জীবনের সমীকরণ

“ … … … আয় খোদা, রহমান,
ভেস্ত নাজেল করিও সকল মৃত্যু-ব্যাথিত প্রান।”
– “কবর”, জসীম উদ্দিন

২রা ডিসেম্বর ২০২০

জীবনের সমীকরণ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। রক্তের সম্পর্কের বাইরেও, কালেভদ্রে দেখা বা সাক্ষাৎ হওয়া মানুষজনদের সাথেও কিভাবে যেন জীবনের মায়ার জাল বিস্তৃত হয়েই চলেছে। করোনাকালে বেশ কয়েকজন নিকট আত্মীয়ের মহাপ্রস্থান হলো। আজকের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘনিষ্টজনদের মধ্যে এই দূর্যোগকালীন সময়ে যাঁরা গত হলেন, তাঁদের বয়স ৬০ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে।

কাছের মানুষদের প্রথম করোনায় মৃত্যুর সংবাদটি ছিল আমার এক খালা-সম্পর্কের আত্মীয়ার, তিনি আমার বড়মামীর ইমিডিয়েট ছোট বোন, যাঁর সাথে সেই ছোট্টকাল থেকেই আমার ঘনিষ্টতা ছিল। রংপুরে থাকতেন। ক্যাডেট কলেজে যখন পড়তাম, ছুটিতে যাবার প্রাক্কালে কিংবা ছুটি থেকে ফিরে তাঁর বাসায় অন্তত একবেলার অবস্থান/বিশ্রাম হতো আমার। আমার প্রতি স্নেহের প্রকাশের অভাব ছিল না তাঁর মধ্যে, অথচ তিনি আমার রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন না। মৃত্যুকালে তিনি সম্ভবতঃ ৬০-এর কাছাকাছি বয়সের ছিলেন। করোনা তাঁকে আর বেশিদিন জীবনটাকে দেখতে দিল না।

এর কিছুদিন পরে বার্ধক্যজনিত সমস্যায় প্রায় ৯০ বছর বয়সে বিদায় নিলেন আমাদের পরিবারের একটা জেনারেশনের একমাত্র মুরুব্বী ব্যাক্তিটি, আমার ভালবাসার নানু। নানুকে নিয়ে আমার স্মৃতির ভাণ্ডার কখনোই ফুরোবার নয়। নানুবাড়ির আমার কোন কাজিনই মনে হয় নানুর স্মৃতিকে সহজে ভুলতে পারবে না। কি অসাধারন স্নেহময়ী এবং পরিশ্রমী একজন নারী ছিলেন তিনি। গ্রামের মানুষ হয়েও প্রতিটি কাজে তাঁর ছিল অসাধারণ শৈল্পিক ছোঁয়া, যার শিক্ষা পেয়েছিলেন আমাদের মা-খালা-রা। আমাদের ছোট্টবেলার শীতের সময়ের স্কুল ছুটির দিনগুলোতে লেপের নিচে সবাই মিলে নানুর কাছে শোনা গল্পের স্মৃতি আমার কাছে এখনও জীবন্ত। তাঁর মুখের “ভাইয়া” ডাকটা এখনো কানে বাজে।

এরপরে বিদায় নিলেন আমার চাচা-শশুর। ৮০-র কাছাকাছি বয়স হবে হয়তো। অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ব্যাঙ্কার ছিলেন। ভুগছিলেন নানান বার্ধক্য জটিলতায়। করোনাকালে বাসা থেকে অতি প্রয়োজন ছাড়া আমরা বের না হলেও আমার চাচা-শশুরকে যেদিন হাস্পাতালের আইসিউতে দেখতে গেলাম, ঠিক তার পরদিন খুব সকালে তাঁর মৃত্যু সংবাদে ঘুম ভেঙেছিল। রাস্তার জ্যামের কারনে জানাজায় শরিক হতে না পেরে সরাসরি গোরস্থানে তাঁর দাফনে অংশ নিয়েছিলাম। তিনি আমার শশুরের, অর্থাৎ আমার স্ত্রীর বাবার ইমিডিয়েট বড় ভাই, আবার আমাদের বিয়েতে তিনিই ছিলেন উকিল বাবা/শশুর। তাঁকে আমি খুব পছন্দ করতাম। আমাদের বিয়ের পরের সেই দিনগুলোতে আমার স্ত্রী-কে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে মাঝেমাঝে থাকতে হতো, তখন সময় কাটানোর জন্য মাঝে-মাঝে একাই আমি তাঁদের বাসায় যেতাম, এবং তিনি আমাকে যথেষ্ট সময় দিতেন। তাঁর সাথে গল্প করতে আমার ভাল লাগতো। শুনেছি, তাঁর এ্যাক্টিভ জীবনে আত্মীয়-স্বজনদের জন্য তিনি একজন সাপোর্টিভ পার্সোনালিটি ছিলেন।

প্রায় ৭০ বছর বয়সী আমার এক ফুপা মারা গেলেন মাত্র ক’দিন আগে। তিনি আমার বাবার ছোট বোনের স্বামী, যিনি গত ১৪ বছর যাবৎ মাত্র কুড়ি বছর বয়সী পুত্রসন্তান হারানোর শোক বুকে ধারন করে বেঁচে ছিলেন। ফুপা মারা যাবার দুদিন পরে আমার ফুপুর সাথে ফোনে কথা বলেছি। আসলে কথা বলার সাহস কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। ফুপা গ্রামের মানুষ। সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাস্ত থাকাতে ভালবাসতেন। মারাও গেলেন বলতে গেলে সেই কাজের মধ্যেই। সম্ভবতঃ গ্রামের অদুরেই বাজার এলাকায় তাঁর বাবার নামে করা স্কুলের কোন কাজ শেষে মোটর-বাইকে উঠে স্টার্ট দেবার পরেই তিনি ব্রেইন স্ট্রোক করে পড়ে যান। একটা চলমান জীবন নিমিষেই নাই হয়ে গেল।

এই দূর্যোগকালের সর্বশেষ সংযোজনটি হলো গতকাল (১লা ডিসেম্বর ২০২০) এক নারীর, যার বয়স হয়তো বা ৩৫-এর আসেপাশে। আমার মোটেও রক্ত-সম্পর্কের নয়। খুব বেশি যে তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে, তাও নয়। তবে কেন যেন এই মৃত্যুটি বেশ নাড়া দিয়েছে আমাকে। সম্পর্কে আমার ছোট এক খালাতো ভাইয়ের স্ত্রী। সম্ভবতঃ, করোনা সাস্পেক্টেড ছিল; টেস্ট করার আগেই তাকে বিদায় নিতে হলো। কি সুন্দর মায়াবী ছোট্ট একটা ছেলে তাদের, কতই বা বয়স হবে, ১০-এর নিচেই হবে নিশ্চয়ই। তাদের বিয়েটা ছিল নিজেদের মধ্যে পূর্বপরিচয়ের। তাদের বিয়ের বৌভাত পর্বে আমি সস্ত্রীক ঢাকা থেকে রংপুরে গিয়ে এটেন্ড করেছিলাম; আমার পরিবারের অন্য সদস্যরাও সেই অনুষ্ঠানে ছিলেন। ছোটবোন সম্পর্কের/পর্যায়ের এই ভাতৃবধুর সাথে আমার খুব বেশি একটা দেখা বা সাক্ষাৎ হতো না। রংপুর ক্যাডেট কলেজের কোন অনুষ্ঠানে গেলে, তা সে সপরিবারে কিংবা একা হলেও, আমি রংপুরে আমার মেজোখালাকে ক্ষণিক সময়ের জন্য হলেও দেখত যাই; খালাম্মা বেশ অসুস্থ অবস্থায় আছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। ক্যাডেট কলেজের কোন প্রোগ্রামের কোন ইভেন্ট মিস করতে চাই না। কাজেই সুদূর রংপুরে ক্ষণিকের জন্য যাওয়া হলে মামা-চাচা-খালার বাসায় খুবই অল্প সময়ের জন্য শুধুই দেখা করতে যাওয়া হয়। অথচ চাকরীজীবি এবং নিজ হাতে শশুর-শাশুড়ী-সহ পুরো পরিবার সামলানো আমার এই ভাতৃবধুটি কোনদিনই আদর-আপ্যায়নের বা আন্তরিকতার কোন ত্রুটি করেনি। দেখা-সাক্ষাৎ খুব একটা হতো না, অথচ এমন হাসিমুখে গ্রহন করতো যেন, আমি তার বাবার বাড়ি থেকে হাতে অল্প সময় নিয়ে বেড়াতে আসা তার আপন বড় ভাই। যেহেতু ক্যাডেট কলেজের কোন প্রোগ্রাম ছাড়া আলাদা কোন ইস্যুতে রংপুরে এখন আর যাওয়া হয় না, আর ক্যাডেট কলেজেই যেহেতু আমাদের সকল মিল/আহার-এর ব্যাবস্থা থাকে, কাজেই খালাম্মার বাসায় আমার/আমাদের এই ঝটিকা সফরে খাওয়া-দাওয়ার পর্বটি এ্যভয়েড করতে চাইতাম। বলা চলে, ক্যাডেট কলেজের প্রোগ্রামগুলোতে থাকার লোভে দৌড়ের উপরেই থাকা হয় রংপুরে দুয়েকজন নিকটাত্মীয়ের সাথে দেখা করার পর্বটিতে। এরই মধ্যে দেখা যেত, আমার এই ভাতৃবধু টেবিলে ভাত-তরকারি সাজিয়ে ফেলেছে, কিংবা অসময়ে আমি/আমরা গিয়ে থাকলে কিছু না কিছু খাবার সামনে নিয়ে চলে এসেছে, যেন সে জানতো তার এই ভাইটি দেখা করেই বেড়িয়ে পড়বে। সারাদিনের অফিস-সংসারের ব্যাস্ততার মাঝেও সেই অল্প সময়ের আমার/আমাদের ঝটিকা মুহূর্তেও তার মুখের হাসিটি ম্লান হতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। প্রায় সময়ই এমন হয়েছে যে, তার আপ্যায়নের জোরাজুরিতে হয়তো তাকে বলেছি, “পারলে এক কাপ চা দাও, আমি খেয়েই দৌড়াবো।” আমি তার কাছে চা চেয়েছি আর সে দিতে দেরি করেছে, এমনটা হয়নি কোনবারেই। নেই সরাসরি কোন রক্তের সম্পর্ক, তারপরেও রংপুরে গিয়ে আমার মতন তাড়াহুড়ো করা ভাশুর সম্পর্কের বড় ভাইয়ের জন্য তার যে শ্রদ্ধা এবং তাৎক্ষণিক আপ্যায়ন-অভ্যর্থনা ছিল, তা কি কখনো ভোলা যায়। মেয়েটার জন্য আজ বড্ড বেশি মায়া লাগছে। মনটা বেশ খারাপ হয়ে আছে। জীবনটাকে সে কতখানি দেখতে পেলো? তাদের বাচ্চাটার কথা ভাবছি বারবার। জীবনের সমীকরণ আসলেই আমাদের হিসেবের নাগালের অনেক-অনেক দূরে।

লেখাটা শুরু করেছিলাম পল্লিকবি জসীম উদ্দিনের “কবর” কবিতার শেষ দেড়-লাইনের উদ্ধৃতি দিতে। এই প্রার্থনাটা ছাড়া আজ আর আমার কি-ই বা করার আছে।

১,৯৬২ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “জীবনের সমীকরণ”

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।