আ জার্নি বাই বাস

ঢাকা শহরে কর্মব্যস্ত মানুষের অর্ধেক সময় কাটে বোধহয় রাস্তায়। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে নিজস্ব গাড়ি অথবা পাবলিক বাসে। জ্যামকালো এই শহরে গাড়ি কিংবা বাসগুলো ছুটে চলার চেয়ে জ্যামের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতেই বেশি অভ্যস্ত। তার সাথে সাথে অভ্যস্ত এই শহরের মানুষগুলোও। এরা ঠাঁঠাঁ রোদে মিরপুর ইউনাইটেড কিংবা বিহংগে’র ভাঙাচোরা তেল চিটচিটে সীটে বসে দরদর করে ঘামে আর দেশটা দিয়ে কেন কিছুই হবেনা তার হিসেব নিকেশ করে সশব্দে, সচকিত ভাবে। তাই বিশেষ করে যারা পাবলিক বাসে যাতায়াত করেন তাদের কাছে বাস মানেই হচ্ছে নিরানন্দ সব অভিজ্ঞতার সহযাত্রী। যেখানে ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি আর দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়ায় খিস্তি খেউড়ের স্রোত বয়ে চলে সমান তালে। কাজেই বসবাস যদি হয় ঢাকায়, আর আপনার কপালেও যদি আমার মত মধ্যবিত্তের সীল মারা থাকে তাহলে পাবলিক বাস এবং এর সংশ্লিষ্ট যন্ত্রনাময় অভিজ্ঞতা এড়ানোর উপায় নেই কোনভাবেই।একটা সময় ছিলো যখন বাসে ওঠাই আমার জন্য রীতিমত এক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা ছিলো। বাসে উঠলেই পেট্রোল পোড়া গন্ধে পেটের ভেতরে তখনো হজম না হওয়া খাদ্যদ্রব্য উগরে দেয়া আমার বাস জার্নির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলো একটা সময় পর্যন্ত। ক্যাডেট কলেজে যারা পড়ে কিংবা পড়েছে সবাই সুযোগ পেলেই বলে বেড়ায় কলেজ তাকে কত কী দিয়েছে এই ছোট্ট জীবনে। আমার বেলায় তার উল্টোটাও ঘটেছে অবশ্য, কলেজ জীবন আমাকে দেয়ার পাশাপাশি অনেক জিনিস কেড়েও নিয়েছে, এই যেমন তার মধ্যে একটা হলো বাসে উঠে বমি করার অভ্যাসটা। ছুটি থেকে বাসায় আসা যাওয়া, কিংবা তারও আগে টাংগাইলে ক্যাডেট কোচিং থেকে বাড়ি যাওয়া কিংবা ফিরে আসার ভেতর দিয়ে অভ্যাসটা একসময় নাই হয়ে গেছে জীবন থেকে। মুহাম্মদ বহু আগে কলেজের প্রতি ঋণ স্বীকার করে ওর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছিলো কেন আমি ঋণী। একইভাবে আমি কোন ব্লগ লিখলে ঋণ স্বীকারের লিস্টে আমার এই বিদঘুটে অভ্যাস দূর করার ব্যাপারটাও থাকবে নির্ঘাৎ। সত্যিই, ক্যাডেট কলেজ জীবন কত কিছু দিয়ে গেল এই জীবনে, কত বিচিত্র উপায়ে!

তো যেটা বলছিলাম, বাস জার্নি ব্যপারটা কোনকালেই তেমন সুখকর কিছু ছিলোনা আমার জন্য। তারপরও ব্যতিক্রম থাকে সব কিছুতেই। যদিও কবি বলে গেছেন ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারেনা, এই মুহুর্তের জন্য কবির থোড়াই কেয়ার করি। যেহেতু উদাহরণ দিতে বসিনাই, ব্লগর ব্লগর করতে বসছি।
অতএব বলতে চাই যে, দুলদুল কিংবা বনশ্রী, শিকড় কিংবা শিখর, অথবা সৌখিন নতুবা শ্যামলী – আপনি যে পরিবহনেই চলাচল করুননা কেন, যদি ক্যাডেট হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে মানতেই হবে – বাস জার্নিও সুখকর হয়, যদি হয় সেটা কলেজ বাস এ।

কলেজ বাস শব্দটা শুনলেই কখন যেন স্মৃতির বাসে চেপে সেই ৯৯ থেকে ২০০৫ এর কত গলি ঘুপচি মনের অজান্তেই ঘুরে আসা হয়। কলেজ বাসে প্রথম চড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো সম্ভবত সেভেন এর এক্সকারশনের সময়। পিটি প্যারেড, আর স্টাফের প্যাদানিতে জীবন যখন অতিষ্ঠ এক্সকারশনে সাভার স্মৃতিসৌধে যাবার জন্য কলেজ বাসে চড়ে তখন মনে হয়েছিলো সব সেভেনীয় ঝামেলা পেছনে ফেলে ৫৩জন প্রায়-ন্যাড়ামাথা খাকীড্রেস পড়া বন্দী বালক পঙ্খীরাজে চেপে যাচ্ছে বাইরের মুক্ত বাতাসে। হাঁফ ছেড়ে, শান না হয়ে বুক ফুলিয়ে নি:শ্বাস নেবার জন্য। কয়েক ঘন্টা পড়েই যে আবার ফিরে আসতে হবে সে নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই। কলেজ বাসটাতে উঠেই দেখলাম কেমন কোমল নীল রঙের সীটের কভার। ছিমছাম, লম্বা একটা বাস। সবাই বসে গেলে বাস ছাড়লো একসময়। বাসে চলা শুরু করতেই ড‌্রাইভার মামা গান ছাড়লেন – মুসু মুসু হাসি। তখনো বাসায় ডিশ ছিলোনা আমাদের, হিন্দি সিনেমা কিংবা সিনেমার নায়ক নায়িকা কাউকেই চিনতাম না। মুসু মুসু হাসি তাই আগে কখনো শুনিনি। কিন্তু ব্যাচের কয়েকজনের দুলে দুলে গাওয়া দেখেই বুঝে গেলাম ওরা আগেও শুনেছে। কিছুক্ষণ শোনার পর কেমন মুখস্ত মতো হয়ে গেলো। আরো কিছুক্ষণ যাওয়ার পর দেখা গেল সবাই মাথা নেড়ে নেড়ে তাল মিলাচ্ছি গানের সাথে। সেভেন বলে কারো কাছেই পার্সোনাল ক্যাসেট ছিলোনা সম্ভবত। তাই বাসে থাকা কয়েকটা ক্যাসেটই ঘুরে ফিরে চলতে লাগলো। আর মুসু মুসু হাসি শুরু হলেই সবাই মিলে গুণগুণানি গানের সাথে। বাস চলতে থাকে নিজের মত, আমরা নিজেরা নিজেরা গল্প করি, হল্লা করি, মকরা পার্টি বাসের পিছনে জটলা করে আসর জমায়, আবার পরিচিত গান শুরু হলেই সবাই মিলে একসাথে চিল্লিয়ে গলা ফাটাই। এখানে এইটের সিনিয়র নেই, তাই কোন চোখ রাঙানিও নেই। এখানে আমরা সবাই রাজা। পুরো জার্নি তাই স্বাধীন রাজার মতই হৈ হুল্লোড় করলাম, কেউ মনে করতে না চাইলেও সবাই জানি কলেজে ফিরে গেলেই এই সময়টাকে আবার হঠাৎ করে ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্নের মত মনে হবে।

ক্লাস এইট কিংবা নাইনের এক্সারশানের কথা বোধহয়। এক্সকারশন শেষে কলেজ বাসে ফিরছি কলেজে। বাইরের আকাশে তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা ভর করতে শুরু করেছে। সারাদিনের আনন্দ আর উত্তেজনা শেষে সবাই সীটে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউবা ঘুমোচ্ছে, আর পিছনের সীট দখল করে রাখা দুষ্ট ছেলের দল তখনো বিপুল উদ্দ্যমে আড্ডাবাজি করেই যাচ্ছে। আমি সে অর্থে দুষ্ট ছেলের দলে ছিলামনা। তবে সেবার পেছনের সীটেই জায়গা হয়েছিলো। টাঙ্গাইলে আমার আজন্ম বেড়ে ওঠা। মুখ খুললেই সেটা বুঝে ফেলে সবাই। কী কথায়, কিংবা কথার টানে। বাস যখন কলেজের গেটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে হঠাৎ কী মনে করে টাঙ্গাইলা ভাষায় জোরে বলে ফেললাম – বয়েজ, আইয়া পড়সি। সে কথায় কী হলো কে জানে, পাশ থেকে প্রথমে কন্ঠ মেলালো ইকবাল, হোসেন, তার সাথে আরও কয়েকজন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল বাস কলেজের ভেতর রাস্তা দিয়ে ছুটছে আর বাসের সবাই তারস্বরে চিল্লাচ্ছে -আইয়া পড়সি, আইয়া পড়সি। হাউসের সামনে আসতে আসতে সে শব্দ তখন আরো তুমুল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আমাদের তারস্বরে গলা ফাটানোয় বাকী ব্যাচগুলাও বুঝে গেছে ততক্ষণে, ৩৭তম ব্যাচ এক্সারশান শেষে কলেজে আবার “আইয়া পড়সে”। সেই থেকে শুরু, এর পর যতবার কলেজের বাইরে যাওয়া হয়েছে ফেরার সময় কলেজে ঢুকে “আইয়া পড়সি” কোরাসে কলেজ মাথায় তোলা আমাদের ব্যাচের অলিখিতি নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। সত্যি মিথ্যা জানিনা, কার কাছে যেন শুনেছিলাম আমরা কলেজ থেকে বের হয়ে আসার পর জুনিয়র ব্যাচেও নাকি এই “আইয়া পড়সি” ট্রেন্ড চালু হয়ে গিয়েছিলো।

তবে আমাদের ব্যাচে সবচেয়ে ঘটনাবহুল বাস জার্নি হয়েছিলো ক্লাস ইলেভেনের ৭দিনের এক্সকারশানের সময়। সেভেন থেকে ইলেভেন – বেশ দীর্ঘসময়। ততদিনে মোটামুটি সবাই কলেজীয় বিবর্তনের পথ ধরে সুবোধ মানুষ থেকে বানর হয়ে গিয়েছে। সাতদিনের জার্নি অনেক বড় ব্যাপার। তাই কেউই সামনের দিকের সীটগুলোতে বসতে চায়না। যেখানে একটু ক্ষণ পরপরই ফর্ম মাস্টার, স্টাফ কিংবা এডজুট্যান্টের সাথে চোখাচোখি হতে হবে। তাই তিন হাউসেই ফন্দিফিকির চলতে লাগলো কিভাবে পেছনের সীটগুলো ধরে ফেলা যায় পুরো হাউসের জন্য। সোহরাওয়ার্দী হাউস, আর নজরুল হাউসের চে আমরা, মানে ফজলুল হক হাউস এক কাঠি এগিয়ে চিন্তা করে ফেললাম। সবাই যখন বাস হাউসের সামনে থামার পর কিভাবে দৌড়ে গিয়ে সীট ধরবে সেটা নিয়ে শলাপরামর্শে ব্যস্ত আমাদের হিমেল, আহমেদ, ফারশাদরা তখন আরেক বু্দ্ধি আঁটলো। সেই অনুযায়ী ওরা করলো কি, যেদিন বিকেলে বাসে সবার মালামাল তোলা হবে সেদিন কোয়াইট আওয়ারে হাউসের সবার নাম আলাদা আলাদা কাগজে লিখে নিয়ে শত্রু হাউসের সামনে দিয়ে কমান্ডো স্টাইলে যাত্রা দিলো গ্যারাজের উদ্দেশ্যে, যেখানে কলেজ বাস রাখা আছে। কলেজের গ্যারাজটা ছিলো প্রিন্সিপালের বাসার সামনেই, আর নজরুল হাউসের পেছনে। কাজেই লক্ষ্যস্থল হিসেবে গ্যারাজটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সেখানে নজরুল হাউস , কিংবা কলেজের স্টাফের চোখ এড়িয়ে যাওয়াটা অনেক কঠিন ছিলো, তাও আবার দিনের আলোতে। সে অসাধ্য সাধনও শেষমেষ হয়ে গেলো অবশ্য, গ্যারাজের শাটার খুলে হিমেল, আহমেদরা মিলে নিঁখুতভাবে পেছনের সীটগুলো বুক করে ফেললো নাম লাগানো কাগজ সেঁটে। মিশন শেষে সবাই যখন ৩২পাটি বের করে ফিরে আসছে হাউসের দিকে সম্ভবত তখনই বেঁধেছিলো বিপত্তিটা। নজরুল হাউস, কিংবা সোহরাওয়ার্দি হাউসের আমাদের ব্যাচের কেউ একজন সেটা দেখে ফেললো। ফজলুল হক হাউসের এই গোপন মিশন কানাকানি হয়ে ঐ দুই হাউসের সব ইলেভেনের কাছেই পৌঁছে যেতে খুব বেশি সময় লাগলোনা। আমরা তখনও সে খবর জানিনা। ওদিকে দুই হাউস মিলে গোপণ বৈঠকে বসলো কিভাবে আমাদের উল্টো বাঁশ দেয়া যায়। বৈঠক শেষে সিদ্ধান্ত হলো তারাও গ্যারাজে যাবে আর আমাদের কাগজ তুলে ফেলে তাদেরটা লাগিয়ে দিয়ে আসবে। সিদ্ধান্ত হতেই মুহুর্তেই কয়েকজনের টীম কাজে লেগে গেল আর গ্যারাজে ঢুকে সাফল্যের সাথে সব কিছু ওকে করে ফেললো। ক্রমশ: বিকেল হচ্ছে আর বাস চলে আসার সময় হয়ে আসছে। আমরা এদিকে টেনশন ফ্রী। টেনশন তো বাকি দুই হাউজের, আমরা মনে মনে ভাবি । ঘড়ির কাঁটা অনেক চেষ্টা করলে আস্তে আস্তে ঘুরতে, কিন্তু তারপরও একসময় সেই মহা আরাধ্য সময়টুকু হাজির হলো। বিকেলে কলেজ বাস আস্তে আস্তে ডাইনিং হলের সামনে এসে থামলো। কিন্তু আমাদের যেন কোন তাড়া নেই, হেলেদুলে কম্বল বোচকা নিয়ে আস্তে আস্তে হাউজ থেকে বেরিয়ে বাসের দিকে যাচ্ছি সবাই। আমরা বরং বাকি দুই হাউজ কিভাবে দৌড়ের উপর বাসের সীট ধরতে যায় সেটা দেখার আশায় তাকিয়ে আছি সামনের দিকে। কিন্তু একটু বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলাম ওদের মাঝেও তেমন একটা তাড়া নেই, ওরাও আমাদের মত সমান তালে হেলেদুলে বাসের দিকে যাচ্ছে। ওদের মুখে তখন শয়তানী হাসি, বলাই বাহুল্য। একটু খটকা লাগলো, কিন্তু আমাদের কেউ তখনো আসল ঘটনাটা বুঝে ওঠেনি। বাসে উঠে রহস্য উদঘাটনের পর লাগলো হাউসে হাউসে কুরুক্ষেত্র। ফজলুল হক হাউসের সবাই গণহারে মাইন্ড খাইলাম, আর ডাইনিং হলের সামনে দাঁড়ায় গালাগালি করতে লাগলাম বাকি দুই হাউসরে। ব্যাপক মাইন্ড খাওয়াখাওয়ির পর বাকি দুই হাউসের সাথে আমাদের কথা বন্ধ হয়ে গেল একদম। ডাইনিং হলেও মুখে কুঁলুপ এটে রইলাম, হাউসে হাউসে কোন কথা নাই। অন্যান্য দিন যেখানে আন্ত: টেবিল হাউকাউ চলে, সেদিন ডিনারে সারা ডাইনিং হলে শুধু কাঁটা চামচ আর গ্লাসের টুং টাং। পরদিন সকালেও একই অবস্থা জারি থাকলো, বাসে উঠে সাত দিনের স্বপ্নময় জার্নি শুরু করলাম আমরা মুখে কুঁলুপ এঁটে। একসময় দুপুর হলো। বাস কুমিল্লাতে পৌঁছে ব্রেক নিলো, তখনো অবস্থার কোন পরিবর্তন নাই। অবশ্য আমরা সেখানে গ্রুপ ফটো তুললাম স্যার, এডজুট্যান্টসহ একসাথে, কিন্তু সবার মুখই যেন মাইক টাইসনের ঘুষি খেয়ে কালো হয়ে আছে। ঠিক কখন এই ঠান্ডা পরিস্থিত কোমল হওয়া শুরু করলো মনে নেই, তবে মনে আছে প্রথম দিনের পরেই আস্তে আস্তে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো। দ্বিতীয় দিনেই দেখা গেল বাসের সামনে পিছনে রোটেশন করে সবাই বসা শুরু করেছে। কলেজ বাসে সবাই আবার সেই পুরনো চেহারায়, আড্ডাবাজি, হল্লাহাটি, আর গলা মিলিয়ে বাসে বাজতে থাকা “কোই মিল গ্যায়া” কিংবা তখনকার পরিচিত কোন হিন্দি গানের সুরে গলা ফাটানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো পুরোদমে। অল্প সময়ের রেষারেষি একদিনের বেশি পাত্তা পেলোনা পাঁচ বছরের পুরনো বন্ধুত্বের কাছে। আগের দিন গলায় গলায় ঝগড়া করা আহমেদ আর ইকবাল কিংবা তেমন দু’জন আবার আগের মত পাশাপাশি বসে যাচ্ছে সব কিছু ভুলে গিয়ে। এর নাম যদি বন্ধুত্ব না হয়, তবে বন্ধুত্ব কাকে বলবো?

সেভেন থেকে টুয়েলভ – সব বছরে সব কলেজ-বাস জার্নির গল্পগুলো এমনই ছিলো, যে গল্পে শুধুই আনন্দ আ‌‌‌‌‌‌‌র নি:স্বার্থ বন্ধুত্বের ছড়াছড়ি। পরে খেয়াল করে দেখেছি কলেজ এক্সকারশানের চৌদ্দআনা মজা ছিলো আসলে কলেজ বাসে যাওয়া আসার সময়টুকুতেই। হাসি, ঠাট্টা, আড্ডাবাজি অথবা রাস্তার পাশের কাউকে টার্গেট করে একসাথে হোওওওওও করে চিল্লানি দিয়ে চমকে দেয়া – সেসবের কাছে এক্সকারশন প্লেসে গিয়ে ঘোরাঘুরির আনন্দ তেমন একটা বেইল পায়নি আসলে কোনকালেই। ১৩বছর পরেও যখন রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে “মুসু মুসু হাসি” গানটা কানে আসে হুট করে সেই চিরচেনা কলেজ কিংবা কলেজ বাসের গন্ধটা নাকে এসে লাগে কিছু বুঝে ওঠার আগেই। পুরনো সেই দিনের কথা ভেবে মনটা ভালো হয়ে যায়, আবার খারাপও হয়ে যায়।

মুনীর চৌধুরী মারা গেছেন সেই কবে। তাঁর বলে যাওয়া কথামত মানুষ আজো মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়। আমি বদলাই, তুমি বদলাও , সে বদলায়। বদলায় না শুধু বুকের ভেতর পরম মমতায় লালন করা ছয়টি বছর, আর সে সময়টুকু ঘিরে জমে ওঠা কত শত মন কেমন করা স্মৃতি। গুণে গুণে ৭টি বছর পার হয়ে গেছে। আমরা সবাই আলাদা আলাদা পথে অনেকটুকু রাস্তা পার হয়ে এসেছি । আমি ঢাকা, রিসাত ইউকে, সাব্বির মালয়েশিয়া, এ সেখানে, ও ওখানে। একে অপরের কাছ থেকে ক্রমশ: দূরে সরে যাওয়ার এ সময়ে “কলেজ বাস” শব্দ দুটো তাই আমার কাছে অন্যকিছু, এ যেন স্মৃতি ভ্রমণের বাহন। যেসব স্মৃতিতে আমি, রিসাত, সাব্বির কিংবা বাকি সবাই মিলে গলা মেলাতাম এক সাথে, ৫৩টি কন্ঠ মিলে গিয়ে যেখানে গাইতো একটি মাত্র গান। বন্ধুত্বের, আর ভালোবাসার। কলেজ বাস শব্দ দুটো আজো তাই আমার কাছে পরম মমতায় আগলে রাখা এক নস্টালজিয়ার নাম। যে নস্টালজিয়া কখনো নস্ট হয়না। বেড়ে ওঠে, শুধুই বেড়ে ওঠে।

পুনশ্চ: সেদিন ভার্সিটি বাসের দোতলায় বসে হঠাৎ নিচে তাকিয়ে দেখি কলেজের পিকআপ ভ্যান পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের বাসের সাথে জ্যামে আটকা পড়ে আছে। কোন কারণ নেই, পিকআপের দরজায় মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ লেখা দেখে কেমন ছেলেমানুষি খুশি লাগলো। উকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলাম আমাদের সময়ের পরিচিত কোন ড্রাইভার আছে কীনা। শেষমেষ অবশ্য দেখতে পারিনি। তাতে কী হয়েছে, ছবি তুলে রাখতে তো আর কোন বাঁধা নেই।

১,৭৭৮ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “আ জার্নি বাই বাস”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আহারে, কি মনে করায় দিলির, সেই মুড়ির টিন টাইপ কলেজ বাস, ড্রাইভার মোস্তফা ভাই, এক্সকারশনের জার্নি... :((

    অসাধারন হইছে, লেখায় ৫ তারা :hatsoff:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    ব্যাপক পোস্ট। কলেজ বাস কিংবা কলেজের বাস( কলেজের ভাড়া করা) নিয়ে স্মৃতিচারণ করলে শেষ হবে না। আপাতত আমাদের ব্যাচের একটা মজার কাহিনী বলে যাই। পরে আরো স্মৃতি শে্যার করবো।

    এই ঘটনা ঘটেছিলো টেন অথবা এসএসসি ক্যান্ডিডেট থাকার সময়। পিকনিকের জন্য আমাদের ক্লাশের জন্য নির্ধারিত বাস চলে এল। হুড়মুড় করে সবাই উঠে পড়লো। বাসের সিটগুলো অনেক জায়গায় উল্টানো ছিলো। তখেয়াল করে সবাই সিট উল্টে নিয়ে বসে পড়ছিলো। যা হোক যথা সময়ে এডজুট্যান্ট মামুন আল মাহমুদ আসলেন। বিভিন্ন ইনস্ট্রাকশন বলা শেষ করে নেমে যাবার আগে তিনি জিজ্ঞেস করলেন , কারো কোন সমস্যা? আমাদের এক বন্ধু হাত তুললো। তুলে বললো, স্যার সিট টা খুব শক্ত। এমন উদ্ভট সমস্যা শুনে মাহমুদ স্যারের ভ্রু কুচকাল, তিনি এগিয়ে এলেন ঐ বন্ধুর জায়গায়। তারপরে দেখলেন আমাদের ঐ বন্ধু উল্টানো সিটের শক্ত জায়গায় উপর বসে আছে আর সিটকে শক্ত বলছে!! স্যারের তৎক্ষণাৎ উত্তর ছিলো, গাধা কি কারো গায়ে লেখা থাকে?

    এর পরে যে কোন প্রোগ্রামে আমরা বাসে বের হওয়ার সময় শুরুতেই সবাই চিল্লাইতে থাকতো , সিট টা খুব শক্ত সিট টা খুব শক্ত বলে।

    মজার এখানে শেষ না। এই কাহিনীর সফল প্রচার সম্পাদক ছিলাম আমি। অথচ বেশিরভাগই এখনো জানে না আমাদের সেই বন্ধুর ছাড়াও শক্ত সিটে (!!) বসে পড়া দ্বিতীয় ব্যাক্তিটি ছিলাম আমি। আর সিট টা খুব শক্ত এই ডায়লগটি আমার প্ররোচনাতেই নাযিল হয়েছিলো। 🙂

    জবাব দিন
  3. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    কি মনে করাইয়া দিলেন জিহাদ ভাই :(( :(( :((


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  4. সুষমা (১৯৯৯-২০০৫)

    আমরা ক্লাস ইলেভেনে থাকতে একবার আমাদের মুড়ির টিন তোরা ধার নিছিলি, কিন্তু যখন ফেরত দিলি বাসের সিট কভারে তোদের লেখা সাহিত্য নিদর্শনে আমরা বিমুগ্ধ হয়ে গেছিলাম 😕 ।

    জবাব দিন
  5. ইমরান (১৯৯৯-২০০৫)
    বদলায় না শুধু বুকের ভেতর পরম মমতায় লালন করা ছয়টি বছর, আর সে সময়টুকু ঘিরে জমে ওঠা কত শত মন কেমন করা স্মৃতি

    নস্টালজিক হয়া গেলাম।


    রঞ্জনা আমি আর আসবো না...

    জবাব দিন
  6. ফজলে রাব্বি নোমান (৮৬-৯২)

    শেষের প্যারা টুকো (যে কথাগুলির জন্য তোমার গল্পটা লিখা) অসাধারণ! টুকটাক কথা বলতে বলতে তোমার এই নার্ভে ঢুকে যাবার স্টাইল টা একটা বিশাল ক্ষমতা !

    জবাব দিন
  7. মীম (২০০৬-২০১১)
    একে অপরের কাছ থেকে ক্রমশ: দূরে সরে যাওয়ার এ সময়ে “কলেজ বাস” শব্দ দুটো তাই আমার কাছে অন্যকিছু, এ যেন স্মৃতি ভ্রমণের বাহন।

    :(( :(( :(( চোখের সামনে অনেক স্মৃতি ভেসে আসছে...... :(( :((

    ভাইয়া :just: ::salute:: এত্ত সুন্দর করে লেখার জন্য......

    জবাব দিন
  8. তপু (৯৯-০৫/ককক)

    দস্ত, ভাল লিখেছ। আম্রা কলেজে ডুকার সময় চিল্লাইআ কইতাম" জাগ বাহে কুণঠে সবাই আম্রা আইশা পরসি" র কমিল্লা বাশি মনে হই আমাদের বাস এর জন্ত্রনাএ তেক্ত আসিল । আর আশেপাশে মেয়ে দেখলে ত কাম শারা। 😀

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জিহাদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।