মোর্শেদ- আমাদের ৫০ নম্বর

ক্যাডেট জীবনে যাদের ব্যাচে কোন আউট হওয়ার ঘটনা বা কোন ক্যাডেট চলে যাওয়ার ঘটনা নেই তারা খুব ভাগ্যবান্‌। আমাদের ব্যাচের ৫০ জন ক্যাডেটের মধ্যে ৪৭ জন কলেজ থেকে শেষ দিন একসাথে বের হয়েছিলাম। আমাদের ৩ জন বন্ধু আমাদের সাথে ছিল না। ক্লাস ৮ এ মোর্শেদ কলেজ ছেড়ে চলে যায়, কারণ সিনিয়রদের কিছু ব্যবহার ও সহ্য করতে পারে নি। পরবর্তিতে আমাদের আরও দুইজন বন্ধু মুরাদ এবং রহমান ক্লাস ৯ এ কলেজ আউট হয়ে গিয়েছিল। আজকের লেখাটা মোর্শেদকে নিয়ে। কারণ আমাদের অন্য ২ জন বন্ধু কলেজ আউট হওয়ার পরেও আমরা ওদের দুইজনের ই খবর পেতাম নিয়মিত। রহমান কোথায় আছে, ও এস.এস.সি. তে কি রেজাল্ট করল, মুরাদই বা কোথায় আছে, এখনও কি সে সব রকম শয়তানি অব্যাহত রেখেছে নাকি, আমরা সব খবরই রাখতাম। কিন্তু মোর্শেদ সেই যে কলেজ ছাড়ল, আমরা না পেলাম ওর কোন খোঁজ, না পেলাম কোন খবর। ও কোথায় পড়াশুনা করেছে, কি রেজাল্ট করল, ও কি এখনও সেই ক্যাঙ্গারুর মত করে দৌড়ায় নাকি, এখনও কি ওর কাশির সাথে রক্ত পড়ার রোগটা আছে নাকি ও এখন পুরোপুরি সুস্থ, ও কি আগের মতোই প্রচণ্ড খাওয়া দাওয়া করতে পারে, ও কি সেই রকম চিকন আছে নাকি অনেক মোটা হয়েছে, লম্বা কতটা হয়েছে কিছুই জানতাম না আমরা কেউ। মোর্শেদ কি এখন কারও সাথে বিকেল বেলা গল্প করে যেমন করত আমার কিংবা আরেফিনের সাথে, ওকি এখনও বড়দের গল্প করে বন্ধুদের লজ্জা দেয়, বিভিন্ন টিজ নাম দিয়ে সবাইকে অতিষ্ঠ করে, নাকি অনেক শান্ত হয়ে গেছে। ওকি আমাদের মত সিগারেট খায় নাকি মাহমুদের মত নন-স্মোকার থেকে গেছে। ও কি এখনও জেমসের গান গুলো গায় চিৎকার করে নাকি অন্য কোন গায়কের গান ওর এখন পছন্দ। হাজার রকম প্রশ্ন মাথায় ঘুরত মোর্শেদকে ঘিরে। কিন্তু এর জবাব কখনও পেতাম না। কারণ ওর সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না। ও আমাদের ব্যাচের একমাত্র ক্যাডেট যে চট্টগ্রাম থাকত। ওর সাথে এক শহরে কেউ থাকত না যে ওর খোঁজ বের করতে পারবে। অনেক অভিমান নিয়ে কলেজ ছাড়ার কারণেই মনে হয় ও কলেজের সাথে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করেছিল। ক্যাডেট কলেজকে ওর জীবন হতে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টারই প্রতিফলন বোধহয় ছিল আমাদের সাথে যোগাযোগ না রাখা।

কলেজ থেকে বের হবার আগেই আমরা ঠিক করি যেভাবে ই হোক ওকে খুঁজে বের করব। কিন্তু কীভাবে খুঁজে বের করব তা কখনই নিশ্চিত ছিলাম না বলেই বোধহয় কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়ে ওঠে নি মোর্শেদকে খোঁজার ব্যাপারে। সময় কেটে যায় কিন্তু আমরা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি না যে কীভাবে মোর্শেদকে খুঁজে বের করা যায়। আমাদের ইচ্ছার কোন ঘাটতি ছিল না কখনই, কিন্তু আলসেমি নাকি সুযোগের অভাব নাকি অন্য কোন কারণে সেটা আমি জান না, মোর্শেদকে খোঁজা আমাদের আর হয়ে ওঠে না। আমাদের ছোটবেলার বন্ধুটিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি, সবার সামনে এটা মানতে না চাইলেও আমি মনে মনে এটা স্বীকার করে নিয়েছিলাম যে ওকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর মধ্যে রাজশাহী মেডিকেলে গিয়ে রহমানের সাথে দেখা করে আসি। রহমান সেই আগের মতোই শুকনা আর ঢ্যাঙ্গা লম্বা আছে। সবসময়ই মুখে একটা মিষ্টি হাসি ধরে রাখে এখনও। উষ্ণ আলিঙ্গনে আমাদের বরণ করতে দেখলাম রহমানকে। এটাই হয়ত স্বাভাবিক, কিন্তু আমি ব্যাপারটায় খুবই আমোদ পাই। রহমানের বুকের মধ্যে আমরা এখনও আছি জেনে আবার বলতে ইচ্ছা করল, “Proud to be a Cadet”। ঢাকায় দেখা হল মুরাদের সাথে, কটা চোখের অধিকারি আমাদের মুরাদ যেন একটু ছোট হয়ে গিয়েছে। অনেক ভদ্র হয়েছে মনে হল। কিছুটা(অনেকটাই বলা যায়) পরিবর্তন হয়েছে মুরাদের, কিন্তু বন্ধুত্বের উষ্ণতায় কোন ভাটা পড়েনি। আমার বন্ধুদের উপর গর্বে বুকটা যেন দুই ইঞ্চি ফুলে গেল আমার। এই সকল সময়েই আমার মনে হয়েছে আমরা একজন কম হয়ে আছি সে ২০০০ সাল থেকে। আমার কেন যেন মনে হয়েছিল আমাদের মোর্শেদকে না পাওয়া পর্যন্ত সেই অপূর্ণতা থেকেই যাবে আমাদের মধ্যে। কিন্তু কোনও উপায় বা রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না মোর্শেদকে খোঁজার।

আমাদের মনের মধ্যকার এই অপুর্ণতাটাকেই মনে হয় দূর করার জন্য হঠাৎ করে ভাগ্য আমাদের প্রতি বেশ সদয় হল। আমরা খুঁজে পেলাম মোর্শেদকে। ৯ বছর পর একজন বন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার অনুভূতি কেমন সেটা লিখে প্রকাশ করার মত লেখণিশক্তি আমার নেই। ওকে দেখার পর কেন ও আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখে নি, এতদিন কই ছিল, কোথায় পড়াশুনা করেছে, কোথায় থাকে, এসব প্রশ্নই যেন অমূলক হয়ে পড়ল। স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া আর কিছু করার কথা মনে থাকল না আমার। অনেক অনুযোগ পুরানো বন্ধুটির প্রতি, কিন্তু কোনটাই করা হল না। কেন? আমি নিজেও জানি না। ওকে কাছে পেয়ে খুশিতে সত্যিকার অর্থে বাকহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সবকিছুর মাঝেও এতটুকু বুঝেছি যে আমার বন্ধুটি এখনও আমারই আছে, আমাদের বন্ধুত্বের উষ্ণতা এতটুকুও কমে নি। এই মোর্শেদ আর সেই মোর্শেদ যেন ভিন্ন মোড়কে একই উপহার, ভিন্ন আঙ্গিকে একই মানুষ। ওর সাথে সবাই দেখা করে টি.এস.সি. তে, আমার পা ভাঙা থাকায় আমি যেতে পারবো না জেনেই সবাই ওকে নিয়ে আমার বাসায় চলে আসে। আমার মত আমার বাবা, মা, নানী কেউই মোর্শেদকে ভুলতে পারেনি দেখে মোর্শেদ যেন বেশ অবাক হল। শেষ করব মোর্শেদকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনাটা বলে।

আমাদের ব্যাচের আরেফিনের আব্বা নৌবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর চট্টগ্রাম একটি চাকরি পান। আঙ্কেলের সাথে সেখানে কাকতালীয় ভাবেই দেখা হয় মোর্শেদের আব্বার। মোর্শেদের আব্বার কাছ থেকেই জানা যায় যে ও এ.আই.ইউ.বি.-তে EEE তে পড়াশুনা করছে। আরেফিনের আব্বার মাধ্যমে মোর্শেদের আব্বার সাথে যোগাযোগ করে পরে মোর্শেদের ফোন নম্বর নিয়ে ওর সাথে সর্বপ্রথম দেখা করে জাহিদ। পরে আমাদের সবার সাথে মোর্শেদের দেখা হয়। এখন মনে হচ্ছে আবার আমরা ৫০ হলাম যেন। এতদিন ১ কম ছিলাম।

৭৩ টি মন্তব্য : “মোর্শেদ- আমাদের ৫০ নম্বর”

  1. নাজমুল (০২-০৮)

    শার্লী ভাই খুব ভালো লাগলো লিখাটা :clap:
    আমাদের আলম কেও খুজে পাচ্ছিনা ওকে পাইলে ৫০ জন হয়ে যাবো 🙁
    আমাদের ৭ জন আউট হইসিলো ৫ জনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। এনাম টা আর আলম টা বেয়াদব x-(
    😡 😡 😡

    জবাব দিন
  2. জাহিদ (১৯৯৯-২০০৫)
    আরেফিনের আব্বার মাধ্যমে মোর্শেদের আব্বার সাথে যোগাযোগ করে পরে মোর্শেদের ফোন নম্বর নিয়ে ওর সাথে সর্বপ্রথম দেখা করে জাহিদ

    শার্লী আমার নাম বলছে :awesome: :awesome: :awesome: :awesome:
    মোর্শেদের ১টা ছবি দিলে পারতি।
    :just: মতামত।

    জবাব দিন
  3. ধুরররর

    শালা লেখাটা পইড়া আর কমেণ্ট গুলা পইড়া গুলায়া ফেলছি কী যে লিখতে চাইছিলাম...

    তুহিনরে স্বাগতম দোস্ত। সুস্থ হয়ে উঠ। ঢাকা গিয়ে ইনশাআল্লাহ তোরে দেখতে যামু 🙁 🙁
    মোর্শেদরে আমার দেখা হয়নাই। আশা করি আগামীতে গিয়ে দেখতে পাবো। আমার কথা ওর মনে আছে কিনা তা অবশ্য জানিনা... যা হোক, আগের দোস্ত তো!
    দিল্ডা কেমুন য্যান করে ওই ৫০ জনের কথা ভাব্লে...
    কত নিত্য দিনের বিপদাপদ আর সুখের সাথী আমরা :dreamy: :dreamy: :dreamy: :dreamy:
    আহা রে!!

    কবে পাবো ফিরে সেইসব দিনগুলি 🙁 🙁

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জিহাদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।