গাধা জহির, মাস্তান রাজিব-৩

গাধা জহির, মাস্তান রাজিব-১
গাধা জহির, মাস্তান রাজিব-২
রাজিব

জহিরের চাচা বললেন, তোমার নাম মাস্তান রাজিব।
জি না শহিদুল আলম রাজিব।
চাচা এক নজর চেয়ে থেকে বললেন, তাই তো মাস্তান রাজিব তো কারো নাম হতে পারে না। অন্য ছাত্ররা দিয়েছে না। খুব খারাপ কথা।
আচ্ছা তোমার প্রিয় খাবার কী ?
গরুর মাংস এবং ভুনা খিচুড়ি।
ভালো। খুব ভালো। তোমার প্রিয় লেখক কে ?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
ভালো। খুব ভালো।
এই জহির দেখ, ওর রুচি কত ভালো !
গরুর মাংসকে প্রিয় খাদ্য হিসেবে উল্লেখ করা এবং শীর্ষেন্দুকে প্রিয় লেখক বলাতে ঠিক কী রুচির পাওয়া যায় জানি না, কিন্তু জানি যে আমি অন্য কারো নাম বললেও জহিরের চাচা একমত হয়ে যেতেন।
আমার মামা ঘরে বসে বসেই যেমন দুনিয়ার সবাইকে শত্র“ ঘোষণা করে একাকী বিদ্রোহ করে যাচ্ছেন জহিরের এই চাচা ঠিক তার উল্টা। তিনি দুনিয়ার সব কাজের সমর্থক। সব বিষয়ে তিনি একমত হয়ে যান। প্রশংসা ছাড়া আর কিছু করতে পারেন না।
একবার তার সঙ্গে এক দোকানির খানিকটা ঝগড়া হয়েছিল। দোকানির আচরণটাই ছিল অন্যায্য। জহিরের বাবা সব শুনে ক্ষেপে গিয়ে বললেন,‘তারপরও তুই চুপ করে থাকলি।’
না। মানে ওর কথাগুলোর মধ্যে একটা জোশ ছিল। বুঝলে ভাইয়া বাজারের একজন সামান্য দোকানি এমন যুক্তিবাদী সচরাচর দেখা যায় না।
তাতেই তোর মনে হল তোর চুপ থাকা উচিত ? অপদার্থ কোথাকার ! তোর উচিত চুড়ি পরা। বল তো কয়েকটা কিনে দিই।
জহিরের চাচা তবু শান্ত ! আরে কী সুন্দর করে কথা বলছিল। আমাকে একবার বলল ছোটলোক। কথাটা ভীষণ মানিয়ে গেল। সত্যি বললে কী ওই সময়টা আমার নিজেকে ছোটলোকই মনে হয়েছিল ?
তোকে নিয়ে তো বাজারের বাকি লোকজনের হাসার কথা। হাসাহাসি করেনি। জিনিস কিনতে গিয়ে গালি খেয়ে এসেছিস ?
হাসাহাসি করেছিল। একজন খুব চমৎকার করে হাসে। আমি ওর হাসি দেখেই আজ প্রথম জানলাম যে মানুষকে টিটকারি দিয়ে হাসার মধ্যেও একটা রুচিশীলতা আছে।
এই হলেন জহিরের চাচা। আমরা ডাকি প্রশংসা চাচা। শত্র“-মিত্র সবার সব কাজে তিনি মুগ্ধ। ঘুরে বেড়ান আর মানুষকে প্রশংসা করার গল্প বয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন। একবার তিনি কয়েকজন ভিক্ষুককে ধরে এনে এক রাত রেখে দিলেন, কারণ তারা নাকি যে গান গেয়ে ভিক্ষা করছিল সেই গানের তাল-লয়-সুর সব একেবারে সঠিক ছিল।
তিনি ঠিক করেলেন, সারা রাত তাদের গান শুনবেন। শুধু গান শুনলেই হবে না, গানোপযোগী পরিবেশও তৈরি করা দরকার।
পরিবেশ তৈরি করতে বাদ্য বাজনা লাগে। মায়ের অতুৎসাহে আমি ছোটবেলা কিছুদিন তবলা শিখেছিলাম, সেই বিদ্যার জোরে এই ভিক্ষুক সংবর্ধনায় তবলচি আমি। হারমোনিয়ামসহ পাশের বাসার মিলা আপা এসে একটা গান গেয়ে গেলেন। দারিদ্র্যের পক্ষের গান।
জহিরের বাবা পুরোপুরি পার্থিব মানুষ। কোর্টে ওকালতি করেন। এ ধরনের পাগলামি সহ্য করা তার পক্ষে মুশকিল। এই কাণ্ড দেখে তিনি প্রায় মূর্ছা যান। তাছাড়া মক্কেলরা যদি জেনে যায় তার বাসায় এসে ভিক্ষুকরা রাত কাটায় এবং গান গায় তাহলে তার ব্যবসা একেবারে শেষ।
তিনি সন্ধ্যা থেকেই ধমকানো শুরু করলেন। এমনিতেই তিনি মেজাজি মানুষ, এসব দেখে মাথায় একেবারে রক্ত উঠে গেছে, এই সময়ই আমি ঢুকেছি তবলা নিয়ে।
তিনি বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, তুই তবলা নিয়ে এসেছিস ! এখানে নৃত্যানুষ্ঠান হবে না !
আমি চুপ করে আছি। কিন্তু তিনি চুপ থাকেন কী করে !
তুই হচ্ছিস মাস্তান রাজিব না ! তোর মাস্তানি আজ আমি ছোটাব। তার আগে আমার বিচ্ছুটাকে শেষ করব। কোথায় গাধাটা কোথায় ? লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়, লোকজন নাকি আমার ছেলেকে, এই গনি উকিলের ছেলেকে গাধা বলে। বাপের ইজ্জতের দিকেও একটু খেয়াল নেই।
কোথায় সে ?
জহির ততক্ষণে দৌড়ে পালিয়েছে।
আমারও আর তবলা বাজানো হল না।
তারপর আর জহিরের বাসামুখো হইনি কখনো।
আজ হয়েছি। কারণ মা এখনো ফেরেননি, এখন বাসায় গেলে জহিরসহ একাকী মামার কবলে পড়তে হবে। এবং তিনি গাধা জহিরকে পেলে জ্বালিয়ে দেবেন। ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন তাকে আচ্ছা করে পেটাবেন।
এরপর নিরাপত্তার স্বার্থেই জহিরকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু মা বলেছেন বলে কথা। মায়ের কোনো কথাই আমি অমান্য করি না।
তাই জহিরের বাসায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে, তার চাচার কিছু প্রশংসা শুনে গেলে সময় খারাপ কাটবে না ভেবেই এদিকে এসেছি। ভালোই কাটছিল। জহিরের চাচা বললেন,
শুনতে পাই তুমি নাকি বেশ বুদ্ধিমান। স্যারদের জব্দ করো। একটা ঘটনা শুনে তো আমি খুব গর্বিত হয়েছি।
কোনটা মামা ? জহির জানতে চায়।
ঐ যে স্যারকে চেয়ারের সঙ্গে আটকে দিয়েছিলে ! দারুণ। ক্রিয়েটিভ আইডিয়া।
কিন্তু সবাই তো আমাকে বলে, মাস্তান জহির।
ভুল করে। বুঝলে প্রতিভার মূল্যায়ন জীবদ্দশায় হয় না। সক্রেটিসের হয়েছিল। প্লেটোর ! হয়নি। তোমার মৃত্যুর পর হবে। দেখবে এই লোকগুলোই বলবে….
খ্যাতিমান হতে হলে মরতে হবে এই আলোচনাটা আমার খুব ভালো লাগে না। মৃত্যুকে আমার বেশ ভয়। অন্ধকার হলে যে আমি ঘুমাতেই পারি না, সেই আমি কী করে একটা কবরে থাকব এটা ভেবেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। এর অবশ্য কোনো সমাধান পাচ্ছি না। সেটা ভাবার জন্য পুরো জীবন পড়ে আছে বলে আপাতত খুব ভাবছি না।
চাচা বললেন, এরপর তোমাদের পরিকল্পনা কী ?
জহির আমাকে দেখিয়ে বলল, ওদের বাসায় যাব। খালা আমাকে দেখা করতে বলেছেন।
খুব ভালো। গুরুজনেরা দেখা করতে ডাকলে দেখা করতে যেতে হয়। ভালো কাপড় পরে যাবে। গিয়ে সালাম দেবে। আসসালামুআলাইকুম। না পায়ে ধরে সালাম করবে। তোমার মা নেই, ওনাকে তুমি মায়ের মতো দেখো। একজনকে মা ভেবে নিলে দেখবে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
হঠাৎ কী ভেবে বলে ফেললাম, আর আমার যে বাবা নেই।
তুমি জহিরের বাবাকে নিজের বাবা ভাববে !
কিন্তু উনি যে খুব রাগী। আমার ভয় হয়।
সেটা একটা সমস্যা। কিন্তু রাগটা বাবাদের থাকতে হয়। থাকলে সন্তানরা ভয় পায়। কেউ একজন ভয়ের না থাকলে ওরা নষ্ট হয়ে যায়।
কথাটা কি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা ? আমি কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছি ?
ইসলামিয়াত স্যার সেদিন বলছিলেন, এই ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেছে কারণ ওর বাবা নেই। বাবা না থাকা ছেলেরা হচ্ছে রাখালহীন গরু। গরু দেখবে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, কখন রাখাল একটু অমনোযোগী হয়। আর সেই সুযোগটা পেলেই অন্যের সর্বনাশ করে।
মাঝে মধ্যেই মনে হয় আমার একজন বাবা থাকলে বেশ হত ! কিন্তু আজকের মতো কখনো মনে হয়নি।
জহিরের যে চাচা সবার সবকিছুর প্রশংসা করেন তিনি পর্যন্ত বিশ্বাস করেন একজন বাবা থাকা দরকার।
কোথায় আমার বাবা !
মাকে এক-আধবার জিজ্ঞেস করলেই বলেন, যাও পড়তে বসো গিয়ে।
একদিন লুকিয়ে মা আর মামার কথোপকথন শুনে ফেলেছিলাম। মামা রেগে গিয়ে বলছিলেন, বললেই হল। ছেলের ছবি পাঠাও। আপা তুই ওর কোনো কথা শুনবি না। তিন বছর বয়সে যে লোক ছেলেকে ফেলে যেতে পারে তার কোনো দাবি নেই।
মা বললেন, চুপ কর।
আপা তোর কথা মতো আমরা সবাই চুপ করে আছি। তুই আর বিয়েও করতে চাইলি না। কিন্তু তুই দেখ লোকজন তোর ছেলেকে দেখিয়ে বলে, বাবা না থাকাতেই ছেলেটা শেষ হয়ে গেল। সংসারে সবার ভূমিকা আছে। চাইলেই একজন মা একাকী সব করতে পারে না। তুই ছেলের জন্য জীবন দিয়ে দিচ্ছিস। সকাল-সন্ধ্যা চাকরি করছিস, তবু দেখ…
মা কড়া গলায় বললেন, লোকে যা ইচ্ছা বলুক। এই ছেলে আমার। আমিই ওর বাবা এবং মা।
সব ঠিক আছে। তবু আমার বারবার মনে হয়, আমার একজন বাবা থাকলে বেশ হত।
যেমন জহির মনে করে ওর একজন মা থাকলে কী মজা হত ! বাবা যখন মেজাজ খারাপ করে ওকে বকাঝকা করেন তখন মায়ের আঁচলে লুকাতে পারত। এখন ওকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে হয়।
শুনে একবার বলেছিলাম, তাহলে বাবা না থাকলেই ভালো !
অবাক হয়ে দেখলাম, জহির একমত হচ্ছে না। বাবা না থাকলে পরীক্ষার পর কে আমাকে ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে যাবে।
আমাদের সমস্যার কথা শুনে শফিক একটা পাগুলে সমাধানের কথা বলেছিল। খুবই হাস্যকর কথা।
বলল, এক কাজ করলে হয়। তোরা দুজন এক বাসায় থাকলেই পারিস। তোর মা, ওর বাবা এবং সঙ্গে তোরা দুই ছেলে মিলে একেবারে সুখের সংসার।
শফিক হাসল। যা বোঝাতে চাইল সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, তবু আমার এবং জহির দুজনেরই মনে হল বাবা-মা দুজনই থাকা দরকার।
রাগী বাবাকে সামলানোর জন্য একজন কোমল মা।
একজন পরিশ্রমী মায়ের ওপরে ছাতা হিসেবে একজন বাবা।

আমাদের বাসায় ঢোকার আগেই দেখি তুমুল হট্টগোল। দেখতে আমি কৌতূহলবশত ঢুকে গেলাম এবং ঢুকে গিয়েই ভুলটা করলাম। কারণ গেম টিচার আমাকে হাতে নাতে ধরে ফেললেন।
মাকে দেখিয়ে বললেন, এই যে এই আপনার গুণধর ছেলে ? তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন।
আমি এসব ক্ষেত্রে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারি। প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, স্যার আপনার পেটের সমস্যা সেরে গেছে। আমরা সবাই যে কী চিন্তায় ছিলাম। আমরা তো সেজন্য খেলতেই নামিনি।
আমার পেটের সমস্যা সেরে গেছে। এবার তোমার পিঠের সমস্যা হবে। ম্যাডাম আপনি কী ব্যবস্থা নেবেন সেটা আপনার ব্যাপার, কিন্তু কাল আমি হেড মাস্টারের কাছে কমপ্লেন করব। ভাবা যায় !
মা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ইসমত সাহেব। আপনি একটু বসুন না।
বসলে আমাকে কিছুক্ষণ শায়েস্তা করা যাবে এই ভেবেই স্যার বসে গেলেন।
মা বললেন, রাজিব যা শুনছি সত্যি।
কী শুনেছ মা ?
তুমি নাকি স্যারকে কী শরবত খাইয়েছ ?
হ্যাঁ। মা। খাইয়েছি তো। মনে হল স্যার এত পরিশ্রম করছেন। তখন যা অবস্থা হয়েছিল। ঘেমে একাকার। কেন মা শরবত খাওয়ানো কি দোষের কিছু ?
মা স্যারকে জিজ্ঞেস করেন, কিসের শরবত ছিল ?
লেবুর শরবতই তো মনে হয়েছিল।
আমি ততক্ষণে সামলে নিয়েছি। বললাম, স্যার লেবুর শরবতই তো ! স্যার তো পুরোটা খেয়েছেনও।
খাওয়ার পরই তো…
খাওয়ার পর কী হয়েছিল স্যার ! আমাদের তো কিছুই বললেন না ! দৌড়ে চলে গেলেন। আমি পরে শফিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম। দেখি শফিক শুধু হাসে। স্যার আপনি কি হাসির কিছু করেছিলেন ?
দেখলেন বেয়াদব ছেলে কথা বলে কীভাবে ?
স্যার আপনার কী হয়েছিল ? শফিক এসে শুধু হাসল কেন স্যার। আমি ভেবেছিলাম কাল ক্লাসে জিজ্ঞেস করব।
তুমি জানো না কী হয়েছিল ?
সত্যি স্যার জানি না।
কাল ক্লাসে জানবে।
যেটা করেছিলেন সেটা কি ক্লাসে আবার করে দেখাবেন ! সবার সামনে…
স্যার প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে উঠে পড়েন।
আমি পেছন পেছন গিয়ে বলি, স্যার সবার সামনে করাটা ঠিক হবে না। সবাই খুব হাসবে। স্যার শুনুন স্যার।
স্যার দুপুরে বাথরুমে যাওয়ার গতিতেই প্রায় দৌড় দেন।
তিনি চলে গেলে আমি স্বস্তির একটা নিশ্বাস নেব তখনই শুনি আমাদের বাইরের ঘরে মামার চিৎকার।
মামা চেঁচিয়ে বলছেন, তোর এত বড়ো সাহস ! আমার ভাগ্নেকে নষ্ট করিস !
ঢুকে দেখি জহির চুপ করে ফাঁসির আসামির মতো বসে আছে। আর মামা তড়পাচ্ছেন।
আমাকে দেখে বললেন, দেখ। আমার কী নিষ্পাপ চেহারার ভাগ্নেটা। তাকে তুই শয়তানের কাতারে নিয়ে গেছিস।
আমি ক্ষুব্ধ গলায় বলি, মামা। তুমি এমন করছ কেন ?
মামা আমাকে উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলেন, তুই চুপ থাক। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন ! দুই টাকার উকিলের ছেলের এত বড়ো সাহস !
হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, দুই টাকার উকিল হলেও তো ওর বাবা আছে।
এতক্ষণ মামার মুখ দিয়ে আগুনের লাভা বেরোচ্ছিল, এই কথাতে তিনি একেবারে চুপ। হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
জানি না কীভাবে যেন আমার মুখ দিয়ে আবার কথাটা বেরোয়, আমার বাবা নেই বলেই আমি নষ্ট হয়ে গেছি। সবাই তাই বলে।
জহির বলে, আর আমি গাধা। সবাই আমাকে গালাগাল দেয়। বলে মা না থাকাতে নাকি আমি কিছুই শিখিনি।
আমি গলা উঁচিয়ে বলি, পারবে এই সমস্যার সমাধান করে দিতে। পারলে করো। ঘরে বসে বসে তো শুধু রাজা-উজির মারো।
তারপর জহিরের দিকে তাকিয়ে ‘চল জহির’ বলতেই জহির একান্ত বাধ্য ছাত্রের মতো আমার পিছু নেয়।
আমি ও জহির বেরিয়ে আসি।
টের পাই পেছনে হা করা চেহারা নিয়ে তাকিয়ে মামা। তারও পেছনে আমার মা। যিনি একাধারে আমার বাবা এবং মা হতে চেয়েছেন এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ সত্ত্বেও পারেননি।

জহির

আমরা একটা খুব সাহসী পরিকল্পনা করে ফেলেছি। আমরা মানে আমি এবং রাজিব। গাধা জহির এবং মাস্তান রাজিব। শফিক আছে আমাদের সঙ্গে। বলতে কী তার উৎসাহটাই সর্বোচ্চ। নেতৃত্বটা খুব সহজেই সে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, যেমন সে নিয়ে থাকে সাধারণত।
আমি একটু কিন্তু কিন্তু করছিলাম। এভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কাজটা একটু ঝুঁকিপূর্ণ। আমার অত সাহসও নেই। কিন্তু শফিক বুঝিয়ে বলল, এর চেয়ে ভালো উপায় আর হয় না। আমরা পালিয়ে গিয়ে যদি শর্ত দেই, আমাদের বাবা এবং মা দুজনই লাগবে তাহলে তখন ঠিকই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
বাসায় থেকে আন্দোলন করলে হয় না ?
না হয় না। শফিক বলল, বাসায় থেকে কী করবি ভাত খাবি না। কিন্তু কতক্ষণ ? রাজিবের মামা ভদ্রলোক তো ওকে পাগল করে ফেলবেন। আর তোর চাচা, উনি তোর প্রশংসা করা শুরু করে তোকে এমন গাছে তুলে দেবেন যে তুই পারবি না।
তবু আমাদের মধ্যে একটা দ্বিধা। কোথায় যাব ! এই শহরের বাইরে তো আমরা তেমন কিছু চিনি না। আমাদের কোথাও চেনা কেউও নেই যে…
শফিক খানিকটা ক্ষেপে গিয়ে বলল, তাহলে মরো এখানে। আমার কী ! কথায় বলে না যার বিয়ে তার খবর নেই। পাড়াপড়শির ঘুম নেই। কিন্তু আমার ঘুম আছে।
বলে শফিক ঘুমাতেই কিনা চলে যেতে উদ্যত হয়।
রাজিব তাকে থামায়, আরে দাঁড়া না ব্যাটা !
শফিক রাগ দেখিয়ে বলে, দাঁড়িয়ে কী হবে ! সবমিলিয়ে আমাদের অবস্থা এখন ভীষণ খারাপ। গেম টিচার হেডমাস্টারের কাছে কমপ্লেন করেছে। কাল শুক্রবার, কিন্তু পরশু স্কুল খুললেই….। তোর বাসায় স্যার চলে গেছে। স্কুলে শান্তি নেই, বাসায়ও যন্ত্রণা।
কিন্তু পালিয়ে গেলে এই সমস্যার সমাধান কী করে হবে ?
আরে আমরা মনে হয় পালিয়ে চলে যাচ্ছি। আমরা যাচ্ছি হিরো হতে। যখন ফিরব তখন হিরোর বেশে ফিরব। আমাদের কৃতিত্ব নিয়ে স্কুলে আলোচনা হবে। পাড়ায়-মহল্লায় আমরা সব বীরপুরুষ। তখন আর আমাদের পায় কে ? কোথায় কোন স্যারকে কী করেছিলাম সেটা কি কারো মনে থাকবে। ভেবে দেখ !
বলে শফিক বসে।
আমরাও ভাবতে শুরু করি।
রাজিবের বাসায় আজ আমার যে অভিজ্ঞতা হল সেটা মনে আসলেই মনে হয় সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাই। রাজিবের মামা আমাকে শুধু মারতে বাকি রেখেছেন।
কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না যখন তখনই রাজিব এসে আমাকে উদ্ধার করেছে। উদ্ধার করে নিয়ে চলে গেল স্কুল মাঠটার পেছনে। এই এখানে একটা জায়গা আছে যে জায়গাটা আমাদের ভুবন। ভূতের ভয় আছে বলে খুব কেউ আসে না, কিন্তু আমরা এখানে আগে আসতাম ভূতের অপেক্ষায়। আমাদের মনে হত ভূত জিনিসটা কেমন দেখা উচিত। তাছাড়া ভূতেরও নিশ্চয়ই একটা হৃদয় আছে, আমাদের দুঃখ কষ্ট ভৌতিক শক্তির জোরে তার এমনিতেই জানা থাকার কথা। কাজেই আমাদের জন্য উপকারি কিছু করবে ধরেই আমরা ভূতের অপেক্ষায় বসে থাকতাম।
ভূত আর এল না। একদিন এলেন আমাদের মসজিদের হুজুর।
হুজুররা সবসময়ই ভূত নিয়ে চিন্তিত থাকেন। তাদের মতে জগতের যাবতীয় অনিয়মের কারণ হচ্ছে ভূতের থাবা। জ্বর হলেও বলেন, কঠিন ভূতের আসর। তিন গ্রামের পুকুরের পানি খেতে হবে। সঙ্গে যদি সাতটা ঠিকঠাক খেয়ে ফেলা যায় তাহলে ভূত তো ছাড়, ভূতের বাপও দৌড়ে পালাবে।
রহিম চাচা এই চিকিৎসায় বিশ্বাস করেছিল। তিন গ্রামের পুকুরের বিচিত্র পানি খেয়ে তার হল ডায়রিয়া। সঙ্গে ডাবের ঠাণ্ডা পানিতে এমন সর্দি যে বেচারা মরতে মরতে বেঁচেছে।
তাতে হুজুরের মার্কেটে একটু ভাটা পড়েছিল। কিন্তু আল্লাহ-রসুল যার সঙ্গে ঘুরে বেড়ান তার সামলাতে বিশেষ সময় লাগে না।
কাজেই এমন ভূতমুখী হুজুর অন্ধকারে আমাদের দুজনকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন, ভূত !
আমরাও ধরে নিলাম, এতদিনে বোধহয় ভূতের দেখা মিলেছে।
আমরাও আনন্দিত গলায় বললাম, ভূত।
হুজুর বলেন, ভূত দেখেও দাঁড়িয়ে কেন ! দৌড়া।
রাজিব বলল, আমরা তো ভূত দেখতেই দাঁড়িয়ে। ভূতের অপেক্ষায়।
হুজুর বললেন, ইন্নালিল্লাহ। এরাই তো দেখি ভূতের বাচ্চা। আল্লাহ আমার কী হবে ! বাল-বাচ্চা।
বলে হুজুর একটা ভো দৌড় দিলেন।
রাজিবও পিছু পিছু একটা দৌড় দিয়েছিল।
হুজুর ধরে নিলেন, ভূতের বাচ্চা দৌড়াচ্ছে। ভূতের বাচ্চা না হলে তো তাকে চিনতে পারত এবং চিনলে তাকে সালাম দিত। এই শহরের সবাই তো তাকে এক নামে চেনে। তাকে সালাম না দিলে আল্লাহর গজব নাজিল হয়ে যেতে পারে বলে তার ছায়া দেখলেই সালাম দিয়ে সবাই সরে পড়ে।
পরের কয়েকদিন হুজুর সবার বাসায় বাসায় গিয়ে গল্পটা বলে আসলেন, স্কুলের পেছনের মাঠে যেন কেউ সন্ধ্যার পর ভুলেও না যায়। ওখানে ভূতের বাসা। বড়ো ভূতরা গভীর রাতের অপেক্ষায় থাকে, কিন্তু বাচ্চা ভূতরা সন্ধ্যার পর থেকেই দাপিয়ে বেড়ায়। খবরদার।
তাই মাঠের এদিকটায় আর কেউ আসে না। আমরাই।
আমি বললাম, আমার আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
রাজিব পিঠে হাত দিয়ে বলল, না থাকলে যাব কোথায় ? আমাদের যাওয়ার আর জায়গা কই।
সেদিন কোনো সিদ্ধান্ত হল না।
রাতে বাসায় গিয়ে দেখলাম, বাবা তার মক্কেলদের নিয়ে খুব ব্যস্ত।
চাচা দেখেই বললেন, তোকে তো দারুণ দেখাচ্ছে রে !
দারুণ !
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে জীবন সৈনিক। ক্লাস সেভেনের একটা ছেলের চেহারায় জীবন যুদ্ধের ছাপ পড়ে যাওয়ার মানে কি জানিস ?
না।
তুই বড়ো হয়ে গেছিস। তুই বড়ো হয়ে যাচ্ছিস।
বলে অকারণ কিছু চিৎকার করে তিনি দূর হয়ে গেলেন।
কিন্তু আমার সারা রাত ঘুম হল না।
বারবার মনে হল, মা থাকলে এখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। মা থাকলে…। আমার মা কোথায় ? জানি আছেন তিনি। অনেক দূরে। চাইলে আসতে পারেন, কিন্তু আর কোনো দিন আসবেন না। একবার আমাকে দেখার জন্য একজন লোক পাঠিয়েছিলেন, বাবা তাকে বলে দিয়েছেন বেশি বাড়াবাড়ি করলে ৩৭০ অথবা ৪২০ ধারায় জেলে ভরে দেবেন। তখন বুঝবেন কত ধানে কত চাল।
জেলের ভয় পেয়ে সেই লোক সেই যে গেছে আর আসেনি।
মারাত্মক কিছু হতে পারে ধরে আজ স্কুলেও যাইনি। শফিক গিয়েছিল শুধু, সে দুপুরে এসে খবর দিয়ে গেল, হেড স্যারের কাছে অভিযোগ গেছে। শনিবার দিন মারাত্মক কিছু একটা ঘটবে।
রাজিব বলল, কিন্তু তোকে কিছু বলল না। তুইও তো ছিলি আমাদের সঙ্গে।
আরে না। আমাকে তো ধরেছে রক্ষাকারী। স্যারকে নিয়ে এ-বাথরুম ও-বাথরুম দৌড়াদৌড়ি করেছি।
অংক স্যার কী বললেন ?
আরে তারা তো ব্যস্ত তাদের মধ্যে কে জিতেছে সেটা নিয়ে। অংক স্যারের দাবি তিনি ইংরেজি স্যারকে কী কৌশলে নাচিয়েছেন !
আর ইংরেজি স্যার কী বলছেন ?
তিনি বলছেন অংক স্যার যে ভাবছেন তাকে নাচিয়েছেন সেটা হচ্ছে বোকার সান্ত্বনা। তিনি তার পেছনে পেছনে দৌড়িয়েছেন অংক স্যারকে ক্লান্ত করতে। প্রমাণ হল সেদিন টিফিনে অংক স্যারের মাথা ঘোরানো শুরু করে এবং তিনি একটা ক্লাসের মাঝখানে বাসায় চলে যেতে বাধ্য হন।
তাহলে আমাদের কথা কেউ বলছে না।
গেম টিচার আতিক স্যার বলছেন। তিনি তো পুরো স্কুল মাতিয়ে রেখেছিলেন। দুপুরে খেলার প্র্যাকটিস শুরুর আগে সবাইকে কান ধরে উঠবোস করিয়ে তারপর খেলায় নামিয়েছেন। যাকে সন্দেহ হয়েছে তাকেই কয়েক ঘা দিয়েছেন। তোদের জন্য স্কুল আাগামী কয়েকদিন নিরাপদ না।
তাহলে কী করব ?
রাজিবের এই প্রশ্নের উত্তরেই শফিক সমাধানের পথটা বাতলে দিল।
আমরা সবাই পালিয়ে যাব। পালিয়ে গিয়ে ফোন করে বলব, আমরা ছেলেধরার হাতে পড়েছি। তখন শর্ত দেব যে ফিরতে পারি এক শর্তে সেটা হল রাজিবের বাবাকে এনে দিতে হবে। আর জহিরের মা।
গাধার মতো কিনা জানি না, কিন্তু প্রশ্নটা করে ফেললাম, আরে ছিনতাইকারী কি বাবা-মা নিয়ে চিন্তা করে নাকি ! ওদের তো লাগে টাকা।
ঠিক আছে আমরা টাকাও চাইব। ছিনতাইকারী হিসেবে ফোন করার দায়িত্ব আমার। তোরা ওসব নিয়ে ভাবিস না।
আবার গাধার মতো প্রশ্নটা করলাম, কিন্তু তুই যাচ্ছিস কেন ? তোর তো কোনো ঝামেলা নেই।
শফিক মাথা নেড়ে বলল, আমার অনেক টাকার দরকার। তোদের ছিনতাইকারী আমি এবং তোদের বাবা-মা যে টাকা পয়সাটা দেবে সেটা হবে আমার। ঠিক আছে !
বলে শফিক হো হো করে হাসতে থাকে।
আমরা একটু অবাক হই।
কিন্তু মনে হয় ঠিকই তো ! ছিনতাইকারী হলে টাকা পয়সা চাইবে, এখন বাবা-মা নিয়ে গেলে সে টাকা পয়সার কী হবে সেটার একটা বিহিতও করা দরকার।
শফিক টাকাটা নিতে রাজি হয়ে যেন আমাদের একটা সমস্যার সমাধানই করে দিল।

(চলবে?)

১,৩৮৮ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “গাধা জহির, মাস্তান রাজিব-৩”

  1. আমার কিন্তু মনে হয়েছে আগের দুই পর্বের চেয়ে এই পর্বে এসে গতিটা একটু কমে গেছে।

    নাকি আগের দুইটা বেশি মজার ছিলো বলে এমন মনে হচ্ছে?
    বাকিদের মতামত দেখি...।

    জবাব দিন
    • টিটো রহমান (৯৪-০০)

      সহমত। আগের পর্ব দুটি বেশি মজার মনে হয়েছে। এজন্যই এটা একটু ট্রাস লাগছে। তবে গতি আছে যথাপূর্বম।

      @মামুন ভাই,
      লেখকরা সমালোচনা সহ্য করে না। বস প্লিজ টেক ইট পজেটিভলী। আপনার কাছে প্রত্যাশা অনেক বলেই ........... 🙂


      আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।