষতও সৃষ্টিই করেনি, কারণ আমার বয়স তখন খুবই কম ছিলো।

এই ধাক্কা নতুন করে লাগতে শুরু করলো গত শতাব্দীর নব্বই-য়ের দিনগুলোতে। পৃথিবীতে তখন একের পর এক ঘটে যাচ্ছে অপ্রত্যাশিত কিন্তু অনিবার্য সব ঘটনা। একসময়ের তৃতীয় বিশ্বের তরুণদের ক্রেজ সমাজতন্ত্রের তখন টালমাটাল অবস্থা। পূর্ব ও পশ্চিমের বিভাজন সৃষ্টিকারী দুইটি মতাদর্শের মাঝামাঝি শান্ত্রীর মতো অটল দাঁড়িয়ে থাকা বার্লিন প্রাচীরের পতন। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পালের গোদা প্রবল প্রতাপশালী পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভরাডুবি অতঃপর তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া। দেশে দেশে একের পর এক সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ও তাদের নেতাদের হয় মৃত্যুদন্ড অথবা পলায়ন, ভাগ্য ভালো থাকলে নিজ দেশেই নিভৃতযাপন। আর এই সব ডামাডোলের মধ্য দিয়ে প্রথমে ইরাকের কুয়েত আগ্রাসন আর তারপর বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বের ঐক্যবদ্ধভাবে ইরাকের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। এইসব কিছু আমাকে নতুন করে ভাবাতে শুরু করলো। এতকাল ইতিহাসে যা পড়েছি তার কতটুকু সত্যি?

আমার এখনো মনে পড়ে ১৯৯০ সালে আমাদের ইতিহাসের ক্লাস নিতে আসা একজন বয়স্ক শিক্ষক যখন আমাদেরকে বোঝাচ্ছিলেন সমাজতন্ত্রের দুর্বল দিকগুলো ও কেন পেরেস্ক্রোয়কা (পুনর্গঠন) প্রয়োজন, আমি তখন অবাক হয়ে উনাকে প্রশ্ন করেছিলাম, “কয়েক বছর আগে একদলীয় কম্যুনিস্ট সরকারের শাসনামলে আপনি কি এই কথাগুলো বলতে পেরেছিলেন? না কি আপনি নিজেই তখন ভিন্ন কথা বলতেন? আপনি এখন যা বলছেন, পূর্বেকার ইতিহাসে তো আমরা ভিন্ন রকম পড়েছি।”

আমার পারিবারিক পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ বামপন্থীদের ছিলেন। তাদের সুবাদে পারিবারিক লাইব্রেরীতে কিছু লালবই (কম্যুনিজম-এর উপর লিখিত বইগুলোকে ঐ নামে ডাকা হতো) ছিলো। আমি মাঝে মাঝে ওগুলো পড়তাম। ঐ কাঁচা বয়সে সমতা, শ্রেণীহীন-শোষণহীন সমাজ ইত্যাদি কথাগুলো দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। আর সেই সময় আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবিদের একটা বিরাট অংশ ঐ মতাদর্শের অনুসারী হওয়ায় তাদের লেখা গল্প-কবিতা-উপন্যাস-গান-সিনেমা-নাটক ও শিল্পে সাম্যবাদী চিন্তা-ভাবনার ছাপ থাকতো, এর দ্বারা আমরা কিশোর-তরুণরাও প্রভাবিত হতাম। আমাদের তখন সাধারণ ধারনা ছিলো যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে রয়েছে শ্রেণীহীন-শোষণহীন সমাজ। পুঁজিবাদের পরবর্তি ও উন্নত ধাপ এটি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশও একসময় ঐ সমাজ ব্যবস্থা গঠন করবে। স্বপ্নের সেই সমাজব্যবস্থা ভিতর থেকে দেখে ও তার টালমাটাল অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে প্রচন্ড মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে শুরু করছিলাম।

বারবার শুধু মনে প্রশ্ন জাগছিলো, তাহলে আমরা লাল বইগুলোতে যা পড়েছিলাম তা কি সত্যি ছিলোনা। ঐ কাঁচা বয়সে ছাপার অক্ষরে কোন কিছু দেখলে তাকে ধ্রুব সত্য মনে করতাম। তদুপরী চোখের সামনে নতুনভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা, ডকুমেন্টারি ফিল্ম, খ্যাতিমান ব্যাক্তিদের টেলিভিশন সাক্ষাৎকার ইত্যাদির মাধ্যমে ক্রমাগত জানতে পারছিলাম যে, অতীতের লেখা ও প্রচার-প্রচারণা গুলোর মধ্যে ছিলো চরম প্রতারণা। আমার এখনো স্পষ্ট মনে করে, মস্কোর রেড স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম একদল মানুষ বিক্ষোভ করছিলো, আমি তাদের প্রশ্ন করেছিলাম, “এতোদিন পর আপনাদের বোধোদয় হলো? আপনারা এতদিন কোথায় ছিলেন?” তারা আমাকে উত্তরে বলেছিলো, ‘মিডিয়া আমাদের সাথে প্রতারণা করেছিলো।” বুঝলাম যে, ছাপার অক্ষরে যা কিছু পড়ি, টেলিভিশন-পেক্ষাগৃহের রঙিন পর্দায় যা কিছু দেখি তার অনেক কিছু প্রতারণামূলকও হতে পারে। তখন মনে মনে নিজেকেই বারবার প্রশ্ন করছিলাম “সত্যের মাপকাঠি কি?”

সম্প্রতি বিশ্বের ইতিহাসে খ্যাতিমান একটি গ্রন্থ আমার হস্তগত হয়েছে। তার কিছু অংশ তুলে দিলাম।

‘ইতিহাস এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিশ্বের সকল জাতি ও গোত্রের কাছে সমভাবে আদরনীয়। কি পন্ডিত কি মূর্খ সকলেই ইতিহাসের মধ্যে উপদেশ অনুসন্ধান করে। ইতিহাস আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে কালচক্রের আবর্তন সকল বিষয় ও বস্তুকেই নিয়ত পরিবর্তন করেছে। একটি রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব ঘটছে, তার ব্যপক বিস্তৃতি পৃথিবীর সমৃদ্ধি আনয়ন করছে, আবার কালের অমোঘ বিধানে তার পতনও ঘটছে।

কিন্তু ইতিহাসের অন্তর্নিহিত শক্তি এই বাহ্য বিবরণের তুলনায় অধিকতর ব্যপক ও তাৎপর্য-মন্ডিত। তা আমাদের সামনে বিষয় ও ঘটনাবলীর কারণ এবং বিকাশ ও বিনাশের মৌলিক উপাদানসমূহকে উদঘাটিত করে। বস্তুত মুসলিম ইতিহাসবিদগণ এই সত্যকে সামনে রেখে ঘটনাবলীর বিবরণ সংগ্রহ ও উহা গ্রন্থাকারে বিন্যস্ত করে গিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তিকালে অনেকেই উক্ত ঘটনাবলীর সাথে মিথ্যা কাহিনী ও কল্পিত বর্ণনার সংযোজন করেছে। বিচার-বিশ্লষণের পরিবর্তে ধারণা ও শ্রুতিনির্ভর কল্পনা ইতিহাস বর্ণনায় তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। পরবর্তি ইতিহাসবিদগণ ক্রমশ এই ধারাকেই অক্ষুন্ন রেখেছে, এবং তাদের এই কল্পিত অতিরঞ্জিত বিবরণই আমাদের নিকট এসে পৌছেছে। এতে সত্যানুসন্ধানের কোন চেষ্টা নাই। বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে কলুষমুক্ত করার কোন প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়না। এর ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, তারা অন্ধ বিশ্বাসের শিকারে পরিণিত হয়েছে এবং বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন লোকদিগের বিবরণের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এই কারণেই সাধারণ মানুষদের মধ্যে অন্ধ বিশ্বাসের এমন ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে।

অসংখ্য ব্যক্তি ইতিহাস রচনায় আত্মনিয়োগ করলেও যথার্থ ইতিহাসবিদের সংখ্যা অতিঁ নগন্য। অনেকে ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে বিস্তারিত বর্ণনার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে ফেলেছেন। আবার অনেকে সমসাময়িক ইতিহাসের বিবরণ দিতে গিয়ে নিজ দেশ, রাষ্ট্র ও অঞ্চলবিশেষের বর্ণনার উপর ইতিহাসকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন। অতঃপর এমন একদল ইতিহাস লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে যারা মানসিকতার দিক থেকে সংকীর্ণ এবং বিশ্বাসের দিক থেকে সম্পুর্ণ অন্ধ ও অবিবেচক। কালচক্রের আবর্তন কিভাবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় এবং তদ্দরুন মানবচরিত্র ও সমাজপ্রগতি কিভাবে বিবর্তিত হয়, তার কার্যকারণ তারা আদৌ উপলদ্ধি করতে পারেনাই। এর ফল দাঁড়িয়েছে যে তাদের বর্ণনা বর্ণনা মাত্রই, এর ভিত্তি জানা যায়নি। তারা কতগুলি পৃষ্ঠা সাজিয়েছেন মাত্র। বিষয় গুরুত্ব বলতে কিছু নাই।

ফলত তাদের সংগৃহিত বিবরণ ঐতিহাসিক দূরদৃষ্টির অভাবে সম্পুর্ণ অন্তসারশূণ্য হয়ে পড়েছে। তারা কোন রাষ্ট্রের বিবরণ দিতে গিয়ে তার উত্থান-পতন ইত্যাদির বিবরণে কার্যকারণ বিশ্লেষেণে কোন প্রকার চেষ্টা করে নাই। সেখানে কেবল রাষ্ট্রশক্তির প্রারম্ভ ও বিনাশের কথাই আছে, একটি রাষ্ট্রশক্তি কিভাবে অন্য একটি শক্তির স্থলাভিষিক্ত হয় – কিভাবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে; সে সম্পর্কে কোন ধারণাই দেয়না। আমার গ্রন্থে উপরোক্ত বিশ্লষণের প্রতি মনোনিবেশ করিব।

এরপর একদল ইতিহাসবিদদের আবির্ভাব ঘটলো যারা সংক্ষিপ্তকরণকেই তাদের মূল লক্ষ্য করলেন। গলে তাদের সংগৃহত ইতিহাস শুধু সম্রাটদের নামের তালিকায় রূপান্তরিত হয়েছিলো। এই সকল বিষয় পর্যালোচনা করে আমি বিশ্লেষণ ভিত্তিক ইতিহাস রচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম, অতীত ঘটনাবলীর রহস্য উদঘাটনে প্রবৃত্ত হইলাম। আশা করি এর ফলে পাঠক অন্ধ-বিশ্বাস ও শ্রুতি নির্ভরতা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে, এবং অতীতের ঘটনাবলীর বিশ্লেষণের আলোকে ভবিষ্যতের চিত্রও নিজের চোখের সম্মুখে দেখতে পাবে।‘

(খ্যাতিমান মুসলিম জ্ঞানতাপস ইবনে খলদুনের (১৩৩২ -১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দ) সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘আল মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থের শুরুর কিছুটা অংশ তুলে ধরলাম)

আসলে ‘ট্রুথ ইন হিষ্ট্রী’ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই চৌদ্দ শতকেই জ্ঞানতাপস ইবনে খলদুন এই বিষয়ের উপর সন্দেহ প্রকাশ করে গিয়েছিলেন। এবং কি করে তার বিচার করতে হয় সেটাও বলেছেন। উনার মৃত্যুর পরেও কয়েক শতাব্দি পেরিয়ে গিয়েছে। আরো অনেক সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটেছে। জন্ম হয়েছে নতুন নতুন মতাদর্শের। ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়েও বিতর্কের অবসান ঘটেনি। আমি বলতে চাই যে, ছাপার অক্ষরে লেখা থাকলেই তা ধ্রুব সত্য নয়। লেখকের মতি-গতি উদ্দেশ্য, সময়কাল, শাসকশ্রেণির প্রভাব থেকে শুরু করে অনেক ফ্যাক্টরই বিবেচনা করে সত্য-অসত্য যাচাই করতে হয়।

ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস নিয়েও ইদানিং বেশ আলোচনা হয়ে নেটে তোলপাড় হচ্ছে। পক্ষে ও বিপক্ষে রেফারেন্স হিসাবে গত শতকের কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করছে। বিষয়টি হলো আটশত বা একহাজার বা দুইহাজার বছর আগের কোন ইতিহাস জানতে চাইলে সেই সময়ের রচিত কোন গ্রন্থেই খুঁজতে হবে। এবার আরো একটা প্রশ্ন জাগে – সেই সময়ে কোন ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়েছিলো কিনা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যা পেলাম – ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসন আরম্ভ হওয়ার পূর্বে কোন ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করা হয়নাই। খোয়ারিজমের আবু রায়হান বিরুনি (আল বিরুনি, ৯৩৭ থেকে ১০৪৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত) সুলতান মাহমুদের হাতে বন্দি হয়ে গজনীতে আনিত হন। অতঃপর একবার মাহমুদের বাহিনীর সাথে পাঞ্জাবে আসেন তিনি। ভারত সম্পর্কে প্রাপ্তব্য সকল সংবাদই তিনি নিষ্ঠার সাথে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। পরে তিনি হিন্দুস্তান (‘তারিখ-আল-হিন্দ’) নাম দিয়ে একখানি বিশ্বকোষের সংকলন করেন। এই বইখানি অমূল্য নানা ঐতিহাসিক তথ্যের ভান্ডার। প্রথম সত্যিকার ইতিহাস অবশ্য রচনা করেন মিনহাজউদ্দিন জুজইয়ানি (জন্ম ১১৯৩ খ্রীষ্টাব্দ) নামে জনৈক পারস্যবাসী। ইনি এর রচিত ইতিবৃত্তখানির নাম দেন এর পৃষ্ঠপোষক সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের নামানুসারে ‘তবাগত-ই-নাসিরি’। চতুর্দশ শতকে ফারসী ভাষায় মূল্যবান নানা ঐতিহাসিক তথ্য সংকলিত করেন জিয়াউদ্দিন বারানি ও শামস্ সিরাজ আফিফ। …… গ্রন্থখানীর নাম দেন ‘তারিখ-ই-ফিরুজ শাহী’। (তথ্যসূত্রঃ ভারতবর্ষের ইতিহাস, গ্রন্থকার: আন্তোনভা, বোনগার্দ-লিভিন-কতোভস্কি), প্রকাশক: প্রগতি প্রকাশনা, মস্কো)।

এবার সত্য-মিথ্যার প্রসঙ্গে আসি। ইতিহাসবিদ তো ইতিহাস লিখেছেন, কিন্তু তিনি কতটুকু সত্য লিখেছেন? কারণ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো, ‘ইতিহাস বিজয়ীদের সম্পদ’। আরও রয়েছে এডলফ হিটলারের প্রচার মন্ত্রী সত্য হন্তারক পল জোসেফ গোয়েবলস-এর ‘বিগ লাই থিওরী’। একটা সিনেমায় দেখেছিলাম, সম্রাট নেপোলিয়ান-এর অভিষেক অনুষ্ঠানে তাঁর মাতা Letizia Ramolino উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু নেপোলিয়ন রাজ-চিত্রকরকে আদেশ দিয়েছিলেন যেন অভিষেক অনুষ্ঠানের পেইনটিং-এ একটি জায়গায় তাঁর মাকে চিত্রিত করা হয়, যাতে ইতিহাস জানে যে তাঁর মাতা অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্মসাল ও বয়স সম্পর্কেও নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে ইংরেজ ইতিহাসবিদদের লেখা কোন কোন বইয়ে মৃত্যুর সময় উনার বয়স দেখানো হয়েছে ১৭ বছর, কোন কোন বইয়ে ১৯ বছর, আবার কোথাও ২১ বছর দেখানো হয়েছে। আবার উনার একটি কন্যা সন্তান (উম্মে জোহরা) ছিলো যার বয়স কোথাও পাঁচ, কোথাও সাত দেখানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো উনার কন্যার বয়স যদি হয় সাত, আর মৃত্যুকালে উনার বয়স যদি হয় উনিশ, তবে কি উনি এগারো বছর বয়সে বিয়ে করে বারো বছর বয়সে সন্তানের পিতা হয়েছিলেন? এইভাবেই সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস রচনাকারীরা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ২০০৫ সালে নোবেল বিজয়ী দার্শনিক-সাহিত্যিক হ্যারল্ড পিন্টার তাঁর নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন -the majority of politicians, on the evidence available to us, are interested not in truth but in power and in the maintenance of that power. To maintain that power it is essential that people remain in ignorance, that they live in ignorance of the truth, even the truth of their own lives. What surrounds us therefore is a vast tapestry of lies, upon which we feed.

তাহলে আমরা কি কেবলই বিভ্রান্তির মধ্যে থাকবো? এমন কোন মাপকাঠি কি নেই যার মাধ্যমে আমরা কোন একটি গ্রন্থের সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারবো?

পরবর্তি পর্বে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
(চলবে)

১,০৭৪ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “ইতিহাস প্রসঙ্গ: সত্য ও মিথ্যার মাপকাঠি – পর্ব ১”

  1. টিটো মোস্তাফিজ

    ছাপার অক্ষরে লেখা থাকলেই তা ধ্রুব সত্য নয়। লেখকের মতি-গতি উদ্দেশ্য, সময়কাল, শাসকশ্রেণির প্রভাব থেকে শুরু করে অনেক ফ্যাক্টরই বিবেচনা করে সত্য-অসত্য যাচাই করতে হয়। :thumbup: :boss:


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন
  2. গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

    এক সময় সবাই ছাপার অক্ষরকে অনেক বেশি বিশ্বাস করত। এখন অবশ্য আর ততটা করে না। এলোমেলো ভাবে কিছু কিছু ইতিহাস পড়ি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, ভারত বিভাগ, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধোত্তর এবং পঁচাত্তর পরবর্তী নানান ঘটনা কয়েকটা সোর্স থেকে পড়তে গেলেই মনে হয়, আমাদের গতানুগতিক ধারণা থেকে ইতিহাস অনেক ভিন্ন। আর, ইতিহাস কাউকেই ছাড় দেয় না, প্রশংসা হয়ত করে, দেবতা বানায় না। কোন একজন ইতিহাসের অধ্যাপকের মুখেই টিভিতে শুনেছিলাম সম্ভবত, কোন ঘটনার ইতিহাস হয়ে উঠতে পঞ্চাশ বছরের মত সময় লাগে। এর আগ পর্যন্ত চলে প্রশংসা আর হেয় করার যুগ। মুক্তিযুদ্ধ এখন সেই ইতিহাস হয়ে ওঠার সময়টা পার করছে। দেখা যাক কী হয়।

    জবাব দিন
  3. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    মাযহারুল হক স্যার আমারও শিক্ষক ছিলেন। আমিও বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়াতে নবম শ্রেণীর পর থেকে তার লেকচার শোনা থেকে বঞ্চিত হই।
    "তাহলে আমরা কি কেবলই বিভ্রান্তির মধ্যে থাকবো? এমন কোন মাপকাঠি কি নেই যার মাধ্যমে আমরা কোন একটি গ্রন্থের সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারবো?" - এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য পরবর্তি পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

    জবাব দিন
  4. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    দ্বিতীয় পর্ব পড়ার পর আবার পড়ে গেলাম ।
    মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম ।
    এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে লেখার প্রাথমিক অবতারনায় মনে হচ্ছে একখানা ওজনদার পান্ডুলিপি তৈরী হতে যাচ্ছে ধারাবাহিক এই লেখায় ইতিহাস বিশ্লেষণের অসচরাচর আলোচিত বিষয়টি নিয়ে ।
    সাধুবাদ সেই প্রচাষ্টাকে ।
    দীর্ঘতর সময় ধরে পড়ে যাবার প্রত্যাশা থাকলো ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।