বদলে না যাওয়া ভালোবাসাগুলো

১৯৯৮ সালের জুন মাসের এক তারিখ

আব্বা, আম্মা আর আমি – এই তিনজন গাড়িতে করে টাঙ্গাইল যাচ্ছি। সবাই বললো ক্যাডেট কলেজে চান্স পাওয়া অনেক কঠিন। তাই ঠিক হলো আমাকে ক্যাডেট কোচিং এ দেয়া হবে। যেখানে থাকি সেখানে ভালো কোন কোচিং নেই। অগত্যা টাঙ্গাইলে চলো। ঠিক হলো আবাসিক থেকে কোচিং করবো কয়েক মাস। আজ সেই দিন। আমাকে কোচিং এ রেখে আসা হবে। গাড়িতে আম্মা আমার পাশে বসা। হাতদুটো শক্ত করে ধরে আছে। যেন ছেড়ে দিলেই কোথাও হারিয়ে যাবো। কাল সারারাত আম্মা ঠিকমতো ঘুমোয়নি। আম্মাকে অনেক দিনের জন্য শেষবারের মত জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর সময় সেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছি। গতরাতের কথা মনে করে হঠাৎ অনুভব করলাম, আজ রাতে আমি আর আম্মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারবোনা। আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই, কিন্তু কিছুই যেন চোখে পড়েনা। সবকিছু বিষণ্ন আর ঝাপসা লাগে। শুধু মনে হতে থাকে আমি আজ রাতে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারবোনা। না বলে কয়েই আমার চোখটা ভীষণ জ্বালা করতে থাকে। আম্মা যেন কিছু বুঝতে না পারে সেজন্য আমি জানলা দিয়ে বাইরেই তাকিয়ে থাকি। মনে মনে শুধু প্রার্থনা করছি এই পথ যেন কখনো শেষ না হয়। না তাকিয়েও বুঝতে কষ্ট হয়না সে প্রার্থনা আম্মাও করছে। আম্মা আমার হাতটা যেন আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু চল্লিশ মিনিট পরেই বোঝা হয়ে যায় এ প্রার্থনা সফল হবার নয়, দেখতে দেখতে কোচিং এ পৌঁছে যাই। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে নিজের রুমে যাই। আম্মা নিজের হাতে সব কিছু গুছিয়ে দিলো, আর সাথে সাথে খাওয়া, পড়া এই সেই নিয়ে হাজারটা উপদেশ। আমি শুধু হু হ্যা করি। রুম গুছানোও একসময় শেষ হয়ে যায়, যেমন করে শেষ হয়ে গেছে শেষ কয়েকটি ঘন্টা। এবার বিদায় দেবার পালা। আব্বা নরম গলায় অনেক উপদেশ দেন, ভালোভাবে থাকতে , নিয়ম মেনে চলতে, আর নিয়ম মেনে পড়াশুনা করতে। আম্মা তখনো হাত আঁকড়ে ধরে আছে শক্ত করে। আম্মা জানে এবার হাত ছেড়ে দিলে সত্যিই হারিয়ে যাবো। শেষ মুহুর্তে আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে, আমি বহু কষ্টে চোখের পানি সামলাই। আমার মনে হতে থাকে আমাকে কাঁদতে দেখলে আম্মা আরো বেশি কষ্ট পাবে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আব্বা, আম্মার চলে যাওয়া দেখি। তখন সন্ধ্যা আসি আসি করছে। আব্বা আম্মা বিশ্বাস বেতকার গলির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় বিকেলের সূর্যটার মতই মিলিয়ে যায়। আমার সব কিছু ঝাপসা আর অস্পষ্ট লাগে। মাথার ভেতর শুধু ঘুরতে থাকে আজ রাতে আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারবোনা।

১২ বছরের ছেলেটি তখনো জানেনা তার একলা ঘুমানোর দিন সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেছে, আম্মাকে জড়িয়ে ঘুমানোর দিন তার জীবনে আগের মত করে আর কখনোই আসবেনা।

৩জুন, ১৯৯৯

মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে আমার প্রথম দিন। আমাকে রেখে যেতে আম্মা আর আব্বা এসেছে শুধু। গত কয়েকদিন মনে কত শত রঙিন স্বপ্ন আর কল্পনা, সাথে খানিকটা আশঙ্কার ছবি এঁকেছি ক্যাডেট কলেজকে নিয়ে। কিন্তু ৩তারিখ যতই কাছে চলে আসছিলো মন খারাপের ঘোড়া ততই ছুটছিলো টগবগিয়ে। পুরনো সেই ভয় আবার আঁকড়ে ধরে, আম্মাকে ছেড়ে থাকতে হবে এতগুলো বছর। সময় কেমন দ্রুত ছুটে চলে। একটু পড়েই আব্বা , আম্মা চলে যাবে। ভেবেছিলাম কোচিং এ কয়েক মাস একা থেকে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। কিছুতেই আর কোন দিন হুট করে চোখ জ্বালা করবেনা কারো কথা ভেবে। কিন্তু আব্বা, আম্মা চলে যাবার সময় যত ঘনিয়ে আসছিলো বড় হওয়ার সব সমীকরণ কেমন ওলোট পালোট হয়ে যেতে লাগলো। বিদায় নেবার আগে আম্মা দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিলো। আমার বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠলো। ইচ্ছে করছিলো তক্ষুণি আম্মার সাথে বাসায় চলে যাই। আমি হাউসের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। আম্মা যেতে যেতে বার বার পিছে ফিরে তাকাচ্ছেন। আমি বড় হওয়ার ভান করে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকি সে পথের দিকে, যে পথ ধরে আম্মা একসময় আমার চোখের আড়ালে চলে যাবে। মির্জাপুরের আকাশ তখন লালচে বিষণ্নতায় ছেঁয়ে আছে। আমি ডিনার ড্রেসের ধবধবে সাদা শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে আরো কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। আমার শুধু আম্মার কথা মনে পড়ে।

আমি বুঝে গেলাম, বড় হওয়ার এখনো ঢের দেরি।

১০ জুন, ২০১২

হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়ে পাক্কা দু’সপ্তাহ বাসায় থেকে আজ আবার ঢাকা চলে যাবো। ভোরের বাসেই চলে যাওয়ার কথা ছিলো, আম্মা সেই ছয়টা থেকে ডাকাডাকি শুরু করেছে। কিন্তু আলসেমিতে আমার আর ওঠা হয়না। আম্মা কপট রাগ দেখায়, আবার একটু খুশিও হয়। আমি আরো কয়েকঘন্টা বাসায় থাকবো বলে। দুপুর হয়ে আসে আস্তে আস্তে। আম্মা জানলা দিয়ে তাকিয়ে বলে – এত কড়া রোদ, তোমার যেতে কষ্ট হবে। আজকে না হয় থেকেই যাও। কাল ভোরে জোর করে হলেও উঠিয়ে দেব। আমি যথাসম্ভব নিরাবেগ গলায় বলি – আজকে যেতেই হবে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে অনেক। আম্মার মনের বিষণ্নতাটুকু পড়তে আমার কষ্ট হয়না। দুপুরে শেষবারের মত খাইয়ে দিতে দিতে আম্মা হা হুতাশ করেন, যাবার আগে শেষবারের মত আরো কিছু আম খাইয়ে দিতে পারলেন না বলে। এরকম অবস্থায় কিভাবে আবার একা একা থাকবো সেটা নিয়ে তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ঘুরে ফিরে বার বার ঠিকমত খাওয়ার উপদেশ শুনতে থাকি কিছুক্ষণ পরপরই। সবকিছু শেষ বারের মত চেক করে বলি – আম্মা আমি বেরোই তাহলে এখন। গেটে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মত বিদায় নেই। আম্মা যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলে- ভালোভাবে যেও। বাসে পূর্ব দিকে বসবে যাতে রোদ না লাগে। আমি ছোট করে আচ্ছা বলে সামনে ঘুরে হাঁটা দেই। ক্যাডেট কলেজে থাকতেও ছুটি থেকে কলেজ ফেরার সময়ও বিদায় নিয়ে কখনো পেছন ফিরে তাকাতাম না। তাকালেই দেখতে পাবো – আম্মা শাড়ির আঁচলে নি:শব্দে চোখ মুছছেন। সে দৃশ্য সহ্য করার অভ্যেস আমার আজো হয়ে ওঠেনি। আজো আমার তাই কখনো পিছনে ফিরে তাকানো হয়না। হাঁটতে হাঁটতে আমার চোখটা সেই ১২ বছরের ছেলেটার মতই জ্বালা করে ওঠে। আম্মা নিশ্চয়ই ভাবে, ছেলে বড় হয়ে গেছে। আগের মত করে মায়ের কথা মনে করে চোখ ভেজায়না আর।

আমি শুধু জানি, আমার বুকের ভেতর সেই ১২ বছরের ছেলেটা আজো ঘুমিয়ে আছে। আমার আর কোনদিনই বড় হওয়া হবেনা।

৫,৯২২ বার দেখা হয়েছে

৬৮ টি মন্তব্য : “বদলে না যাওয়া ভালোবাসাগুলো”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    লেখা হইছে মোটামুটি মার্কা, মাকে নিয়ে আরও সুন্দর করে লেখা উচিৎ।

    যাউজ্ঞা, রুম পরিস্কার করছো তো ঠিকঠাক, সানাউল্লাহ ভাই ঠিক মত ইন্সপেকন্স করছে তো নাকি ভুইলা গেছে। :grr:


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    সুস্থতার খবর শুনে ভাল লাগলো, লেখা দূর্দান্ত হয়েছে। বড় হয়ে যাওয়া আসলেই লস।

    :hatsoff: :hatsoff:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. খেয়া (০৬ - ১১)

    :boss: :boss: :boss:
    হলে বসেই লেখাটা পড়লাম। আর পড়তে পড়তেই মা ফোন করলো। কথা বলতে গিয়ে গলাটা কেঁপেও গেছে মনে হয়। মা সেটা টের পেয়েই বোধকরি উদ্বিগ্ন হয়ে ব্জিজ্ঞাসা করলো, " তুমি ভালো আছো তো মা?"
    লেখাটা পরে বুকের ভেতর অনেক বাষ্প জমে গেছে, আজ রাতে বোধহয় বর্ষা আসার আগেই চোখে নোনা বৃষ্টি নামবে। ধন্যবাদ ভাইয়া। এরকম একটা বৃষ্টির খুব দরকার ছিল আমার।
    :clap: :clap:


    খেয়া (২০০৬-২০১১)

    জবাব দিন
  4. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)
    তাকালেই দেখতে পাবো – আম্মা শাড়ির আঁচলে নি:শব্দে চোখ মুছছেন। সে দৃশ্য সহ্য করার অভ্যেস আমার আজো হয়ে ওঠেনি। আজো আমার তাই কখনো পিছনে ফিরে তাকানো হয়না। হাঁটতে হাঁটতে আমার চোখটা সেই ১২ বছরের ছেলেটার মতই জ্বালা করে ওঠে।

    অসাধারণ...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  5. আসিফ মাহমুদ

    .....কিভাবে যেন পড়াশুনা না করার ফলে Khulna University এর Architecture ছাড়া আর কোথাও Admission Test এ through করতে পারিনি... কিন্তু নিজের বাসা খুলনায় মা'র সাথে ৫ বছর কাটিয়ে দিলাম...তখন ভেবেছিলাম যে ভুল করলাম কিন্তু এখন মনে হয় আমি আসলেই অনেক ভাগ্যবান...জীবন তো মাত্র কয়েকদিনের,মা'র সাথে এত বছর থাকার ভাগ্য কয়জনের হয়,তাও আবার ক্যাডেট কলেজে ৬ বছর থাকার পর? তবে একথা সত্য যে Class 7 এ যে ছেলেটি বাসা থেকে একবার বের হয় তার আর বাসায় ফেরা হয়না....যাই হোক আমি আছি বলেই হয়তো আমার অসুস্থ মা কিছুটা হলেও শান্তি পান ...


    ...একদিন সবকিছু মুছে যায় হিমেল হাওয়ায়, স্মৃতিমাত্র লিখে নাম...সেইখানে আমিও ছিলাম...

    জবাব দিন
  6. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    জিহাদ: ইউটিউব খুঁজতে খুঁজতে জান বাইরাইয়া গ্যাল!! মাকে নিয়ে আসলেই মনে হয় তেমন অসাধারণ গান বাংলায় নাই!! শেষে এই গানডা পাইলাম...........


    মায়ের কান্দন যাবজ্জীবন: মমতাজ


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  7. আমার ক্যাডেট কলেজে পড়ার সৌভাগ্য হয় নাই, কিন্তু এখন আর মার সাথে থাকা হয় না পড়াশোনার কারনে। প্রতিবার মাকে বিদায় দেবার সময় ঠিক একি জিনিস গুলো মাথায় আসে।

    জবাব দিন
  8. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    বেশ কিছুদিন পর সিসিবি পড়ছি।
    এই লেখা পড়ে একটা শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। দীর্ঘ ১৬ বছর পর এখন আবার আমি বাসায়। পানি খেতে ইচ্ছে হলেই চীৎকার দেই আম্মু বলে। একেবারে অসম্ভব সম্ভব করেছি।
    জিহাদ ভাল আছ তো এখন? একটু দেরি হয়ে গেল কি জিজ্ঞেস করতে।

    জবাব দিন
  9. তপু (৯৯-০৫/ককক)

    "আমি শুধু জানি, আমার বুকের ভেতর সেই ১২ বছরের ছেলেটা আজো ঘুমিয়ে আছে। আমার আর কোনদিনই বড় হওয়া হবেনা। "

    বন্ধু অনেক ভাল লেখসস। কিছুকিছু কথা ত প্রান ছুয়ে গেল। আশলেই সেই জে ক্লাস ৭ এ ঘর ছারলাম আজ অ ঘরে জেতে পারিনি।
    চালিয়ে যাও মামা :clap:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ইমরান (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।