আমার নতুন পরিচয়: আমি ক্যাডেট

১৫ এপ্রিল, ২০০৬। বাসে উঠলাম সকাল বেলায় আব্বু আম্মুর সাথে…… গন্তব্য ফেনী। বাসে উঠেই আম্মু প্রথমে  আমাকে যা যা বোঝানো শুরু করল তা হল ক্যাডেট কলেজে যেন ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করি,নামাজ পড়ি, ঠিক মতো পড়াশোনা করি,নিজের যত্ন নেই আর…… আর যাই হোক মাথা গরম করে আমি যেন কার সাথে মারামারি না করি। কারণ সেই পিচ্চি বেলায় ক্লাস থ্রি তে থাকতে ঘুষি মেরে ১ টা  ছেলের নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। আমি আম্মু কে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে এখন বড় হয়ে গেছি আর অমন করবো না। তাও আম্মু কে খুব ১ টা নিশ্চিন্ত দেখলাম না। আম্মু আরও অনেক উপদেশ দিচ্ছিল কিন্তু আমার শুধু ১ টা কথাই মনে হচ্ছিল…ক্যাডেট লাইফ…নতুন জায়গা……নতুন জীবন……কত্ত অ্যাডভেনচার!!! ভাবতেই শিহরিত হচ্ছিলাম……আর ভাবছিলাম নতুন ভাবি বন্ধু দের নিয়ে…যাদের তখনও দেখি ও নি……তারা কেমন হবে…!!!! কারণ ভরতি কোচিং করার সময় এক্স ক্যাডেট ভাইয়াদের মুখে শুধু বন্ধু দের কথাই শুনেছি। ভাবতে ভাবতে আর আম্মুর অজস্র উপদেশ শুনতে শুনতে ফেনী পৌঁছলাম। আমরা CNG নিলাম কলেজ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য।

কিছুদূর যেয়েই দেখলাম ১টা বিশাল মাঠে মেলা হচ্ছে। আমি ভাবলাম বৈশাখী মেলা। রঙ বেরঙের পতাকা উড়ছে মাঠের চারপাশে। আব্বু ভুল ধরিয়ে দিল আমার, ওটাই নাকি আমার ক্যাডেট কলেজ। আমি এর আগে ঝিনাইদহ,পাবনা আর মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ দেখেছিলাম। কিন্তু সে গুলোর কোনোটার সাথেই ১ বিন্দু মিল খুঁজে পেলাম না। কিছুটা আশাহতই হলাম। এরপর অনেক মানুষের ভিড় ঠেলে আব্বু গিয়ে জেনে আসলো আমার নতুন পরিচয়। ক্যাডেট মীম, ক্যাডেট নম্বর ০২, খাদিজা হাউজ, হাউজ রঙ নীল। এরপর গেট ধরে এগিয়ে গেলাম। ১ জন হাউজ বেয়ারা দিদি সাথে ছিলেন আমাদের। হাউজ গেট এ থামতে হল। ২জন স্যার দেখলাম নাম এন্ট্রি করছেন। আমি গিয়ে ক্যাডেট নম্বর ০২ বলাতে আমাকে বলা হল অপেক্ষা করতে। ক্যাডেট নম্বর ০১ আগে ঢুকবে। তখন আমি গেট এ দাঁড়িয়ে জনৈক মিথিলা রোয়াজা’র জন্য পথ গুনতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর  আরেক জন স্যার আসলেন। তাঁকে দেখে আগের ২ জন দাঁড়িয়ে গেলেন।

“কি ব্যাপার…আপনারা মেয়ে টাকে এইভাবে দাঁড়া করিয়ে রেখেছেন কেন?”-নতুন স্যার। “না না ক্যাডেট নম্বর ০১ এর জন্য অপেক্ষা যে করছেন আপনারা যদি না আসে ওই মেয়ে তখন!” পুরো  ঘটনা শুনে স্যার বললেন। এরপর স্যার আব্বুর সাথে হাত মিলালেন “আমি সাইফুল্লাহ আল মুর্তজা। আপনার মেয়ে যেই হাউজে, আমি সেই হাউজের হাউজ মাস্টার।” উনাকে ১বার নতুন করে দেখতে উনার দিকে তাকাতেই হুংকার “এই মেয়ে তোমার নাম কি?” আমি খুবই অবাক হয়ে গেলাম। যার নরমাল ভয়েস ই এমন তার তো কাউকে বকা দেয়ার দরকারই পড়বে না। আর দিলেও ডিরেক্ত সে হার্ট অ্যাটাক। ভয়ে ভয়ে বললাম আদিবা সুলতানা মীম। “অর্থ কি এই নামের?” এইটা কমন কোশ্চেন, ভাইভার জন্য মুখস্ত করেছিলাম। “the queen of the disciplined girls” এরপর উনি কিছু ১টা বললেন যা আমি ঠিক বুঝলাম না।

হাউজ এর দিকে পা বাড়ালাম। আব্বু আমাকে বললেন “মা তুমিই প্রথম ‘খাদিজা হাউজ’ প্রবেশ করলে, হয়তো এটা কোন ইতিহাস হবে না। কিন্তু এই কলেজ টা নতুন……আর এই নতুন কলেজ এর ইতিহাসে আমি আলাদা করে তোমার নাম দেখতে চাই।” কথাগুলোর মধ্যে অদ্ভুত কিছু ১ টা ছিল যেটা অনুভব করতে খুব ভালো লাগছিল কিন্তু কেন যেন খুব কান্না পেয়ে গেল। কিন্তু আমি আব্বু কে আগেই প্রমিস করেছিলাম কাঁদব না। তাই তাড়াতাড়ি করে সামনে এগিয়ে হাউজ বেয়ারা দিদি কে অনুসরণ করলাম।

ডরম নম্বর ২০৩। আমার ডরম। আম্মু আমার লকার বেড সব গুছিয়ে দিচ্ছিল আর আমি আব্বুর সাথে হাউজ টা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগ্লাম। কেন যেন হাউজ টাকে আমার প্রথম দেখাতেই বেশ পছন্দ হয়ে গেল, অবশ্য পছন্দ না করার মতো কোন কারণই নেই। আমার বাকি ডরমমেটরাও এসে গেল। এর কিছুক্ষণ পর আমরা সবাই ডাইনিং এ গেলাম। প্রিন্সিপাল স্যার এর বক্তৃতা- চা চক্র সব শেষে…… আব্বু আম্মুর বিদায়। আমি না ঠিক কলেজে চান্স পাওয়ার আনন্দে বুঝতেই পারি নি যে সত্যিই আমাকে একা একা সবাই কে ছেড়ে থাকতে হবে। আম্মু আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরে শেষ বারের মতো অনেক অনেক আদর করে দিলেন। হঠাৎ অবাক চোখে দেখলাম আব্বু আম্মু চলে যাচ্ছে আমাকে রেখে……চোখের পানিতে তাদের বিদায় টা আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে যেতে থাকল…………আর আমি……………আমি রয়ে গেলাম সম্পূর্ণ অচেনা অজানা নতুন ১টা জায়গায়……নতুন কিছু অচেনা মুখের ভিড়ে……যেখানে আমার সাথে আমার পরিচিত কেউই রইল না এমনকি আমি নিজেও না। কারণ তখন তো আমার নতুন এক পরিচয়। আমি ১জন ক্যাডেট। ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজ এর প্রথম ইনটেক এর ১জন ক্যাডেট। ক্যাডেট মীম।

 

২,২৪৭ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “আমার নতুন পরিচয়: আমি ক্যাডেট”

  1. সামিয়া (৯৯-০৫)

    চমৎকার!

    আমার ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা, একই অনুভূতি। আমি কোন প্রথম ইনটেকের ক্যাডেট না, কিন্ত আমার ইনটেক, আমার জন্য সারাজীবন ইতিহাস হয়ে থাকবে।
    আমার ক্যাডেট নম্বর অসাধারণ কোন সংখ্যা না। কিন্তু আমার কাছে এটা সারাজীবন অসাধারণ হয়ে থাকবে শুধুমাত্র এই জন্য যে এটা আমার ক্যাডেট নম্বর। যুগে যুগে আমরা একই অনুভূতি বয়ে বেড়াই আমাদের মস্তিষ্কে। এই ব্যাপারটা আমাকে বেশ মজা দেয়।

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    প্রথম ইনটেক এর ভাবসাবই আলাদা... :thumbup:

    আমাদের ভাব তোমাদের চেয়ে ৩১ গুণ কম, আমরা ৩২ ইনটেক...... 🙁
    সিসিবিতে স্বাগতম... :clap:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।