জীবন’টা তাহলে এমনই!

বছর আটেক আগে এ’পাড়ায় থাকতে এসে খুবই খুশি! এমন একটা পাড়ায় আমি থাকবো; ভাবাই যায় না। অনেক বড়-বড় মানুষের বাড়ি এ’পাড়ায়। ভালোই আছি; জীবন চলে যাচ্ছে; ধীরে-ধীরে প্রতিবেশীদের সাথে পরিচিত হচ্ছি। বেশ কদিন চলে গেলো। এ’পাড়ার বাসিন্দা হিসেবে মনের মধ্যে একটা ভাব এসেছে খেয়াল করলাম। নিজেকে বড়-বড় লাগে। চললো জীবন।
সিনেমায় যেমনটা ঘটে, ঠিক তেমনি করেই আমার সুখ আর বেশিদিন সইলো না। এ’পাড়ায় আমার প্রথম কুরবানী ঈদের নামাজ সেরে আসার পথে দেখি আমার প্রতিবেশি মুনির সাহেব (সত্যিকার নাম নয়) ঠিক রাস্তার মাঝখানে পশু ফেলে কুরবানী করছেন। রাস্তার একপাশে নয়, একেবারে মাঝখানে। আমার মনের, আমার ভাবের স্বর্গপতন হলো। একি! এ’পাড়ার মানুষ আর কারো কথা চিন্তা না করেই রাস্তার মাঝখানে কুরবানী করেন!
দাঁড়িয়ে মুনির সাহেবকে আলতো করে জিজ্ঞেস করলাম তার এমন সিদ্ধান্তের কারণ কি। তিনি আমার কথা ভ্রুক্ষেপ’তো করলেনই না; বরং তার বাবা যে একজন সমাজপতি ছিলেন সেই গল্প শোনাতে শুরু করলেন।
আমি বুঝে গেলাম এ’পাড়ার বাসিন্দা হিসেবে আমার ভাব নেয়া বন্ধ করতে হবে। আর না দাঁড়িয়ে নিজের কাজে গেলাম। তার পর বেশ ক’বছর কেটে গেলো, তিনি ঠিক রাস্তার মাঝখানেই কুরবানী করেন এবং তাকে কেউ কিছু বলে না। কেউ বলতে গেলেই তিনি তার বাবার নাম-ধাম নিয়ে গল্প শুরু করেন। বেচারা বাবা যদি যানতেন তার ছেলে কিভাবে তার নাম ক্ষুন্ন করছে! তাকে নিয়ে আমি আর চিন্তাও করি না।
এই গেলো কুরবানী ঈদে ঘটলো আরো মজার ঘটনা। আমি নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরেই দেখি আমার দু’জন কাছের প্রতিবেশী — যারা আমার সাথে একই ভবনে থাকেন – আমি যেখানে গাড়ী রাখি সেখানে গরু ফেলে কুরবানী করে দিয়েছেন! আমার পার্কিং’এর স্থান লালে-লাল। একবারও আমায় জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করেন নি। আমায় জিজ্ঞেস করলে আমি হয়তো না করতাম না, কিন্তু আমায় কিছু না বলায় আমার রাগ হল। গেলাম তাদের কাছে। বললামঃ “এটা আপনারা একেবারেই ঠিক করেন নি”। তারা কুরবানী শেষ হলে মাংস অন্যখানে সরিয়ে নিলেন এবং একজন দুঃখ প্রকাশও করলেন।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। তার ক’দিন পর আমার স্ত্রীর কাছে শুনলাম এই দু’জন এক হয়ে এখন আমার কি-কি দোষের কাজ করি তা বের করার চেষ্টা করছেন। তাদের অভিযোগ, আমি নাকি ঈদের দিন তাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছি! এরই একজন এক সময় নাকি ক্যাডেট কলেজে পড়াশোনা করেছেন!
আমি অবাক হলাম না; এটা অবাক হবার মত কিছু নয় বোধ করি। আমাদের চোখের সামনে আরো কত অবাক করা ঘটনা অবলীলায় ঘটে চলেছে! কই কারো’তো সমস্যা হচ্ছে না; আমারও বা কেনো হবে? তারা হয়’তো আমার কিছুই করতে পারবে না, তবে খারাপ লাগলো এই ভেবে যে ই মানুষগুলো অন্যের কথা একবারের জন্যেও ভাবে না। আর ভাববেই বা কেন? আমাদের জাতীয় জীবনে এরকম হাজারো ঘটনা আছে যা নিয়মিত ঘটে চলেছে কারো কথা চিন্তা না করে। ফুটপাতে চলার সময় আশেপাশে না তাকয়ে থুথু ফেলা, রাষ্ট্রপ্রধান আর কারো কথা না ভেবে রাস্তের উলটো পাশ দিয়ে চলাচল করা, পুলিশ সার্জেন্টরা মানুষকে সাহায্য না করে বিপদে ফেলার চেষ্টা করা – এমন অনেক অনেক কিছুই’তো হচ্ছে। তারপরও তো জীবন থেমে থাকে না। আমরা পথ চলতে থাকি।
জীবন বোধহয় এভাবেই চলে এবং এসব কিছু আমাদের মেনে নিতে হয় এই মনে করে যে আমাদের চারিপাশে মন খারাপ হওয়ার মত যা হচ্ছে তাই বোধহয় স্বাভাবিক। তাই কি? তাহলে বলেই ফেলি আসিফের গল্প’টা।
আসিফুর রহীম আমার ছাত্র ছিল। আমি তাকে কদিন ইংরেজী পড়িয়েছিলাম অনেক আগে। এখন সে আমার সহকর্মী; প্রতিদিন দেখা হয়। সম্প্রতি আমি সিগ্রেট ছেড়ে দেয়ার জন্য বেশ চেষ্টা করছি। সে কারণে বেশ দাম দিয়ে একটা ই-সিগ্রেট কিনলাম; দশদিন খুবই আস্থার সাথে তামাক, আলকাতরা ও কার্বন মন-অক্সাইড যুক্ত সিগ্রেট বাদ দিয়ে দিব্যি ই-সিগ্রেট টেনে যাচ্ছি। ভালোই লাগছে।
দশদিন যাবার পর আমার আবার কপাল ভাঙ্গলো। হাত থেকে ই-সিগ্রেট’টা পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে গেলো। বেশ দামী ছিলো তাই আবার কেনার ইচ্ছে থাকলেও সাহস হল না। আবার ফিরে গেলাম সেই পুরনো অভ্যাসে। কয়েকদিন গেলো। একদিন অফিসের নীচে নেমে সিগ্রেট ধরিয়েছি, দেখি আসিফও সেখানে দাঁড়িয়ে ই-সিগ্রেট টানছে। সিগ্রেটে সাধারনত তার কোন অভ্যাস নেই, তবে একটা ই-সিগ্রেট একটা কিনেছে এবং মাঝে-মাঝে টান দেয়া তার জন্য একটা ফ্যাশন। আমায় দেখেই আসিফ জিজ্ঞেস করলো আমার ই-সিগ্রেটের কথা। আমি তাকে আমার কপাল পোড়ার কথা বললাম। সে একটা হাঁসি দিয়ে চলে গেল ভেতরে।
সন্ধায় অফিস ছুটির সময় লিফটে আবার দেখা। নীচে নেমে আবার পকেটে হাত দিলাম সিগ্রেট বের করার জন্য। আমার পকেটে হাত দেয়া দেখেই আসিফ আমার কাছে এসে বললোঃ “আমার ই-সিগ্রেট’টা আসলে আমার প্রয়োজন নেই; আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি; কিন্তু আপনি প্লীজ আর এই ধুমপান করবেন না।“
আমি তার দিকে স্থির তাকয়ে রইলাম। জানতাম আসিফ আমাকে পছন্দ করে, কিন্তু এবারে দেখলাম ভালোবাসা। অবিভুত আমি! ভাষা খুঁযে পেলাম না তাকে ধন্যবাদ জানানোর। তবে এ্যাতোটুকু বুঝলাম জীবনে সারাক্ষনই মন খারাপ করা ঘটনাই ঘটে না, প্রচন্ড ভাললাগার বিষয়গুলোও সব খারাপকে ছাপিয়ে আমাদের সামনে এগুতে শক্তি যোগায়।

২,১৪০ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “জীবন’টা তাহলে এমনই!”

  1. ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)

    ১। এবার সিটি কর্পোরেশনের "নির্ধারিত" স্থানে কোরবানি করতে অনুরোধের প্রেক্ষিতে অনেকের অনুভূতি আহত পর্যন্ত হয়েছে...

    ২। জীবনে সারাক্ষনই মন খারাপ করা ঘটনাই ঘটে না দিনশেষে কথা সেটাই... (ভাগ্যিস)



     

    এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...

    জবাব দিন
  2. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    ই-সিগারেট টানতে দেখেছিলাম আমার একটা আমেরিকান বান্ধবীকে। আমার বেশ মজা লেগেছিল ওর এই মিছেমিছি স্মোক করা দেখে। ও নিকোটিন প্যাচ ব্যবহার করতো প্রথমে; পরে সেটি ছেড়ে ই-সিগারেট ধরেছে। মজার ব্যাপার হলো লরা ই-সিগারেটের সাথে সাথে সতি্যকার সিগারেটও টানে। আমরা ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা লেবানিজ রেস্তোরাঁতে মজা করে এ্যাপল-সিনামন ফ্লেভাডর্ হুকা টেনেছিলাম একবার।

    জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    শেষ হল আশাবাদ দিয়েই, তাই ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে গেলাম। কিন্তু লেখার শুরুর দিকের ছবিগুলো মন থেকে তাড়াতে পারছি না। অস্থির হয়ে পড়ছি।
    বয়স যে হচ্ছে তার প্রমাণ। 🙂

    ইকরাম ভাই, অনেকদিন পর আপনার লেখায় মন্তব্য করা হল। আপনার লেখা ভীষণ ভালো লাগে।
    ভালো আছেন?

    জবাব দিন
  4. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    হ্যাঁ, সেটাই।
    ভাল মন্দ - এসব নিয়েই জীবনের এগিয়ে চলা।
    এতে হতাশাও আছে, আবার তা কাটানোর উপায়ও আছে......

    লেটস কন্টিনিউ দ্যা ওয়াইল্ড রাইড, মাই ফ্রেন্ড...


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  5. জিহাদ (৯৯-০৫)

    সবকিছু মিলিয়েই জীবন। আপনারা তো সবসময় গাড়িতে চলাচল করেন। কখনো পায়ে হেটে ফার্মগেটের দিকে আসলে তেজগাঁও স্কুলের সামনের ওভারব্রীজের এক কোণায় দেখবেন ছোট একটা পলিথিনের ছাউনি করা আছে। আমি একদিন যাওয়ার সময় দেখি মাঝবয়েসী একজন ছাউনির নিচের কাউকে পরম আদরে খাইয়ে দিচ্ছে। একটু কাছে যেতেই সন্ধ্যার আলোতে দেখলাম পরম আদরের মানুষটা আর কেউ না, তার পোষা কুকুর। তাকে শুইয়ে দিয়ে উপর দিয়ে চাদর দিয়ে আবার ঢেকে দিয়েছে। তারপর থেকে ঐদিক আসার সময় আমি উৎসুক হয়ে এই দুইজনকে খুঁজি। মাঝে মাঝেই দেখা মিলে যায়। দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়। এত মন্দের ভীড়েও এইরকম কিছু ভালো অভিজ্ঞতার কারণেই জীবনটাকে পুরোপুরি খারাপ বলতে পারিনা।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  6. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    দূর থেকে সব বনই ঘন।
    সব পকুরই গভীরতম।

    কাছে গেলেই উন্মোচনে বেরোয় সে তো কেবলি পাঁচখানা বুড়ো বৃক্ষ অথবা সাত জনমের জলা মজানো।

    জীবন এমনই প্রহসনময় সত্য আড়াল করা হেঁয়ালী। আর তার পরতে পরতে গাঁট হয়ে বসে থাকে চোরকাঁটা, ঢোরা সাপ। ভয়ানক বিপদের যেনো ছবি নয়তো অভিশাপ।

    হেসে তারে ধূম্রকূটশলাকার উদগীরিত ধোঁয়ার মতোই হাত দাবড়ে তাড়িয়ে দিতে যতোটুকুন দেরী এই যা।

    এমন লেখা আমাদের সেই হাত নাড়ানোতে আরো দ্রুত ক্রিয়াশীল করে তুলবে।

    ধন্যবাদ বন্ধু। (সম্পাদিত)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।