ভিডিও গেম এখনও শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছুতে পারেনি মেনে নিলে সিনেমাই পৃথিবীর আধুনিকতম শিল্প। পাঠ্যপুস্তকে যা আছে তা থেকে মনে হয় এর ইতিহাসটা ১০০ বছর বা খুব বেশি হলে ১৫০ বছরের। কিন্তু আমি এক প্রাগৈতিহাসিক অনুপ্রেরণায় বা কিছু হারানো স্বপ্নের তাগিদে ইতিহাসটাকে কয়েক সহস্রাব্দ পিছিয়ে দেব, যদি ৩২ সহস্রাব্দকে আপনাদের মাত্র কয়েক সহস্রাব্দ মনে হয়। এই নিয়মে সিনেমার ইতিহাসটা শুরু হবে তুষার যুগের এক মানব গোষ্ঠীকে দিয়ে যারা ফ্রান্সের শোভে (Chauvet) গুহার আশপাশে বসবাস করতো আজ থেকে অন্ততপক্ষে ৩২,০০০ বছর পূর্বে।
সেই মানুষেরা কোন আগন্তুক নয়, তারা আমাদের পূর্বপুরুষ। কিন্তু তাদের আধ্যাত্মিক চেতনা আর মননের অর্থটা আমি বুঝেছিলাম সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক‘ (১৯৯২) সিনেমা দেখে। আগন্তুকের প্রেক্ষাপটটা এমন- এক স্বপ্নবাজ একরোখা যুবক অনেক আগে তার ঘর-সংসার-পরিবার ত্যাগ করে বেড়িয়ে পড়েছিল আদিম ঐতিহ্যের টানে। এরপর পেরিয়ে গেছে তিন দশক, সেই বেপরোয়া বিচ্ছু আজ প্রৌঢ়, কিন্তু না, অন্য আট দশজন প্রৌঢ়র মত তার জীবনটাকে চালসের গান দিয়ে মাপা যাবে না। সে ঘর ছেড়েছিল প্রকৃতির সবচেয়ে কাছাকাছি বসবাসকারী আদিবাসীদের বন্ধু বা আত্মীয় হতে। আমেরিকা, আফ্রিকা আর ইউরোপ মহাদেশের পাট চুকিয়ে এবার সে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের গান শুনতে যাচ্ছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে দিল্লীতে নামার পর কোলকাতায় নিজ বাড়ির টান অনুভব করে, দেখা করে যেতে চায় বর্তমানে জীবিত তার একমাত্র আত্মীয়, ভাগ্নীর সাথে।
বাড়ি এলে ভাগ্নী তাকে অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেই ফেলে- কেন ঘর ছেড়েছিলেন? উত্তর দিতে গিয়ে প্রৌঢ়র মুখে হুবহু সেই স্বপ্নকাতর যুবকের ছাপ ফুটে উঠে। সে বলে চলে-
“ছেলেবেলায় প্রচণ্ড ভাল ছবি আঁকতাম। তো আমি ঠিক করেছিলাম কলেজের পড়া শেষ করে আর্ট স্কুলে ভর্তি হব। একদিন হল কি, আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, হাতে একটা বিদেশী পত্রিকা এল। খুলে দেখি পাতা জোড়া বাইসনের ছবি। ফটো নয়, হাতে আঁকা… সে শিং বাড়িয়ে চার্জ করছে। জান মা, সে এক আশ্চর্য ছবি, এমন তেজ, এমন দৃপ্ত ভঙ্গি, যেন দা ভিঞ্চিকে হার মানিয়ে দেয়। কে এঁকেছে এই ছবি, কে সেই অসামান্য শিল্পী? ছবির নিচে দেখি লেখা আছে, যে আজ থেকে বিশ হাজার বছর আগে প্রস্তর যুগে স্পেনের আলতামিরা অঞ্চলে একজন আদিম গুহাবাসী এঁকেছিল এই ছবি। ব্যাপারটা এমনই অদ্ভূত যে মনে মনে বললাম- ‘তোমার খুনে দণ্ডবৎ বাইসন ভায়া, আমি জীবনে আর যাই হই না কেন কিছুতেই আর্টিস্ট হব না। কেননা দুনিয়ায় এমন কোন আর্ট স্কুল নেই যা আমাকে এইরকম বাইসন আঁকতে শেখাতে পারে।’ সেই থেকে সভ্য ব্যাপারটা কি আর অসভ্য ব্যাপারটাই বা কি এই নিয়ে একটা গভীর কৌতুহল আমার মনে জেগে উঠেছিল। আর তার সঙ্গে যোগ হল ভানডেরলুস্ট (ভ্রমণের নেশা), এই দুয়ে মিলে আমাকে দেশছাড়া করেছিল।”
ভানডেরলুস্ট (Wanderlust) অতোটা নেই বলেই হয়তো আমি আগন্তুক মহাশয়ের মত এখনও ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়িনি। কিন্তু বাইসনের নেশা আমাকে খুব ভালমতোই পেয়ে বসেছে। সে নেশার চিতায় ঘি ঢেলেছে ভের্নার হেরৎসগের সিনেমা ‘কেইভ অফ ফরগটেন ড্রিমস‘ (২০১০)। এবার আলতামিরা নয় হেরৎসগের ক্যামেরায় ভর করে পৌঁছে গেলাম ফ্রান্সের শোভে গুহার অন্ধগর্ভে। গিয়ে দেখি গুহার দেয়ালে ছবির ছড়াছড়ি। বিজ্ঞানীদের মতে ৩২,০০০ বছর পূর্বে খুব সম্ভবত পেশাদার চিত্রশিল্পীরা এসব ছবি আঁকতো, আর মানুষেরা সব গুহার নিকশ অন্ধকারে মশালের ক্ষীণ আলোয় বিভোর হয়ে তা দেখতো। এই গুহায় বাস করতো না কেউ, এখানে তারা আসতো কেবল অন্তরটাকে রিচার্জ করতে।
প্যালিওলিথিক যুগের মানুষেরা যেভাবে গুহার দেয়ালটি দেখতো একবিংশ শতকের ক্যামেরা আর ত্রিমাত্রিক প্রযুক্তির সাহায্যে ঠিক সেই আবহটা তৈরি করলেন হেরৎসগ। তারপর শক্ত জার্মান উচ্চারণের ইংরেজিতে বলে চললেন, ‘For these Paleolithic painters, the play of light and shadows from their torches could possibly have looked something like this. For them, the animals perhaps appeared moving, living. We should note that the artists painted this bison with eight legs, suggesting movement, almost a form of proto-cinema. The walls themselves are not flat but have their own three-dimensional dynamic, their own movement, which was utilized by the artists. In the upper left corner, another multilegged animal. And the rhino to the right seems also to have the illusion of movement, like frames in an animated film.’
এই সমৃদ্ধ অতীতের উৎপাদ আমরা সবাই। যে অতীতের মানুষেরা একই প্রাণীর একেক ভঙ্গির ছবি পরপর এঁকে এনিমেশনের আবহ তৈরির চেষ্টা করতো। তারপরও কিভাবে বলি যে চলচ্চিত্র আধুনিকতার সৃষ্টি? অবশ্যই প্রযুক্তিটি উনবিংশ শতকের মানুষের, কিন্তু সেই প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের যে স্বপ্ন রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ পেয়েছে সেই স্বপ্নটা যে বহু পুরনো। সেই স্বপ্ন দেখতেন আমাদের ত্রিশ সহস্রাব্দ আগের পূর্বপুরুষেরা। সেই ভুলে যাওয়া স্বপ্নটা আমরা বোঝার চেষ্টা করি তাদের আর্টের মাধ্যমে। ছবিকে আমরা প্রশ্ন করি, তোমার আঁকিয়ে বা তোমার দর্শকেরা কি কাঁদতো? হাসতো? কি ছিল তাদের অন্তরের হাসিকান্নার রহস্য? আমাদের মতোই কি স্কেলের এক প্রান্তে হাসি আর অন্য প্রান্তে কান্নাকে রেখে মধ্যিখানে তাদের অসীম সংখ্যক অনুভূতির দাগ ছিল?
অনুভূতির এই স্কেল দিয়ে অন্য আট দশটা শিল্পের মতোই মানুষকে মেপে চলে সিনেমা। তবে সিনেমার সুবিধা হচ্ছে সে নির্লজ্জভাবে অন্য সব শিল্প থেকে ধার নিতে পারে, এমনকি কখনও কখনও ভব্যতার সব সীমা অতিক্রম করে ভিন্ন শিল্পকে পুরোপুরি অধিগ্রহণ করে বসে। বত্রিশ সহস্রাব্দ পূর্বের সেই স্বপ্নটাকে ঘুমের কোল থেকে নামিয়ে আনার জন্য তাই উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিলেন ফ্রান্সের দুই ভাই- অগুস্ত লুমিয়ে এবং লুই লুমিয়ে। শোভে গুহার মানুষেরা জানতে পারেনি যে তাদের খুব কাছের প্রতিবেশীরাই তাদের ঘুমকাতর মাথায় প্রথম হাত রাখবে, ঠিক যেমন লুমিয়ে ভাইরাও জানতে পারেনি তাদের সিনেমাটোগ্রাফ উদ্ভাবনের ১০০ বছর পর ১৯৯৪ সালে তাদের দেশের আর্দেশ নদীর কাছেই পাওয়া যাবে প্রাক-সিনেমার কল্পকারদের সন্ধান।
তবে সিনেমার ইতিহাসটা অবশ্যই এত রৈখিক নয়। সিনেমা রূপকথার মত শোভে বা আলতামিরা গুহার ভেতরের দেয়ালে লুকিয়ে থাকা কোন গুপ্তধন নয় যা উনবিংশ শতাব্দীতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এটা মানুষের ভয়ানক অরৈখিক ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি, আর প্রতিটি মানুষের বিশৃঙ্খল অরৈখিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। সেই ইতিহাসের একটা সারসংক্ষেপ পাওয়া যেতে পারে ইউটিউবের এই ভিডিওতে। আমি ইতিহাসবিদ বা ইতিহাসের একনিষ্ঠ পাঠক নই, ইতিহাসকে তাই ব্যবহার করছি নিজের স্বার্থে।
লুমিয়ে ভাইদের একটি সিনেমাই প্রথম বারের মত চলচ্চিত্রকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ১৮৯৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই অতি সংক্ষিপ্ত সিনেমার পুরো নাম ‘লারিভে দ্যঁ ত্রাঁ অঁ গারে দে লা সোতা’ (L’Arrivée d’un train en gare de La Ciotat), ইংরেজিতে ‘The Arrival of a Train at La Ciotat Station’, বাংলায় ‘লা সোতা স্টেশনে একটি ট্রেনের আগমন’। সংক্ষেপে কেবল ‘লারিভে দ্যঁ ত্রাঁ’ (একটি ট্রেনের আগমন) বলা যায়। সিনেমার ইতিহাস বর্ণনার শুরুটা এর মাধ্যমে করাটাই যুক্তিযুক্ত মনে হল। এটাও আমার একটা স্বপ্নের মত, শোভে গুহার মানুষদের মত অতো মৌলিক স্বপ্ন দেখা আমার কর্ম নয়, তাই অন্যের স্বপ্নের বারোটা বাজানোই হয়ে উঠেছে আমার স্বপ্ন। ইচ্ছা আছে ১৮৯৬ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত প্রতি বছরের সেরা একটি সিনেমা নিয়ে লিখে যাব। কবে নাগাদ ২০১২ তে পৌঁছাব সেটা অবশ্য পুরোপুরিই নির্ভর করে আমার অরৈখিক জীবনের বাঁকগুলোর উপর। তবে বাইসনের খুনের শপথ করে বলছি একদিন না একদিন শেষ করবোই।
আপাতদৃষ্টিতে ৫০ সেকেন্ডের সিনেমা লারিভে দ্যঁ ত্রাঁ-কে খুব সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু চাইলেই এ থেকে বের করে আনা যাবে রাজ্যের মনি-মুক্তো। ১৮৯৫ সালের কোন এক সময় ফ্রান্সের লা সোতা শহরের রেলস্টেশনে চলচ্চিত্রটি ধারণ করেছিলেন লুমিয়ে ভাইরা। এমন অনেকগুলো ছোট ছোট প্রামাণ্য চিত্র একসাথে মানুষের সামনে প্রদর্শন করতেন তারা। প্রতিটি চিত্র একটি নম্বর দিয়ে চিহ্নিত থাকতো, যেমন এটির নম্বর ৬৫৩। অবশ্য ৬৫৩ নম্বরের অধীনে দুটো সিনেমা আছে, দুটোর নামই লারিভে দ্যঁ ত্রাঁ, পার্থক্য শুধু একটি দৃশ্যে। একটি সংস্করণে দেখা যায় একজন মা তার ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে রেললাইনের বেশ কাছ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর যে সংস্করণের ভিডিও দিলাম তাতে ব্যতিক্রমধর্মী দৃশ্য হচ্ছে, একটি লোক ট্রেন থেকে নেমে ক্যামেরা তথা লুমিয়ে ভাইদের সিনেমাটোগ্রাফ দেখতে পায়, হয়তো বুঝতে পারে সে কোন যন্ত্রের সামনে পড়ে গেছে; নিজেকে শট থেকে সরিয়ে নিতে চায়, কিন্তু ক্যামেরার প্রতি আগ্রহও থেকে যায়, তাই সে উল্টো হয়ে হাঁটতে থাকে, যাতে শট থেকে সরে যাওয়ার সময়ও ক্যামেরাটি চোখের আড়াল না হয়।
সিনেমার দৃশ্যটি আসলেই খুব সাধারণ, রেললাইনের খুব কাছে সিনেমাটোগ্রাফটি রাখা আছে, সেটি কখনোই নড়ানো হয় না। প্রথমে শুধু রেলস্টেশনটিকে দেখা যায়, লাইনের ধারে কিছু মানুষ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রেনটিকে আসতে দেখা যায়। ট্রেনটি ধীরে ধীরে এসে স্টেশনে থামে, কেউ নেমে পড়ে কেউ বা আবার তড়িঘড়ি করে ট্রেনে ওঠে। এই সাধারণ দৃশ্যেই আসলে সিনেমার একেবারে প্রাথমিক ব্যকরণটির সতর্ক বা হয়তো অসতর্ক ব্যবহার হয়ে গেছে।
ব্যকরণটি হচ্ছে- লং শট, মিডিয়াম শট ও ক্লোজ-আপ এর যোগসাজোশ। প্রথমে অনেক দূর থেকে লং শটের মাধ্যমে কাহিনীর পুরো মঞ্চ বা প্রতিবেশটি দেখানো হয়, তারপর একটি মিডিয়াম শটের মাধ্যমে দৃশ্যের চরিত্রগুলোকে দেখানো হয়, এবং সব শেষে ক্লোজ-আপের মাধ্যমে চরিত্রগুলোর মুখভঙ্গি তথা অনুভূতি দেখানো হয়। তবে শট তিনটির জন্য ক্যামেরাকেই সরাতে হবে এমন কোন কথা নেই, স্বয়ং চরিত্রকেই সরানো যায়। একটি দৃশ্য কল্পনা করা যাক, রাস্তার উপর ক্যামেরা রাখা, বিশাল সরলরৈখিক রাস্তা, উপরে আকাশ- সব দেখা যাচ্ছে, আর অনেক দূরে দৃশ্যমান একটি বিন্দু। বিন্দুটি ক্যামেরার দিকেই আসছে, অর্ধেক পথ আসার পর বোঝা যায় বিন্দুটি আসলে একজন মানুষ, আর একেবারে কাছে আসার পর বোঝা যায় মানুষটি কি ভাবছে। লুমিয়েরা মানুষের বদলে ব্যবহার করেছেন ট্রেন।
তবে শুধু ব্যকরণ দিয়েই সিনেমার কার্যসিদ্ধি হয় না, ব্যকরণ তো কঙ্কাল, তাতে মাংসপেশী আর রক্ত সরবরাহ করতে হয় যে। ৫০ সেকেন্ডের এমন দৃশ্যে যতোটা করা সম্ভব তার পুরোটাই করেছেন লুমিয়েরা। তবে এই ছোট্ট পরিসরে রক্তমাংসের আলোচনার চেয়েও বেশি প্রয়োজন রক্তমাংসের প্রভাবটা আলোচনা করা।
বুঝতে হবে তখনও মানুষ চলচ্চিত্র তথা চলমান চিত্র দেখায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি। চলচ্চিত্র দিয়ে যে কতো ভয়ানক ইল্যুশন বা ভ্রম তৈরি করা সম্ভব তা তারা বুঝতে শুরু করেছিল কেবল। এটা যে আসলে অনেকগুলো স্থিরচিত্রের মাধ্যমে তৈরি একটি ইল্যুশন সেটা যারা সিনেমা দেখতে গিয়েছিল তারা ঠিকই জানতো। তারপরও মানুষের একটা অদ্ভূত স্বভাব আছে, সে কোনকিছু ইল্যুশন- এটা জানার পরও তা দেখে ভয় পায়, বিস্মিত হয়, বিমোহিত হয়। তাই সিনেমার ভ্রমাত্মক প্রকৃতি সবার জানা থাকার পরও প্রতিক্রিয়া যে নাটকীয় হবে সেটা লুমিয়ে ভাইরা খুব ভালভাবেই জানতেন।
এবং তাদেরকে হতাশও হতে হয়নি। প্রতিক্রিয়া এতোই নাটকীয় ছিল যে লারিভে দ্যঁ ত্রাঁ-র প্রথম প্রদর্শনকে ঘিরে একটি জনপ্রিয় নাগরিক পুরাণও গড়ে উঠেছে। প্রথম দর্শনে ট্রেনটি সরাসরি তাদের দিকে আসছে ভেবে ভয়ে অনেক দর্শক নাকি আসন ছেড়ে প্রেক্ষাগৃহের পেছনের দিকে ছুটতে শুরু করেছিল। এটি হয়তো কেবলই পুরাণ, তবে যা ঘটে তার কিছুটা হলেও বটে। আমরা অন্তত এটা নিশ্চিত হতে পারি যে, বিশাল পর্দায় ট্রেনটি আসতে দেখে মানুষের হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল, তারা ঘামতে শুরু করেছিল এবং অনেকেই একসাথে চিৎকার করে উঠেছিল, যদিও তাদের সবাই জানতো এ কেবলই ছবি, বাস্তব কিছু নয়। কিন্তু লুমিয়ে ভাইরা প্রথম সিনেমার মাধ্যমে একটি দার্শনিক বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন।
স্বপ্নের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছুতে পারে সিনেমা। স্বপ্ন দেখে আমরা ঘেমে উঠি, আমাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, কখনও দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে জেগে উঠি, কখনও বা বর্ণীল স্বপ্নজগতের মোহে ঘুমের মধ্যেই আমাদের ঠোঁট নড়ে, আমরা কথা বলে উঠি। পুরো ব্যাপারটা ভ্রম জানার পরও স্বপ্ন মনে রাখতে আমাদের ভাল লাগে, কোন একটা স্বপ্ন ভুলে গেছি দেখে হতাশ হয়ে পড়ি। সিনেমা বাস্তবতাকে খুব বেশি তুলে ধরে এটা যেমন সত্য, তেমনি সিনেমা বাস্তব এবং অবাস্তবের সীমা সবচেয়ে বেশি ধূসর করে দেয়া- এটাও সত্যি।
সিনেমার এই ভয়াবহ আবেদন লারিভে দ্যঁ ত্রাঁ-এর প্রথম দর্শকরা বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু তাদেরকে একটু শান্ত হওয়ার সুযোগও করে দেন লুমিয়ে ভাইরা। ট্রেনটি লা সোতা স্টেশনে কিছুক্ষণ থামে, অনেকে ট্রেন থেকে নেমে আসে অনেকে আবার উঠে বসে। একসময় দর্শকরা খেয়াল করে, তারা আর ট্রেনটিকে ভয় পাচ্ছে না, দেখছে পর্দার অর্ধেক স্থান জুড়ে আছে একটি দানবীয় যন্ত্র আর বাকি অর্ধেকে মানুষ, মানুষের জীবন আর মানুষেরই ব্যস্ততা ও ঢিলেমিতা। রেলের ধারের মানুষদের সাথে দর্শকরাও এক ধরণের একাত্মতা বোধ করে, বিকল্প দৃশ্যে ছোট মেয়েটি যেমন মা-র হাতের মুঠো থেকে মুক্ত হতে পারছিল না ঠিক সেভাবেই আমরা পারি না ভ্রমের মোহ থেকে মুক্ত হতে। অনেক সময় ভ্রমের রহস্য বুঝে ফেলি আমরা, পেছন ফিরে হাঁটতে থাকা সেই লোকটির মত তখন চেষ্টা করি স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে, ঘোষণা করতে যে ভ্রমের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখানোর কিছু নেই, তারপরও পারি না, লোকটি যেমন পারে না ক্যামেরায় বন্দি হওয়া ঠেকাতে।
তবে সবাই যে ট্রেনের আগমন দৃশ্যটি দেখে ভয় পান তা নয়। বাংলার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক-কে আমরা ভয় পেতে দেখিনি। ঘটকের ছাত্র কুমার সাহানি তাদের লারিভে দ্যঁ ত্রাঁ দর্শনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বেশ মজা পান। ফিল্ম স্কুলে ঘটক ও সাহানি লারিভে দ্যঁ ত্রাঁ-র আসল প্রিন্ট মাঝেমধ্যেই বড় পর্দায় দেখতেন। এবং প্রতিবার দেখার সময়ই এই ভেবে হেসে উঠতেন যে, একটি যন্ত্র (ক্যামেরা) আরেকটি যন্ত্রের (ট্রেন) দিকে তাকিয়ে আছে। যন্ত্র দিয়ে যন্ত্র তোলার এই চক্রটা ঋত্বিক ঘটকের খুব প্রিয় ছিল যার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার তিনি ‘অযান্ত্রিক‘ (১৯৫৮) সিনেমায় করেছেন।
লুমিয়ে ভাইদের যন্ত্র যুগে যুগে মানুষকে এভাবে পাগল করেই চলেছে। বর্তমানের যে চলচ্চিত্রকার সিনেমাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন তার নাম মার্টিন স্কোরসেজি। কেবল সিনেমা বানিয়েই ক্ষান্ত হন না তিনি, চেষ্টা করেন সিনেমার প্রতি তার ভালবাসার কথাটা প্রচার করতে। তার সাম্প্রতিকতম সিনেমা ‘হ্যুগো’ (২০১১) তেই এটা সবচেয়ে বেশি ব্যক্ত হয়েছে। হ্যুগো সিনেমায় তিন বার লুমিয়ে ভাইদের এই সিনেমার শুরুটা নিজের মত করে দেখিয়েছেন।
তবে লারিভে দ্যঁ ত্রাঁ পুনর্নির্মাণের জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন একটি নতুন প্রযুক্তি, যেটা লুমিয়ে ভাইরা আজ বেঁচে থাকলেও করতেন- ত্রিমাত্রিক চিত্র। লুমিয়েরা ট্রেনের মাধ্যমে দর্শকদের মনে যে ধরণের অনুভূতি জাগাতে চেয়েছিলেন তার জন্য ত্রিমাত্রিক প্রযুক্তি খুবই উপযুক্ত। ত্রিমাত্রিক লারিভে দ্যঁ ত্রাঁ দিয়ে এক অর্থে স্কোরসেজি ইতিহাসকে ব্যবহার করেছেন, ইতিহাসকে পুনরজ্জীবিত করেছেন, যে ইতিহাস কোনদিন হারিয়ে যাবার নয়। তবে আরেকটু সাহস দেখিয়ে স্কোরসেজি লুমিয়েদের বড় পর্দা এবং দর্শক- পুরোটা একসাথে একটি আধুনিক বড় পর্দায় তুলে এনেছেন। পর্দায় আমরা দেখেছি ট্রেন দেখে কিভাবে ভড়কে গিয়েছিল মানুষ। স্কোরসেজির বদৌলতে এবার নাগরিক পুরাণটিও চিত্ররূপ পেল।
:clap: :clap: :clap:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ধন্যবাদ 🙂
ঐ মুহাম্মদ, এখন কোন দেশে আছো তুমি? ফ্রী আছো মনে হইতেছে কয়েকদিন? 🙂
লেখা পড়লাম, তুমি দেখি দিনকে দিন ক্রিটিক হই যাইতেছ। অন্য ভাষায় ব্লগানো শুরু করছো নাকি? ইংরেজীতে? না করলে শুরু করা উচিৎ। তোমার লেখা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ক্রস করি ফেলছে।
যাউজ্ঞা, ভালো থাইকো, দেশে আসলে আওয়াজ দিও, স্টারে গিয়া কাবাব খামুনে একদিন।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
আমি এখন ইতালি। শেষ সেমিস্টার তো, ক্লাস নাই কোন, শুধু থিসিসের কাজ। তাই একটু ফ্রিই আছি বলা যায়, অবশ্য লেখার আগ্রহটাও আগের চেয়ে বাড়ছে...
ধন্যবাদ তবে আমার ইংরেজি লেখা দেখলে লোকজন দৌড় দিবে। 😀
দেশে আসতেছি অগাস্টের ১ তারিখ, ২ মাসের জন্য। স্টারের দাওয়াত পাওনা রইল তাইলে...
কড়া ব্লগ।
আমরা শুধু সাবটাইটেল দেখি, আর কাহিনী ডিটেল বুঝার চেষ্টা করি। অধিকাংশ সময়ই থার্ড টাইম দেখার পর কিছুটা বুঝি। 😛 😛
তবে আপনার মুভি ব্লগগুলো সত্যিই চমৎকার।
অফটপিকঃ আপনি গ্রনিগেন কবে আসতেছেন?
ধন্যবাদ।
আমি অক্টোবরে নেদারল্যান্ড আসতেছি।
আমার মত মুভি পাগলদের জন্য আপনার মুভি ব্লগ গুলো খুব কাজের। অনেক সময় অনেক কিছুই মাথার উপর দিয়ে যায়। এক মুভি ৩-৪ বার দেখেতে হয়। তবে আপনার মত ক্রিটিক হইতে পারুম না। মুহাম্মদ ভাই খুব ভাল লাগল।
তানভীর আহমেদ
ক্রিটিক হইতে আমিও পারব না। বিভিন্ন ক্রিটিকের লেখা পড়ে বাংলায় কিছু লেখার চেষ্টা আর কি! ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
তোমার লেখাটি যখন পড়তে শুরু করি তখন সকাল।বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সরোদ শুনছিলাম।
সত্যজিত উৎপল দত্ত হয়ে ক্রুদ্ধ স্থির বাইসনচিত্রে পৌঁছে সরোদের সুর ঝলমলে রোদের ভেতর দিয়ে কি না নিয়ে এলো একটি প্রাগৈতিহাসিক ট্টেন! কেঁপে কেঁপে না উঠে কিছুতেই পারিনা... ভিডিওটি শেষ হতে' নেপথ্যের সরোদ ফের জেগে ওঠে।একটা সিগারেট ধরানোর জন্যে হাতটা যে নিশপিশ করে এর জন্যে তোমাকে দায়ী করে ফেলি।
আমাকে না, ঐ ট্রেনকেই দায়ী করেন। ভেবে দেখি, এটা কেবল একটি ট্রেনের আগমন নয় বরং স্বয়ং সিনেমার আগমন।
চমৎকার একটা লেখা। এই কদিন আগেও " আগন্তুক " দেখেছিলাম। লুমিয়ের ভাইদের শহরে গিয়ে তাদের বাড়ি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, ঐ শহরটা ( বোজঁসঁ) গুহার জন্য বেশ পরিচিত। শোভে যেতে পারিনি বলে আফসোস হচ্ছে এখন।
হিংসা হচ্ছে। অবশ্য শোভে গুহার আশেপাশে গেলেও ভেতরে ঢুকতে দিত না। তবে শোভে গুহার একটা হুবহু প্রতিরূপ তৈরা করা হচ্ছে মূল সাইট থেকে কয়েক মাইল দূরে। কেইভ অফ ফরগটেন ড্রিমসে দেখলাম শোভে গুহায় যে প্রাগৈতিহাসিক গন্ধ আছে সেটাও কৃত্রিমভাবে তৈরির চেষ্টা করা হবে নতুন সাইটে। মূল গুহায় না গেলেও এই প্রতিরূপটা দেখতে পেলেও হতো...
সিনেমার দর্শণ নিয়ে যে ব্যখ্যা দিলে তা পড়ে আনন্দ পেলাম। আমার একটা প্রশ্ন আছে। আমরা জানি যে ত্রিমাত্রিক কোন বস্তু ফসিল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু রেখা চিত্র কিভাবে ৩২০০০ হাজার পরও টিকে থাকে? তারা কিসের উপর (গুহার গঠন) কি দিয়ে এঁকেছিল?
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
গুহাচিত্র বা শিলাচিত্রের সাথে ফসিলের পার্থক্য আছে।
গুহাচিত্রগুলো আঁকা হয়েছিল গুহার ভেতরের দেয়ালে, এমন একটি স্থানে যেখানে আলো প্রবেশ করতে পারে না। সুতরাং তাদের গুহাচিত্র আঁকা বা দেখার একমাত্র উপায় ছিল মশালের আলো। সে কারণে এমনিতেই তারা একটু বেশি সংরক্ষিত ছিল। সেভাবে ৫০০০ বছর ছবিগুলো সংরক্ষিত ছিল মনে হয়। কারণ শোভে গুহায় ৩২০০০ বছর এবং ২৭০০০ বছর আগের ছবি পাওয়া গেছে, মানে কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের আনাগোনা ছিল সেখানে।
ছবি আঁকা হয়েছিল প্রধানত ochre (গিরিমাটি), কাঠ-কয়লা, হেমাটাইট (লোহিতাশ্ম) বা ম্যাগানিজ অক্সাইড দিয়ে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তারা প্রাণীটির অবয়ব আগে পাথরের পৃষ্ঠে উৎকীর্ণ করে তারপরও উপরে রঙ মেখেছে। তাই এদেরকে কেবল রেখাচিত্র বলা যাবে না, পাবলো পিকাসো গুহাচিত্র দেখে মন্তব্য করেছিলেন, 'ওরাই সব উদ্ভাবন করেছে'।
শোভে গুহারগুলো সবচেয়ে ভাল সংরক্ষিত থাকার কারণ সম্ভবত ২৫০০০(?) বছর আগে একটি পাথর ধ্বসে পড়ে গুহার মুখটা বন্ধ করে দিয়েছিল। অর্থাৎ গত আড়াই সহস্রাব্দ জুড়ে গুহাটা বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। 🙂
:clap: :clap:
জানার আছে অনেক কিছু। কবে যে এইসব জায়গা নিজে স্বচক্ষে দেখতে পারব, সেই দিনের প্রতীক্ষায়... 🙁
আগন্তুক দিয়ে শুরু করলে, ভাবলাম আজ কবিগুরুর জন্মদিন, গরু রচনা দিয়ে শুরু করলেও শেষটা হয়তো নদী রচনা দিয়েই হবে। তা হয়নি, পুরো লেখাতেই বিজ্ঞানের আবহ, ভাল লেখা তো বটেই।
নাও গুরুর একটা গান শোন, আগন্তুকের গানঃ
http://www.youtube.com/watch?v=m7i-RT-BPvA
@ আলীমুজ্জামান ভাই,
আপনার ইমেইল আইডি বা ফোন নম্বর পাওয়া যাবে কি? জরুরী দরকার ছিলো আপনার সাথে যোগাযোগ করার। আমার ই-মেইল mahmud735এটজিমেইল.com
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মজার ব্যাপার হইলো আমিও ট্রেন আইতে দেইখা ভয় পাইছি। ফান হিসাবে নিস না।
আর আগন্তুক আমার প্রিয় ছবির একটা (সত্যজিতের)।
উতপল দত্ত ও প্রিয় অভিনেতা।
প্রতি বছরের ছবি নিয়া লেখা শুরু কর। কোন সিরিয়াল ফল করবি কি?
জে এফ কে নিয়া একটা লেখা লিখিস। আবদার।
জে এফ কে আমারে পুরা আউলা কইরা দিছে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
মোহাম্মদ ভাই অসাধারণ একটা ব্লগ পড়লাম, সেই সাথে হিংসাও বোধ করি, কি সুন্দর আপনার ব্লগ গুলা।
খুব আফসোস হইতেসে, হলে চলাকালীন সময়ে হুগো মুভীটা না দেখার কারণে, এই ছবি দেখার পর মন হইসে থ্রীডী ভার্শণ না দেখে মিস করলাম।
এককথায় অসাধারণ একটা ব্লগ ভাইয়া 🙂
উপরের কয়েকটি কমেন্টের সাথে দারুন ভাবে একমত। আসলেই "তোমার লেখা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ক্রস করি ফেলছে। "
তুমি কি নিয়ে পড়াশুনা করছো? সিনেমাটোগ্রাফি নাকি?