আমার ব্যাচ

৩৬ তম ব্যাচ। একটা সংখ্যা আমাদের ৫০টি ছেলেকে একই সূতায় বেঁধে রাখে। আজ কেউ জাপানে, কেউ পাকিস্তানে, কেউ বা ইংল্যান্ডে, আর অনেকেই বাংলাদেশে, কিন্তু এই একটি সংখ্যা আমাদের সবাইকে আজ পর্যন্ত এবং আমাদের জীবনভর এক পদতলে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কেউ যদি আমার সৎ মতামত চায় যে আমাদের ব্যাচ কেমন ছিল, আমি বলব আমরা একটি অতি সাধারণ ব্যাচ ছিলাম। যদিও ক্লাস সেভেন থেকেই আমরা স্টাফ লাউঞ্জে বেশ একটা আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। স্যারদের সহজ সরল মতামত ছিল, যে আমাদের ব্যাচ প্রচণ্ড উচ্ছৃঙ্খল, বেআদব আর পড়াশুনার দিক থেকে অত্যন্ত খারাপ একটা ব্যাচ। কয়েকজন ক্যাডেট বাদে আমাদের ব্যাচের সবাই খুবই খারাপ ছাত্র ছিলাম বলে স্যারদের একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল(আমি এর জন্য স্যারদের খুব একটা দোষ দেব না)। আমাদের ডিসিপ্লিনের অবস্থা ছিল তথৈবচ। স্যারদের যন্ত্রণা করায় আমাদের ব্যাচ মোটামুটি সিদ্ধহস্ত ছিল। আমি কেমন ছিলাম সেটা নাহয় অন্য একদিন বলব, এখন ব্যাচের কিছু কথা বলি।

স্যারদের যন্ত্রণা করা বিশেষ কিছু কাহিনী এখন বলি। ঘটনাগুলো এখন মনে পরলে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়, কিন্তু কম বয়সের আনন্দ লাভের খাতিরে এসব আমরা করেছিলাম। আমাদের প্রচণ্ড শ্রদ্ধেয় একজন বাংলার স্যারকে(নামটা না বলাই ভালো) আমরা বি ফর্মের কিছু ছেলে মিলে টিজ করি একবার। টিজ করার অবস্থাটা ছিল, স্যার এ ফর্মে ক্লাস নিচ্ছেন, আর আমরা বি ফর্মের চারজন এ ফর্মের চার দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে টিজ করছি(বি ফর্মে ওইদিন কোনও স্যার আসেননি)। স্যার প্রথমে কিছুক্ষণ সহ্য করলেন। তারপর বি ফর্মে এসে আমাদের কিছুটা বকাঝকা করতে লাগলেন। এমন সময় আমার এ ফর্মের কয়েকজন মিলে এসে বি ফর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে স্যারকে টিজ করতে লাগল। স্যার আবার উলটা ঘুরে এ ফর্মে ফিরে গেলে আমরা আবার স্যারকে টিজ করলাম চার দরজায় দাঁড়িয়ে। ঠিক তখনই স্যার হঠাৎ ছুটে গেলেন একাডেমি ব্লকের করিডরে(আমাদের ক্লাস দোতলায় ছিল), আর বলতে লাগলেন, “আমি কিন্তু এখনই আত্মহত্যা করব, আমি কিন্তু এখনই আত্মহত্যা করব”। এ ফর্মের কিছু ছেলে তাকে শান্ত করে আবার ক্লাসে নিয়ে যায়। এরপরও আমাদের মন ভরে নি। আমরা আবার টিজ করতে গেলাম স্যারকে। স্যার আর কিছু করার না পেয়ে নিজের জুতা খুলে বলা শুরু করলেন, “আমার জুতা দিয়ে আমাকে মারো, আমার জুতা দিয়ে আমাকে মারো”। এই পর্যায়ে আমরা ক্ষান্ত দেই। আরেকজন বাংলা স্যারের ক্লাসে আমি তাকে এটা স্বীকার করতে বাধ্য করেছিলাম যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন ব্যর্থ লেখক এবং বিলাসী একটি ব্যর্থ ছোট গল্প। ক্লাসের শেষে উনি চলে যাওয়ার সময় বলে, “আমার ২৩ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কেউ স্বীকার করাতে পারেনি যে শরৎচন্দ্র একজন ব্যর্থ লেখক”। এমন আরো অনেক ঘটনা আছে যা বলা শুরু করলে আমার ব্যাচ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এই টিজটা সাধারণত স্যারদের বরণ করে নেয়ার জন্য করা হত। আমরা আমাদের শিক্ষকদের প্রচণ্ড সম্মান করতাম, করি এবং করে যাবো। এখানে একটা কথা না বললেই নয়, মকক থেকে একবার একজন পৌরনীতি শিক্ষক আমাদের কলেজে আসেন। আমরা তখন ক্লাস ইলেভেনে। স্যার এসেই বলেন(মানবিক হবার সুবিধা স্বরূপ আমি শুনেছিলাম) মকক এর ছেলেরা বলেছে আমরা নাকি স্যারদের খুব টর্চার করি এবং স্যারের নাকি খবর আছে। স্যার বলেন, “আমি তো জানি তোমরা খুব ভালো, তোমরা স্যারদের খুব সম্মান কর, তোমরা এমন কিছু করতেই পারো না”। যাই হোক আমাদের ব্যাচের অবস্থা এমন ছিল। কিন্তু আমাদের এই সাধারণ ব্যাচ কলেজে কিছু অসাধারণ অর্জন করে আসছে যা এখনও অটুট আছে বলেই জানি।

আমাদের মুসলেহ তার কলেজ জীবনে যে ৬টা ইংরেজী উপস্থিত বক্তৃতায় অংশ নেয় তার সবগুলাতেই ১ম স্থান অর্জন করেছিল। এমন রেকর্ড আমাদের কলেজ ইতিহাসে আর আছে বলে আমি জানি না। ফারহান কলেজে এখন পর্যন্ত রেকর্ড পরিমাণ মেডেল জিতেছে তাও ১টা পুরো আর একটা অর্ধেক বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ না নিতে পেরে। ফারহানের অবস্ট্যাকল কোর্সের রেকর্ড এখনও অক্ষুণ্ণ আছে বলেই জানি। আর একটা রেকর্ড আমার নিজের তাই বলার লোভ সামলাতে পারছি না। কলেজে জিলাপি খাওয়ার রেকর্ড এখনও আমার দখলে। যদিও জিলাপি আমার প্রিয় কোন খাবার ছিল না কিন্তু শুধুমাত্র চ্যালেঞ্জ রক্ষার্থে ৪৩টা জিলাপি খেয়েছিলাম। আমার ৫২টা ব্রেডের রেকর্ড মনে হয় ভেঙে গেছে এতদিনে। এইচ.এস.সির রেজাল্টে আমাদের মাত্র ৩ জন ক্যাডেট A+ পায় নি, যা আমাদের সময়ের হিসাবে বেশ উঁচু হার ছিল। রাজশাহী সাদী সায়েন্সের মধ্যে ২য়, আমাদের মাহমুদ মনে হয় ৩য় অথবা ৪র্থ হয়েছিল। মানবিকে আমাদের জাকারিয়া রাজশাহী বোর্ডে ১ম হয়েছিল। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় আমাদের আলী ১ম হয়েছিল(তখনকার রেকর্ড মার্ক্স স্কোর করে)। অন্য অনেক ব্যাচের তুলনায় এই অর্জন হয়ত তেমন কিছু না, কিন্তু আমার হিসেবে তা অনেক। আমি না লিখে মাহমুদ লিখলে হয়ত আরো তথ্যবহুল হত, কিন্তু এই পোস্টটা লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। কারণ এই লেখাটা যে আমার ব্যাচকে নিয়ে। আমার ৩৬ তম ব্যাচ। আমাদের ৩৬ তম ব্যাচ।

৪৫ টি মন্তব্য : “আমার ব্যাচ”

  1. আরেকজন বাংলা স্যারের ক্লাসে আমি তাকে এটা স্বীকার করতে বাধ্য করেছিলাম যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন ব্যর্থ লেখক এবং বিলাসী একটি ব্যর্থ ছোট গল্প

    :goragori: :goragori: :goragori: :goragori: :goragori: :goragori: :goragori: :goragori: :goragori: :goragori:

    দোস্ত, তোরে জড়ায়া ধরতে ইচ্ছা করতেছে... কী মনে করায়া দিলি!!
    ইশশ, স্যার মনে হয় খুব কষ্ট পাইছিলো... তবে সেইরকম মজা লাগছিলো সেইদিন।
    :gulti: :gulti:
    ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে :khekz: :khekz:

    আহারে ঘটনাগুলো!! 😛

    জবাব দিন
  2. ফারহানের ব্যাপারে বলিঃ

    আমাদের আন্তঃহাউস যত খেলা ছিলো, প্রায় সবগুলো তারিক হাউস চ্যাম্পিয়ন হতাম। ওর ব্যাপক অবদান থাকত। এখানে মেডেল পেতই। এছাড়া ফারহানের জন্য সাঁতার এবং এ্যাথলেটিকস এর প্রতিটি ইভেন্টে ১ম মেডেল অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোনদিন এই ঘটনার ব্যত্যয় ঘটেনি...... দু'একটা দ্বিতীয় ছিলো, কিন্তু মেডেল ছিলো অবশ্যই। ওর বেস্ট প্লেয়ারেরে ক্রেস্ট ছিলো ১৮টা খুব সম্ভব। মেডেল ও ক্রেস্ট মিলে ওর পদক সংখ্যা ৬২টা ছিলো.

    যদিও সে পক্স হবার কারণে একই সাথে একটি এ্যাথলেটিক্স এর ৫টা+ সাঁতার এর ৮টা = মোট ১১ টা মেডেল পায়নি, দুর্ভাগ্য। আমাদের খুব মন খারাপ হয়েছিল... 🙁

    ওইগুলো পেলে তার ক্রেস্ট হত ২০, মেডেল হত ৭১ :dreamy: :dreamy:

    জবাব দিন
  3. রেজওয়ান (৯৯-০৫)
    কিন্তু শুধুমাত্র চ্যালেঞ্জ রক্ষার্থে ৪৩টা জিলাপি খেয়েছিলাম। আমার ৫২টা ব্রেডের রেকর্ড মনে হয় ভেঙে গেছে এতদিনে।

    তোর তো দেখি খালি খাওয়ারি রেকর্ড...... :goragori:
    ভাল হইলি না রে :khekz:

    জবাব দিন
  4. হাসান (১৯৯৬-২০০২)
    আরেকজন বাংলা স্যারের ক্লাসে আমি তাকে এটা স্বীকার করতে বাধ্য করেছিলাম যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন ব্যর্থ লেখক এবং বিলাসী একটি ব্যর্থ ছোট গল্প

    বুঝাই যাচ্ছে উকিল হিসেবে তোমার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাস্ফ্যু

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।