২০০৪ সালের দিকে পেশাগত কাজে মিরপুর মাজার রোডে প্রতিদিনই আমার যেতে হতো। যেদিন সন্ধ্যাবেলায় যেতাম, এক নাম্বার গোল চত্বরের কাছে নির্দিষ্ট একটি যায়গায় প্রতিদিন কিছু লোকের জটলা দেখতাম। একদিন কৌতুহলে উঁকি দিয়ে দেখলাম দুজন লোক একটি কাপড় দিয়ে ঢাকা বালতির ভেতর থেকে ছোট ছোট প্লেটে কিছু তুলে তুলে মানুষকে দিচ্ছে। এবার একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম-একি? এ যে খাবারের উচ্ছিষ্ট, এ কি করে সম্ভব? আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, এগুলো কি বিক্রি হচ্ছে”? লোকটি বললো, “এগুলা হইলো কমিউনিটি সেন্টারের ঝুটা”।
ভীষণ ধাক্কা খেলাম। এরপর থেকে কৌতুহল বশতঃ আমি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে এই সান্ধ্য বিকিকিনি দেখতে লাগলাম। যতদূর মনে পড়ে, তখন প্রতি প্লেট পাঁচ টাকা করে বিক্রি হতো। ক্রেতা এলে বিক্রেতা বালতির ভেতর হাত ঢুকিয়ে ছোট একটি প্লেটে যা উঠে আসে তা দিয়ে দিত। কারো ভাগ্যে আধ খাওয়া কাবাব-পোলাও, কারো ভাগ্যে রোস্টের হাড়ে লেগে থাকা উচ্ছিষ্ট-পোলাও আর কারো বা ভাগ্যে পড়তো রেজালার ভগ্নাংশ-পোলাও। কারো যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন না থাকতো, তাহলে জর্দা বা ফিরনি মাখানো পোলাও পড়তো, খাবারের একমুখী স্বাদ থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হতো। কখনও কখনও দেখেছি শিশু কাস্টমার প্লেটে খাবার আসার পর আকুল চোখে বিক্রেতাকে বলত, “আমারে একটা রোস্টের টুকরা দিবেন”? বিক্রেতা তখন বালতি হাতড়ে আধখাওয়া রোস্টের একটি টুকরা শিশুটির পাতে তুলে দিয়ে বলতো, “যা, দূরে গিয়া খাইস”। শিশুটির মুখ তখন অপার্থিব হাসিতে ভরে উঠতো। এখনও ভাবলে আমি স্তম্ভিত হই, নিজের চোখে না দেখলে হয়তো তা আমি বিশ্বাস করতাম না।
আমার এ জীবনে আমি জার্নি, কাজের চাপ বা জোর করে করা ডায়েটিং ছাড়া কখনও তিন বেলা খাবার মিস করেছি বলে মনে করতে পারছিনা। আমরা আমাদের বাচ্চাদের পেছনে পড়ে আছি তাদেরকে জোর করে খাওয়ানোর জন্য। যদি কখনও সন্তান একটি বেলায় দু’ লোকমা খাবার কম খেয়েছে, তখন অস্থির হয়ে বাচ্চাকে নিয়ে ছুটেছি শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে “ডাক্তার সাহেব, বাচ্চা কিছুই খাচ্ছেনা”।
প্রতিদিন যে খাদ্যের শ্রাদ্ধ আমরা করে চলেছি, তা যে আমাদের প্রতিপালকের কত বড় দান, তা হয়তো আমরা সমগ্র জীবদ্দশায় স্মরণ না করেই বিদায় নিচ্ছি পৃথিবী থেকে। শুধুমাত্র একটি চালের পরিমান খাদ্য মানুষ শ্রেষ্ঠতম ল্যাবরেটরিতেও এখনও তৈরী করতে পারেনি এবং ভবিষ্যতে পারার সম্ভাবনাও প্রায় শূন্যের কোঠায়। বিয়ে বাড়ীতে মুরগীর রোস্টের যে অংশ আমরা চিবিয়ে ফেলে দিয়ে মিরপুরের সেই লোকগুলোর পাতে ঠেলে দিচ্ছি সে মুরগী হলো একটি প্রোটিন জাতীয় খাদ্য। আমাদের এক কামড় মাংসের কয়েক কোটি ভাগের একভাগ হলো একটি প্রোটিন অনু। অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, আল্লাহর সৃষ্টি জগতের অবিশ্বাস্য রহস্যময় একটি সৃষ্টি হলো এ প্রোটিন অনু, যার ভেতরে থাকা ডিএনএ আর আরএনএ এর আকাশ পাতাল রহস্যের বেশীরভাগ এখনও মানুষের ধারণার বাইরেই রয়ে গেছে। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে আল্লাহর সৃষ্টির রহস্যময়তা ঘুরে বেড়িয়েছে, তবে আমরা তা কখনও দেখিনি, বরং প্লেট ভর্তি খাবার নষ্ট করেছি, কাজের লোককে ডেকে বলেছি, “আজ আর খাবোনা, এগুলো ফেলে দে”।
আমাদের টেবিল ভর্তি খাবার আজ দিন শেষে ডাস্টবিন ভর্তি করে চলে যাচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের ভাগাড়ে। অধিকাংশ ঘরে নিজেরা যে পানি আমরা খাই বা সন্তানদের খাওয়াই, তা প্রথমে ফূটানো হয়, এরপর ঠান্ডা করে ফিল্টারের ভেতর দেয়া হয় এবং এরপর সেই পানি ফিল্টার হয়ে এলে তারপর তা খাই। আর আমাদের ফেলে দেয়া খাবারগুলো আমাদের বাচ্চাদের মতই রক্তে মাংসের শিশুরা ডাস্টবিনের ভাগাড়ে ঢুকে সমস্ত ময়লা থেকে তা তুলে তুলে নিয়ে খায়। কখনও যদি সেখানে ভালো কিছু পেয়ে যায়, পকেট থেকে পলিথিন বের করে অনুপস্থিত ছোট বোনটির জন্য নিয়ে যায়। আল্লাহ আমাদের ভালো খেতে মানা করেননি, তবে খাদ্যের মতো অপরিসীম নিয়ামাত আমরা নিজেরা হেলায় অপচয় করে চলেছি আর আমাদের সন্তানদেরকে অপচয়ে প্রশ্রয় দিচ্ছি। এর পরিণতি কখনও ভালো হবার নয়।
সহীহ বুখারীতে আইশা রাঃ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাঃ এর ঘরে আমাদের এমন কখনো হয়নি যে পর পর তিনদিন আমাদের বাড়ীতে চুলা জ্বলেছে। কখনও কখনও এমন হয়েছে যে, মাসের পর মাস আমাদের ঘরে চুলা জ্বলেনি”। মানুষ আইশাকে জিজ্ঞেস করলো, “তখন আপনারা কি খেয়ে থেকেছেন”? তিনি বললেন, “ঘরে একটি থলেতে খেজুর রাখা থাকতো। আমরা দু-একটি খেজুর আর পানি খেয়ে নিতাম”।
কখনও যদি রাসুল সাঃ এর সামনে ভালো কোন খাবার এসেছে, তাঁর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে অশ্রু, আর তিনি আল্লাহকে বলেছেন, “জানিনা হে আমার প্রতিপালক, আমার সকল নিয়ামাতের প্রাপ্য তুমি এই পৃথিবীতে দিয়ে দিচ্ছ কিনা”। রাসুল সাঃ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন এমন অবস্থায় যে, তিনি কখনও চিকেন চোখে দেখেননি, অধিকাংশ সবজি দেখে যেতে পারেননি, ভাত বলতে যে একটা খাদ্য আছে তা তো তিনি দেখেও যেতে পারেননি, তাঁর সাহাবাগণও তা চোখে দেখেছেন রাসুলের মৃত্যুর পর। (আজকের যারা বড় বড় উপাধী গ্রহণকারী নামধারী বুজুর্গ বা অলী হিসাবে নিজেদের পরিচয় দেয়, তাদের শান শওকত দেখে ভাবা অসম্ভব যে, এ লোকটি মানুষকে রাসুলের শিক্ষা দিতে পারে)।
ঘটনাটির সত্য মিথ্যা আমি জানিনা, তবে এক বন্ধু ঠাট্টাচ্ছলে একবার কথাটা বলেছিলো, যা মনে করলে কেন জানি এখনও বুকটা হু হু করে উঠে।
মা ছেলের পেছনে মাখা ভাত নিয়ে ঘুরছে, ছেলে কিছুতেই খাবেনা। এক সময় জানালার কাছে গিয়ে দূর বস্তিতে উদোম গা শিশুদের দেখিয়ে মা বাচ্চাকে বললেন, “খাও বাবা, তুমি কি জানো, বেশীরভাগ দিন ঐ বাচ্চাগুলো সারাদিনে দু’বেলা ভাত খেতে পারেনা”। ছেলে বলল, “বাহ, বেশ তো, ভাত খেতে পারেনা তো কি হয়েছে, বার্গার খাবে”।
কিছুদিন আগে মাত্র ৬ মিনিটের চমৎকার এই শর্ট ফিল্মের লিঙ্ক পেলাম
আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।
:clap: :clap: :clap:
খেয়া (২০০৬-২০১১)
থ্যাংকস খেয়া
ফাইয়াদ,
হৃদয় নাড়ানো লিখা! আল্লাহর কাছে আমরা এর শুকরিয়া কিভাবে আদায় করবো জানিনা।
তোমাকে-আমাকে-সকলকে আল্লাহ ওদের দুঃখে পাশে দাঁড়ানোর তৌফিক, মনমানসিকতা দান করুন। আমীন।
পুনশ্চঃ ফ্রান্স বিপ্লবের ইতিহাস বলে, ভুখা নাঙ্গা দরিদ্র জনগণের হাতে বাস্তিল দুর্গ পতন প্রায় আস্নন, রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটক আক্রান্ত, ফ্রান্সের রাজা লুইস নেশায় রক্তিম চোখে চাটুকারদের প্রশ্ন করেছিল, " ওরা এত উত্তেজিত হয়ে কি চায়" উত্তরে চাটুকাররা বলে " হুজুর, ওরা রুটি খেতে চায়" রাজা তখন বলেনঃ "ওদের রুটি বদলে কেক খেতে দাও!"
তার অল্প পরেই বাস্তিল দুর্গ পতন হয় এবং প্রতিটি কথিত "নীল রক্ত ধারি" নারী-পুরুষ শিশুকে গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ করা হয়।
Smile n live, help let others do!
আজিজুল ভাই
লিখেছি বটে তবে আমিও অপরাধী। রাসুল সাঃ বলেছেন, "সে ব্যক্তি মুমিন নয়, যে নিজে পেট পুরে খেল, অথচ তার প্রতিবেশী উপোস থাকল"। আল্লাহর অনন্ত ক্ষমা ব্যতীত মুক্তির পথ দেখছিনা।
:clap:
থ্যাংকস রিদওয়ান
:thumbup: