নিষ্ঠজনের আলোয় দেখা

cad 1978মূল ইংরেজি প্রবন্ধঃ একরাম কবির

একজন ক্যাডেট ছাড়া আর কেউ কখনও বুঝতে পারবে না, একেবারে কাঁচা বয়সে সম্পূর্ণ এলিয়েন এক প্রতিষ্ঠানে দিনাতিপাত করতে কেমন লাগে। কেউ বুঝতে পারবে না, ১২ বছর বয়সের এক ছেলে ক্যাডেট কলেজে গিয়ে কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। ক্যাডেট ছাড়া আর কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কলেজ জীবনের ছয়টি বছরে সকল পানিশমেন্ট, শাসন এবং আনন্দ-নীলের দিনগুলো পেরিয়ে বাস্তব জীবনযুদ্ধে প্রবেশ করতে কেমন লাগে। সে ছাড়া আর কেউ জানতে পাবে না, তার সাথে তার কমরেডদের সম্পর্কটা কেমন, যারা সব একই কলেজ থেকে পাশ করেছে।

বাংলাদেশে ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানী শাসনের সময়, সেনাবাহিনী সুসংহত করাই ছিল এই প্রতিষ্ঠার মূল কারণ। অনেক পরিকল্পনার মাধ্যমে এমনটি করা হয়েছিল। প্রথম ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের পাঞ্জাবে। আর পৃথিবীর এ অংশে ক্যাডেট কলেজের সুফল বইতে শুরু করে ১৯৫০-এর দশক থেকেই। তখন থেকে, পাকিস্তানী শাসনে এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি বিশাল অংশ সরবরাহ করে আসছে ক্যাডেট কলেজ।

শাকুর মজিদ” তার “ক্লাস সেভেন ১৯৭৮” বইয়ে বাংলাদেশে ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠার পটভূমি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেছে প্রথমেই। কেউ যদি এক বসায় বইটি পড়ে ফেলতে পারে, তবে নিঃসন্দেহে বুঝতে পারবে, কেমন ছিল সেই অতীতের দিনগুলো। সেই সাথে সে জানতে পাবে, মানুষ নিজের অতীত জীবনের সুখময় স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াতে কতটা পছন্দ করে। নিজের ক্যাডেট জীবনের রূপ ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে মজিদ তার বইয়ে প্রকাশ করে গেছে, কিভাবে এক অবুঝ বালক ধীরে ধীরে ক্যাডেট হয়ে উঠে। আর বইয়ের শিরোনাম দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে: মজিদ এটি লিখেছে তার ক্যাডেট জীবনের প্রথম বছরটি নিয়ে।

মজিদ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে বের হয়। এই কলেজটি ক্যাডেটদের মধ্যে সাধারণত এফসিসি নামে পরিচিত। বইয়ে মজিদ যা লিখেছে তার সবই দিবালোকের মত সত্য।

একজন ক্যাডেটকে সবই শেখানো হয়, জীবনে বেঁচে থাকতে হলে যা যা শেখা প্রয়োজন, যা শিখলে সে নেতৃত্ব দানের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে; এমন কিছু যা তাকে এক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করবে। মজিদের লেখা এই সবগুলো তথ্যকেই ফুটিয়ে তুলেছে। ক্যাডেট জীবন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে চাইলে তাই বইটি পড়ার কোন বিকল্প নেই।

মজিদ একজন সৎ লেখক। সে এমন অনেক কিছুর উল্লেখ করেছে, এফসিসিতে যাওয়ার আগে যে সম্পর্কে তার কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। আর অবশ্যই এ বিষয়গুলোতে অন্য সব ক্যাডেটও একমত হবে। কারণ সেখানে গিয়ে সবাই এমন কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করে যা নিজ বাবা-মায়ের ঘরে থাকতে সে পায়নি। চামচ দিয়ে খাওয়ার বিষয়টাই ধরা যাক। অধিকাংশ ক্যাডেটই কলেজে যাওয়ার আগে জীবনে চামচ দিয়ে খায়নি। এছাড়া, কোন ক্যাডেটই হয়তো সেখানে যাবার আগে টাইয়ের নট বাঁধতে শিখেনি। কেউই সেখানে যাবার আগে এতোগুলো খেলায় কিছুটা হলেও অংশ নিতে পারেনি। কেউই কলেজে যাবার আগে গণ বক্তৃতার শিল্প, বিতর্ক, আবৃত্তি বা এ ধরণের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের স্বাদ পায়নি। কেউ এতোটা নিয়ম মেনে চলার কথা ভাবতে পারেনি আগে, যে নিয়মানুবর্তিতার কথা সেখানে বলা হয়।

হ্যাঁ, ক্যাডেট কলেজ এই সবই শিক্ষা দেয়।

মজিদ তার বইয়ের একটি অধ্যায় ক্যাডেট কলেজে শেখা মঞ্চ সংস্কৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছে। কিন্তু সে ক্লাস সেভেনের ছেলেদের করা “ট্যালেন্ট শো” সম্পর্কে কিছু লিখেনি। প্রথম যে মঞ্চ প্রতিযোগিতায় ক্যাডেটরা অংশ নেয় তা হল এই আন্তঃহাউজ ট্যালেন্ট শো প্রতিযোগিতা। তারা সেখানে গায়, অভিনয় ও আবৃত্তি করে আর কৌতুক শোনায়। এর উপর পুরস্কারও দেয়া হয়।

ক্যাডেট, বিশেষত এক্স-ক্যাডেটদের সমাজ জীবনে একটি কড়া সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়, আর তা হল, তারা নাকি অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী। শুধু প্রতিবেশ নয় পরিবারেও যে এই সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় তা আমিও জানি। আমি মানি, ক্যাডেটদের সম্বন্ধে এমন সমালোচনা করা যায়, কিন্তু সাথে এও মানতে হবে প্রায় সব ক্যাডেটই জীবনে সফলতা লাভ করতে সমর্থ হয়। একজন ক্যাডেট শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কলেজে যা শিখে তার সবই মজিদ তার বইয়ে ব্যাখ্যা করেছে।

ক্যাডেট কলেজগুলো হয় শুধু ছেলেদের না হয় শুধু মেয়েদের জন্য। ছেলেরা তাদের কলেজে থেকে কখনও মেয়েদের সম্বন্ধে জানতে পারে না, যেমন মেয়েরাও পারে না ছেলেদের সম্বন্ধে জানতে। কিন্তু সেই একলিঙ্গিক পরিবেশে তারা ভ্রাতৃত্বের যে শিক্ষা পায় কেবল তা নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়া যেতে পারে। মজিদ এফসিসি’র একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার কথা লিখেছে। কলেজে তাদের এক সিনিয়র ভাই (কবির ভাই) সুইমিং পুলে ডুবে মারা যায়। কলেজের সবাই সেই সাঁতার প্রতিযোগিতা বাতিলের দাবী জানায়। কবির ভাই ভাল বক্সারও ছিলেন। তাই বক্সিং প্রতিযোগিতায় কেউ অংশ নিতে রাজি হয়নি। লক্ষ্য ছিল, কেউ অংশ না নেয়া যাতে কবির ভাইকেই বিজয়ী ঘোষণা করা যায়। এভাবেই মৃত্যুর পর ক্যাডেটদের মনে গেঁথে থাকেন কবির ভাই।

মজিদ, সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবেই, একজন ক্যাডেটকে সিনিয়র, শিক্ষক এবং স্বয়ং প্রিন্সিপালের হাতে যেসব অবিচারের শিকার হতে হয় সে সম্বন্ধে কিছু লিখেনি। মজিদ সম্ভবত শুধু তার সুখময় স্মৃতিগুলোই লিখতে চেয়েছে। ক্যাডেট কলেজ কোন কোন ক্যাডেটের পক্ষে নিকৃষ্টতম স্থানও হয়ে উঠতে পারে, যদি কোন কারণে সে দুষ্ট ছেলে হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। কেউ একবার এই আখ্যা পেলেই হল, কলেজের বাকিটা জীবন সে চিহ্ন বয়ে বেড়াতে হয়। তুমি যত চেষ্টাই কর বা যেভাবেই জীবন চালাও এ থেকে মুক্তি নেই। শিক্ষক ও সিনিয়ররা এভাবে চিহ্নিত একজন ক্যাডেটকে কখনই ভাল হবার সুযোগ দেয় না। ফলে সে একের পর এক পরীক্ষায় খারাপ করতে থাকে, যত চেষ্টাই করুক কলেজের পরীক্ষায় আর ভাল করতে পারে না। সে আসলেই কতটা পারে তা পরখ করার জন্য বোর্ড পরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এই দুষ্ট ছেলেগুলো সাধারণত বোর্ড পরীক্ষায় ভাল করে। কারণ, বোর্ড পরীক্ষার খাতাগুলো তো আর কলেজের পক্ষপাতদুষ্ট শিক্ষকেরা দেখে না।

মজিদ বাংলাদেশের প্রতিটি এক্স-ক্যাডেটকে জীবন চলার পথ দেখাতে চেয়েছে। একজন ক্যাডেট যদি তার ক্যাডেট জীবনের ছয় বছরের দিকে তাকায় তবে সহজেই বুঝতে পারবে, তার সমগ্র জীবনের স্বর্ণযুগ ছিল এই ছয়টি বছর। কিন্তু অবশ্যই, একেক ক্যাডেট তার জীবনকে একেকভাবে ব্যাখ্যা করবে। কারণ একেক জনের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। এ কারণেই, প্রতিটি এক্স-ক্যাডেটের উচিত তার কলেজ জীবনের স্মৃতি লিখে ফেলা।

ক্যাডেট কলেজের জীবন মোটেই সহজ নয়। কিন্তু পুরো জীবনটা পার করে আসার পর বাকি জীবন তার জন্য খানিকটা সহজ হয়ে যায়। এই বইটি তাদের জন্য পড়া আবশ্যক যারা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে চায়। মজিদ বইটি সেরকম আকর্ষণীয় করেই লিখেছে যাতে ছোট ছেলেরা পড়তে পারে, যারা একসময় ক্যাডেট হবে।

মজিদ একজন সনামধন্য লেখক; তার অনেকগুলো লেখাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। গল্প বলাতেও তার দক্ষতা আছে। আরও ভাল হত, যদি সে এই বইটি উপন্যাস আকারে লিখত, যদি বইটির একটি নাটকীয় কাহিনী থাকত। এমনটি করলে, সে একই সাথে একটি ভাল মানের সাহিত্য আমাদেরকে উপহার দিতে পারতো।

প্রকাশিত হয়েছে যেখানেঃ In the glare of the martinets – দ্য ডেইলি স্টার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
# উল্লেখ্যঃ একরাম কবির (জেসিসি) শাকুর মজিদের (এফসিসি) সহপাঠি। অবশ্য দু’জন ভিন্ন কলেজের।

২,১৪৬ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “নিষ্ঠজনের আলোয় দেখা”

  1. শুধু "কলেজ ক্যাপ্টেন" না, "ক্যাডেট নম্বর ৫৯৫" ও ক্যাডেটদের টেক্সটবুক হওয়া উচিৎ। দুটোই মামুন ভাইয়ের। কেউ কি ওনাকে আনতে পারবে এখানে? তাহলে আমরা জোশ জোশ সব লেখা পেতাম।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।