প্রেয়ার বেল……


আমাদের মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের মসজিদটা হয়তো অন্যান্য ক্যাডেট কলেজের মতই। মাগরিবের নামাজের আগে দিয়ে গমগম করতো, অন্যান্য সময় সুনশান নিরবতা। একদম সামনের দিকে নিরীহ কিছু ক্লাস সেভেন……কখন ক্লাস এইট কি নিয়ে ধরে বসে সেই নিয়ে ঘেমে টেমে একাকার। তার একটু পিছনের সারিতে নব্য সিনিয়র হওয়া ক্লাস এইট। আরো পেছনে নতুন গোলটুপি পড়ার পারমিশন পাওয়া ভাবের জগতে থাকা ক্লাস নাইন। আমাদের সময় এই গোলটুপির ইস্যুটা খুব সাংঘাতিক ছিল। এই নিয়ে ক্লাস নাইন আর ইলেভেনের মাঝে দুইদিন পরে পরেই কোন না কোন গ্যাঞ্জাম হতো। আর ছিল ডিজাইন করা পাঞ্জাবি নিয়ে। যেখানে বাচ্চা ক্লাসের ক্যাডেটরা কলেজ থেকে দেয়া থান কাপড় সদৃশ পাঞ্জাবি হবার অযোগ্য পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে উপরের ক্লাসের ক্যাডেটরা বাসা থেকে আনা সাদার ভেতর ফুল ফুল নকশা করা পাঞ্জাবি পড়ে ভাব নিয়ে বেড়াচ্ছে খুব। সে এক অবস্থা! মসজিদের পেছনের দিকে ফাকা ফাকা হয়ে বসা ক্লাস টেন, ইলেভেন আর টুয়েল্ভ- মসজিদের ভেতরেই দুনিয়ার গল্পে মশগুল তারা। মাঝে মাঝে কোনায় থেকে নোটবুকে চুপেচুপে ডিফল্টারদের নাম টুকতে থাকা স্টাফ। আশে পাশে সারাদিন ক্যাডেটদের পেছনে দৌড়ে ক্লান্ত ডিউটি মাস্টার। অনেক উপরে আস্তে আস্তে ঘুরতে থাকা গুটিকতক ফ্যান আর সিজনে মশার অত্যাচার । এই নিয়েই তো ছিল মসজিদটা।


এত ক্যাডেটের মাঝে প্রায় প্রতিদিনই কিছু ক্যাডেট থাকতো যারা দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তো। ইসলামে ধর্মে অক্ষম হলে বসে নামাজ পড়ার রীতি থাকলেও দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া জায়েজ, এমনটা শুনিনি কখনো। মাঝে মাঝে ইমাম নুরুল হুদা নিষেধ করতেন যতদূর মনে পড়ে। কিছুদিন বন্ধ থাকতো। তারপরে আবার দেখা যেত কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে।

মসজিদের গেটের ভেতর, মসজিদের ঠিক বাইরেই ছিল একটা আম গাছ। মসজিদের গাছ বলে বাইরের কলেজ ক্যাম্পাসের বাচ্চাগুলো এই গাছে হাত দিত না। ফলাফল……বাধ্য হয়ে মাগ্রিবের নামাজ পড়ে…নাইলে তাও পড়তো না এরকম ক্যাডেটদের দেখা যেত গ্রীষ্মকালের শুক্রবার গুলোতে আসরের নামাজ পড়তে ঠিক মসজিদে হাজির হতে। ঢোকা বা বের হবার সময় আশে পাশে কেউ না তাকিয়ে থাকলেই হয়ে গেলো কাজ……টুকরো ইটের নিখুত নিশানা ভেদ।


নামাজ শেষে, সুন্নাতের পরে আবার একটা মুনাজাত হতো বড় করে। ক্যাডেট কলেজের বড় মুনাজাতটাযে আসলে কত ছোট সেটা প্রথম টের পাই ভালমতো – বাইরের জুম্মার নামাজের পর। হাত টনটন করে। তবূ আল্লাহর কাছে মানুষের চাওয়া শেষ হতে চায় না। টার্ম ফাইনালের আগে আগে হাউজের প্রেয়ার রুমে যেমন ক্যাডেটের সংখ্যা বাড়তো, জায়গা পাওয়া যেত না……তেমনি মাগ্রিবের সুন্নাত নামাজের পরে পরে নফল নামাজ পড়িয়েদের সংখ্যাও বেড়েই চলতো।

মাঝে মাঝে মিলাদ হতো। হুজুর সুর করে করে নবীজীর স্তুতি পড়তেন, সাথে সাথে আমরাও জোরে জোরে। এক পর্যায়ে শেখসাদীর কবিতাটা…”কাশাফাদ্দুজা…বিজামালিহি” (ভুল লিখলে ক্ষমা) ……এটাও সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে শুরু করতো……কিন্ত দ্বিতীয় লাইন শুরু হলেই বেশিরভাগই চুপ……কারণ বেশিরভাগই পারে না। আবার কেউ কেউ সেটা স্বীকার করতে চাইতোনা। তাই হুজুরের সাথে সাথে বলছে এরকম করে ঠোট মেলাতো……একদল আবার থাকতো – কারা পারে না কিন্তু ভাব করছে পারে………তাদের খুঁজে বের করবে টীজ করার জন্য……। মিলাদের শেষে একটা বড় মুনাজাত হতো। সেটায় আবার অনেকে ডজ খেত। শেষ হবার আগেই “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” শুনে হাত মুখে ঘষে আবিষ্কার করতো আসলে মুনাজাত তখনো শেষ হয়নি। আরেকটু বাকি আছে। কারা কারা ডজ খেলো সেটাও আবার আরেকগ্রুপ খেয়াল করতো খুব……পরে টীজ করবে ।


একটা ছোট ঘটনা দিয়ে শেষ করি। আমরা তখন ক্লাস টুয়েল্ভে। মিলাদ হচ্ছে। মিলাদের পরে সরাসরি ডিনার হবে। বৃহষ্পতিবারের রাত। স্পেশাল ডিনার আছে। আর আছে মির্জাপুরের তখনকার হট ফেভারিট স্পেশাল ডিনারের কাবাব যেটা ছিল বেশিরভাগ বাজীর/বেটের প্রাইজ। তো মিলাদের মুনাজাত শুরু হয়েছে……আমাদের ব্যাচের হাসান আর বাশার পাশাপাশি বসে। দুইটাই চরম ফাজিল আর বদমাইশ টাইপের। তো হাসান মুনাজাতের শেষের দিকে জোরে জোরে আমাদেরকে আর স্পেশালি বাশারকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, “হে আল্লাহ…তুমি বাশারের মনটাকে নরম করে দাও। বাশার যেন খুশি মনে আমাকে আজকে ওর কাবাবটা দিয়ে দেয়।” এটা শুনে আমরা আশে পাশের ক্যাডেটরা নড়ে চড়ে বসলাম। সবার দাঁত বের হয়ে গেছে। একেবারে কঠিন অবস্থা! ডাইরেক্ট আল্লাহর কাছে বাশারের কাবাব চাওয়া হয়ে গেছে। আড়চোখে বাশারের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছি……এমন সময় বাশার……মুনাজাতের হাত বাঁধা অবস্থাতেই……”হে আল্লাহ, হাসানের এই দোয়া যেন কবুল না হয়!” মুনাজাতের মাঝেই হাসতে হাসতে আমাদের অবস্থা খারাপ!!!!


আমরাতো সেই সময়গুলোতে অনেক ছোট। ভালমন্দ ঠিকভাবে বুঝতে চেষ্টা করিনি কখনো। আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল। প্রার্থনা করি আমাদের সেই শিশুসুলভতা যেন ক্ষমা করে দেন।

১,৯৪৬ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “প্রেয়ার বেল……”

  1. ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

    ভাল লাগলো আশিক।
    সুন্দর সাবলীল লেখা। পড়তে ভাল লাগে।
    আর নিজের কলেজ নিয়ে লেখা- একটানে পড়ে ফেললাম।
    আর রাজ্যের স্মৃতি ভীড় করলো চিরসবুজ মানসপটে।
    🙂

    'আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল। প্রার্থনা করি আমাদের সেই শিশুসুলভতা যেন ক্ষমা করে দেন।'


    সৈয়দ সাফী

    জবাব দিন
  2. জিহাদ (৯৯-০৫)

    মসজিদ নিয়ে একেবারে পারফেক্ট স্মৃতিচারণ ।

    এখনো মনে আছে গোল টুপি পড়া নিয়ে কি ক্যাচালই না হইসিল :grr:

    ”হে আল্লাহ, হাসানের এই দোয়া যেন কবুল না হয়!”

    =)) =))


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  3. সাব্বির (৯৫-০১)

    সব কলেজের মসজিদের কাহিনী গুলা হুবহু একই।
    তবে আমাদের BCC তে বসার সিস্টেম টা একটু আলাদা ছিল।
    সবার সামনে ১০,৯,৮,৭,১১ সবার শেষে ১২।
    নাকি অন্য রকম?? কিছু টা কনফিউসড্‌।
    BCC পার্টি সাহায্য করো।

    জবাব দিন
  4. আমাদের ইমিডিয়েট সিনিয়র ভাই ছিলেন কামাল ভাই। ৭,৮ এ অনেক জ্বালালেও নাইন এ উঠে আমাদের খুব প্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন...।মাগরিবের নামাজ শেষে 'বালাগাল উলা...'র সময় আমরা আস্তে আস্তে বলে 'কামালিহি' বলতাম জোরে জোরে...
    ইমরান ভাই,মনে আছে সেসব???

    জবাব দিন
    • আশিক (১৯৯৬-২০০২)

      কিস্তি টুপি আর গোল টুপি। পার্থক্য বুঝছেন? 😛 বুঝেন নাই? 😛 কিস্তি টুপি হলো লম্বাটে টাইপের টুপি। ওইটা কলেজ কর্তৃক নির্দেশিত টুপি। আর গোল টুপি হলো রাউন্ড শেপের। বাইরে আমরা ওগুলাই অহরহ পড়ি। কলেজে কিস্তি টুপি পড়তো জুনিয়ররা। আর সিনিয়ররা গোল টুপি। ক্লাস নাইনের কোন এক সময় গোল্টুপি পড়ার পারমিশন পাওয়া যেত। ওইটা নিয়ে নাইন ভার্সেস ইলেভেনের মধ্যে ঝামেলা হতো আরকি 😛

      জবাব দিন
  5. আমাদের কলেজে সবার পিছনে বসতো ক্লাস ১২।
    সবাই সিজদায় গেলে আমরা ক'জন উঠে যেতাম। মসজিদের সাথে লাগানো এক কোনায় ছিল ইমাম হুজুরের রুম। আমরা তার রুমে গিয়ে চুরি করে বিস্কিট , চানাচুর যা পেতাম খেয়ে আসতাম।

    দারুন লেখা। কাবাবের ঘটনা টা তো সেইরকম মজার।

    জবাব দিন
  6. তারেক (৯৪ - ০০)

    ইশ, মসজিদের কথা মনে পইড়া গেলো।
    আমাদের ওখানে সবার সামনে সেভেন বসতো, তারপরে ক্রমান্বয়ে অন্য ক্লাস, একদম পেছনে প্রিন্সিপালের সাথে টুএলভ।


    www.tareqnurulhasan.com

    জবাব দিন
  7. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    হা হা ।জুমার নামাজের আগে আর শবে বরাতের রাতে নুরুল হুদার বাংলা ব্যাটিং এর কথা মনে পড়ল।লেখাটা ভালো হইছএ।
    আরো অনেক ঘটনা আছে মসজিদে।যেমন পাঞ্জাবি গিট দেয়ার কথা মনে পড়ে।
    আবার আমরা কিছু লোক নামাজ পড়তাম না ইলেভেনে।সবাই সেজদায় গেলে আমরা এক কোনায় আড় অপর কোনায় ইমিডিয়েট সিনিয়র রেদওয়ান ভাইরা একে অন্যকে হাত নাড়াতাম।
    আর জালাল উদ্দিন স্যারের কথা মনে পড়ছে।শবে বরাত রাতে তিনি বক্তৃতার মধ্যে আচমকা মিলাদ শুরু করে দিতেন।আর মিলাদের সাথে সুর করে আমরা তখনকার প্রিন্সিপাল রইসের উদ্দেশ্যে বলতাম ,ওরে টাকলা ছাইড়া দেনা........বাকিটা আর নাই বললাম।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আশিক (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।