“Andrei Tarkovsky – Senses of Cinema” by Maximilian Le Cain [অনুবাদ – খান মুহাম্মদ]
সের্গেই আইজেনস্টাইনের পরই রাশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কি। সিনেমাকে তিনি যেভাবে কবিতা হিসেবে দেখেছেন তা আধুনিক আর্ট ফিল্মের ভিত্তি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। রাজনীতিকে সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ না করলেও সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ তার উপর সর্বদা সদয় থাকেনি; বিশেষ করে তার আন্দ্রেই রুবলেভ, মিরর এবং স্টকার-এর কিছু প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছিল। অন্য অনেক রুশ চলচ্চিত্রকারের মত তিনিও সরকারের সাথে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ার পার করেছেন। ২৭ বছরের পরিচালনা জীবনে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বানিয়েছেন মাত্র ৭টি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও দৃঢ়তার বিচারে যার কোনটিই কোনটির চেয়ে কম নয়। পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে তিনি আরও ভাল করতে পারতেন কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, পুঁজিবাদী দেশে থেকেও তো ব্রেসোঁ এবং ড্রেয়ারকে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে।
তারকোভস্কির জন্ম ১৯৩২ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের Zavrzhe শহরে। শহরটি বর্তমানে বেলারুশের অন্তর্গত। তার বাবা সুপরিচিত কবি আরসেনি তারকোভস্কি এবং মা অভিনেত্রী মারিয়া ইভানোভনা। শিশুকালেই তার বাবা-মা-র বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মিরর, স্টকার এবং নস্টালজিয়া-তে তার বাবার কবিতার উল্লেখ আছে, আর মিরর-এ তার মা অভিনয় করেছেন।
১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তারকোভস্কি মস্কো ইনস্টিটিউট অফ অরিয়েন্টাল ল্যাংগুয়েজ-এ আরবি ভাষা অধ্যয়ন করেন এবং পরে সাইবেরিয়াতে ভূতত্ত্বের উপর পড়াশোনা করেন। ১৯৫৯ সালে মস্কোর বিখ্যাত VGIK সিনেমা স্কুলে ভর্তি হন। তার শিক্ষক ছিলেন মিখাইল রোম। সেখানে থাকা অবস্থায় টেলিভিশনের জন্য “দেয়ার উইল বি নো লিভ টুডে” (১৯৫৯) নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের জন্য নির্মাণ করেন “দ্য স্টিমরোলার এন্ড দ্য ভায়োলিন” (১৯৬০) যা একটি পুরস্কার জিতে নেয়। এই ছবির চিত্রনাট্যে তার সাথে কাজ করেছিলেন আন্দ্রেই মিখালকোভ-কোনচালোভস্কি যিনি পরবর্তীতে তার আন্দ্রেই রুবলেভেও কাজ করেছেন।
তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র “ইভানস চাইল্ডহুড” (১৯৬২) ভ্লাদিমির বোগোমোলোভের একটি যুদ্ধের গল্প থেকে করা। সিনেমাটি ১২ বছরের এক এতিম কিশোরকে নিয়ে যার হারিয়ে যাওয়া শৈশব অসাধারণ সব স্বাপ্নিক দৃশ্যরূপে সহসাই ফুটে ওঠে। পুরো সিনেমায় একশন সিনেমার নায়কোচিত দৃশ্যায়ন এড়িয়ে চলা হয়। তার বদলে দুটি মিশনের মধ্যবর্তী অলস সময়ে একটি সৈন্যবাহিনীর মধ্যে অস্থিরতা এবং উদ্বেগ নিয়ে পরীক্ষা চালান তারকোভস্কি। এই সিনেমাতে তার স্টাইল পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত না হলেও যে অনন্য দক্ষতার সাথে তিনি প্রকৃতিকে ক্যামেরায় ধারণ করতে পারেন সেটা বোঝা যায়। এর সবচেয়ে স্মরণীয় উপাদান হচ্ছে বনের ভেতর কাব্যিক অথচ ক্লস্ট্রোফোবিক (আবদ্ধ) দৃশ্যগুলো। সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরা যুদ্ধের সিনেমা ইভানস চাইল্ডহুড পশ্চিমে পরিচালককে বেশ পরিচিত করে তোলে, কারণ এটি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লায়ন তথা সর্বোচ্চ পুরস্কার লাভ করে।
আন্দ্রেই রুবলেভ-এ তারকোভস্কির কৌশলে অসামান্য উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। সিনেমার কাহিনী মধ্যযুগের একজন আইকন চিত্রকরকে নিয়ে হলেও অনেকে মনে করেন এর মাধ্যমে সোভিয়েত যুগের আবদ্ধ শিল্প এবং শিল্পীদের সংগ্রামকে নির্দেশ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনার প্রতিকূলে শিল্পীর অবস্থান এবং সময়ের সাথে শিল্পের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ক একটি ধ্যান বলা যেতে পারে একে।
এই সিনেমাগুলোর মাধ্যমে তারকোভস্কি নিজের সব ভিজুয়াল স্টাইল ও থিমকে সাজিয়ে ফেলতে পেরেছিলেন। নিজের চলচ্চিত্র তত্ত্ব বিষয়ক বই “স্কাল্পটিং ইন টাইম”-এ তিনি বলেছেন, সিনেমার সময়কে ধরে রাখার ক্ষমতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই হয়ত তিনি লং শটকে প্রাধান্য দিতেন- লং শট দর্শকের মনে দৃঢ়ভাবে বর্তমান সময়ের অনুভূতি স্থাপন করে দিতে পারে। ছবির মত সিনেমা বানানোর এই কৌশলে চরিত্রগুলোকে তাদের প্রতিবেশের সাথে যুক্ত করার প্রয়াস রয়েছে, তার ক্যামেরা বসানোর স্থান এবং ক্যামেরার ধীরগতির চলন দুটোই এক্ষেত্রে কাজে লেগেছে। আন্তোনিওনির মতই তিনি বলতে চেয়েছেন, পরবর্তীতে কি ঘটবে সেই উত্তেজনা বা কাহিনীকেন্দ্রিকতা নয় বরং বর্তমানকে নিবিঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করাই হওয়া উচিত সিনেমার লক্ষ্য।
প্রকটভাবে প্রস্ফূটিত করে তোলা প্রকৃতির ছবিগুলোতে তারকোভস্কি বারংবার চারটি উপাদান নিয়ে খেলেছেন- মাটি, বায়ু, আগুন এবং পানি। তার সিনেমায় বিভিন্ন প্রাণী বিশেষ করে কুকুর দেখা যায় অনেক সময়- সম্ভবত প্রকৃতির সর্বব্যাপী শক্তির আরেকটি প্রকাশ হিসেবে। দালান-কোঠাগুলো দেখা যায় সবসময় ভগ্ন দশায়, যেন অচিরেই প্রকৃতি একে নিজের বলে দাবী করে নিতে পারে। মানুষের তৈরি কৃত্রিম দালান-কোঠা কিভাবে প্রকৃতিতে মিশে যাচ্ছে সেটা স্পষ্ট তার প্রতিটি শটেই। এমনকি মিরর এবং দ্য স্যাক্রিফাইস (১৯৮৬) এর বাড়িগুলো যাতে এখনও মানুষ বাস করছে, সেগুলোও লোকালয় থেকে অনেক দূরে এবং নাজুক। অন্য অনেক ছবিতেও এই নড়বড়ে ভাব প্রকাশিত হয়- আন্দ্রেই রুবলেভে একটি পরিত্যক্ত উপাসনালয়ের ছাদের উপর দিয়ে তুষার ভেসে যাওয়া, সোলারিস (১৯৭২) এর শেষ দৃশ্যে নায়কের বাড়ির ছাদের ফুটো দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদি।
তার সেটিংগুলোতে কালহীনতার একটি অনুভূতি পাওয়া যায়। কেবল ঐতিহাসিক নয় বর্তমান কালের পটভূমিতে বানানো সিনেমার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। আধুনিক শহুরে পরিবেশ নিয়ে তিনি মাত্র ৩টি সিনেমা করেছেন। মিরর-এ পুরো শহর কেবলমাত্র বিভিন্ন এপার্টমেন্টের অভ্যন্তরভাগ, উঠোন এবং কল-কারখানার মাধ্যমে দেখানো হয়। সোলারিস, নস্টালজিয়া এবং দ্য স্যাক্রিফাইস- প্রতিটিতে একটি করে শহরের সংক্ষিপ্ত দৃশ্য রয়েছে। তারকোভস্কির সমগ্র আইকনোগ্রাফিতে এগুলোই শহরের একমাত্র শট।
প্রকৃতি ও প্রতিবেশের পাশাপাশি তার সিনেমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যপট হচ্ছে মানুষের মুখ। গ্যারেল এবং পাসোলিনির মত তিনিও সিনেমার অন্যতম সেরা পোর্ট্রেট শিল্পী। তার ক্যামেরা অভিনয়শিল্পীদের মুখের উপর দীর্ঘক্ষণ থাকে, পুরুষ চরিত্র হলে তিনি নির্দয়ভাবে তাদের তীব্র যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলেন, কিন্তু নারী চরিত্রের ক্ষেত্রে একটি বিস্ময়কর দূরত্ব বজায় রাখেন। চলচ্চিত্রের এসব তথাকথিত পোর্ট্রেটের পাশাপাশি তারকোভস্কি অনেক সময় প্রকৃত চিত্রশিল্প ব্যবহার করেছেন: ইভানস চাইল্ডহুডে আলব্রেখট ডুরার এর ছবি, আন্দ্রেই রুবলেভে মধ্যযুগীয় সাংকেতিক চিহ্ন, সোলারিসে Pieter Bruegel, মিরর এবং দ্য স্যাক্রিফাইসে লেওনার্দো দা ভিঞ্চি এবং নস্টালজিয়াতে পিয়ের দেলা ফ্রানচেস্কা।
আন্দ্রেই রুবলেভই প্রথম সিনেমা যাতে তারকোভস্কি রঙিন এবং সাদাকালো দৃশ্য পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন, পরবর্তীতে তার অনেক সিনেমায় যা দেখা যায়। আন্দ্রেই রুবলেভে রং দেখা যায় কেবল রুবলেভের শেষ ছবির কল-কম্পমান মন্টাজের সময়। মধ্যযুগের মর্মবিদারক জীবন ও মৃত্যু এবং তৎপরবর্তী প্রতিবেশের দুঃখ-কষ্ট ও যাতনা দেখে বিমূঢ় হয়ে একজন আদর্শবাদী তরুণ চিত্রকর থেকে রুবলেভের নির্বাক সন্ন্যাসীতে পরিণত হওয়ার পরই এই রঙিন ছবির মন্টাজ শুরু হয়। কিন্তু সিনেমা শেষের বিশোধক দৃশ্যে যখন রুবলেভ দেখে ছাদ থেকে পড়ে জীবন হারানোর ঝুঁকি নিয়েও এক ঘণ্টা নির্মাতা একটি চার্চে প্রথমবারের মত ঘণ্টা লাগানোর চেষ্টা করছে তখন সে আবার অনুপ্রাণিত হয়।
এই সিনেমায় রুবলেভ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন পরিচালকের প্রিয় অভিনেতা আনাতোলি সোলোনিৎসিন যাকে তারকোভস্কির পরের সবগুলো সিনেমাতেই দেখা গেছে। অন্য অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন নিকোলাই গ্রিংকো, যাকে বেশ অনেকগুলো সিনেমায় নিয়েছেন তারকোভস্কি। চিত্রগ্রাহক ছিলেন ভাদিম ইউসভ যিনি মিরর পর্যন্ত সবগুলো সিনেমাতেই চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছে।
আন্দ্রেই রুবলেভ মুক্তি পেতে পেতে ১৯৭১ সাল চলে আসে। এর মধ্যে অভিনেতা ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি তারকোভস্কি তার পরবর্তী সিনেমার পরিকল্পনা করতে থাকেন। স্তানিসলাভ লেম এর কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস থেকে করা তার পরবর্তী সিনেমার নাম সোলারিস, ১৯৭২ সালে যা মুক্তি পায়। মূল রুশ ভাষায় এর উচ্চারণ হবে খানিকটা “সোলিয়ারিস” এর মত। সোলারিসকে অনেক সময় স্ট্যানলি কুবরিকের ২০০১: আ স্পেস অডিসির সাথে তুলনা করা হয়। তারকোভস্কি স্পেস অডিসিকে ভয়ানক শীতল এবং অমানবিক হিসেবে নিয়েছিলেন, তাই অনেকে মনে করেন সোলারিস স্পেস অডিসির উপযুক্ত জবাব। এই সিনেমায় দেখা যায়, সোলারিস নামক একটি অদ্ভূত গ্রহের চারদিকে আবর্তনরত একটি মনুষ্য নির্মীত মনুষ্যবাহী কৃত্রিম উপগ্রহে ঘটতে থাকা অদ্ভূত সব ঘটনার তদন্ত ও সমাধানের জন্য পৃথিবী থেকে একজন মনোবিজ্ঞানীকে (দোনাতাস বানিয়োনিস) প্রেরণ করা হয়। অনেকে ব্যাখ্যা করেন যে, সোলারিস চেতনাযুক্ত পদার্থ দিয়ে তৈরি, যেন পুরো গ্রহটিই এক বিশাল মস্তিষ্ক। বানিয়োনিস লক্ষ্য করেন গ্রহটি কৃত্রিম উপগ্রহের অধিবাসীদের অবচেতন মনে প্রবেশ করে যা পায় তাকেই জলজ্যান্ত বাস্তবের মত তার সামনে এনে উপস্থিত করতে পারে। বানিয়োনিসের অবচেতন থেকে সোলারিস বের করে আনে তার স্ত্রীকে (Natalya Bondarchuk) যে কয়েক মাস আগেই আত্মহত্যা করেছে। নভোযানে নিজের মৃত স্ত্রীর সাথে বানিয়োনিসের একটি নিবিঢ় কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কের সূচনা ঘটে।
সোলারিসই তারকোভস্কির একমাত্র সিনেমা যার কাহিনী আবর্তিত হয় প্রেম নিয়ে। ইভানস চাইল্ডহুডে ক্ষণিকের একটি রোমান্টিক দৃশ্য দেখা যায়, আর মিরর, স্টকার ও দ্য স্যাক্রিফাইস সবগুলোতেই জুটিগুলো হয় বিবাহিত নয়তো বিচ্ছিন্ন এবং তাদের সম্পর্ক সকল ক্ষেত্রেই আন্তরিকতাশূন্য। প্রেমের পরিতৃপ্তি সবসময়ই যেন অতীতের স্রোতে ভেসে যাওয়া অসম্ভব আদর্শ। সোলারিসে নাতালিয়া চরিত্রটি প্রকৃত নারী নয় বরং বানিয়োনিসের হারানো প্রেমের অপরাধবোধে আক্রান্ত স্মৃতি। নস্টালজিয়াতে নির্বাসিত কবিকে সর্বদা সোভিয়েত ইউনিয়নে রয়ে যাওয়া তার স্ত্রীর স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায়। তারকোভস্কির সিনেমায় প্রেমের সবচেয়ে অভূতপূর্ব দৃশ্যায়ন দেখা যায় মিররে- বিচ্ছেদের ঠিক পূর্বে বর্ণনাকারীর বাবা-মার ছবি, একপলক যা দেখা যায়, লক্ষ্যণীয় এটিও কেবল স্মৃতি। তার সিনেমায় যৌনতা নেই বলে অনেকে মন্তব্য করলেও প্রকৃতপক্ষে সোলারিস, মিরর এবং নস্টালজিয়ার বেশ কিছু স্বপ্ন ও স্মৃতির দৃশ্যে মনে রাখার মত আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এর বাইরে তার সিনেমায় যৌনতা মূলত প্রতীকী: আন্দ্রেই রুবলেভের পেগান আচারানুষ্ঠান পর্বে প্রলোভন, নস্টালজিয়ায় ইয়াংকোভস্কির সুন্দরী দোভাষীর তাকে দেয়া প্রস্তাব এবং দ্য স্যাক্রিফাইস-এ উদ্বিগ্ন নায়ক নিউক্লীয় বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য এক ডাকিনীর সাথে শুয়ে যেভাবে পুনরায় আধ্যাত্মিকতার সূত্রপাত ঘটায়।
তারকোভস্কির অন্য কল্পবিজ্ঞান সিনেমা স্টকার-এর মত সোলারিস-এও মূল বিষয়বস্তু নিজের সাথে মোকাবেলা। সোলারিস-এ গ্রহটির সাথে ক্ষীণ যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর নিজের মধ্যকার অশুভের সাথে মোকাবেলার করার মাধ্যমে নায়ক এক সময় নিজের সাথেই কিছুটা সন্ধি করতে সক্ষম হয়। সেদিক দিয়ে স্টকার অনেক নৈরাশ্যবাদী। এতে কোনভাবে নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত আত্মদ্বন্দ্বটি এড়িয়েই যান পরিচালক। স্টকার-এর কাহিনী হচ্ছে: নিকট ভবিষ্যতে পৃথিবীতে একটি অদ্ভূত ও ভয়ংকর অঞ্চলের উদ্ভব ঘটে যার উৎপত্তির কারণ অনিশ্চিত। এ অঞ্চলে ঘটতে পারে না এমন কিছু নেই, আর তার কেন্দ্রে আছে সিনেমার “কক্ষ”-টি। এই ঘরে প্রবেশ করলে নিজের গভীরতম ইচ্ছা পূরণ হয়। এখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ হলেও স্টকার নামে পরিচিত কিছু লোক আছে যারা অর্থের বিনিময়ে অনেককে অঞ্চলটির সীমানা পেরিয়ে কেন্দ্রীয় ঘরটিতে নিয়ে যায়। স্টকার সিনেমায় এমনই একজন স্টকারের যাত্রা অনুসরণ করা হয় যে একজন লেখক এবং একজন বিজ্ঞানীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় এই নিষিদ্ধ ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে। আত্মা অনুসন্ধানের অনেক হালকা তামাশার পর তিনজনের কেউই ঘরটিতে প্রবেশের সাহস করে না এবং স্টকার বাড়িতে তার বিহ্বল স্ত্রী ও খোঁড়া মেয়ের কাছে ফিরে আসে। অঞ্চলটির পরিবেশে সর্বদা ঘোরাফেরার কারণেই সম্ভবত স্টকারের মেয়ে জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী।
সোলারিস এবং স্টকার এর মাঝে তারকোভস্কি তৈরি করেছেন মিরর- একটি নন-ন্যারেটিভ, আত্মজীবনীমূলক কাব্যিক চলচ্চিত্র যাতে বর্ণনাকারীর সাথে তার মা, প্রাক্তন সহধর্মিনী ও ছেলের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। মিরর-এ শৈশবের স্মৃতির বিভিন্ন দৃশ্যের সাথে নিউজরিল (সংবাদ চলচ্চিত্র) ফুটেজ ও সমসাময়িক ঘটনা দেখানোর মাধ্যমে বর্ণনাকারীর চেতনার ধারা প্রকাশ করা হয়। অনেকে এই সিনেমাকে দুর্ভেদ্য এবং অবোধ্য বলে আখ্যায়িত করলেও কেবলমাত্র শৈশবের দৃশ্যগুলোই এত মনোমুগ্ধকর এবং নেশা-জাগানিয়া যে তাদের সকল আখ্যাই নিমেষে দ্রবীভূত হয়ে যায়। তারকোভস্কির ক্যামেরায় প্রকৃতির স্মৃতি-জাগানিয়া দৃশ্যের সবচেয়ে সম্মোহনী প্রকাশ ঘটেছে এই সিনেমায়। মনে রাখতে হবে তার অনন্যসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলোর অধিকাংশই স্মৃতি অথবা স্বপ্নের জগতের। বর্ণনাকারীর জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর নিউজরিল ফুটেজ খুব চিন্তাশীল বিচ্ছিন্নতার সাথে দেখানো হয়েছে যাতে বর্ণনাকারী নিজে কোনভাবেই অংশ নেননি। স্মৃতির সাথে মানুষের আত্মীয়তা এবং বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে তার বিচ্ছিন্নতা এখানে সুস্পষ্ট। নিউজরিলের দূর সম্পর্কের ভৌতিক দৃশ্যগুলো রূপায়িত হয়েছে সঙ্গীত ও কবিতার অসামান্য ব্যবহারের মাধ্যমে। আর সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহে- প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে কথাবার্তা, মার ফোন কল, ছেলের সাথে কথোপকথন- ইত্যাদি কোনকিছুতেই বর্ণনাকারীকে দেখানো হয় না, যা দর্শকদেরকে দেখতে বাধ্য করে যেভাবে বর্ণনাকারী নিজে সবকিছু দেখছে, অর্থাৎ বর্ণনাকারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। মার্গারেটা তেরেকোভা অদৃশ্য বর্ণনাকারীর প্রাক্তন স্ত্রী এবং মা-র যৌবনকাল দুটি চরিত্রেই অভিনয় করেছেন। মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়ার বিনোদন হিসেবে যদি কোন সিনেমা নির্মীত হয়ে থাকে তাহলে মিরর-ই সেটি। এ কেবল তারকোভস্কির মাস্টারপিস নয় বরং বিশ্ব সিনেমার প্রগতিতে একটি পর্বতচূড়া।
১৯৮০-র দশকের প্রথম দিকে তারকোভস্কি চিরতরে রাশিয়া ত্যাগ করেন। জীবনের বাকি দিনগুলো তাকে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছে নিজের পরিবার বিশেষ করে কিশোর ছেলেটিকে নিজের কাছে আনার জন্য। মিরর-এর পর সবচেয়ে সফল চলচ্চিত্র নস্টালজিয়া নির্মাণ করেন এখানেই, এটি রচনায় তাকে সাহায্য করেন বিখ্যাত ইতালীয় চিত্রনাট্যকার তোনিনো গুয়েরা। নস্টালজিয়া নির্মাণের জন্য তারকোভস্কির ইতালি ভ্রমণ নিয়ে “ভয়েজ ইন টাইম” (১৯৮৩) নামে একটি টেলিভিশন প্রামাণ্য চিত্র সিনেমাটির আগেই মুক্তি পেয়েছিল। নস্টালজিয়ায় দেখা যায়: একজন রুশ কবি তার দোভাষীকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন ইতালির একটি স্পা-তে। ইতালিতে এসেছেন একটি বইয়ের জন্য গবেষণা করছেন, স্পা-এর অসামান্য সৌন্দর্য্য সত্ত্বেও বাড়ির জন্য তার মন কাঁদছে। এখানে তার বন্ধু হয়ে খামখেয়ালী এক ইতালিয়ান যে নাকি তার পরিবারের সবাইকে বাড়িতে বন্দি করে রেখে পৃথিবীর ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করেছিল। কোন কাহিনীবিহীন এই ন্যারেটিভ, তারকোভস্কি তার নতুন চিত্রগ্রাহককে সাথে নিয়ে যে অনন্যসাধারণ পরিবেশ তৈরি করেছেন তা উপভোগ করতে দর্শকদের সাহায্য করে। যেকোন বস্তুকে জীবন্ত করে তুলতে তারকোভস্কি অদ্বিতীয়, এই সিনেমায় জীবন্ত সব দৃশ্যের আবহ মনে হয় সিনেমার পর্দা চুইয়ে আমাদের জগতে চলে আসছে। নস্টালজিয়ার শেষ দৃশ্য একটি দীর্ঘ্য শটে ধারণ করা হয়েছে- দেখা যায় আমাদের মুমূর্ষু কবি তার ইতালীয় বন্ধুর অনুরোধে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে হ্রদ পার হওয়ার চেষ্টা করছে। এটি সম্ভবত তারকোভস্কির সবচেয়ে আবেগ ভারাক্রান্ত শট।
পরবর্তী সিনেমা “দ্য স্যাক্রিফাইস” এর কাজ যখন শুরু করেছেন তখন তারকোভস্কি জানতেন দুরারোগ্য ক্যান্সারে অচিরেই তিনি জীবন হারাবেন। সুইডেনে নির্মীত এই সিনেমা আত্মত্যাগের রূপক, মূল চরিত্র একটি নিউক্লীয় বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য জীবনের প্রিয় সবকিছু অকাতরে ত্যাগ করে। অভিনেতা Erland Josephson এবং চিত্রগ্রাহক Sven Nykvist কে সাথে নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন- এতেই তার উপর ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বারিমান গুটিকয়েক চলচ্চিত্রকারের একজন তারকোভস্কি সবসময় যাদের আন্তরিকভাবে প্রশংসা করেছেন। পূর্ণতা ও ত্রুটিহীনতার দিক দিয়ে নস্টালজিয়ার চেয়ে নিচু হলেও দ্য স্যাক্রিফাইস তার সম্মানিত কিন্তু কঠিন ক্যারিয়ারের সমাপ্তি হিসেবে যথাযোগ্য।
১৯৮৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন তারকোভস্কি, তাকে সমাধিস্থ করা হয় প্যারিসে। পরবর্তী সময়ের বেশ ক’জন চলচ্চিত্রকারের মাঝে তার সুগভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তার বন্ধু আলেকসান্দর সকুরোভ-কে অনেক সময় তার উত্তরসূরী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সকুরোভের গ্রাম্য পরিবেশের দৃশ্য এবং আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণা থেকে সেরকমই মনে হয়। তিনি তারকোভস্কির উপর Moscow Elegy নামে খুব সুন্দর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ১৯৮৭ সালে। কিন্তু সাদৃশ্যের চেয়ে তাদের পার্থক্যই বেশি। এবং কেবলই “নতুন তারকোভস্কি” আখ্যা দিলে সকুরোভের অনেক অনন্য অর্জনকে অবজ্ঞা করা হবে। লিথুয়ানিয়ান চলচ্চিত্রকার শারুনাস বারতাস (Šarūnas Bartas) এর অনেক কিছুই তারকোভস্কিয়ান। বস্তু, মুখ এবং দালান-কোঠার গড়ন-কাঠামোর প্রতি মনোযোগ এবং সময়ের ব্যবহারের দিক দিয়ে বারতাস তারকোভস্কির অনুসারী। তবে তারকোভস্কির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জবাব পাওয়া যায় সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রকার বিলা তর-এর (Béla Tarr) সিনেমায়। হাঙ্গেরীয় এই চলচ্চিত্রকারের মাস্টারপিস Sátántango (১৯৯৭) এর কথা না বললেই নয়। শাতানতংগো-তে তারকোভস্কির অনেক কৌশলের ব্যবহার থাকলেও এটি আসলে এই রুশ মহারথীর ঋণাত্মক দর্পণ প্রতিবিম্ব। বিলা তর নাস্তিক, মানব জীবনের গুরুত্বের বিরোধী এবং নাস্তিবাদী তথা নাইহিলিস্ট। স্বাভাবিকভাবেই তিনি মনে করেন পরিত্রাণ একটি ভয়ংকর ভ্রম যা শক্তির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্যোগ ও সহিংসতা ডেকে আনে। অন্যদিকে তারকোভস্কিয়ান জগতের ভিত্তি পুরোপুরিই বিশ্বাস, প্রার্থনা, স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা এবং মহামুক্তি, যেন গৌতম বুদ্ধের মহানির্বাণের চলচ্চিত্রায়ন।
:clap: :clap:
অসাধারণ ভাইয়া,
অনেক সময় নিয়ে লিখেছেন মনে হচ্ছে??
কেবলই অনুবাদ...
আন্দ্রেই তারকোভস্কি এবং তাঁর কাজের সাথে পরিচয় করায় দেয়ায় ধনেপাতা মুহম্মদ। তবে অনুবাদটা পড়তে একটু শক্ত খটোমটো ঠেকলো। তারকোভস্কির সিনেমাগুলির প্রতিটার রেটিং তো দেখি সাংঘাতিক! দেখার ইচ্ছা রাখি 🙂
আমার বন্ধুয়া বিহনে
তারকোভস্কি সত্যিকার অর্থে সিনেমার গৌতম বুদ্ধ। তবে তার সিনেমা দেখতে হলে একেবারে ভিন্ন একটা আবহ লাগে, অন্য কোন ধরণের সিনেমার সাথেই এইটা মিলে না। খুবই স্লো এবং লং শটের দৃশ্য সব। আব্বাস কিয়ারোস্তামি এবং বিলা তর এর সিনেমা দেখে থাকলে মনে হয় পরবর্তীতে তারকোভস্কি দেখতে অনেক সুবিধা হয়।
ইনি কোন তারকোভস্কি, আমরা ছোট বেলায় যার নাম শুনতাম তিনি নাকি? 😕
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
তাই তো মনে হয়... আমার জন্মের আগে বরছর মারা গেছেন তিনি...