সোশ্যাল লোফিং

দ্যা আর্ট অফ থিংকিং ক্লিয়ারলি- ১

একবার এক রাজা সিদ্ধান্ত নিলো সে দুধের পুকুর বানাবে। সব প্রজাদের ইনস্ট্রাকশন দেওয়া হলো সবাই পরদিন সকালে এক কলসি দুধ নিয়ে পুকুরে ঢালবে। রাতে সবাই ভাবলো ” আমি যদি এক কলসি পানি দেই তাতে কোন সমস্যা হবে না, যেহেতু সবাই দুধ নিয়ে যাবে” ফলাফলঃ দুধের বদলে পানির পুকুর হয়ে গেলো।

একটি ট্রাক থেকে একজন মানুষ ১০০টি ইট নামাতে যদি ১০ মিনিট সময় লাগে তাহলে ৮ জন মানুষ ৮০০ ইট নামাতে কতো সময় লাগবে?
সহজ প্রশ্ন। হয়তো ক্লাস ওয়ান টু থেকেই শুনে আসছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে গণিত আপনাকে সহজ উত্তর ১০ মিনিট বললেও মনোবিজ্ঞান বলবে ; না, সময়টা বাড়বে। দলের উপর নির্ভরশীলতার কারণে বা ব্যাক্তিগত নৈপুণ্য একচেটিয়াভাবে প্রদর্শিত না হওয়ার কারণে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রোডাক্টিভিটি কমে যাওয়ার এই প্রভাবকে বলে ‘সোশ্যাল লোফিং’

এই বিষয়ে ১৯১৩ সালে করা ম্যাক্সিমিলিয়ান রিঙ্গলম্যানের করা একটি এক্সপেরিমেন্ট সর্বাধিক আলোচিত। তিনি পরীক্ষা করে দেখেন যে একজন ব্যাক্তিকে একটি দড়ি টানতে দিলে সে যে পরিমাণ বল প্রয়োগ করে ২ জনকে দিলে একেকজন তার প্রায় ৯৩% প্রয়োগ করে। সহযোগীর সংখ্যা ৩ হলে বল প্রয়োগ কমে হয়ে যায় প্রায় ৮৫%। একইভাবে সর্বোচ্চ ৮ জনের দলে একেকজন নিজের সামর্থ্যের প্রায় ৪৯% প্রয়োগ করে।

সর্বপ্রকার দলীয় কাজে যে সোশ্যাল লোফিং ঘটবে ব্যাপারটা তা’ও না। নৌকা বাইচের দল যতটা সোশ্যাল লোফিং এর স্বীকার হয়, রিলে রেসের দল ততটা হয় না। একেবারেই হয় না বলা চলে। কারণ রিলেতে ব্যাক্তিগত নৈপুণ্য শতভাগ দৃশ্যমান।

ব্যাপারটাকে আপাতদৃষ্টিতে যতটা স্বার্থপর মনে হচ্ছে আসলে ততটা না। দলের আকারের কারণে প্রোডাক্টিভিটি সাধারণত আমরা ইচ্ছা করে কমিয়ে দেই না। বরং আমাদের মস্তিষ্কই অবচেতনভাবে ফিল্টার করে নেয়। উদাহরণস্বরূপ একটা মিটিং এর কথাই ধরা যাক। ৫ জনের একটা মিটিং’এ আপনি যেভাবে পার্টিসিপেট করেন, ৫০ জনের মিটিং হলে কি সেভাবে করেন? করেন না। এটার মানে কিন্তু এই না যে, ৫০ জনের মিটিংটাকে আপনি কম গুরুত্ব দিচ্ছেন। বরং আপনার মস্তিষ্কই ফিল্টার করে দেয় যে “যেহেতু এখানে মানুষ বেশি, সুতরাং চুপ থাকো”।

এর মানে কী দলের আকার সবসময় ৫ জনেরই হতে হবে? না। আপনার দল কতো বড় হলে সর্বাধিক প্রোডাক্টিভিটি আশা করতে পারেন সেটা সম্পূর্ণই আপনার বিবেচনা। তবে এ সম্পর্কে অ্যামাজনের সিইও জেফ বেজোসের ‘২ পিৎজা নীতি’ সর্বমহলে সমাদৃত। তার থিওরী হচ্ছে দলের আকার এমন হওয়া উচিত যেন পুরো দলকে ২ টি পিৎজা দিয়ে আপ্যায়ন করা যায়। আপনার দল যদি তার চেয়েও বড় হয় তাহলে ধরে নিতে হবে আপনি এবং আপনার দল সোশ্যাল লোফিং’এর স্বীকার হতে যাচ্ছেন। কিছুটা অবাস্তব মনে হলেও অল্পকিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া প্রায় সবরকম দলের ক্ষেত্রেই এই থিওরী খেটে যায়।

পক্ষান্তরে ব্যাপারটাকে যতটা নিষ্পাপ মনে হয়, সবসময় ততটাও না। আপনি যদি একজন কর্পোরেট চাকুরীজীবি হয়ে থাকেন তাহলে আপনার অফিসের দিকে তাকান (কিংবা নিজের দিকেই)। আপনার যে কলিগ বসের সামনে সারাদিন ” কোম্পানীর স্বার্থ, কোম্পানীর স্বার্থ” বুলি ফোটায়, সে ইউরোপ আম্রিকা ট্রিপের মূলা ঝুলানো থাকলে নিজের একটা কাজ যতটা এফোর্ট দিয়ে করে, আপনার লিডারশীপে দলীয় একটা কাজে কী ততটা এফোর্ট দেয়? যত বড় ‘কোম্পানীর স্বার্থ’ই জড়িত থাকুক। অথবা আপনি নিজে কী একই দোষে কখনো দোষী হন নি?
(কর্পোরেট ভাইয়েরা মারতে আসবেন না প্লিজ। একটা উদাহরণ লাগতো, নিজের পিঠ বাঁচালাম জাস্ট)

যেসব চালাক ভাইয়েরা সোশ্যাল লোফিংকে ব্যাক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করেন তাদের হিসাব আলাদা। তবে আসল সোশ্যাল লোফিং’এর যেসব সমাধান বিশেষজ্ঞরা দিয়ে থাকেন তার কয়েকটা হলোঃ দলের আকার ছোট রাখা, সবার অবদানকে দৃশ্যমান রাখা, স্কিল অনুযায়ী কাজ ভাগ করা, যার যার কাজ অনুযায়ী প্রণোদনার ব্যাবস্থা রাখা, সব কাজের ইভালুয়্যাশনের ব্যাবস্থা করা ইত্যাদি।

সবচেয়ে প্র‍্যাকটিক্যাল সমাধান পাওয়া যায় বোধহয় সামরিক বাহিনীতে। একদম প্রথম সমস্যাটায় ফিরে যান।
সমাধানঃ You all are going to unload 100 bricks each from the truck. Once you are done, report individual timing to the adjutant. Break off!!

 

৮৩৩ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “সোশ্যাল লোফিং”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।