স্মৃতির পাতায় বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপ এক উন্মাদনার নাম ;বিশ্বব্যাপী আরাধ্য ভালবাসার নাম । টুকরো টুকরো জ্বলজ্বলে সব স্মৃতি নিয়ে আর মাত্র কয়েকদিনেই হাজির হচ্ছে বিশ্বকাপ ২০১৪। সপ্তম বারের মত হাজির হবে মানসপটে, মনের আনাচে কানাচে লুকানো স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসবার এখনই সময় । সত্যি বলতে কোন বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচ তো দেখা হয় ই নি – এমনকি সিংহভাগও না । কারণ বিভিন্ন, কিন্তু মূল সুর অভিন্ন। না দেখার কষ্ট, আর যেটুকু দেখা তার তীব্র আনন্দ কিংবা হতাশা । এই সামান্য অথবা মন ভরে, দুচোখ ভরে দেখার অনাবিল আনন্দ-ই বিশ্বকাপকে করেছে বিশ্বের কাপ । বিশ্বকাপ তাই কেবল একটি বিজয়ী দলের নয় – সকলের আবেগ আর অনুভূতি সিক্ত হয়ে আজ সার্বজনীন, বিশ্বজনীন ।

আমার কথা বলি। ১৯৯০। বয়স মাত্র চার। হঠাৎ একদিন বিকালে বাসায় আবিস্কার করলাম একটা টেলিভিশন – আমাদের টেলিভিশন !! শুনলাম রাতে নাকি বাঘ আর সিংহের লড়াই হবে । খুব ভয়ে আড়চোখে দেখতে লাগলাম । কখন জানি ঘুমিয়েও পড়ি । সকালে উঠে শুনি সিংহ নাকি বাঘকে হারিয়ে দিয়েছে । সেই থেকে সিংহের আলাদা একটা সম্ভ্রম আমার কাছে বহুদিন ছিল। বড় হয়ে পরে জানতে পারি ওটা ছিল আফ্রিকার সিংহ ক্যামেরুন আর আর্জেন্টিনার লড়াই। আমাদের নতুন টিভির মত বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে আজো বিক্রি হয় হাজারো টিভি – পত্রিকার পাতা জুড়ে আকর্ষণীয় সব বিজ্ঞাপন আর ডিসকাউন্টের ফুলঝুরি । যাই হোক নব্বই বিশ্বকাপের স্মৃতি আমার ওটুকুই।

চারবছর পর ১৯৯৪ । ততদিনে পুরোদস্তুর পড়াশুনা করি – পাঠ্য বইয়ের চেয়ে পত্রিকাই বেশি । জানি বিশ্বকাপ কি, কবে , কোথায় হবে, কারা খেলবে ইত্যাদি । তখনকার পাঠ্যবইয়ে (সম্ভবত ক্লাস ফাইভের ) কালোমানিক পেলের গল্প পড়ে ব্রাজিল নামক একটা দেশের প্রতি টানও জন্মায় কিছুটা। মার্কিন মুলুকে শুরু হয় বিশ্বকাপ । বাসার তিনজন এবার তিনদলের সমর্থক – আব্বু আর্জেন্টিনা , আম্মু জার্মানি আর আমি ব্রাজিল। ফলাও করে ছাপানো হয় কলম্বিয়া নাকি টপ ফেভারিট ; বিশ্বকাপ জেতার দৌড়ে আরো আছে আর্জেন্টিনা, ইটালি, ব্রাজিল ; ম্যারাডোনা এবারও হবেন সেরা খেলোয়াড়… ইত্যাদি । কয়েকদিন পর আবার নিউজ আসে ডোপ নিয়েছেন ম্যারাডোনা, বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ । ডোপ কী বুঝি না তখন কিন্তু তা যে ভাল কিছু নয় তা বুঝতে সমস্যা হয় নি । একদিন সকালে বুলগেরিয়ার সাথে আর্জেন্টিনার খেলা । রন্ধ্রে রন্ধ্রে তখন বিরোধিতার সুর। শেষ পর্যন্ত হেরেই গেল আর্জেন্টিনা । সবাইকে খুশিমনে ক্ষ্যাপাতে লাগলাম । আর হ্যাঁ কেউ কোনদলের সমর্থক জিজ্ঞেস করলে নির্দ্বিধায় বলে দেই ব্রাজিল । রোমারিও-বেবেতোরা জয় করে নিয়েছে শিশু-হৃদয়। ক্রমেই শেষ হয়ে আসে আসর। মনে গেঁথে যান স্টয়চকভ , রজার মিলা, ক্লিন্সম্যান, হাজি, বাতিস্তুতা, ভলদারামা আর এসকোবার। সবশেষে ফাইনাল। টাইব্রেকার। অন্তিম মুহূর্ত । রবার্টো ব্যাজ্জিওর মিস। বিশ্বজয়ের আনন্দ – ব্রাজিলের সাথে আমারও।

১৯৯৮ সাল। ফ্রান্স। স্টিকার ,কোকাকালার মুখ , জার্সি, ফিক্সচার, ছবি নিয়ে মাতামাতির দুরন্ত কৈশোর । ততদিনে খেলাটা মোটামুটি বুঝি । রিকি মার্টিনের ‘গো ফর গোল’ তখন মুখে মুখে । শুরু হয় খেলা, গোলের লড়াই। মুগ্ধ হই এক টেকোর পায়ের জাদুতে – রোনাল্ডো । হেলেদুলে ঘুরতে থাকা ঐ শরীর বক্সে গেলে কীভাবে যে এত গতি পায়!! ক্রমেই মুগ্ধ হই চিলির বিখ্যাত ‘জা-সা’ জুটির খেলায় , মাইকেল ওয়েনের দুর্দান্ত গোলে মুগ্ধ হই। ভাল লাগে এরিয়েল ওর্তেগার ড্রিবলিং , ক্লাইভার্টের পাস আর ট্যাকল। হোসে লুই চিলাভার্টের গোলকিপিং ভাল লাগা বাড়িয়ে দেয় আরো এক ধাপ। এগোতে থাকে ম্যাচ; বাদ পড়তে থাকে সব দল একে একে । সবশেষে রইল বাকি দুই । স্বাগতিক ফ্রান্স আর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। হেসেখেলেই জিতবে ব্রাজিল এ ভেবেই দেখতে বসি । কথায় আছে না পানির স্পর্শে কুমির হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর , তেমনি দেশের মাটিতে ফরাসিরা হয়ে ওঠে ভয়ঙ্করতম। শুরুতেই গোল । হাফ টাইমের আগে আরো একটা । দুই গোল খেয়েও ভাবি শোধ হবে । কিসের কী । শেষ মুহুর্তে আরও এক গোল খেয়ে তিন গোলে হারল ব্রাজিল। শোকে পাথর হয়ে যাই । জুলে রিমের দেশে গেল বিশ্বকাপ ।

দেখতে দেখতে ২০০২ । ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ। হুনাইন হাউজ। কলেজে দেখা একমাত্র বিশ্বকাপ । বিতর্কিত গোলে তুরস্ককে হারায় ব্রাজিল ; কোন গোল পর্যন্ত করতে না পেরে বিদায় নেয় ফ্রান্স; বাজে খেলে বিদায় নেয় পর্তুগাল। বেশী মনে পড়ে আর্জেণ্টিনা- সুইডেন ম্যাচ । আর্জেন্টিনার চাই জয় , সুইডেনের ড্র । ক্লাস শেষে দৌড়ে কমনরুমে … আগে ছুটি হল সেদিন ।কলেজ প্রিফেক্ট ফয়সল ভাই , আমি আর বন্ধুবর আমজাদ। ঢুকলাম সাথে সাথেই গোল খেল আর্জেন্টিনা। কমনরুমের চেয়ার থাবড়াতে লাগলাম আর সেই সাথে চিৎকার । হঠাৎ ক্ষেপে গেলেন আর্জেন্টিনা সমর্থক ফয়সল ভাই। আমাদের দুইজনকে নিয়ে গেলেন রুমের সামনে। সেই প্রথম ও শেষবারের মত ক্রসবেল্টের মার খাওয়া । আমাদের আক্রোশেই আর্জেন্টিনা বিদায় নিল কিনা কে জানে! স্মরণীয় হয়ে আছে আরেক ম্যাচ – স্পেন আর আয়ারল্যান্ড । স্পেন শুরুতেই গোল দেয় । ইয়ান হার্টের পেনাল্টি মিসের পর শেষ মিনিটে গোল শোধ করেন রবি কিন – এরপর এল এক্সট্রা টাইম । উত্তেজনা তুমুল , সেই সাথে উত্তেজনা ব্লক টয়লেটেও । প্রেপ ডিউটি নাকি আমিরুল ইসলাম স্যারের । শুরু হয় টাইব্রেকার । ওদিকে স্যারও এগিয়ে আসছেন । গোল দিল রবি কিন , উল্লাস নেই কোন !! স্যার ঘুরে চলে গেলেন। শেষ হল ম্যাচ। জিতল স্পেন। ভাঙল বাথরুমে লুকানো রেডিওশ্রোতা আমাদের কয়েকজনের হৃদয় । ঐ বিশ্বকাপে অলিভার কান আর রুস্ত রেকবারের পারফরম্যান্স নজর কাড়ে । দুই গোলরক্ষকের নির্ভীক পদচারণায় উজ্জীবিত হয়ে আমি নিজেও কিছুদিন গোল কিপিং করি । এর মধ্যে খেলাও এগিয়ে চলে। রোনালদিনহোর অবিস্মরণীয় গোল , পক্ষপাতিত্বের সুবাদে কোরিয়া পৌঁছায় সেমিতে , সেনেগালের কিছু অসাধারন মুভ মন ভরিয়ে দেয় , তুরস্কের টিম এফোর্ট মুগ্ধ করে। আর হ্যাঁ শেষ হল প্রত্যাশিত রোনালদো আর কানের জমজমাট লড়াইয়ে । কানের দৃষ্টিনন্দন সব সেভের পরও স্কোরলাইন রোনালদো ২- ০ কান ।

২০০৬ বিশ্বকাপ । বড় অসময়ে এল । বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি । ফার্স্ট টার্ম । দিনশেষে ঘুমানোই যেখানে সামান্য স্বস্তির নিঃশ্বাস , সেখানে খেলা দেখা যে নিতান্তই বিলাসিতা ! তারপর ও ভালবাসা তো আর ঠেকিয়ে রাখা যায় না ! সারাদিনের পরিশ্রমের পর মাঝরাতে দেখি একটা দুটো ম্যাচ। রুমে আসতে থাকে দৈনিক পত্রিকা । স্মৃতির পাতায় খুব বেশি ম্যাচ নেই – গ্রুপ পর্বের একটা ম্যাচ ও দেখা হয় নি । তবু জেনে যাই গ্রুপ অফ ডেথ থেকে আর্জেন্টিনা পরের রাউন্ডে , সব ফেভারিটরাও আছে । এরপর দেখি ব্রাজিল-ঘানায় জয় ব্রাজিলের– তবে স্কোরলাইন ঠিক বলেনি , ভাল স্ট্রাইকার থাকলে ঘানা ৪/৫ গোল দিলেও দিতে পারত । পর্তুগাল নেদারল্যান্ড কে হারালো , ইংল্যান্ডকেও । জার্মানি টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনাকে হারায় ; বড় ভুল হিসাবে রয়ে যায় রক্ষণাত্মক কৌশল । জিদানের অসাধারন পায়ের জাদুতে আবারো অসহায় পরাজয় ব্রাজিলের ; অসাধারন সব ড্রিবলিং আজো মনে পড়ে। ১১৯ মিনিট ঠেকিয়েও শেষ রক্ষা হল না স্বাগতিক জার্মানির । আসে আরাধ্য ছুটি , সাথে আরেকটি ফাইনাল । ফ্রান্স আর ইতালি । ওহ জিদান ! স্বপ্নের নায়কের মহাকাব্যিক বিদায় আর শোকগাথা নিয়ে শেষ হল বিশ্বকাপ , পেনাল্টি শুট আউটের সময় তো আমি গভীর ঘুমে ।

২০১০। দক্ষিন আফ্রিকা। আর আমি তখন সিলেটে, চলছে বেসিক কমান্ডো কোর্স । সকালে উঠতে হয় ৫টার আগেই – তাই ঘুমানোর তাড়না থাকে অনেক বেশি । তাই বলে ঘুম কি আর খেলাকে হারাতে পারে ? দেখতে থাকি এরই ফাঁকে ফাঁকে । এবার ঘটল একটু অন্য ঘটনা । নিজের জার্সি তো কিনলাম ই , বোনকেও কিনে দিলাম ব্রাজিলের জার্সি । আর হ্যাঁ কিনলাম আর্জেন্টিনার জার্সিও । প্রেয়সীর প্রিয় দল যে আর্জেন্টিনা! তাইতো ব্রাজিল হারলেও চেয়েছিলাম আর্জেন্টিনা থাকুক !! ৪-০ এর অপমানে মনে মনে ব্যাথিত হই – ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা তর্ক তখন আর রোচে না ; বিস্বাদ ঠেকে । শেষ অবধি ফাইনালে ওঠে স্পেন আর নেদারল্যান্ড । সুন্দর ফুটবলের দল নেদারল্যান্ড জন্ম দেয় অসুন্দর ফুটবলের আর স্পেন ধীর লয় টিকিটাকা দিয়ে জিতে নেয় বিশ্বকাপ । কিছুটা হতাশ হলেও সম্পূর্ণ নতুন এক পদ্ধতিতে খেলে জয়ে প্রশংসা স্পেনের প্রাপ্য ই ; করতে ভুলিও নি।

এই তো একে একে শেষ হয়ে এল স্মৃতিকথা । দুয়ারে ২০১৪। ১০০ ঘণ্টারও নিচে অপেক্ষার সময়। অপেক্ষা করি আর ভাবি … এইতো সেদিনের ঘটনা … ২০১০ এ … কনফিডেন্স টাওয়ার পার হচ্ছি । ভয় লাগছে – সামনে অনেকখানি সরু পথ , উঁচু নিচু … অনেক নীচে লেকের স্বচ্ছ পানি … এগিয়ে চলেছে সময়ের কাটা – পাস ফেলের জটিল হিসাব নিয়ে। দুরু দুরু বুকে আগাতে থাকি – হঠাৎ দূর হতে কোর্সমেটরা চিৎকার করে বলে ব্রাজিল … আহ এক নির্ভয় চিত্ত যেন হাজির হয়ে গেল । মুহুর্তেই পার হয়ে গেলাম টাওয়ারটা । ব্রাজিল যে এক সাহস আর নির্ভরতার প্রতীক । ঐ সাহস আর নির্ভরতা নিয়ে থাকছি ব্রাজিলেই ; আর্জেন্টিনার প্রতি গোপন ভালবাসা তো আছেই ।

৮ টি মন্তব্য : “স্মৃতির পাতায় বিশ্বকাপ”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লাগলো, এক ঝলকে পাঁচটা বিশ্বকাপ ঘুরে আসলাম :clap:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    ব্রাজিল ব্রাজিল ব্রাজিল! 😀
    অসম্ভব ভালো লাগলো আরিফ।

    ২০১০ এর বিশ্বকাপটা আর মন দিয়ে দেখা হয়নি। প্রফেশনাল চাপে সব বিস্বাদ ঠেকছিলো। এবারো তেমন করে দেখা হবেনা। আসলে ছাত্রজীবনের মতো করে আর কোনদিন খেলা দেখা হবেনা। জীবন-মরণ লড়াইটা খেলার মাঠ থেকে সরে এসে যখন জীবনেই হামলে পড়ে তখন খেলাও কেমন পানসে হয়ে যায়। ধুর, বেশি আঁতলামি হয়ে গেলো। 😛

    জবাব দিন
  3. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    যাক সাম্প্রতিক বিশ্বকাপগুলো দেখা হয়ে গেল! 😀 ২০০৬ ও ২০১০ একদমই মনে নেই কি কিভাবে কোথায় হয়েছে! 😕


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  4. সাজেদ (২০০৪-২০১০)

    ভাই, জন্মের আগ থেকে শুরু করে সর্বশেষ বিশ্বকাপ এর ধারাভাষ্য দেখে যারপরনাই আনন্দিত হলাম......... অসাধারণ লাগল।
    🙂 ::salute:: :hatsoff:


    "মরনের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস,

    জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।