বাবা এণ্ড কোং … ২১শে জুন ২০২০

সার্টিফিকেটে লেখা জন্ম তারিখ অনুযায়ী ব্যাক্তিজীবনে প্রফেসর সুলতান আলমের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮-এর ডিসেম্বরের ৫ তারিখে। কিন্তু বাবা হিসেবে এই একই মানুষটার জন্ম হয় ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখে ভোর ৩টার দিকে। আবার বাবা হিসেবে আমার জন্ম ২০১২-এর ৩০শে সেপ্টেম্বরের প্রথম বিকেলে। ঘড়ির কাঁটায় সময়টা মনে নেই, তবে লাঞ্চের পরপরই ছিল সেই মুহূর্তটা, এটুকু মনে আছে। সেদিন লাঞ্চটা ঠিকমত করতে পারিনি, সেজন্যই সম্ভবত পড়ন্ত দুপুর বা প্রথম বিকেল, এই সময়টা মনে পড়ছে।

বাবা হবার, বিশেষ করে প্রত্যেক পুরুষের জীবনে প্রথমবার বাবা হবার অনুভুতিটা অন্যরকমের। তবে আমার বাবার বাবা হওয়া আর আমার বাবা হওয়া যে একই রকমের অনুভুতির ছিল না, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। আমার বাবা বাবা হয়েছিলেন না জেনেই, সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে হচ্ছে। আর আমি বিজ্ঞানের জোরে জেনেশুনেই ছেলের বাবা হতে যাচ্ছিলাম, যেটাতে আমার বাবার মন কিছুটা ভার ছিল। তবে বিজ্ঞানের পূর্বাভাসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমাদের মেয়ে দূনিয়ার বুকে এসে আমাকে বাবা বানানোতে যে মানুষটা হাস্পাতালে আনন্দের অতিশায্যে চিৎকার দিয়ে উঠেছিলেন, সেটাই আমার বাবা।

যাহোক, বাবা হবার পরে আমার তেমন কোন পরিবর্তন বুঝিনি, এখনো বুঝিনা। মেয়েকে প্রথম কোলে নিয়ে চোখে পানি চলে এসেছিল, এটুকুই যা, আর এখন মেয়ের জ্বর হলে বা শরীর কিংবা মন খারাপ হলে আমারো অনেক খারাপ লাগে, এটুকুই। মেয়ের মা যেহেতু মেয়েকে নিয়ে অতিরিক্ত ব্যাস্ত, কাজেই আমার মতন ফাঁকিবাজ এবং সুযোগ বুঝে ক্রেডিট পেয়ে যাওয়া বাবারা এমন মায়েদের সিনসিয়ারিটির ফাঁক-ফোকড় দিয়েই বেরিয়ে যায়। শুধু মেয়ে যখন গলাটা জড়িয়ে ধরে চুমু দেয়, কিংবা তার মায়ের বকা খেলে ছল-ছল চোখে ঠোঁট উল্টিয়ে গাল ফুলিয়ে আমাকে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় জড়িয়ে ধরে, তখন কেমন যেন উদাস হয়ে যাই। মনে হতে থাকে, “কেন পীরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু, ছেড়ে যাইবা যদি।” বাবাই যে একটা মেয়ের প্রথম প্রেম, সেটা বুঝতেই থাকি, বুঝতেই থাকি। বাবা হওয়ায় তেমন কোন আলাদা বা আলগা ফিলিংস পাই না; শুধু ঘুমানোর সময় মেয়ে যদি আমার কোলের ভিতরে ঢুকে না থাকে, কিংবা আমাকে কোল বালিশের মতন জড়িয়ে না ধরে, তাহলেই শুধু অস্বস্তি লাগে। এটা মনে হয় কোন ফিলিংস না, অভ্যাসের কারনেই হয়, তাই না?

যাহোক, তবে ছেলে হিসেবে আবার প্রথম হীরো আমার সেই বাবাই। আমি বাপিমনি ডাকি। ছোটবেলায় ডাকতাম। এখনো তাইই ডাকি। বন্ধুরা হাসাহাসি করে। করুক। আমার হীরোকে আমি কি নামে ডাকব, সেটাতে কে হাসল, তাতে আমার কি আসে যায়!

তবে ইডিপাস কমপ্লেক্সের সূত্র ধরে বাবাদের সাথে ছেলেদের যে ইন্টার-জেনারেশনাল কনফ্লিক্টস বা ডিজেগ্রিমেন্টস থাকে, তা আর সবার মতন আমার জীবনেও ছিল-আছে এবং হয়তো থেকেই যাবে। থাকুক। জগতের নিয়ম। এটাই যদি স্বাভাবিকভাবে ভালবাসাকে জেনারেশন থেকে জেনারেশনে বহন করে নিয়ে যায়, তো যাক।

তবে যাই হোক, যে যাই বলুক, বাবাই আমার হীরো। প্রথম নয়, একমাত্র। বাবার প্রফেশনে যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না, এবং এটা মারাত্মক রকমের সত্যি কথা। বাবাও চাইতেন না যে, আমি শিক্ষকতায় আসি। প্রথম জীবনে হঠাৎ কর্পোরেটে চাকরি ছেড়ে দেয়া, এবং ফলশ্রিতেত বাবার বাক্যবাণে প্রতিমুহূর্ত জর্জরিত হওয়া, বাবা ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি। বাবা সে দিনগুলোতে ভীষণ বিরক্ত ছিলেন আমার ওপরে। তারপরে কিভাবে যেন গত ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাবার পেশাতেই আটকা পড়ে থাকলাম।

বাবারা চান সন্তানেরা সেটাই ছুঁয়ে যাক, যেটা তাঁরা কালের পরিক্রমায় ছুঁতে পারেননি। আমার বাবার কাছে মাত্র কিছুদিন আগে জানলাম, তাঁর শিক্ষকতার জীবনের শুরুর দিকে কিভাবে নানান চক্র-পরিক্রমায় তাঁর জীবনে আর এমফিল-পিএইচডির মতন হায়ার স্টাডিজে যোগদান সম্ভব হয়নি। আবার এটাও শুনেছি, তাঁরই ক্লাসের লেকচারের কম্পাইল্ড কালেকশন থেকে কিভাবে বাজারে অন্যের লেখা বইয়ে বা নোটে ছাপ চলে এসেছিল একসময়, এবং যার ছাপ তিনি পরীক্ষক হিসেবে বিভিন্ন পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতাতেও দেখেছেন। যাহোক, চাকরী থেকে অবসর নেয়া এই বাবাই আমার উচ্চশিক্ষার যাবতীয় খরচ বহন করে চলেছেন। প্রায়ই খোঁজখবর নেন, আমার কাজ কতদূর এগুলো। কাজের অগ্রগতি ধীরে হচ্ছে শুনলে তিনিই আমাকে তাগাদা দিয়ে যান, যেন ডিগ্রীটা আমার নয়, তাঁরই দরকার।

আমার এই বাবাটাই তাঁর নিজের বাবার জীবনের শেষ সময়গুলোতে দেশের সর্বোত্তরে অবস্থিত আমাদের গ্রামের বাড়ির কাছাকাছি জেলা শহরের কর্মস্থলে থাকার চেষ্টা করেছেন। ঢাকা শহরের ডেপুটেশনের এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পোস্টিং ফেলে জেলা শহরের সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি নিজেই স্বেচ্ছায় বদলির অবস্থান নেন। যদি সন্তান হিসেবে আমি তাঁর সামান্য আদর্শও ধারণ করতে পারি, আর তার কিছুটা যদি বাবা হিসেবে আমি আমার সন্তানকে শিখিয়ে দিতে পারি, তবেই একজন সন্তান এবং বাবা হিসেবে নিজেকে স্বার্থক ভাবতে পারব।

কেবল জন্মদাতাই যে বাবা, একথার অন্যপিঠে, আজকের অনুধাবন মনে হয় কিছুটা ভিন্নতার দাবী রাখে। বিয়ের পরে আমার স্ত্রীর বাবাকে জীবনে নতুন করে সংযোজিত বাবা হিসেবে পেলাম, যার সাথে বেশ কিছু বিষয়েই আমার বাবার বিস্তর ফারাক। বাবা শিক্ষক, আর শ্বশুর ব্যাঙ্কার। বাবা মেজাজি মানুষ, আর শশুর পুরোই উল্টো ধাঁচে গড়া মানুষ। বাবা সমজাবিজ্ঞানের মানুষ, আর শশুর একাউন্টিং-এর। পেশাগত কারনেও উভয়ের এক্সপ্রেশন প্যাটার্ণের অনেক পার্থক্য। মিল শুধু এক জায়গাতেই, দুজনেই অনেক-অনেক উদার। তবে এই উদারতাতেও পার্থক্য খেয়াল করার মত; আমার শ্বশুর নরম মনের হওয়াতে মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ্য, আর আমার বাবার কড়া নিয়ম কানুনের ধাঁচে ভালবাসাটা গোপন সেবায়, প্রায় অপ্রকাশ্যের মতই, এবং মজার কথা হলো আমার দাদাও এমনটাই ছিলেন। বেশ অদ্ভুত পার্থক্য আমার বাবা এবং শ্বশুরের মাঝে; টার্গেট সেইম, পলিসি আলাদা। হা হা হা…

আবার ক্যাডেট কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কর্মক্ষেত্র, সর্বক্ষেত্রেই চলার পথে আরো বেশ কিছু বাবা পেয়েছি। তাঁদের অবদানও শ্রদ্ধার সাথে সর্বদাই স্মরণ করি। আর সবচেয়ে মজার কথা হলো, এঁদের প্রত্যেকেই ইউনিক। কারো সাথেই কারো মিল নেই, তারপরেও আমার জীবনে প্রত্যেকেই মিশে আছেন। আজকের বাবা দিবসের প্রথম প্রহরে পৃথিবীর সকল বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা।

বাবাদিবস২০২০

৩,৬৪৯ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “বাবা এণ্ড কোং … ২১শে জুন ২০২০”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    নিজ বাবা এবং জগতের তাবত বাবাদের প্রতি এ শ্রদ্ধাঞ্জলি খুব সুন্দর হয়েছে। "বাবা এণ্ড কোং" শিরোনামটাও বেশ অভিনব।
    আমার বাবার সাথে কখনো আমার কোন ছবি তোলা হয়নি। তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৮৮ এর মে মাসে, এবং তার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৮৭ সালের জুন মাসে। আফসোস, তখন এখনকার মত স্মার্টফোন ছিল না!

    জবাব দিন
    • আহমদ (৮৮-৯৪)

      ভাইয়া, সালাম নেবেন। অনেকদিন পরে একটা পোস্ট এডিট করতে সিসিবিতে আসা। এসেই দেখি আপনার মন্তব্য। আপনার মতন গুণী মানুষের এই ভার্চুয়াল সান্যিধ্য আমার মতন অনেককেই প্রসিদ্ধ করছে (যদিও আমাদের সম্মুখ সাক্ষাত মাত্র একদিনের, ক্লাবের সেই বইমেলায়)। ভাল থাকবেন, ভাইয়া।


      চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।